জানা অজানা । অগ্রহায়ণ ১৪৩১




     ছবি আঁকার পথে মানুষের
 বিচরণ
 











সুদীপ্ত শেখর পাল
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

আলোচনা শুরু করা যাক আমাদের বিদ্যারম্ভ দিয়ে। বাংলা বর্ণমালা হোক কিংবা ইংরেজি বর্ণমালাই হোক সে আসলে একটা ছবি। বইয়ের মধ্যে আঁকা বর্ণের ছবি দেখে দেখে নিজের খাতায় আঁকা অভ্যাস করি। একে তখন কেউ ছবি আঁকা বলি না, বলি লেখা। একই অক্ষর ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রের খাতায় ভিন্ন রূপে দেখা যায়।

কিন্তু বইয়ের বর্ণের সঙ্গে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যে মিল থাকার জন্য অন্যে চিনতে পারে অর্থাৎ পড়তে পারে। পরবর্তী কালে আমাদের আঁকতে হয় গাছ পশু, পাখি, শরীরের নানা অংশ এমনকি খালি চোখে দেখা যায় না এমন জিনিসও তখনও হুবহু না আঁকলেও অসুবিধা হয় না। পাঠ্য পুস্তকে আঁকা গাছের ছবিতে সাতখানা পাতা থাকতে পারে আর আমার আঁকা ছবিতে থাকতে পারে পাঁচটা কিংবা দশটা। সে ছবি গাছের ছবিই হয় কেননা গাছের বৈশিষ্ট্য তার পাতার সংখ্যার উপর নির্ভর করে না। যে বৈশিষ্ট্যের জন্য সেটা গাছ এবং কোন বৈশিষ্টের জন্য সেটা বিশেষ জাতের গাছ এটা কালির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হলেই ছবিটি সঠিক হবে। এই পর্যায়ে এলে ছবি আঁকার উদ্দেশ্য হিসাবে বলা যায় কোন বস্তু সম্বন্ধে নিজের জানাকে সহজে অন্যকে জানানো। কিছুটা পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে ছবিকে বলতে পারি ভাষার একটা দৃশ্য রূপ। গাছ শব্দটা দেখলে বাংলা ভাষা যারা জানে তারাই কেবল গাছের ধারণা করতে পারবে। কিন্তু গাছের ছবি দেখলে সবাই গাছের ধারণা করতে পারবে। ভিন্ন ভিন্ন নামে তারা গাছকে জানলেও অসুবিধা হবে না। আদিম যুগের মানুষ তাদের দেখা জন্তু বা শিকারের দৃশ্য  গুহা গাত্রে ছবি এঁকে রেখেছে। এখন সহজে বুঝতে পারছি।যদি লিখতে জানত আর লিখে  রাখত আদৌ বুঝতে পারতাম কিনা কে জানে! কারণলিখতে যারা পেরেছে তাদের লেখার একটা অংশ পরবর্তীতে কোনরকম ভাবের সৃষ্টি করতে পারেনিকেননা পড়া যায়নি। ছবির ক্ষেত্রে এই ধরণের সমস্যা নেই বলে চিত্রশিল্পের মর্যাদা এত বেশি।  

আদিম যুগ পেরিয়ে এসেও ছবির বিষয়বস্তুতে কোন পরিবর্তন আসেনি বহুকাল। অর্থাৎ তখনো মানুষ ছবি এঁকে দৈনন্দিন জীবনকে স্থায়ী করার চেষ্টা করত। কোন এক সময় মানুষ নিজেদের প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করল। ক্যামেরা আবিস্কারের আগে একমাত্র শিল্পীর দ্বারা ছবি আঁকিয়ে নিজেদের ছবি স্থায়ী করা যেত।ক্যামেরার প্রচলন হলেও এই ভাবে আঁকা ছবির কদর শেষ হয়ে যায়নি। তাই এই রকম ছবি আঁকা কিছু শিল্পীর কাছে জীবিকা নির্বাহের উপায় এই সব শিল্পীরা যেমন দেখেন তেমনি আঁকতে পারেন-- যেমন গম্ভীর জমিদারকর্মক্লান্ত কৃষক ইত্যাদি।

কিন্তু যখন প্রয়োজন হল বুদ্ধদেব কিংবা যিশু খৃষ্টের মতো মহামানবের ছবি আঁকার তখন শিল্পীদের চিরাচরিত দক্ষতার উপরে প্রয়োজন হল আরও কিছু ক্ষমতার। সেই অতিরিক্ত ক্ষমতার বলে কেউ কেউ নিজেদের অন্তর্জগতের অনুভূতিকে প্রকাশ করলেন ছবিতে।এই পর্যায়ে সরাসরি দেখে আঁকার ব্যাপারটা রইল না। কিন্তু সেই  অভিজ্ঞতাটা রইল পুরোমাত্রায়। তখন ছবি আঁকতে পারলেই আর শিল্পী হিসাবে মর্যাদা পেল না। যেমন শরতকাল রচনা কিংবা মেলার বর্ণনা লিখলে আমরা তাকে লেখক বলতে চাই না। উদাহরণ হিসাবে মনে করতে পারি যিশু খৃষ্টের জীবন নিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা দ্য লাস্ট সাপার রহস্যময় হাসির অধিকারিণী মোনালিসা। আমাদের দেশে আঁকা হয়েছে রাধা- কৃষ্ণের ছবি কিংবা বুদ্ধদেবের ছবি। 

এছাড়া জাতক কাহিনি কিংবা তপস্যা ক্লিষ্ট সিদ্ধার্থকে পায়েস নিবেদনের   দৃশ্যও আঁকা হয়েছে পরম মমতায়। এই ধরনের ছবিতে যে কল্পনাশক্তির প্রয়োগ দেখা যায়সেই কল্পনা এসেছে বাস্তবতাকে ভিত্তি করেই। এ জন্য শিল্পীকে বাস্তব জগতের বহু কিছুকে  যত্ন সহকারে পর্যবেক্ষণ করে আঁকতে হয় নিঁখুত ভাবে। কেউ কেউ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক শিক্ষাও গ্রহণ করেছেন। যেমন পাখির ছবি নিখুঁত ভাবে আঁকার জন্য লিওনার্দো ভিঞ্চি পাখির অস্থিবিদ্যা শিখেছিলেন। বহু গুণী শিল্পী জন্ম দিয়েছেন নতুন নতুন দক্ষতার।  লিওনার্দো মোনালিসা ছবির পিছনে যে প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকলেন সেটি আঁকার সময় মনে রাখলেন বাতাসের বাধার জন্য কীভাবে একটা দৃশ্যের রঙ বদলে যায়। মাইকেল এঞ্জেলো যখন সাড়ে চার বছর ধরে গীর্জার ছাতে বাইবেলের দৃশ্য আঁকলেন তখন তাকে রঙ লাগাতে হলো অভিকর্ষের বিরূদ্ধে। করেজজো গীর্জার গম্বুজের নীচে এমন ভাবে দেবদূত আঁকলেন যেনীচের থেকে মনে হবে যেন সে উড়ে যাচ্ছে। ইতালির মাজাচ্চো ছবিতে আনলেন পারসপেকটিভ। এর ফলে বোঝা গেল ছবির ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে কে কতটা সামনে কিংবা পিছনে আছে। 

ডাচ শিল্পী ফ্রাঞ্জ হ্যালস মানুষের কর্মব্যস্ত জীবনের খণ্ড সময়ের অভিব্যক্তিটুকু ধরলেন। যেমন কারো অট্টহাসি। সামনে মডেল হিসাবে কাউকে রেখে আঁকার মত ক্ষণিকের অট্টহাসি আঁকা যায় না।আরেক রকমের দক্ষতা দেখা গেছে সে দেশের আরেক ক্ষণজন্মা শিল্পী ভেরমেয়ারের মধ্যে। তাঁর ছবির বস্তু গুলি দেখলে বোঝা যেত সেটার গায়ে হাত দিলে কী অনুভূতি হবে কিংবা সেটা কী উপাদানে তৈরি। ছবির এই বিশেষত্বের নাম হলো 'টেক্সচার'

স্পেনের পাবলো পিকাসো ছবিকে ভাবলেন এক ভিন্ন ধারায়। মানুষের পরিচিত মুখকে ভেঙে চুরে জ্যামিতিক নকশা দিয়ে নতুন করে সাজালেন।

এইভাবে শিল্পের বহু রকম বৈশিষ্ট্য আবিস্কার ও প্রয়োগের দক্ষতা আজও হয়ে চলেছে। আবার এক ধরণের শিল্পী আছেন যারা এগুলোকে হুবহু নকল করতে পারেন। তবুও তাদের সবাই শিল্পী হন না। কেননা শিল্পীকে সর্বদা মনে রাখতে হয় এই দক্ষতাই তার শেষ কথা নয়। লেখা পড়ায় দক্ষ হলেই যেমন একজন কবি বা সাহিত্যিক হয়  না তেমনি শিল্পী হতে গেলে শুধু দক্ষতা থাকলেই হয় না। সেই সঙ্গে  প্রয়োজন চিন্তাশক্তিও।

কোন ব্যক্তির প্রতিকৃতি আঁকার কথায় একথা বললাম বটেতবে একথা সমান ভাবে প্রযোজ্য নিসর্গ দৃশ্যের ক্ষেত্রে। আবার চিত্রশিল্প ছাড়াও একথা প্রযোজ্য ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও। 

এই সব শিল্পকর্ম ছাড়াও আরেক ধরণের শিল্পকর্ম যুগে যুগে নানা রকমে মানুষের মনকে আনন্দ দিয়েছে।সেগুলি হলো নানা রকম ব্যবহার্য্য বস্তুর উপর অলঙ্করণ ও চিত্র। এসবের খুব কমই প্রকৃত ছবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। হয়তো একটা ফুলের ছবি কেউ এঁকেছেন। প্রথাগত শিল্পের নিরীখে হয়তো তার অবদান সামান্যকিন্তু সেই ছবি দেখে কারও মনে যদি ফুলের মতো নিজেকে সুন্দর করার প্রেরণা আসে তবে সে ছবি সার্থক।আবার কেউ হয়তো কোন ছবিতে রঙের এমন সমাবেশ ঘটালেন যে দর্শকের মন অন্তর্মুখী হয়ে নিজেকে নিজে বিচার বিশ্লেষণ করতে শুরু করলসে ছবিও কালজয়ী

যে চিন্তাশক্তির জন্য একজন ছবি আঁকার ক্ষমতাকে সঙ্গী করে শিল্পী হতে ওঠেন সেই চিন্তার ধরণ পরিবর্তিত হয়েছে যুগে যুগে। কখনো প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রতিবাদ কখনো নিজের অবদমিত ইচ্ছা- আকাঙ্খা কখনো ভক্তিবাদ প্রাধান্য পেয়েছে বিচিত্র শিল্পকর্মে। বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে রঙীন তুলির শেষ আঁচড় পর্যন্ত থেকে যায় শিল্পীর প্রতিভার স্ফূরণ।


আরও পড়ুন  -


বেচারা তিমি 

নানা রকম দেখা

মাধ্যাকর্ষণের পথ ধরে

ইংরাজি ভাষা ও তার অক্ষর পরিচয়

 

<
সূ চি প ত্র