গল্প - ৫ । কার্তিক ১৪৩১

 


 কান্না 











নন্দিতা সাহা

গাজিয়াবাদ, উত্তর প্রদেশ



 

ধীরে ধীরে উঠে বসলো। চোখ খুললো। চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার! গাছের ফাঁকে ফাঁকে তারার মতো জোনাকিরা টিমটিম করে জ্বলছে। বুবু উঠে দাঁড়ালো। গায়ের জামা কেমন ভেজা ভেজা, মাথার পেছনে হাত দিয়ে দেখল কেমন বিচ্ছিরি চ্যাটচ্যাটে, কিন্তু কোন গন্ধ নেই। কি বা লেগেছে? অন্ধকারে দেখতেও পাচ্ছে না। ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলয়। শুয়ে আছে বুবু! এই পান্ডব বর্জিত জায়গায়! মাঝেমধ্যে একটা-দুটো পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে, এদিক ওদিক একটা দুটো পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। কুঁচকে চিন্তা করার চেষ্টা করল বুবু

শিগগিরই সব মনে পড়ে গেল। কংকালী পাহাড়, মানে পাহাড় মত ছোট টিলা। এখানে  তো  সকলের আসা মানা। নামটি শুনলেই কেমন  কঙ্কাল কঙ্কাল ভর্তি পাহাড় বলে মনে হয়, কেমন যেন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগে, গা ছমছম করে। ভয়ে কেউতো এদিকটা মোটেও মাড়ায় না।

 বুবুর মনে পড়ল ওরা তিনজন এসেছিল, বুবু বাচ্চু আর মানিক। মানিকই ওদের ফুসলিয়ে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ওরা এসেছিল সেই দুপুরে এখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত! বাচ্চু, মানিক ওরাই বা কোথায়? কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না এ তল্লাটে ! একটু একটু মনে পড়ছে বুবুর, ও আসলে টিলার ওপর থেকে নিচে ধপ করে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরল কি করে?  ওর তো মনে হচ্ছে কেউ যেন পেছন থেকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল, কিন্তু  কে? ওরা  তিনজনেই  তো  ছিল। নাকি ---! পা পিছলে! তাহলে কি ভু---! কে জানে! 

  বাচ্চু, মানিক? ওরাও  কি উপর থেকে পড়ে গেছে? স্পষ্ট মনে পড়ছে ওর পরবার সময় বাচ্চু ধারেকাছে ছিলনা, বাচ্চু ওর থেকে অনেকটা পেছনে ছিল। কড়ে আঙ্গুল দেখিয়ে গাছের আড়ালে গিয়েছিলো মানে পেটে চাপ এসেছিল। তবে মানিক কি--- ! কিন্তু মানিক কেন এমনটা করবে। ওরা তো বন্ধু। মানিক ছেলেটা বড় দুষ্টু, দু দুটো স্কুল থেকে ওর নাম কাটিয়ে দিয়েছে তারপর ছেলেটা বাউন্ডুলের মত সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ায় বন বাদাড়ে, মাথার মধ্যে নানা বদবুদ্ধি কিলবিল করে।

বুবুর মা সব সময় মানা করে, "বুবু সাবধান, মানিক কিন্তু খুব দুষ্টু। বাপ মা মরা ছেলেকে বাড়িতে ওই বুড়ো দাদু দিদার শাসন করার ক্ষমতা  নেই। তুই কিন্তু ওর পাল্লায় পরিস না। ও কিন্তু গোল্লায় যাচ্ছে।" বলেই মা আবার মন খারাপ করে বলে," বেচারা মা বাবার স্নেহ ভালোবাসা পেল না, খারাপ লাগে মানিক টার জন্য। আমি তো নিজের চোখের সামনেই জন্মাতে দেখলাম ওকে। বেচারা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। কত ভালো ছিল ওর বাবা মা। বাপ মা থাকলে কি আর এমন ধম্মের ষাঁড় হত? ছেলেটা অযত্নে অমন বিগড়ে গেল।" 

বাচ্চু পড়ে ক্লাস এইটে, ওদের থেকে ছোট। বুবু এবার  ক্লাস টেনে উঠল, মানিক বুবুর থেকে তিন বছরের বড় তবুও ঘষটে ঘষটে ক্লাস নাইন  পর্যন্ত এসে থেমেছে। যতই তিনজন বন্ধু হোক তবুও বুবু একটু সরে  সরেই থাকে। মানিকই ওদের দুজনকে দলে টানে। মানিকের মধ্যে এক অদ্ভুত হিপনোটিক পাওয়ার আছে, মানিক ডাকলে বুবু, বাচ্চু কেউই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে না। মানিকের সঙ্গটা মন্দ লাগে না ওদের। মানিক  কত অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনায়। শুধু শোনায় না, করেও দেখায়।   রাতদুপুরে শ্মশানে ঘুরে এসে বলে, দেখ আমার কত সাহস! হেলে সাপের লেজ ধরে আচ্ছা করে ছুঁড়ে মারে, মগডালে তরতর করে উঠে পাখির ডিম   এনে পটাশ পটাশ করে ফাটায়। 

মানিক দাদুর বাড়ি থাকি। বাড়ির পেছনে একটা ছোট ঘর আছে, বহু পুরনো। সেই ঘরভর্তি মানিকের কত রকমের সরঞ্জাম। মাঝেমধ্যেই বুবু বাচ্চু ওই ঘরে ঢুকে আড্ডা মারে, হাতিপাতি করে। রংতুলি থেকে বইয়ের সুতোয় মাঞ্জা দেয়। সেবার তো বুবু কে টেনে ধরতে বলে কতটা মাঞ্জা হয়েছে দেখার জন্য। বুবু যেই না টান মেরেছে আঙ্গুল কেটে দরদর করে রক্ত বেরল। দেখেতো মানিক হেসে কুটিকুটি, বলে, আঙ্গুল কাটলে কি হবে গলা কাটার মত ধার করতে হবে। খুব রাগ হয়েছিল বুবুর। বাচ্চুকে সঙ্গে নিয়ে আড়ি দিয়ে চলে এসেছিল। পরদিন একটা কবুতর পড়েছিল ওদের বাড়ি ঠিক সামনে, গলা কাটা। কি জানি হয়তো মানিকের কান্ড হবে! বুবুর  সন্দেহ হয়েছিল প্রকট এটা মানিকেরই কাজ। ওর মনে মায়া মমতা কিচ্ছুটি নেই। হুজুগে ছেলেটা বড্ড ডানপিটে, নিষ্ঠুর ও বটে।

একদিন মানিকই ওদের বাড়ি এসে জোর করে বুঝিয়ে সুজিয়ে আবার ভাব করে নিয়ে গেছে ওর ডেরায়, আবার বন্ধুত্ব পাকাপোক্ত হয়ে গেল  তিনজনের।

বর্ধিষ্ণু গ্রাম, ছোট শহর এই কুসুমপুর। মানিকের সব আলিগলি একেবারে নখদর্পণে। এই ছোট্ট শহরের একদিকে তোরসা নদী, অন্যদিকে কংকালী পাহাড়, ঝোপঝাড়ে ভর্তি। কেউ যায় না, বলে কিনাওখানে অপদেবতা আছে ভূত প্রেত আছে, যে যায় আর ফেরে না। কিছু অমঙ্গল  ঘটবেই।

নানাজনে নানা গল্প করে। কেউ বলে নীল আন্দোলনের সময় নাকি ঝাঁকে ঝাঁকে নীলচাষীদের ওখানে জ্যান্ত পুঁতে দেওয়া হয়েছে। সত্যি-মিথ্যা কেউ জানে না তবে এমনটাই প্রচলিত। কখনো হাহা করে হাসির শব্দ কখনো গুনগুন করে গান আবার কখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসে।

মানিকের অনেকদিনের লোভ ওখানে যায়। হয়তো সবার অলক্ষ্যে গিয়েও ছিল। মানিকই বুবু আর বাচ্চুর মগজ ধোলাই করলো, বলল কিচ্ছু নেই রে ভূতটুৎ। বড় বড় ডাঁসা পেয়ারা আছে আর প্রচুর টোপা টোপা কুল গাছ আছে। এই দেখ, ঘরে নিয়ে দেখিয়েছিল, এইগুলো ওইখানকার গাছের পেয়ারা। মানিক খবর নিয়েছে পাশের গ্রাম থেকে লোকেরা এসে এই ডাঁসা পেয়ারা নিয়ে যায় বাজারে বিক্রি করে, সেগুলোই আমরা খাই।

ঠিক হলো শনিবার হাফ স্কুল। স্কুল থেকে ফিরে ওরা তিনজন যাবে কিন্তু বাড়িতে কাউকে বলবে না। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। দুরু দুরু বক্ষে পা বাড়ালো তিনজন ভরদুপুরে, বুবুর একটু অপরাধবোধ হলো বটে। মাকে মিছে কথা বলেছে। বাচ্চু সবার পেছনে পেছনে, ও সবচাইতে ছোট যে। আর মানিক লাফিয়ে লাফিয়ে কাটা গুল্ম, ঝোপ ঝাড় ছাড়িয়ে এগিয়ে চললো হাতে একটা বিরাট লাঠি। ওরা এগিয়ে চলল সেই ভয়ঙ্কর রহস্যেঘেরা কংকালী পাহাড়ের দিকে। ওখানে নাকি কান্না শোনা যায়, শোনা যায় মাটি কাটার শব্দ, শোনা যায় সপাং সপাং চাবুকের শব্দ। আচ্ছা ওরাও কি শুনবে!   কাঁটা দিচ্ছে, গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে! আবার মনের ভেতরে শিহরণ হচ্ছে, উত্তেজনা হচ্ছে। বিরাট অ্যাডভেঞ্চার বলে কথা! মাকে গিয়ে পরে  সব বলতে হবে, একদিন মাকে নিয়ে আসতে হবে। কখনো চোখ বন্ধ করে কখনো মিটমিট করে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে ওরা তিনজন এসে পৌঁছল  রহস্যাবৃত কংকালী পাহাড়ে। মানিক তরতর করে ওপরে উঠে গেলো। মানিক খুব খুশি, চোখ বড় বড় করে বলছিল এসে দেখ এখান থেকে আমাদের গ্রামটা কেমন সুন্দর লাগে। বাচ্চু বেশ খানিকটা পেছনে রয়ে গেল। বুবু দৌড়ে একেবারে টিলার উপরে পৌঁছল, সত্যিই এমন চমৎকার!  ছবির মতো, ওই তোরসা নদী বয়ে চলেছে কুলকুল করে। বুবু একমনে প্রকৃতির শোভা দেখছিল দুই চোখ ভরে। ওদের কুসুমপুর যে এত সুন্দর! মানিক না  নিয়ে  এলে  জানতেই  পারত  না। পেছন ফিরে মানিককে ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কি যে হলো? কিছু বোঝার আগেই ওপর থেকে একেবারে নীচে --- ! তারপর শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার!! 

ধীরে ধীরে অন্ধকারটা এখন সয়ে এসেছে বুবুর চোখে। গাছগুলো আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। সব মনে পড়ে যাচ্ছে বুবুর। মনে হচ্ছে কেউ যেন ওকে ধাক্কাই দিয়েছিল, কিন্তু অত উপর থেকে পড়ল অথচ শরীরে ব্যথা নেই তেমন! হয়ত কাদা মাটির ওপর পড়েছে। গা টা একটু ম্যাজম্যাজ করছে বটে। ওরা কোথায়? বাচ্চু মানিক? ওকে একা রেখে চলে গেল?   মানিকটা অবশ্য সবই পারে। নাকি ওরাও এখানে পড়ে আছে? মা বাবা    ঠাম, নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে, রাত যে  অনেক।

পা বাড়ালো বুবু, শরীরটা একটু টলে গেল। আসার সময় খুব ভয় করছিল, এখন কিন্তু মোটেই ভয় করছেনা। কিসের ভয়! কেন ভয়! কাকে ভয়! আগে ভূতের ভয় ছিল, এখন ভয় উধাও, বরং ফুরফুরে লাগছে মনটা। শুধু বাড়ির জন্য চিন্তা হচ্ছে। বড় রাস্তার দিকে এগোলো, দূরে লাইট গুলো দেখা যাচ্ছে। বুবু একটু জোরে পা বাড়ালো, কিন্তু জোরে চলতে গেলে কেমন যেন পা দুটো টলে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে পায়ের তলায় মাটি যেন সরে সরে যাচ্ছে। থাকুক আস্তে আস্তেই হেঁটে যাবে আবার যদি মাথা ঘুরে পড়ে যায়। আরও কিছুটা এগোল। ওই তো ওই তো ওদের বাড়ি দেখা যাচ্ছে, বাড়ির সামনে লোকজন! কি হলো!! সবাই ঠিক আছে তো? সবাই ওকে নিয়েই হয়ত চিন্তা করছে! কি জানি, ঠাম এর ও বয়স হয়েছে, শরীর তেমন ভালো থাকেনা। কিছু হলো না তো? সেই কখন বেরিয়েছে ও বাড়ি থেকে। বাবা! বাবার কিছু হয়নি তো? গতি এবার দ্রুত হলো। পায়ের তলার মাটি   সড়তে লাগল, ছুটতে ছুটতে ওর শরীর কেমন যেন হালকা হাওয়ায় উড়ছে মনে হল। হাওয়ায় প্রায় ভাসতে ভাসতে চলে এলো। পরিষ্কার মায়ের কান্নার শব্দ! বুবু গেট দিয়ে ভেতরে গেল। কেউ বুবুকে একটিবারের জন্য তাকিয়েও  দেখল না, রাগ করেছে? সবাই এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। কিছুতো একটা হয়েছে! বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। ভেতর উঠোনে  গেল বুবু, ওই তো মা! কাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে! ঠাম এর  মাথায় দু-একজন জল ঢালছে। কিন্তু মা কাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে? বুবু সামনে এলো, ডাকলো মা মাগো! কোন সাড়া নেই মায়ের, মা কেঁদেই  চলেছে।

বুবু উঁকি দিয়ে দেখল, এইবার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল। ও মাগো!!!  সর্বনাশ!!! একি দেখছে বুবু!! ছিটকে সরে গেল বুবু। মুখটা কি বীভৎস!   মা তো ওকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদছে হাউ হাউ করে। ওর সারা শরীরে চাপ  চাপ রক্ত, মাথার পেছনটা  ঘিলু বেরিয়ে গেছে, চোখ দুটো বেরিয়ে এসেছে!! ওর একটা ভয়ংকর চেহারা হয়েছে! নিজের মাথার পেছনে হাত দিলো বুবু, ওর মাথার পেছনে খুলি তো একেবারে ফেটে চৌচির, কেবল চ্যাট চেটে  ঘিলু!! 

এটাতো ওর ডেড বডি! নিজের মৃতদেহের পাশে বুবু হতভম্বের মতো দাড়িয়ে রইল, এতক্ষণে বুঝলে ও মরে গেছে ও ভূত হয়ে গেছে ওকে কেউ দেখতেও পাচ্ছে না। ও এখন বিদেহী আত্মা। কান্নার ঢেউ উঠলো বুবুর বুকে। মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে বাবা। হাওয়ায় ভেসে চট করে   বুবু নিজের ঘরের বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়ালো, বুবু শুনেছে আয়নায়  ভুতের প্রতিবিম্ব পড়ে না। আয়নার দিকে তাকালো, না আয়নায় বুবুকে দেখা যাচ্ছে না। ওহ মাগো! বুবুর চোখে জলের ধারা। চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সবাইকে দেখছে বুবু। 

কখন যে বাচ্চু এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করেনি। চোখে চোখ পড়তেই  বাচ্চু কাছে এলো, চোখে জল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, --- দেখ ওই শয়তান মানিকটা আমাদের মেরে ফেলল। 

--- কিন্তু কেন? 

--- ওই যে আমরা ওর ঘরে ভোজালি, বারুদ দেখেছিলাম। একটা  বন্দুক ও দেখেছিলাম। ও ভেবেছে আমরা যদি বলে দি সবাই কে।

--- ( বুবু অবাক ) তুই ও মরে গেছিস বাচ্চু?  

--- হ্যাঁ, আমার পায়ের দিকে তাকা। 

--- কি হয়েছে ভাই? 

--- দেখ পাদুটো শূন্যে ঝুলছে, কিছুতেই মাটিতে লাগছে না।  

বুবু ভালো করে তাকিয়ে দেখল ওরা দুজনেই শূন্যে ঝুলছে। আর  সন্দেহ নেই, ওরা আর এই মনুষ্য জগতের আর কেউ নয়। ওরা এখন  অশরীরী। ওদের শরীর নেই। ওদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ওরা তো জানে ওদের মনটা একই রকম আছে। 

বুবুর চোখ পরল ওই এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে মানিক, ভালো  মানুষের মত মুখ করে। রাগে ফেটে পড়ল বুবু আর বাচ্চু। আর দেরি নয়, এর আগে কোনদিন এত রাগ হয়নি বুবুর। আজ আর রাগ সামলাতে পারল না। ঠিক সেইসময় সবাইকে অবাক করে হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দে এক দমকা হাওয়া উঠলো। সেই দমকা হাওয়ায় মানিক লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে পানা পুকুরে গিয়ে পড়ল। প্রচন্ড ঢেউ উঠলো পুকুরে। কেউ যেন মানিককে জলে জোর করে ঠেসে ধরেছে। ধীরে ধীরে মানিক আর মাথা তুলতে পারলো না, স্থির হয়ে গেল পুকুরের জল। দমকা হাওয়া নিজের মতো উড়ে চলে গেল সেই কংকালী পাহাড়ের দিকে। সঙ্গে এক চাপা কান্নার শব্দ, যদিও সেই  শব্দ কারও কানে পৌঁছুল না। 

কদিন পর পুলিশ এল মানিকের বাড়ি। জানা গেল ও নাকি কোন উগ্রবাদী সংগঠনের সাথে কাজ করতো, খুব শিগগিরই নাশকতার ছক কষেছিল, সাংঘাতিক প্রাণহানি হতো। যাক সবাই বেঁচে গেল। 

কঙ্কালী পাহাড় থেকে বুবু হা করে তাকিয়ে থাকে বাড়ির দিকে। ও জানে কখন মা আসবে কল তলায়। ঠিক তখনি হাওয়ায় মিশে চলে যায় বাড়ি। চুপটি করে চালতা গাছে বসে থাকে, চালতা গাছ ভূতেদের বড় প্রিয় গাছ। মাকে দুচোখ ভরে দ্যাখে। ওপর থেকে টুপ টুপ করে দুটো পাকা চালতা মায়ের পায়ের কাছে পড়ে। মা তুলে নেয়, ভ্রু কুঁচকে গাছের দিকে তাকায়, অবাক হয়ে ভাবে কি করে চালতা দুটো অমনি অমনি গাছ থেকে খসে পরলো? আহা আমার বুবুটা চালতার আচার খুব ভালোবাসতো। চাটনি বানিয়ে অপুদের দিয়ে আসব, ওরা খাবে 'খন। মা চালতা দুটো নিয়ে ঘরে চলে যায়। বুবু মাকে আলতো ছুঁয়ে ফিরে আসে কংকালী পাহাড়ে।    

বাবা-মা, ঠাম প্রতি শনিবার কংকালী পাহাড়ে এসে প্রদীপ জ্বালায়, একটুক্ষণ থেকে আবার ফিরে যায়। বুবু ঠিক সেই সময় ওদের আশেপাশেই থাকে, দুচোখ ভরে দ্যাখে। হাওয়ার মধ্যে মিশে ওদের জড়িয়ে থাকে, মায়ের শরীরের গন্ধ নেয়, বাবার কপালের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দেয়। তবে কংকালী পাহাড়ে এখন সবার ভয় কেটে গেছে, বিকেলে অনেকেই এখন ঘুরতে আসে। আগে অনেক দুর্ঘটনা ঘটতো। কিন্তু এখন আর তেমন ঘটে  না। অনেকেই বলে দুর্ঘটনা ঘটতে ঘটতে, আর ঘটে না। কেউ কেউ বলে  পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, কিন্তু কেউ যেন ওদের পিছন থেকে টেনে বাঁচিয়েছিল, যদিও কাউকে দেখা যায় না। সবাই বিশ্বাস করে বিদেহী আত্মা, মানে ভূত যদি সত্যিই কঙ্কালী পাহাড়ে থাকে সে বড় ভালো মানুষ ছিল, বড় ভালো ভূত। কারোর ক্ষতি করেনা, বরং বিপদ থেকে রক্ষা করে। 

কিন্তু সেই ভূত কাঁদে। কেঁদে কেঁদে বেড়ায়। কংকালী পাহাড়ে  আছড়ে পড়ে সেই কান্না। কারও কানে পৌছয় না সেই কান্না, সেই  হাহাকার।