যদি মনে পড়তে একটু দেরি হয় তাহলে একজন সাহিত্যিকের নাম মনে করা যাক। এবার নিশ্চয় মনে পড়বে শরৎচন্দ্র কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের নাম। এঁরা সাহিত্যিক। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের নাম মনে এলো না কেন, তারা কবি বলে? কবিতা আর সাহিত্য কি আলাদা? ভারতের প্রাচীন সাহিত্যগুলো আসলে কবিতা বা কাব্য। বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত– সবই কাব্য। অথচ সেগুলিকে আমারা অবলীলায় বৈদিক সাহিত্য বা প্রাচীন সাহিত্য বলে উল্লেখ করে থাকি। আসলে গদ্য আর পদ্যের মধ্যে এমন কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে যার জন্য সে সব গুলিকে আমরা এক কথায় সাহিত্য বলে উল্লেখ করে থাকি।
প্রাচীন কাব্য কিংবা আধুনিক কালে রচিত কোন গল্প – উপন্যাস উভয়ের মধ্যে আছে কোন না কোন ঘটনা। হতে পারে বাস্তব ঘটনা, হতে পারে বাস্তবের মতো কিংবা বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন কোন কাল্পনিক ঘটনা। তবে আশপাশে ঘটে চলা সব ঘটনা যদি লিপিবদ্ধ করা হয় তবে সেগুলিকে কি সাহিত্য বলতাম?
ধরা যাক একজন জেলে মাছ ধরছে। সেই বর্ণনা দেওয়ার পর লেখা হল তার ছেলে তাকে ডেকে নিয়ে গেল। এই ঘটনা গদ্যে লেখা হোক কিংবা পদ্যে লেখা হোক সাহিত্য হবে কি? না, এ ঘটনা এতই সাধারণ যে এটা নিছক একটা খবর ছাড়া কিছু নয়। শুধু ঐ জেলের কাছে যারা মাছ কিনবে এবং তার পরিবারের কাছে এই ঘটনার মূল্য আছে।আমার মন কিন্তু ঐ ঘটনার পরে এমন কিছু চাইছে, যার অভাবে মন তৃপ্ত হচ্ছে না বা মনের মধ্যে কোন অনুভূতি তৈরি হচ্ছে না। যে জিনিসটার জন্য এই অভাব বোধ তৈরি হলো সেটাই হলো সাহিত্যের প্রাণ ভোমরা। তাকে নিজে বোঝা আর অন্যকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে অবিরাম। তবুও যেন ঠিক করে বলে ওঠা যাচ্ছে না। এবার মনে করি এমন কয়েকজন জেলের কথা যারা প্রায় দু’হাজার বছর আগে মাছ ধরছিল মধ্য এশিয়ার গ্যালিলি হ্রদে। আর সেই সময় যুবক যীশু খ্রীষ্ট তাদেরকে ডেকে বললেন – “আমার সঙ্গে এসো, আমি তোমাদের মানুষ ধরার জেলে তৈরি করব।” যুবকের আহ্বান ঘটনাটিকে সাহিত্য সমাজে এমন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলো যে, দু’হাজার বছর পরেও তার আবেদন অমলিন। কথায় কথায় বলে ফেললাম ‘আবেদন’ কথাটি। তাহলে বলতে হয়, কোন ঘটনার মধ্যে যদি আবেদন থাকে তাহলে সেটা হবে সাহিত্য। নিশ্চয় এ আবেদন বিয়েবাড়ি কিংবা সভা সমিতিতে যোগদানের আবেদন নয়। এ আবেদন মনের কাছে, দেহের কাছে নয়। মনকে ভাবানোর ক্ষমতা থাকা চাই, এমন আবেদনের কথাই বলছি। সে আবেদন যদি গানের মধ্যে থাকে তবে সে গান হবে সাহিত্য, যদি চিঠির মধ্যে থাকে তবে সে চিঠিকে বলব পত্র সাহিত্য। এইভাবে কোন ব্যক্তির রোজ নামচাও বসতে পারে সাহিত্যের আসনে।
ঐ জেলেদের কাছে যদি কেউ ডাকাতের দলে নাম লেখানোর কথা বলত তবে কি আমরা তাকে এতদিন পরে মনে করতাম? কেননা সে আবেদনের মধ্যে কোন উন্নত হওয়ার হাতছানি নেই, নেই কোন মানসিক প্রশান্তির আয়োজন।
এতক্ষণে বুঝি আলোর রেখা পাওয়া গেল। সাহিত্যের মধ্যে আবশ্যকীয় উপাদানকেই তুলনা করছি আলোর সঙ্গে। বহূদিনের জমাট অন্ধকার যেমন এক মুহূর্তের আলোর ঝলকানিতে দূরীভূত হয় – তেমনি মনের মধ্যে জমে থাকা বহূদিনের সমস্যা দূরীভূত হতে পারে সাহিত্যের দ্বারা। সমস্যা থেকে জন্ম নেয় হতাশা, উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ। এর প্রভাব পড়ে মানুষের দৈনন্দিন কাজে। কেননা মানুষ শুধু দেহের জোরে কাজ করে না, কাজ করে মনের জোরেও। আবার মনের সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিবিড়। এই সমস্ত কিছু মাথায় রেখে, এক কথায় বলা যায় যে, সাহিত্যের কাজ হলো মানুষের মঙ্গল করা। ‘মঙ্গল’কে আমরা এতটাই পছন্দ করি যে, শুভেচ্ছা জানাতে বলি – ঈশ্বর তোমায় মঙ্গল করুন। তাই কবিতা হোক, গল্প হোক কিংবা ভ্রমণ কাহিনী হোক তাতে যেন নিহীত থাকে মঙ্গলবার্তা। তবেই সে হবে সাহিত্য। তবে কথাটা বিপরীতক্রমে সত্য নাও হতে পারে। অর্থাৎ বলতে চাইছি যে, যেন তেন প্রকারে মানুষের ভালোর কথা লিখে ফেললে সাহিত্য হবে এমন কোন কথা নেই। যেমন, গণ চেতনা জাগরণের কোন বিজ্ঞাপনকে আমরা সাহিত্য বলতে পারি না।
‘মঙ্গল’ শব্দটিকে আমি সাহিত্যের প্রাণ হিসাবে ধরেছি। হয়তো এজন্যই বাংলা ভাষায় রচিত দেব দেবীর মহিমা সমবলিত কাব্যের নাম দেওয়া হয়েছে মঙ্গলকাব্য – মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি।
মঙ্গলের একটি প্রতিশব্দ হিত। এই শব্দটি সাহিত্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সাহিত্যের এই বিশেষ দিকটির দিকে লক্ষ রেখে হয়তো গল্প – উপন্যাস সহ অন্যান্য রচনাকে ‘সাহিত্য’ নামে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। আমরা বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করি কিন্তু শব্দটিকে কবে থেকে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে সে সম্বন্ধে তেমন কোন ধারণা করতে পারি না। তবে সাহিত্যের নানা আঙ্গিক – কাব্য, নাটক, প্রহসন, গল্প উপন্যাস, পত্র, প্রবন্ধ ইত্যাদি মানব সভ্যতার কোন কোন সময় আত্মপ্রকাশ করেছিল তার ইতিহাস জানা যায়। কাব্যের মধ্যে পড়ে ছন্দোবদ্ধ কবিতা, মুক্তছন্দের কবিতা, সঙ্গিত, পাঁচালী ইত্যাদি। আবার যাত্রা, সিনেমা, নাটক আলাদা আলাদা হলেও মূলে তারা নাটক। কারণ তাদের মধ্যে থাকতে হবে অভিনয়পোযোগী নাটকীয়তা। নাটক যেমন নানা দৃশ্য ও অঙ্কে বিভক্ত থাকে তেমনি গল্প ও উপন্যাস নানা পরিচ্ছদে বিভক্ত থাকে। কোন ক্ষুদ্র ঘটনা কে আশ্রয় করে একটি অঙ্কে নাটক সমাপ্ত হলে তাকে একাঙ্ক নাটক বলা হয়। আবার মূল ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে চলা নানা ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে সার্থক পরিণতিতে উপনীত হতে হয় একাধিক অঙ্কের মাধ্যমে। ঠিক এইভাবে গদ্যে বর্ণনা করা গল্পকে কখনো বলা হয় ছোট গল্প, কখনো বলা হয় বড় গল্প। আবার গল্পের ব্যপ্তি আরো বাড়িয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া যায় উপন্যাসের আঙিনায়। কোন সাহিত্য সাধক যে ধারায় তাঁর সাহিত্য রচনা করেন তাঁকে আমরা তদনুযায়ী উপাধিতে ভূষিত করি। যেমন – কবি, নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ইত্যাদি। কোন ভাবকে প্রকাশ করতে ঘটনার দরকার হয়, আবার ঘটনার জন্য দরকার হয় মানুষ ও তার পরিবেশ। এ কারণে মনে হতে পারে যে, সাহিত্য বুঝি আয়নার মতো – যার মধ্যে শুধু মানুষ নয়, মানুষ সহ গোটা সমাজ প্রতিফলিত। তবে এ কথা সব সময় খাটে না।
ধরা যাক, কোন মানুষের কীর্তি কিংবা পরাজয়ের কথা নিয়ে সাহিত্য লেখা হলো । এই চিত্র বাস্তব বটে, তবে তাকে নিছক সংবাদ বলতে পারি। কিছুদিন পরে সেটাকে বলতে পারি ইতিহাস। ঘটনার সমসাময়িক কালে কেউ লিখলে তাকে বলাতে পারি সাংবাদিক, কিছু সময় পরে লিখলে তাকে বলতে পারি ঐতিহাসিক। কিন্তু সাহিত্যিক বলব তখনই যখন সেই লেখার মধ্যে থাকবে কিছু বৈশিষ্ট্য। যাদেরকে বলা হয় ‘রস’। যেমন, হাসির উদ্রেক করলে হাস্যরস, দুঃখের ঘটনার সঙ্গে থাকে করুণরস, বীরত্বের সঙ্গে থাকে বীররস ইত্যাদি।
যে সমস্ত ঘটনায় দুঃখ, কষ্ট, বিচ্ছেদ ইত্যাদির ভাব আসে তাকে বলা হয় বিয়োগান্ত ঘটনা। ইংরাজি ভাষায় বলা হয় ট্রাজেডি (tragedy )। এর বীপরীতে থাকে কমেডি (comedy )। সাধারণ ভাবে কমেডি হাস্যরসকে সূচিত করলেও সমস্ত রকম মিলণাত্মক লেখাকেই কমেডি নামে অভিহিত করা হয়।
কোন ঘটনার মধ্যে যখন মানুষের মন প্রবেশ করে তখন সে ঘটনার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে। তাই, অন্যায় – অত্যাচারের বিরূদ্ধে যে রুখে দাঁড়ায় পাঠক তাকে নায়কের মর্যাদা দেয়। নায়কের দুঃখে পাঠক দুঃখিত হয়, নায়কের সাফল্যে খুশি হয়। শুধু তাই নয় নিজের বাস্তব জীবনে প্রেরণাও পায়। আবার প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার যে কৌশল কাহিনীতে থাকে তা’ যত বাস্তব ধর্মী হয় তত সুবিধা হয় বাস্তবে প্রয়োগ করতে। যেমন, গোয়েন্দা গল্পের মধ্যে থাকে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায়। যে সব কাহিনীতে এই সব বৈশিষ্ট্য থাকে সে সব কাহিনীকে এক কথায় বলা যায় মিলনাত্মক লেখা। সাহিত্যের পরিনতি বিয়োগান্ত হলে কোন সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার বুদ্ধি হতভম্ব হয়ে পড়ে। যে ত্রুটির ফলে সংকট সৃষ্টি হয় যুক্তি দিয়ে সেই ত্রুটিকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা পেয়ে বসে। মনে হতে পারে যে, ঘটনার নায়ক সমস্যা সমাধানে অকৃতকার্য্য হলেও পাঠক কিন্তু সমস্যা সমাধানের চিন্তা করবে। কিন্তু, সাধারণত তা’ হয় না। কারণ, সাহিত্যে বর্ণিত অকৃতকার্য্যতার কারণ পাঠককে এমন ভাবে ভাবিয়ে তোলে যে তার চিন্তার সঙ্গে নিস্ক্রিয় ভাবে জড়িয়ে থাকে। বাস্তবে যখন সমজাতীয় সমস্যার সৃষ্টি হয় তখন অবচেতন মনের প্রেরণায় সেই জাতীয় আচরণ আপনা আপনি করে থাকে ও ব্যর্থতাকে আমন্ত্রণ করে।