আর কিছুদিন পরেই রিতুর জন্মদিন, আর এই বছরই তার দশ বছর হবে। রিতু চায়, এই বার্থডেটা খুব বড় করে সেলিব্রেট করা হোক। ওর ইচ্ছে, ওর সব বন্ধুদের ডাকবে, আর তাদের সাথে অনেক মজা
করবে।
কিন্তু সেই জন্মদিন যদি পালনই না করা হয়, সেকথা ভেবেই রিতুর কান্না পেয়ে গেল।
রিতুদের বাড়ির পাশেই একটা পার্ক আছে। পার্কের পাশেই মস্ত
বড় ঝিল, তাতে পদ্ম আর শালুক ফুটে থাকে।রিতুর যখন খুব মন খারাপ হয়, তখন সে ওই পার্কে গিয়ে বসে। ওখানে খুব সুন্দর ফুলের গাছ
আছে, শীতকাল এলেই পুরো পার্কটা ফুলে ফুলে ঢেকে যায়। হাওয়া যখন
নাড়া দেয় গাছের ডালগুলোকে, তখন ভারী সুন্দর দেখতে লাগে, মনে হয় যেন গাছগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এরকম জায়গায়
গেলেই মনটা আপনিই ভালো হয়ে যায়।
রিতু আস্তে আস্তে মাকে জিজ্ঞেস করলো, "মা,
আমি একটু পার্কটা থেকে ঘুরে আসবো?"
মা তখনও খুব রেগে ছিলো রিতুর ওপর। বললো, "হ্যাঁ, যেখানে খুশি যাও। একটা অংক, এতবার বোঝানোর পরও করতে পারছ না, যেখানে পারো যাও!"
রিতুর খুব খারাপ লাগলো মায়ের কথা শুনে। সে কিছুক্ষণ
দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
পার্কের গেট পর্যন্ত গিয়ে রিতু দেখল, আজ সেখানে লোক খুব কম, প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু
একজন বুড়ো দাদু একটা বেঞ্চে বসে খবরের কাগজ পড়ছে, আর পার্কের
বাইরে ফুচকাওয়ালা কাকু ফুচকা বিক্রি করছে, সেখানেও খুব বেশি লোকজন নেই।
রিতু ধীরে ধীরে পার্কে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসলো। এই বেঞ্চটার
পাশেই একটা বড় ফুলগাছ, তাতে ভারী সুন্দর গোলাপী আর সাদা রঙের ফুল ফুটে আছে।
রিতু ভাবতে লাগলো, সে কেন অঙ্ক করতে পারছে না? মা তো বলছে অঙ্কটা নাকি খুব সহজ, তাহলে সে কেনো বুঝতে পারছে না? আচ্ছা, সত্যিই যদি এবার বাবা মা
তার বার্থডে না সেলিব্রেট করে? তাহলে কি হবে?
এসব ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছে রিতু, এমন সময়ে হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো, "ম্যাও!"
চমকে উঠে চারিদিকে তাকালো রিতু। ওমা কেউ নেই তো! তাহলে
ম্যাও করে কে ডাকল?
হঠাৎ রিতু খেয়াল করল, তার বেঞ্চের পাশেই একটা
ঝোপে ছোট্ট একটা বেড়ালছানা। তার গায়ের রং কুচকুচে কালো, শুধু বুকের কাছে, আর চারটে থাবার কাছে সাদা
রং, হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন পায়ে মোজা পরেছে। সে তার ছোট্ট
দুটো হলুদ চোখ নিয়ে রিতুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
ওকে দেখেই খুব ভাল লেগে গেলো রিতুর। যত্ত সব বাজে
চিন্তাভাবনা, যেনো এক নিমেষেই দুর হয়ে গেলো মন থেকে। মনটাও খুব ভালো
হয়ে গেলো।
রিতু ঠিক করে ফেললো, এই বেড়ালটাকে ও বাড়ি
নিয়ে গিয়ে পুষবে। ও জিজ্ঞেস করল, "কিরে ম্যাও, তুই যাবি আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে?"
বেড়ালটা আবার বলল, "ম্যাও"!
রিতু বেড়াছানাটাকে কোলে নিয়ে বাড়ি চলে এলো। আস্তে আস্তে দরজা খুলে ঢুকে রিতু মাকে বলল, "মা,
এই দেখ, আমি কাকে নিয়ে এসেছি! কি
মিষ্টি না মা, বেড়ালটা? ওকে আমরা পুষব, কেমন?"
কিন্তু মা তখনো খুব রেগে ছিল রিতুর উপর। বলল, "অঙ্ক ভুল করে আবার বেড়াল কুকুর নিয়ে আসা হচ্ছে? আগে ভালো করে পড়াশোনাটা কর তারপর এসব করবে। এক্ষুনি ওকে
বের করে দাও বাড়ি থেকে।"
শুনে ভীষণ খারাপ লাগলো রিতুর। তবু সে আস্তে করে বেড়ালটাকে
রাস্তায় নামিয়ে দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল, "তুই আমার ওপর
রাগ করিস না প্লিজ! আমি রোজ বিকেল বেলায় পার্কে গিয়ে তোর সাথে দেখা করব, প্রমিস!"
বিড়ালটা আবার বলে উঠলো "ম্যাও!"
ঠিক তাই করে ঋতু রোজ বিকেলবেলায় সে চুপি চুপি পার্কে গিয়ে
বিড়ালের সাথে দেখা করে। তার অবশ্য নামও দেওয়া হয়েছে। নামটা হল মিতু। ঋতু নিজের
নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে।
তবে,
একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেছে রিতু। যখনই সে বিড়ালটার
সাথে দেখা করে, সময় কাটায় তার মাথাটা যেন বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়। আর
পড়াগুলোও বেশ মাথায় ঢুকে যায়। এখন কিন্তু সে আর সহজ অংকে একটুও ভুল করে না।
গুণের জায়গায় গুণ আর ভাগের জায়গায় ভাগই করে। মাঝে মাঝে কোন অংক যদি তার খুব
কঠিন মনে হয়, সে মনে মনে মিতুর কথা ভাবে, আর অংকটা ঠিক
পেরেও যায়। তবে যতই পড়ার চাপ থাকুক না কেন, মিতুর সাথে দেখা করতে
কিন্তু ভোলে না রিতু।
আর দুদিন পরে রিতুর অংক পরীক্ষা। তার কিন্তু বেশ ভয় করছে।
যদি সে ভালো রেজাল্ট না করে তবে তো বাবা-মা তার জন্মদিনে সেলিব্রেট করবে না! তবে
সারাদিন পড়ার মাঝে ১০ মিনিট সময় করে ঠিকই পার্কে যায়। দেখা করে আসে নিজের বেস্ট
ফ্রেন্ড মিতুর সাথে।
অবশেষে পরীক্ষার দিন চলে এলো। ঋতু বেশ ভালই পরীক্ষা দিল, আর তারপর বাড়িতে এসে মিতুকে বলল শোন মিতু আমি যদি ভালো রেজাল্ট করি তাহলে আমার জন্মদিনের গিফট হিসেবে
তোকে পুষতে চাইব, কেমন?"
রিতুর যেনো মনে হলো, বেড়ালটা তার কথা শুনে
হাসলো।
আর কয়েকদিন পরে রেজাল্ট বেরোলো রিতুর। স্কুলে রিপোর্ট
কার্ডটা হাতে পেয়ে রিতু খুব ভয়ে ভয়ে বাড়ি এলো। মা আগে থেকেই বললো, "ও দেখে আর কিই বা হবে? আমরা তো জানিই, খুব বাজে রেজাল্ট করবে।"
খোলার পর দেখা গেল, এই বছর অংকের টপারের নাম
ঋত্বিকা ঘোষ, ওরফে আমাদের রিতু!
বাবা আর মা ভীষণ অবাক হয়ে গেলো। মা পর্যন্ত এক গাল হেসে
বললো, "তুই কি করে এত্ত ভালো রেজাল্ট করলি রে রিতু? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না রে! এই কদিন আগেও তো তুই সোজা
অংকে পর্যন্ত ভুল করতিস! আর তুইই কিনা টপার!"
বাবাও ভীষণ খুশি হলো। ঠিক হলো, রিতুর জন্মদিন এবার খুব বড় করে পালন করা হবে।
আজ রিতুর জন্মদিন। চারিদিকে ঝলমল করছে রংবেরঙের আলো।
দেওয়ালে নানারকম বেলুন ঝোলানো হয়েছে, তার মাঝখানে বড় বড় সোনালী
অক্ষরে লেখা, "হ্যাপী বার্থডে"। সুন্দর করে সাজানো একটা গোল টেবিলের
উপরে রাখা হয়েছে কেক। রিতুর অনেক বন্ধুদের ডাকা হয়েছে, তারা মাঝে মাঝেই রিতুর খুব প্রশংসা করছে, ওর রেজাল্টের জন্য।
আনা হয়েছে রিতুর খুব পছন্দের চকলেট কেক, তার উপর সুন্দর করে রিতুর নামটা লেখা রয়েছে। রিতুও খুব
সুন্দর একটা ড্রেস পরেছে আজ।
রিতু যখন সবে কেকটা কাটতে যাবে, অমনি কে যেন বলে উঠল, "ম্যাও!"
আবার চমকে উঠল রিতু। ওমা, মায়ের কোলে
ওটা কি? রিতু দেখলো, মা তার বেড়ালছানা মিতুকে
লোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বললো, "এবার আমি সত্যিই খুব খুশি
হয়েছি রে তোর ওপর। তাই, তুই যখন ঘুম থেকেই উঠিসনি, আমি গিয়ে তোর
ওই বেড়ালটাকে পার্ক থেকে নিয়ে এসেছি। আজ থেকে ও আমাদের বাড়িতে, আমাদের সাথেই থাকবে।"
রিতু ভীষণ ভীষণ খুশি হলো। মিতুকে কোলে নিল রিতু। তারপর তার
কানে কানে ফিস ফিস করে বলল,
"শোন, মিতু, আর কেউ না জানলেও আমি খুব ভালো করেই জানি, যে আমি এত ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছি শুধুমাত্র তোরই জন্যে।
তোকে দেখলেই আমার মনটা ভালো হয়ে যায়, মাথা পরিষ্কার হয়ে যায়।
থ্যাঙ্ক ইউ রে মিতু, থ্যাঙ্ক ইউ! আর আজ থেকে আমরা একসাথে থাকব, অনেক গল্প করব, খেলব, আর অনেক অনেক মজা করব। কেমন?আমি জানি তুই
সারাদিন আমার কাছে থাকলে,
শুধু অংকে নয় আমি ক্লাসের সব সাবজেক্টেই টপার হবো
দেখিস"
মিতু আস্তে করে থাবাটা রিতুর হাতের উপর রেখে বলল, "ম্যাও!"
জন্মদিনের আলোগুলো তখন রিতুর মুখের মতোই ঝলমল করছিল।