বই-ম্যাগাজিন-কাগজ মিলিয়ে
প্রকাশিত প্রায় চল্লিশ হাজার কবিতা আছে তাঁর। নিজের নামের বাইরেও তাঁর নানা
ছদ্মনাম—সবুজবুড়ো, ভবানন্দ ভারতী, দুর্গাপ্রসাদ দেবশর্মা, কৃষ্ণস্বামী গোস্বামী,
বেচারাম বাচস্পতি, কেনারাম কাব্যতীর্থ,
মোল্লা হাসিরুদ্দিন নামেও অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে
বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে, পাড়ার ক্লাব, স্কুল,
লাইব্রেরির দেওয়াল পত্রিকা, স্মারক সংখ্যা কিংবা কারও জন্মদিনে উপহার দেওয়া ছড়ার সংখ্যা আরও কয়েক
হাজার। যিনি এমন কাজটা করেছেন অনায়াসে তাঁর নাম কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।
তিনি মনে করেন, তাঁর সৃষ্টির সংখ্যা লক্ষাধিক। এত সৃষ্টি, বেশ কয়েক হাজার প্রকাশিত বই, অনলাইনে কয়েকশো
ছড়া-কবিতা থাকলেও তার থেকে কার্যত কোনও রয়্যালটি পান না ভবানীবাবু। একটি-দুটি
প্রকাশনা তাঁকে মাঝে মাঝে সামান্য সাম্মানিক পাঠায়। বাকিদের অনেকে তাঁর নামটাও
ব্যবহার করেন না। ফলে সংসারে আর্থিক সমস্যাও রয়েছে তাঁর।
ছড়া আর কবিতা লিখে যদি
গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে নাম তোলা যেত, তাহলে
হাওড়ার শানপুরের বাসিন্দা ভবানীপ্রসাদের নামটা এতদিনে রেকর্ডের খাতায় নিশ্চয়ই উঠে
যেত। কিন্তু তিনি সেই চেষ্টা কখনও করেননি। যেমন করেননি তাঁর ছড়া-কবিতা নিয়ে
অন্যদের ব্যাবসা করার কাজে বাধা দেওয়ারও।
এই ভবানীবাবু এখন মোটেই
ভালো নেই। সদা হাসিখুশি থাকা ৭২ বছরের মানুষটা দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিসে শয্যাশায়ী।
বাঁ-পা হাঁটুর নীচে থেকে বাদ গিয়েছে, তা ক্রশম
বিষিয়ে যাওয়ার কারণে। বিছানা থেকে উঠে বসে মাঝে মাঝে ছড়া লেখার চেষ্টা করেন
হুইল-চেয়ারে বসে। কিন্তু লিখতে বসে হাত কাঁপে। স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসে। দুই মেয়ে
মধুমিতা, মনোমিতা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়র। একজন বিদেশে থাকেন।
অন্যজন শহরে থাকলেও চরম ব্যস্ত নিজের পেশায়। ফলে স্ত্রী পদ্মাই ভবানীবাবুকে এবং
তাঁর সৃষ্টিকর্মকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন।
এমন মানুষটি আজ
হুইল-চেয়ারে বসে বেশ অসহায়। তবে কোনও রয়্যালটি না পাওয়া, কোনও সরকারি অনুদান না পাওয়া নিয়ে তাঁর কোনও আক্ষেপ নেই।
শানপুরে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে গিয়ে এ নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তাঁর জবাব,
‘আমি তো রোজগারের লক্ষ্যে ছড়া-কবিতা লিখি না। লিখি সবাইকে আনন্দ
দিতে। তাই যে-কেউ সেই লেখা ছাপুক। আমি চাই আমার ছড়া বেঁচে থাকুক, লোকের মুখে মুখে ফিরে।’
প্রতিবছর ভাষা দিবস এলেই
এ-পার বাংলা, ও-পার বাংলার ছোটো-বড়ো নামি-অনামি
আবৃত্তিকাররা আবৃত্তি করেন—‘ছেলে আমার খুব সিরিয়াস/ কথায়
কথায় হাসে না,/ জানেন দাদা, আমার
ছেলের/ বাংলাটা ঠিক আসে না।’ এই আবৃত্তি উপচে পড়ে ইউটিউবে।
বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগে ভেসে যাওয়া এই কবিতাটির নাম—‘বাঙালিবাবু,
বাংলা মে কাবু’। আবার বাংলা পাঠ্যপুস্তকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ানো হয় তাঁর মজার কবিতা ‘দারোগাবাবু এবং হাবু’। ফল নিয়ে, ফুল নিয়ে, রেলস্টেশন
নিয়ে, মেলা নিয়ে, স্বাধীনতা দিবস নিয়ে,
বাংলার বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থান নিয়েও তাঁর বহু ছড়া মুখে মুখে ফেরে
বাঙালি কবিতাপ্রেমী মানুষের। শিশুদের আবৃত্তির মুখে-খড়ি হয় তাঁর বিভিন্ন মজার
ছড়া—‘রংবদলের ব্যাপার স্যাপার’ দিয়েই।
আটের দশকে ছোটোদের পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর সহ-সম্পাদক হয়েছিলেন। তাই
ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের স্নেহধন্য। ১৯৮৮ সালে সত্যজিৎ রায় নিজের হাতে ভবানীবাবুর গলায়
পরিয়ে দিয়েছিলেন ‘সুকুমার রায় শতবার্ষিকী স্বর্ণপদক’। পরে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৫০ বছর
জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে দেওয়া হয় বাংলা অ্যাকাডেমি ছড়া-সাহিত্য পুরস্কারও।
ভবানীবাবু মনে করেন, তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে সত্যজিৎ রায়ের
হাত থেকে নেওয়া পুরস্কারটাই সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। কারণ, সত্যজিৎ
রায়ই তো ছিলেন তাঁর আদর্শ।