গল্প - ৩ । মাঘ ১৪৩১



সুকন্ঠ বিদ্যাধর 
বাড়ি ফেরেনি












অমিয় আদক 

হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ



 

গল্পটা অনেক পুরানো। এক প্রতিভাবান ছেলের গল্প। রাজ্যের নাম আনন্দনগরী। সেই রাজ্যের ছোট এক গ্রাম। বনভূমির লাগোয়া ছবির মতোই গ্রামটি। গ্রামের নাম উজানগাঁও। গাঁয়ের পশ্চিমে নদী। নাম তার উজানী। সেই গাঁয়ের এক দরিদ্র কায়স্থ পরিবার। পরিবারের পদবি দত্ত। পরিবারের সদস্য সংখ্যা আট। চার ভাই, দুই বোন আর মা বাবা। সেই পরিবারের ছোটছেলে বিদ্যাধর।

তার পরেই দুই বোন। দত্ত পরিবারে, বাবার আয়ে সংসার চলে। জমিজমা নেই। বাবার সামান্য বেতনের চাকরি। সংসারে অভাবের সীমা নেই। সবদিন সকলের পেটপুরে খাবারও জোটেনা। ছেলেরা পাঠশালায় যায়। মেয়ে দুটোর পাঠশালায় যাওয়ার বয়স হয়নি। বাবা গুরুমশাইয়ের বেতন দিতে পারেন না। তবুও গুরুমশাই লেখাপড়া শেখান। বিদ্যাধরের দাদারা লেখাপড়ায় মনযোগী।

সে কিন্তু লেখাপড়ায় মনযোগ দিতে পারেনা। সে পাঠশালা থেকে ফেরে। ঘরে তার মন টেকেনা। চলে যায় বাড়ির কাছের জঙ্গলে। সেখানে সে কিছু একটা ঘোর অনুভব করে। আপন খেয়ালে ঘুরে বেড়ায়। পাখিদের ডাক শোনে। কোকিল, বুলবুলি ইত্যাদি পাখিদের ডাক তার ভালো লাগে। সে গান শুনতে ভালোবাসে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিখারিদের গান শোনে। বাউলদের একতারার সুর তাকে বেজায় টানে। সে নিজেই একতারা বানানোর চেষ্টাকরে। পারেনা। সে পাড়ার বন্ধু নবীনের কাছে যায়। তার আড়বাঁশিটা চায়। বাজানোর চেষ্টাকরে। নবীন তাকে বাঁশি বাজানো শেখায়। কয়েক দিনেই সে বাঁশিতে মিষ্টি সুর বাজাতে পারে। নবীন অবাক। সেই খুশিতেই তার একটা বাঁশি বিদ্যাধরকে বাজাতে দেয়। তখন বাঁশি বাজানোই বিদ্যাধরে ধ্যানজ্ঞান।

পাঠশালা থেকে ফিরে আসে। বাঁশি হাতে বেরিয়ে পড়ে জঙ্গলে। বুড়ো বটগাছের ঝুরির আড়ালে বসে। আপন মনে বাঁশিতে সুর তোলে। সুরেই মগ্ন। খিদের কথা তার খেয়ালেই আসেনা। তার মা দাদাদের খুঁজতে পাঠান। দাদারা তাকে জোরকরে বাড়ি নিয়ে যায়। তারাই ইঁদারারা জল তোলে। ছোটভাই বিদ্যাধরকে সেই জলেই চান করায়। তখন প্রায় বিকেল। সুর্যের আলোয় কমলা কোয়া আভা। তখন খেতে বসে বিদ্যাধর। খেতেখেতেও মায়ের বকাঝকা কানে আসে। তার খাওয়ার পরে সূর্য ডোবে। চুপচাপ বসে থাকে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে। গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যে নামে। খানিক পরেই মা যান তুলসী তলায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাতে।

সেই ফাঁকেই বিদ্যাধর পালায়। পৌঁছায় পাশের পাড়ার মন্দির চত্ত্বরে। সেখানে মন্দিরের সামনের আটচালা। সেখানে রোজ সংকীর্তনের আসর। একটু দূরে বসেই গায়কের গানে গলা মেলায়। তারা কেউ জানতেও পারেনা। তখন বিদ্যাধরের বয়স মাত্র আট। বিদ্যাধরের গানের প্রতি বেজায় টান। অন্যের গান শুনে অবিকল গায়। বাবামা রাগ করেন। দিনে সংকীর্তনের আসরে হাজির, সন্ধ্যায় হাজির পাশের পাড়ার মন্দিরে। মা রাগারাগি করেন। প্রায়দিন ঘরে আটকে রাখেন। তবুও ছেলের লেখাপড়ায় মন বসাতে পারেন না।

তিনি বিদ্যাধরকে বোঝান, ‘বাবা বিদ্যা, লেখাপড়া তোমায় শিখতেই হবে। কায়স্থের ঘরের ছেলে তুমি। চাষ করতে পারবে না। তাছাড়া আমাদের জমিজমাও নেই। লেখাপড়া না শিখলে কেউ চাকরি দেবেনা। সংসারে অভাব দেখতেই পাচ্ছো। তোমাদের সবাইকে একদিন রোজগার করতেই হবে। নাহলে, সংসার চলবে কি করে?’ উত্তরে বিদ্যাধর জানায়, ‘মা গুরুমশাই যা শেখান সবই আমার মনে থাকে। বাড়িতে পড়ার আর দরকার হয়না। আমার গান ভালোলাগে। বাঁশি বাজিয়ে মনে আনন্দ পাই। তাই বাঁশি বাজাই। সংকীর্তনের আসরেও যাই। জঙ্গলে যাই পাখিদের গান শুনতে। তোমরা এতো রাগ করো কেন? গুরুমশাই কি আমার নামে নালিশ করেছেন?’

‘তা করেননি। তোমার পড়ার অবহেলা তোমার বাবা মোটেই মানতে পারেন না। পড়াশোনায় মন দাও।’

‘আমি পারবোনা মা কিছুতেই। আমি মন্দিরে, বনে যাবোই। আমিতো পড়াশোনায় ফাঁকি দিইনা। গুরুমশাই তেমন নালিশও করেন না। তবুও তোমরা আমার উপরে রাগ দেখাও। ঘরে আটকে রাখো। এসব আমার ভালো লাগেনা।’ 

গানের আসরে যেতে বাবামার নিষেধ। নিষেধ সে মানেনা। সে নিষেধ মানতেই পারেনা। গানের এবং সুরের চুম্বক টান তাকে পাগল করে তোলে। সেই সন্ধ্যায় পাশের পাড়ার মন্দিরের সামনে আটচালায় নতুন গাইয়ে। বেশ সুরেলা গলা। তার গানের সুরে মোহিত বিদ্যাধর। সময় পেরিয়ে রাত ন’টা। তবুও সে ফিরতে পারছেনা। তার দুই দাদা হাজির। তাকে চ্যাংদোলা করে চাগিয়ে নেয়। নিয়ে যায় বাড়িতে। বিদ্যাধরের আপত্তি তারা শোনেনা। বাড়িতে ফিরতেই মায়ের রাগারাগি। বাবার বকাবকি। সে সহজ ভাবেই জানায়, ‘তোমরা এতো রাগারাগি বকাবকি করছো কেন? আমি কি অন্যায় করেছি?’

বাবা হুঙ্কার দেন, ‘লেখাপড়া না করে কেত্তন শুনে জীবন কাটেরে হতচ্ছাড়া। পাঠশালায় শুধু পড়লে হবেনা। বাড়িতেও সেই পড়া তৈরি করতে হয়। বুঝলি কিছু?’

খুব সহজেই উত্তর দেয় বিদ্যাধর, ‘পাঠশালায় গুরুমশাই যা পড়ান, তাতেই আমার পড়া তৈরি। আমার আর পড়ার দরকার নেই।’ সেই উত্তর তার বাবার পছন্দ নয়। বেজায় রেগে যান। হাতের সামনে পেয়ে যান একটা কঞ্চি। তাই দিয়েই আট বছর বয়সী বিদ্যাধরকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকেন। বিদ্যাধরের মা কঞ্চি কেড়ে নেন। ছেলেকে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢোকেন। বাইরে তার বাবার কথা থামেনা। তিনি বলেন, ‘তোমার আস্কারাতেই ছোটছেলে উৎসন্নে যাবে। তা তুমি দেখে নিও। ওর কপালে ভিক্ষেও জুটবে না।’ 

তার মা তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। পড়শোনা করার জন্য বুঝিয়ে বলতে থাকেন। তবুও বিদ্যাধরের মনে বেজায় কষ্ট। বিস্তর অভিমান তার। সে মনেমনে ঠিক করে, ঘরে আর থাকবে না। সে ভোরেই বেরিয়ে পড়ে। কোথায় যাবে, তারও ঠিক নেই। গ্রাম ছেড়ে পুবের পানে হাঁটতে থাকে। হাজির প্রায় আট ক্রোশ দূরে। এতো দূরত্ব আসায় খিদেয় কাতর। খাবার কোথায় পাবে, তাও জানে না। ধুতির খুঁটে সামান্য ক’টা পয়সা। অসহ্য খিদে লাগে। অজানা গাঁয়ের পুকুর ঘাটে নামে। আঁজলা ভরে জল পানকরে। এক বয়স্কা মহিলা ঘাটে তখন। মহিলাটি অনুমান করেন, ছেলেটি খিদেয় কাতর। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাবা, তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি যাবেই বা কোথায়?’

‘আমার বাড়ি অনেক দূরে। আমি গান শেখার গুরুর খোঁজে বেরিয়েছি।’

‘কোথায় তোমার গানের গুরুর বাড়ি?’

‘তাতো জানিনা। এখানের গাঁয়ে গানের কোন গুরুর খোঁজ আপনি দিতে পারেন?’

‘রাখো তোমার গানের গুরু। আমায় বলতো, তুমি এইটুকু ছেলে, কে তোমায় গান শেখাবে? তাছাড়া এতো বেলায় শুধু জল খাচ্ছো কেন? পিপাসা পেয়েছে?’

‘নাঃ, খুব খিদে পেয়েছে। খাবার কিছু কাছে নেই। তাই জল খেলাম।’

‘শোনো বাছা, তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে চলো। কিছু খাবে। তারপর তোমার গুরুর খোঁজে বেরোবে।’

‘না মাসীমা, আমি কোথাও কিছু কিনে খেয়ে নেবো।’

‘পাগল ছেলে! বলছি খেয়ে যাবে। তবুও শুনবে না? শোন বাছা, বাড়িতে আমরা দু’জন। ভয় নেই। কেউ কিছু বলবেনা। চলো আমার সাথে।’ বেশ লজ্জ্বা লাগে তার। তবুও, মহিলার সাথে তাঁদের বাড়িতে যায়।

বেশ যত্নের সাথেই বিদ্যাধরকে খেতে দেন তিনি। খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই হাজির মহিলার স্বামী। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘প্রমীলা, ছেলেটি কি তোমার কোন আত্মীয়ের ছেলে?’

‘নাগো, ছেলেটি গান শিখতে চায়। তুমিতো বাড়িতে গান শেখাও। এগাঁয়ে-সেগাঁয়ে গান শিখিয়ে বেড়াও। এই ছোট ছেলেটিকে তুমি গান শেখাতে পারবেনা?’

‘পারবোনা কেন? কিন্তু কাদের ছেলে? কোথায় বাড়ি? সেগুলো জানতে হবেতো। নাহলে শেখাবো কি করে?’

‘জানো, ছেলেটির নাম ঠিকানা এখনও জানা হয়নি। তুমিই নাহয় জেনে নাও।’

বিদ্যাধর মহিলার স্বামী মন্দ্র সেনের সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। সে মিথ্যে একটাও বলেনা। মন্দ্র সেন জানান, ‘গানের জন্য তুমি বাড়ি ছেড়েছো। গানের প্রতি সত্যই তোমার অনুরাগ আছে। আমার বাড়িতে থেকেই তুমি গান শিখবে। আগামিকালই তোমার বাবাকে আমার কাছে আনবে। তাঁর অনুমতি পেলেই আমি গান শেখাবো। তোমার গলার স্বর সত্যিই গানের উপযুক্ত। তুমি এখনি বাড়ি ফিরে যাও।’

‘বাবাতো গান পছন্দ করেন না। যদি আসতে না চান? তাহলে কি গান আমার শেখা হবেনা?’

‘তোমার বাবাকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার। তাঁকে সঙ্গে আনবে। যাও আজই বাড়ি ফিরে যাও।’

এদিকে বিদ্যাধরের বাড়ি থেকে পালানোয় তাদের বাড়িতে নেমে আসে উদ্বেগের ছায়া। চারদিকে খোঁজাখুঁজি চলে। সব আত্মীয়ের বাড়িতে খোঁজ পাঠায়। কোথাও খোঁজ মেলেনা। সবাই পাগলের মতো বিদ্যাধরের খোঁজে। তাদের উদ্বেগের অবসান ঘটে। বিকেলের ম্লান আলোয় বাড়ি ফেরে বিদ্যাধর। রাতে বাবাকে মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে। সে গান শিখবেই। গান ছাড়া সে কোন কিছুই শিখতে চায়না। তার বাবাকে তার সাথে যেতেই হবে। তার বাবা নিম-রাজি। অন্তর থেকে সায় নেই। তার মায়ের অনুরোধেই পরের সকালে বিদ্যাধরের সাথে বেরিয়ে পড়েন। তারা হাঁটতে থাকেন মন্দ্র সেনের গাঁয়ের উদ্দেশ্যে। 

মন্দ্র সেনের সাথে তার বাবার কথা চলতেই থাকে। অনেক বাদানুবাদের পর শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেন। তার সাথে কিছু শর্ত রাখেন। বলেন, ‘বিদ্যাধর গান শিখলেও বাড়িতে ফিরতে পারবেনা। তার টাকা রোজগারের ক্ষমতাই থাকবে না। অমন ছেলেকে বাড়িতে ফেরাতে চাইনা। গান শিখে খাবে কি?’ মন্দ্র সেন জানান, ‘ঠিক আছে বিদ্যাধর বাড়ি ফিরবেনা। আপনি বাড়ি ফিরে যান। তার দায়িত্ব আমিই নিলাম।’ বিদ্যাধরের বাবা বাড়ি ফেরেন।

বিদ্যাধরের গানের তালিম চলতে থাকে, গুরু মন্দ্র সেনের কাছে। তিনিই বিদ্যাধরের নাম দেন সুকণ্ঠ। দশ বছরে সুকন্ঠ পরিণত সঙ্গীতজ্ঞ। সুকন্ঠের সঙ্গীতের সুনাম আনন্দনগরীর রাজার কানে পৌঁছায়। তিনি বালিকা রাজকুমারীর সঙ্গীতগুরু হিসাবে নিয়ে যান সুকণ্ঠকে। সুকণ্ঠের বাবার কাছে ছেলের সুসংবাদ পৌঁছায়। তিনি ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চান। ছেলে রাজবাড়ির সঙ্গীত শিক্ষক। অনেক বেতন! ছেলের কাছে কিছু টাকা চাইবেন। তাঁদের অভাব মেটাতে। 

অনেক পথ হেঁটেই রাজবাড়িতে পৌঁছান তিনি। ছেলে বিদ্যাধরের সাথে দেখা করার জন্য তিনি উদগ্রীব। প্রহরীর কাছে বিদ্যাধর দত্ত নামে সঙ্গীতজ্ঞের খোঁজ করেন। প্রহরী জানায়, ‘এই নামে কোন সঙ্গীতজ্ঞ রাজবাড়িতে নেই।’ বিদ্যাধরের বাবা ফিরে আসেন না। রাজবাড়ির বাগানে অপেক্ষা করেন। খানিক পরেই সুকণ্ঠ রাজকুমারীর গানের তালিম দিতে বসেন। ছেলের গলার স্বর চিনতে পারেন তিনি। প্রহরীকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘যিনি গান শেখাচ্ছেন, তাঁর নাম কি?’

‘তাঁর নাম সুকণ্ঠ সেন।’

‘কিন্তু গলার স্বরটা অবিকল আমার ছেলের মতোই।’

‘গলার স্বর এক হলেও, উনি বিদ্যাধর দত্ত নন।’ প্রহরীর কথা বিশ্বাস করতে পারেন না তিনি। বাগানেই অপেক্ষা করেন। যদি ছেলেকে দেখতে পান, নিজেই ডেকে নেবেন। এমন বিশ্বাস নিয়েই অপেক্ষা করেন।

প্রহরী তাঁকে আবার বাগানে দেখে। সে ভাবে, লোকটির মতলব খারাপ হতেপারে। যদি লোকটি কোনভাবে রাজবাড়িতে ঢুকে পড়ে। তাহলে তার নিজের উপরেই দায়িত্বহীনের তকমা জুটবে। তাই লোকটাকে বাগান থেকে হটাতেই হবে। প্রহরী আগিয়ে যায়। গিয়ে বলে, ‘তোমার মতলব ভালো নয়। তুমি এখান থেকে না গেলে, তোমায় কারাগারে পাঠিয়ে দেবো।’

‘আমাকে কারাগারে পাঠালেও, আমি যাবো। আমার ছেলের সাথে দেখা করবোই। ওই গায়ক আমার ছেলে বিদ্যাধর। আমি হলফ করেই বলতে পারি।’

‘তাহলে তোমার হলফ তোমার থাক। তোমাকে কারাগারেই পাঠাচ্ছি।’ প্রহরী অন্য এক প্রহরীকে ডেকে তাঁকে বন্দীকরে। কারাগারে পাঠায়।

প্রায় আলো নেই কারাগারে। সেখানে খেতে পায়। কিন্তু বাইরের দিকে কোন জানালা নেই। সেই গায়ককে দেখার সুযোগ পাননা। তাঁর গান, কন্ঠস্বর কানে আসে। কেঁদেই দিন কাটে। কারাগারের প্রহরীকে জানায়, ‘আমিতো অপরাধী। আমার বিচার কবে?’

‘সে আমি বলতে পারবো না। রাজামশাইয়ের মর্জি হলেই, তোমার বিচার হবে।’ চলতে থাকে বিচারের জন্য দিন গোনা। দিন যায়। তিন মাসের পর তাঁকে হাজির করে বিচার সভায়। রাজা জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি রাজবাড়ির বাগানে এসেছিলে কেন?’

‘মহারাজ, আমার ছেলে রাজবাড়ির সঙ্গীত শিক্ষক।’

‘কি নাম তাঁর?’

‘বিদ্যাধর দত্ত।’

‘পাগলের প্রলাপ, বিদ্যাধর নামে রাজবাড়িতে কেউ নেই। পণ্ডিত সুকণ্ঠ, মন্দ্র সেনের ছেলে। তুমি মিথ্যে বলছো।’

‘না মহারাজ আমি মিথ্যে বলছিনা। আমি তার গান রোজ শুনি। আপনি সুকণ্ঠ সেনকে বিচার সভায় আসার অনুমতি দিন। আমি নিজের চোখে তাকে দেখবো।’ 

‘তোমার অনুরোধেই তাঁকে আনার ব্যবস্থা করছি। প্রহরী, পণ্ডিত সুকন্ঠজিকে সম্মানের সাথে বিচার সভায় আসার অনুরোধ জানাও এবং সঙ্গেই আনো।’

আসেন সুকণ্ঠ সেন। মুখ ভর্তি দাড়ি, শীর্ণ শরীর, তাঁর বাবার। দেখেই তিনি শিউরে ওঠেন। ভাবেন, বাবার কিসের অপরাধ?

ছেলেকে দেখেই চেঁচিয়ে ওঠেন বাবা, ‘ওইতো আমার ছেলে বিদ্যাধর।’ রাজা জিজ্ঞাসা করেন, ‘পণ্ডিতজি, উনি আপনার বাবা?’

‘হ্যাঁ মহারাজ। উনিই আমার বাবা। পণ্ডিত মন্দ্র সেন আমার গুরু এবং পালক পিতা।’

‘পণ্ডিতজি, তাহলে আপনার প্রকৃত নাম বিদ্যাধর দত্ত?’

‘হ্যাঁ মহারাজ, গুরুজি ডাকতেন সুকণ্ঠ সেন। সেই নামটাই আপনারা সকলে জানেন।’

‘তাহলে আপনার বাবা নির্দোষ পণ্ডিতজি। প্রহরী, হাতের বাঁধন খুলে দাও।’ 

বাঁধন খোলা হাত দিয়ে তিনি সুকন্ঠকে জড়িয়ে ধরেন। সুকণ্ঠ তাঁর বাবাকে বলেন, ‘আপনি বাড়ি ফিরে যান। প্রতিমাসেই রাজবাড়ির কেউ আপনাকে টাকা দিয়ে আসবে। আমি শুনেছি দাদারা এখন পৃথক। মা এবং আপনি কষ্টেই আছেন। তাই আমি টাকা পাঠাবো। মাকে আমার প্রণাম জানাবেন। 

তবে হাজার অনুরোধ করলেও এখনের সুকণ্ঠ, বিদ্যাধর হিসাবে বাড়ি ফিরবে না।

আপনি তখন আমার আগ্রহের প্রতি সম্মান জানাননি। তাই আমি ফিরে যাবোনা। কারণ গান আমার প্রাণ। আমি আসছি বাবা। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। আপনাদের ইচ্ছাহলে, আমার সাথে মাঝেমাঝে দেখা করতে পারবেন।’ কথাগুলো শেষ করেই সুকণ্ঠ রাজবাড়িতে ফিরে যান।