স্মৃতি সততই
সুখের। আবার দুঃখেরও বটে। স্মৃতির ভাণ্ডার কখনো-কখনো বিশ্বাসঘাতকতাও করে। তার
ঝাঁপিতে যেসব রত্নরাজি আছে, সবকিছু সময়মতো
প্রকাশ্যে আসে না। বিস্মৃতির অতলে মুখ লুকিয়ে থাকে। আমার ডায়েরি লেখার অভ্যেস নেই।
তাই বহু ঘটনাই কালের গর্ভে নিরুদ্দেশ। এতকালের সম্পর্ক, এত
গুণীজন, তবু স্মৃতি হাতড়ে যেটুকু হাতড়াতে পারি তাই মূল্যবান। ভবানীপ্রসাদের
সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় পঞ্চাশ বছরের মতো। তখন আমি কলেজের প্রথম সিঁড়িতে। ১৯৭৩ কি
১৯৭৫, ঠিক মনে নেই। আমার এক সাহিত্য-পাগল বন্ধু
শ্রী আভাসচন্দ্র মজুমদার আমাকে হাওড়ার বোষ্টম পাড়ায় ‘অভিনব
অগ্রণী’-র দপ্তরে নিয়ে যায়। ওই পত্রিকার সম্পাদক দিলীপকুমার
বাগ। আভাস একটা পত্রিকা বের করত হাওড়ার শিবপুরের কৈপুকুর থেকে। ওখানেই ওর বাড়ি। ওর
পত্রিকার নাম ছিল ‘সাহিত্যবাণী’। ওই ‘অভিনব অগ্রণী’-তে প্রথম পরিচয় হল ভবানীদার সঙ্গে।
প্রথম
আলাপেই আমি মুগ্ধ। তখন ওঁর ছড়ার সৌরভ বাংলার দিকে দিকে প্রসারিত। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়
লেখা বের হচ্ছে। কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে ‘রামধনু’ সম্পাদক ক্ষিতীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য আর একপ্রান্তে ধীরেন্দ্রলাল ধর।
দুজনের চোখের মণি ভবানীপ্রসাদ। অন্য কথায় পরে আসছি।
সেই ৭৩ কি
৭৫ সালের ভবানীপ্রসাদকে দেখে আমি অবাক। নো গ্ল্যামার। একেবারেই ছাপোষা। প্রথম
আলাপেই আপনজন করে নেওয়া।
তখন থেকেই
হরেন ঘটক, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ।
‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় লেখা বের হচ্ছে। কিন্তু
কোনও অহংকার নেই। সকলকে আপন করে নেবার প্রবল চেষ্টা। এখন অনেক নাম মনে নেই। হাওড়ার
আশপাশ থেকে সবাই জড়ো হতেন। সালকিয়া থেকে মানিক মুখোপাধ্যায় আসতেন। আর এক
মাস্টারমশাই, যতদূর মনে পড়ে তাঁর নাম সুনীল। পদবি মনে নেই।
ওরকম মাস্টারমশাই আমি অল্প দেখেছি। বিয়ে করেননি। রিটায়ারের পর সমস্ত টাকা স্কুলকে
দান করেছেন। এই মানিকদা আর সুনীলদা ভবানীদাকে খুব ভালোবাসতেন। ওঁকে ছড়া বলতে
উৎসাহিত করতেন। ছড়াপাঠের পর হাসির ফোয়ারা ছুটত।
চিত্ত বলে
একটা ছেলে আসত। গরমে ঘামতে ঘামতে এসে কবি সুকান্তকে নিয়ে জ্বালাময়ী কবিতা পড়ে
হাঁপাত। ভবানীদা ওকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। চিত্ত পরে হাইকোর্টের ল-ইয়ার হয়।
আসতেন
পঞ্চাননদা। পদবি মনে নেই। হাওড়ার গেস্ট কিন উইলিয়ামসের সুপারভাইজার ছিলেন। আসতেন
সুধীরচন্দ্র দে, শিশির রায়, অশ্রুরঞ্জন
চক্রবর্তী, সুমন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌমেনদা, পদবি মনে নেই। ‘সাথী’ নামে
একটা সুন্দর পত্রিকা ছিল।
শিবপুর থেকে
আসতেন নয়নরঞ্জন বিশ্বাস। ওঁর ‘আনন্দজগৎ’ বা ‘আনন্দহাট’
নামে সুন্দর একটা পত্রিকা ছিল। আমরা সবাই লিখতাম। ভবানীদা ওই
পত্রিকাটার সম্বন্ধে পরামর্শ দিতেন। কাকে পরামর্শ দেননি? পরবর্তীকালে
যত ছোটোদের পত্রিকা দেখেছি, সবেতেই ভবানীদা। বাংলার এমন কোনও
পত্রিকা নেই যেখানে ভবানীদা নেই। লেখা তো থাকবেই। তাছাড়া হয় সম্পাদকমণ্ডলী,
নয় উপদেষ্টা হয়ে বিরাজমান।
আরও কতজন ‘অভিনব অগ্রণী’-তে
আসতেন, এখন অনেক নাম মনে নেই। এত নাম করার কারণ, ভবানীদার সংস্পর্শে এসে সবাই ভালোই লিখতেন। অনেক ভালো ভালো পত্রিকায় লেখা
বের হত। যাঁর লেখা পছন্দ হত, তাঁর লেখাই ভবানীদা নিতেন।
ছাপাতেন। ‘সত্যযুগ’-এ ছোটোদের পাতায়
অনেকেরই লেখা ছাপা হত। তখন ওখানে মনে হয় হরেন ঘটক ছোটোদের পাতা দেখতেন। আমার বাড়ির
কাছেই ‘অভিনব অগ্রণী’। এমন হল, বুধবার এলেই ছুটতাম। হীরক খণ্ডটার উদ্দেশ্যে। হাসির ছড়া শুনব। শুধু তাই নয়,
নিজের লেখা গল্প পড়ব। শুনে ভবানীদা কী বলেন জানতে চাই। আর ভালো হলেই
উৎসাহ বোধ করতাম।
আবার
কখনো-কখনো ভবানীদা আমার বাড়িতে এসে হাজির। তারপর দুজনে ‘অভিনব অগ্রণী’-তে
হাজির। পরে অবশ্য এই ‘অভিনব অগ্রণী’ ওই
বাড়ি থেকে উঠে যায়। দিলীপদা শ্রীরামপুর থেকে প্রতি বুধবার আসতেন। পরে বড়বাগানে
পাকাপাকি হয়। তার পরেও আমাদের দিলীপদার কাছে যাওয়া হত। কত ফিস্ট হয়েছে।
কত নাম মনে
পড়ছে।—
রেবা ঘোষ।
মনে হয় রেবাদির একটা পত্রিকা ছিল। এখন আর নাম মনে নেই। উনি হাওড়া বালটিকরি ই.এস.আই
হাসপাতালের হেড নার্স ছিলেন। আরাধনা গুপ্ত। সাহিত্য-পাগল মানুষ। উল্টোডাঙায়
থাকতেন। তাঁরও একটা পত্রিকা ছিল। দুজনে ভবানীদাকে তো ভাই বলতে অজ্ঞান। ভবানীদা যেন
সকলের মাথার মণি। ভবানীদাকে সকলের চাই।
আমি আশ্চর্য
হয়ে যেতাম। কী করে এত পারে মানুষ! স্কুলে হেড-মাস্টারের চাকরি। নিজের সংসার। বিধবা
মা। বিধবা বোন ও ভাগনে-ভাগনিদের দায়িত্ব। কাগজের অফিস, নিজের লেখা, অন্যের
লেখা সংশোধন করা, ভালো লাগলে তাঁর লেখা কাগজে ছাপানোর
দায়িত্ব নেওয়া।
আজকাল একটু
নামকরা লেখক-সম্পাদকরা সুটেড-বুটেড। কর্পোরেট কালচার। নিজের লেখা ছাড়া অন্যের লেখা
পড়া বা তাঁকে উৎসাহিত করা থেকে শত হস্ত দূরে থাকেন। নো দায়িত্ব। সমাজে বাস করেও
সমাজচ্যুত। শুধু কাকে ধরলে সরকারি পুরস্কার পাওয়া যায়, ফেসবুকে কত মুখ দেখানো যায়, বইয়ের কত প্রচার করা যায়—তারই ঢক্কানিনাদ। কিন্তু তাঁরা জীবিতকালেই ফুস।
এই একজনকে
আমি নিজে সামনে থেকে দেখেছি কতজনকে ঘষে-মেজে ছড়াকার করে গড়ে তুলেছেন। আজ বাংলা ছড়া
জগতে যাঁরা মধ্যগগনে, তাঁরা অধিকাংশই এই ভবানীদার স্পর্শ
পেয়েছেন। কেউই অস্বীকার করবেন না। দীপ মুখোপাধ্যায়, অপূর্ব
দত্ত, শিশিরকুমার মজুমদার, কুমার মিত্র,
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়রা তো সবসময় ভবানীদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কেউ কেউ
আছেন উলটো সুর গান; ভবানীদা অন্যের লেখা নকল করেছেন,
ব্যবহার ভালো নয়। আমি তো ওঁকে কখনও রাগতে দেখিনি। সবসময় হাসিমুখ।
আমার সঙ্গে এত হৃদ্যতা, কখনও ওঁর মুখে কারও সম্বন্ধে নিন্দে
শুনিনি। আমি হয়তো বলেছি অমুক আপনার সম্বন্ধে এই বলেছে। উনি হাসতেন। বলতেন, ওসব ছেড়ে দাও। যে যা বলছে বলুক। নিজের লেখাটা লিখে যাও। এমনও বলেছেন যে যত
নিন্দে করে, তত জেদ চেপে যায়। সত্যি সত্যি উনি কত জেদি। তা
তো আমি নিজের চোখে পরখ করেছি।
একটা ছোট্ট
ঘর। নড়বড়ে টেবিল-চেয়ার। আসবাবহীন ঘরে ভবানীদা লিখে চলেছেন। ক্লান্তিহীন। ওঁর ঘরে
বসে থাকতে আমার কষ্ট হচ্ছে। টালির চাল। অসহ্য গরম। হাতপাখা। পাশেই কেউ ঘুঁটে
দিচ্ছে। গোবরের গন্ধ। আর আশ্চর্য, তখনই ওঁর কলম সৃষ্টি করছে অফুরন্ত হাসির ছড়া। কখনো-বা সমাজের প্রতি তীব্র
প্রতিবাদ। ‘কাদের তরে লিখছ দাদা, কাদের
তরে লিখছ?’, ‘দলবিচার’। যানবাহন নিয়ে কতরকম ছড়া। ওঁর ছড়ায় কেউ বাদ নেই। কুলিমজুর, আস্তাকুঁড়, ফুল,
পাখি, মহাপুরুষ, সমাজসেবী,
রামায়ণ, মহাভারত, এই
দেশের স্বার্থপর মানুষ, জীবজন্তু, ভূত,
খেলা, হাওড়া, কলকাতা,
যুদ্ধ—কী নেই! পরবর্তী ছড়াকারদের জন্য কোনও বিষয় বাদ রাখেননি। আর
ছন্দ? কতরকমের ছন্দ। ছোটো ছেলেরা আবৃত্তি করে কত আনন্দ পায়।
ভবানীদার ‘মজার ছড়া’ বের হল
১৯৮১ সালের মে মাসে। শিশু সাহিত্য সংসদ থেকে। কর্ণধার দেবজ্যোতি দত্ত ওঁর সঙ্গে
যোগাযোগ করেছিলেন। এ সম্বন্ধে অনেক কথা আমায় বলেছিলেন। আমার কিছুই মনে নেই। এখনও
ওই বই হু হু করে বিক্রি হয়। অসম্ভব ভদ্র পাবলিকেশন। রয়্যালটির ব্যাপারে নিখুঁত। আজ
এই সময়ে ভবানীদা ঘরে বসে। ক্ষমতা নেই নিজে হেঁটে কোথাও যান। এই প্রকাশক খোঁজ
নিলেন। রয়্যালটির জন্য ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিল নির্মলেন্দু শাঁখারু। বড়ো
ভালো ছেলে। ‘ফজলি’ পত্রিকার সম্পাদক।
সরকারি কলেজের লাইব্রেরিয়ান। যারা ভবানীদার কাছে লেখা নিয়ে সবসময় তাঁর কাছে যেত,
কেউ এগিয়ে আসেনি। এসেছিল এই ছেলেটি। বছর খানেক আগে বউদি ওর খুব
প্রশংসা করলেন আমার কাছে।
মনে হয় আশির
দশকের গোড়া। একদিন ভবানীদার সঙ্গে বেলতলা রোডে ক্ষিতীনদার বাড়ি গেছি। আড্ডা বসত।
জমাটি আড্ডা। কে না আসতেন সেখানে—শৈল চক্রবর্তী, ননীগোপাল চক্রবর্তী, উপেন মল্লিক (অভিনেতা রঞ্জিত
মল্লিকের পিতা), পরেশ দত্ত, মঞ্জিল
সেন। মনে আছে, ভবানীদা ‘মন্দ বরাত’
ছড়াটা পড়লেন। আর সে কী হাসি! ক্ষিতীনদা আর উপেনদার হাসি আর থামে না।
মনে আছে, ভবানীদা একবার বলেছিলেন, ‘সন্দেশ’-এ একটা লেখা জমা দিয়েছেন। দুই সম্পাদকের হাত
ঘুরে লেখা গেছে সত্যজিৎ রায়ের হাতে। চা খেতে খেতে তিনি ভবানীদার লেখা পড়ে এমন
হাসলেন যে কিছুটা চা চলকে পড়ে গেল। এ-কথা সত্যজিৎ রায় ভবানীদাকে বলেছিলেন। ভবানীদা
আমাকে।
‘প্রবর্তক’ পত্রিকার
কথা বলতে হয়। বউবাজারে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পেরিয়ে ‘প্রবর্তক
আর্ট ফার্নিচার’। মেট্রো রেলের স্টেশনের কারণে সে-দোকান উঠে গেল। আড্ডাও উঠে
গেল। শনিবার দুপুরের শেষে আড্ডা বসত। চন্দননগরের মতিলাল রায়ের প্রতিষ্ঠিত এই ‘প্রবর্তক’ পত্রিকা।
এখন আর মনে নেই সব শনিবার হত কি না। তা সেখানকার সভার মধ্যমণি হলেন ধীরেন্দ্রলাল
ধর। প্রত্যেকে গল্প-কবিতা পড়তেন। দীপেন রাহা বলে একজন অসাধারণ গল্প পড়তেন।
জগৎরঞ্জন মজুমদার আসতেন। তিনি ‘সাহিত্য ভারতী’ নামে একটা পত্রিকা বের করতেন। আরাধনাদি আসতেন। আরও কতজন। নাম আর মনে নেই
সব। তৃপ্তি ব্রহ্ম নামে এক দিদি আসতেন। দারুণ দারুণ সব গল্প পড়তেন। কিন্তু সবশেষের
আকর্ষণ ভবানীদা। পাঠ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে হাসির ফোয়ারা। একটা পাঠ করলে রেহাই নেই।
আরও। আরও। আর বিভিন্ন সম্পাদক বসে থাকতেন, ভবানীদাকে লেখা
দিতে হবে।
একটা ছবি
স্মৃতিতে স্পষ্ট ধরা আছে। ধীরেনদাকে কখনও বসতে দেখিনি। তিনি যেখানেই যান, দাঁড়িয়ে থাকেন। বাঁহাত দেয়ালে ঠেকানো।
ভবানীদা লেখা শেষ করলেন আর ধীরেনদা ডানহাতটা নেড়ে দিলেন। হাসি হাসি মুখ। মানে পাশ।
সভা শেষে খাওয়াদাওয়ার পর্ব। এখান থেকে বেরিয়ে উলটোদিকের ফিরিঙ্গি কালীর পাশে একটা
দোকানে আবার খাওয়া। আড্ডা। ভবানীদার একপ্রস্থ ছড়াপাঠ।
এই
খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা খুব মজার। লেখা মজার হলেই হয় না, মানুষটা মজার হলে জমে বেশ। খাওয়ার গল্প আর
কত বলব। দু-তিনটে বলি। ভবানীদা ভোজনরসিক। তেলেভাজা খুব প্রিয়। কলেজ স্ট্রিট চত্বরে
যত তেলেভাজার দোকান, খাইনি এমন দোকান নেই। তেলেভাজা আনার ভার
পড়ত আমার ওপর। এই শতকের গোড়ার দিকে শুক্রবার শুক্রবার আড্ডা ছিল নাথ ব্রাদার্সের
দোকানের পাশের ঘরে। এখন যেখানে ‘লালমাটি’, ওই গলির সামনে বিরাট বিরাট বেগুনি ভাজত। ওই বেগুনি ভবানীদা খাবেনই। সূর্য
সেন আর আমহার্স্ট স্ট্রিটের ক্রসিংয়ের কাছে বিখ্যাত ‘কালিকাবাহিনী’-র তেলেভাজার দোকান। ওই তেলেভাজা খাওয়া চাই। ঠনঠনে কালীবাড়ির পূর্বদিকে
একটা রাস্তা গেছে। মনে হয় ওই রাস্তারই দক্ষিণদিকে টাটকা শনপাপড়ি হত। আমরা ক’জন খেতাম নিউস্ক্রিপ্টের আড্ডা থেকে ফেরার সময়। রাস্তা থেকে আম কেনা হল।
রাস্তার কলে ধোয়ার শেষ নেই। বার বার ধোয়ার পর আমায় বলতেন, ‘এবার
খাই, কী বলো। আর ধুলো নেই।’
একটা
বিয়েবাড়ির কথা না বললেই নয়। সাত্তারদা, মানে চম্পক সৌরভ। উনি ইন্ডিয়ান অয়েলের ভিজিল্যান্সে কাজ করতেন।
বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভার শ্রমমন্ত্রী আবদুস সাত্তারের ছেলে। এই চম্পক সৌরভ
আবার ‘শিশিরকুমার মজুমদার স্মৃতি সমিতি’-র প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বাড়িতে প্রতিমাসে মিটিং হত। সঙ্গে জমাটি ইটিং। বউদি
রাঁধতেন। বিরিয়ানি হবেই। ভবানীদা নিজের বাড়ির মতো চেয়ে নিয়ে খেতেন। সেখানে আর একজন
মানুষ থাকতেন। অসিত চৌধুরী। আশাপূর্ণা দেবীর বোনপো। এই খাওয়া নিয়ে ভবানীদার পেছনে
লাগতেন। সেখানে উপস্থিত থাকতেন কুমার মিত্র, মঞ্জিল সেন,
সুকুমার ভট্টাচার্য, ‘সন্দেশ’-এর প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাহুল মজুমদার, দেবাশিস সেন ও আরও অনেকে। তা এই সাত্তারদার বড়ো মেয়ে মুন্নির বিয়ে হল
পার্ক সার্কাসের এক গির্জা ভাড়া করে। বিশাল ব্যবস্থা। যেমন হয়। একদিকে ভেজ আর একদিকে নন-ভেজ। তা ভবানীদা আমার
সঙ্গে সঙ্গে নন-ভেজে খেলেন। খাওয়ার পরেই বললেন, ‘শোভন,
একবার ভেজেও খাই। কী খাওয়ায় দেখি।’ দিব্যি
খেতে চলে গেলেন। তারপর ফিরনি খাওয়ার বহর। দুজনেই খুব খেয়েছি।
একটা সময়
আমি ভবানীদার ছায়াসঙ্গী ছিলাম। যেখানেই যাব, আমরা দুজন। কোথায় না গিয়েছি? বারিপদায় বঙ্গসাহিত্য
সম্মেলন হল। প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রর সঙ্গী হয়ে আমরা। প্রতি বৃহস্পতিবার বিডন
স্ট্রিটের কাছে বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে পাঠ হত। আমরা দুজন। অম্বিকা কালনায় সমরকুমার
চট্টোপাধ্যায় ‘অম্বুকণ্ঠ’ বের করতেন।
আমরা দুজন। বেথুয়াডহরি। দুজন। শ্রীরামপুর-শেওড়াফুলির অলিগলিতে আমরা দুজন। ওখানে
কৃষ্ণচন্দ্র ভড়ের ‘শ্রীরামপুর সমাচার’ ও
আরও একটা পত্রিকা ছিল। শিশির সাঁতরা। ওঁর বাড়ি।
কত দুজনে
ঘুরেছি। এইজন্যে রাহুল মজুমদার আর দেবাশিস সেন আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলবেন, ‘কী রে, তোর গুরুর
খবর কী?’ এখনও বলেন। বলুন গে। ওঁদেরও গুরু। যাঁর হাতে এমন
অক্ষয় কলম, তিনি তো সবার গুরু। আজ যাঁরা বড়োদের কবিতার জগতে
প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা সকলেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোঁয়ায় তৈরি।
কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। ‘কৃত্তিবাস’ কবি তৈরির আঁতুড়ঘর। তেমনি ওভারল্যান্ড পত্রিকায় ‘সবুজবুড়ো’-র সম্পাদনায় কেউ লেখেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ‘সোনা মানিক’ পত্রিকায় কে না লিখেছেন। ওদিকে ‘সুস্বাস্থ্য’ পত্রিকা। যাঁকে মনে হয়েছে এঁর মধ্যে
সম্ভাবনা আছে, তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছেন। জোর করে লেখা নিয়েছেন।
তারপর অজস্র
লিটল ম্যাগাজিন। পশ্চিমবাংলার এমন কোনও জেলা নেই যেখানে ওঁর কেউ স্পর্শ পায়নি।
আজকের সম্পাদকরা তো লেখাই পড়েন না। নামি হলেই দামি। অনামির লেখা পোস্টে এলে
ডাস্টবিন তার আশ্রয়স্থল হয়। একটা ঘটনার কথা বলি। উনি তখন ওভারল্যান্ডের ছোটোদের
পাতা দেখছেন, আবার ‘সোনা
মানিক’ দেখছেন। একদিন দুজনে বাসে বসে আছি। বললেন, ‘একটা গল্প বলি শোনো।’ বলে একটা গল্প পড়লেন। ভালো
গল্প। পড়া শেষ হলে বললেন, ‘এটা আমি ছাপাব। শুনলে অবাক হবে,
এই ছেলেটা একটা চায়ের দোকানে কাপ-ডিশ ধোয়।’ ছাপা
হয়েছিল। একেই বলে সম্পাদক। জহুরি। আজকাল সম্পাদক কই? শুধুই
স্বজনপোষণ। চেনাজানা। খগেন্দ্রনাথ মিত্র, স্বপনবুড়ো, বিশু মুখোপাধ্যায়, হরেন ঘটক, সরল
দে, নির্মলেন্দু গৌতম, মঞ্জিল সেন,
শিশিরকুমার মজুমদার, ধীরেন্দ্রলাল ধর, যামিনীকান্ত সোম আর হয় না। আছে। আড়ালে। সম্পাদকের চোখ নেই।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিলাসী সম্পাদক ধুলো ওড়াবেন, কিন্তু হিরের
স্পর্শ পাবেন না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তেও ব্যর্থ। রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চোখ ছিল। তাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করেছেন।
এরপর?
শুধু ছড়াকার
নন, সম্পাদক হিসেবেও তিনি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
সত্যজিৎ রায় ভবানীদাকে চিনেছিলেন। সন্দেশে বিজ্ঞাপন বের হত। কে.সি দাশের, সি.ই.এস.সি-র। তিনি ভবানীদাকে দিয়ে বিজ্ঞাপনের ছড়া লেখাতেন। ধীরেনদা
ভবানীদাকে তাঁর বাবা-মায়ের নামের পুরস্কার ‘অমৃত-কমল’
দিলেন। সত্যজিৎ রায় ‘সুকুমার রায় জন্মশতবর্ষ’-র প্রথম পদক পরিয়ে দিলেন ভবানীদার গলায়। তিনিই উপলব্ধি করেছিলেন সুকুমার
রায়ের সুযোগ্য উত্তরসূরি কে। পুরস্কারের বন্যা। এ নিয়ে অন্য কেউ বলবেন।
এ প্রসঙ্গে
মনে পড়ল ছোটো গল্পকার রমানাথ রায়ের কথা। একদিন সকালে আমায় ফোন করে বললেন, ‘শোভনবাবু, বঙ্কিম
পুরস্কার পায়ে হেঁটে আমার বাড়িতে এসেছে।’ অসাধারণ কথা।
ভবানীদারও তাই। তৈলমর্দন নয়। প্রকৃত প্রতিভার স্বীকৃতি। আজ দিনকাল অন্যরকম।
মানুষটি
ব্যক্তিগতভাবে খুব ভিতু। একটা ঘটনার কথা বলি। একবার কলেজ স্ট্রিটে বাস থেকে নামতে
গিয়ে পা মুচকে যায়। আমার বাড়ি থেকে পনেরো মিনিটের পথ। বাড়ি গেলাম। খুব চিন্তিত।
আমি সাহস জোগালাম। লিখতে বললাম। আবার কলেজ স্ট্রিট। বিধাতা আমাদের নিয়ে খেলা করেন।
যাঁর হাতের কলমে এত জ্যোতি দান করেন, তাঁরই একটা পা কেড়ে নেন। এখন বিষাদগ্রস্ত। আমার দেখা সেই হাস্যোজ্জ্বল
ভবানীদা আজ অন্তর্হিত। আমি বার বার বলি লিখুন, লিখুন। লেখার
জগতে ডুবে থাকুন। হাসেন। আসলে ওই হাসি দুঃখের অন্য রূপ। ওঁর কষ্ট আমি কী করে বুঝব?
বুঝতে পারতেন একমাত্র সরল দে। এত নাম, বাংলার
কচিকাঁচাদের অন্তরের মণি তিনি। কিন্তু অনাড়ম্বর জীবন। কোনোদিন খুব দামি জামাকাপড়
পড়তে দেখিনি। কখনও ইস্ত্রিহীন জামা-প্যান্ট। বড়ো বড়ো সভাতেও মোটামুটি।
আগেই বলেছি, একটুকরো ঘরে থাকতেন। পরে পরিবর্তন
নামমাত্র। শানপুর কালীতলায় ছোট্ট দোতলা ঘর। ওপরে একটা, নীচে একটা। নীচের ঘরেই ছোট্ট বিছানায় বসতাম।
সেখানেই লেখালেখি। হাঁটাচলার রাস্তা নেই। ঘরের একদিকে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত
শুধু বই আর বই। ওঁরই লেখা সব পত্রিকা। বের করতে গেলে হুড়মুড়িয়ে পড়বে। বার বার
বলেছি, একটা জায়গায় গুছিয়ে রাখুন। হেসেছেন।
...আমার দেখা সেই হাস্যোজ্জ্বল ভবানীদা আজ অন্তর্হিত।
এই মুহূর্তে
বদলে গেছেন। বইয়ের স্তূপের জায়গায় স্থান পেয়েছে হুইল-চেয়ার। হুইল-চেয়ারে আত্মমগ্ন
বাংলার শ্রেষ্ঠ ছড়াকার। কিছু বললে মৃদু হাসি। বাইরের লোকজন বউদিকে সামলাতে হয়।
উলটোদিকে শানপুর বিদ্যালয়। দীর্ঘদিন হেড-মাস্টারি করেছেন। আমি বাজার গেলেই একবার
ওই স্কুলে যেতাম। দেখা করতাম।
বছর বারো
আদ্যাপিঠের ‘মাতৃপূজা’ পত্রিকাটি
দেখতাম। লেখা জোগাড় করতাম। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাকে ওঁর কাছে যেতে হত। উনি কতজনের
যে লেখা আমায় দিতেন। বলতেন, ‘এগুলো দেখবে।’ বাড়িতে এসে লেখাগুলো পড়তাম। প্রত্যেকটা লেখা উনি সবুজ কালি দিয়ে নতুন করে
লিখে দিয়েছেন কারেকশন করে। কত অজানা নাম। আজ ওঁর ছোঁয়ায় তাঁরা নাম করেছেন। আজ
এ-মানুষ কোথায়? শুধু আমি, আমি। স্বার্থ
আর স্বার্থ।
বিখ্যাত হলে
শত্রুও জন্মায়। উনি যাঁকে বাংলা আকাদেমির মেম্বার করে দিলেন, তিনি সামনে মনভোলানো হাসি হাসলেও আড়ালে
কুৎসা রটান। তাঁরই লেখা ভবানীদা কত ঘষে-মেজে দিয়েছেন। এই ব্যক্তিই এখন অনেক জায়গায়
সাহিত্যের ছড়ি ঘোরান। আবার এমন একজন আছেন যিনি বছর বছর ঢাউস সংকলন বের করেন। প্রথম
সংকলন বের হওয়ার পরেই বলেছিলাম, ‘এ কী করলে! কতজনের লেখা আছে,
কিন্তু ভবানীদা বাদ! এ তো শিবহীন যজ্ঞ।’ ব্যস,
ক্ষুদে সম্পাদক আমার ওপর রুষ্ট। ভবানীদাকে এ-কথা বলতে শুধু মৃদু
হেসেছিলেন। যে সত্যজিৎ রায় ভবানীদাকে সুকুমার পদক গলায় পরিয়ে দিলেন, ‘সন্দেশ’-এর অনুষ্ঠান মানেই মুখে মুখে ছড়া বলে
অনুষ্ঠান পরিচালনার ভার ভবানীদার ওপর, ‘সন্দেশ’ মানেই ভবানীদার ছড়া; সেই ‘সন্দেশ’
আজ ভবানীদাকে ভুলতে বসেছে। সত্যজিৎ রায় নেই। নলিনী দাশ নেই।
মুষ্টিমেয় সবজান্তার আসর। কর্পোরেট কালচার। প্রাতিষ্ঠানিক গন্ধ। অনেক আগের কথা।
তখন ‘গণশক্তি’-র পাতায়
ভবানীদার বহু ভালো ভালো লেখা বের হচ্ছে। ‘শুকতারা’-য় লেখা বের হল। ব্যস, বাম মনস্ক একগুঁয়েদের
সমালোচনা। ভবানী শেষ। এসব আমার সামনেই ঘটেছে। শুনেছি কেবল। তাহলে সত্যি কথা বলতেই
হয়, বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ওঁকে কিনতে চেয়েছিল। ওঁদের ওখানেই
শুধু লিখতে হবে। ভবানীদা নিজেকে বেচে দেননি। আজকালকার অনেক লেখককে আমি চিনি যাঁদের
গলায় বকলস। অর্থ আছে, স্বাধীনতা নেই। আজকাল সমাজের সর্বত্র
দুর্বৃত্তায়ন। সাহিত্যই-বা বাদ থাকে কেন?
ভবানীদা
মনের দিক থেকে খুব কোমল। মনে আছে, ধীরেনদা তখন খুব অসুস্থ। একদিন আমি আর ভবানীদা ধীরেনদাকে দেখতে গেলাম।
এখনও সেই ছবি চোখে ভাসে। বাইরে বেরিয়ে এসে ভবানীদা কেঁদে ফেললেন।
আরাধনা
গুপ্তর কথা আগে বলেছি। তাঁর একটা প্রতিবন্ধী মেয়ে ছিল। আমাদের লেখা পাঠ হত। সেই
মেয়েটা কাছেই বাঁধা থাকত। চেঁচাত। করুণ দৃশ্য। সভা শেষে হাওড়ার বাসে দুজনে সওয়ারি
হতাম। ভবানীদা একসময় বললেন, ‘কী কষ্ট বলো তো। এই যে আরাধনাদি
কবিতার পত্রিকা বের করেছে, সভা করছে, এত
খরচা করছে, বিনিময়ে পাবে কী? ঈশ্বর কী
নিষ্ঠুর!’
দীর্ঘ সময়।
প্রচুর ঘটনা। নিউস্ক্রিপ্টের আড্ডার কথা শুরু করলে শেষ হবে না।
কলেজ
স্ট্রিটের মামা, অরবিন্দদা, মেঘনাদ
স্রষ্টা স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভবানীপ্রসাদ দে, সুধীন্দ্র সরকার—সকলের প্রিয় ‘ভবানী’। শিশিরকুমার
মজুমদারের সঙ্গেই কত গল্প। রাহুল মজুমদার আর দেবাশিস সেনদের অন্তরের মানুষ। কত ঘটনা।
কত আর বলব। শব্দ দিয়ে দিয়ে লেখা বড়ো হতে থাকবে। কলম থামাতেই হল।
|