প্রায় ষোলো বছর আগে মধ্য
কলকাতায় তালতলা পাবলিক লাইব্রেরির ১২৫তম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে কবি ভবানীপ্রসাদ
মজুমদারকে প্রথম দেখি। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে অন্যান্য সাহিত্যিকদের
সঙ্গে ভবানীবাবুও আমন্ত্রিত ছিলেন। বলা যেতে পারে উনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন
জেনে অনুষ্ঠানটি হাতছাড়া করতে চাইনি। মুগ্ধ হয়ে ওঁর কথা ও ছড়া-কবিতা শুনেছিলাম।
কিন্তু এগিয়ে গিয়ে আলাপ পরিচয় করার তখন সাহস হয়নি। এরই মধ্যে কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান, সন্দেশ, গণশক্তি, ওভারল্যান্ড
ইত্যাদি পত্রিকা ও বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে ভবানীবাবুর লেখা অজস্র মিঠেকড়া ছড়া
পড়া হয়ে গেছে।
আধুনিক কালের ছড়া-কবিদের
মধ্যে ভবানীবাবুর ছড়াগুলিই মনকে বেশি আকৃষ্ট করত। ওঁর ‘দুর্গা আসেন, কাঁদেন-হাসেন’ ছড়াটি যেদিন পড়লাম, মুগ্ধ হয়েছিলাম। যেন সোনার
কাঠি খুঁজে পেলাম। দু-দিনেই মুখস্থ করে ফেললাম। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মঞ্চে আবৃত্তি
করতে শুরু করে দিলাম। নিজের মতো করেই। দর্শকরাও বেশ উপভোগ করত। ছড়ার কয়েকটি লাইন
এখানে তুলে দিলাম।
‘যদি দুর্গা আসেন ঘোড়ায়
শিব আর অসুর কুস্তি লড়েন মনুমেন্টের গোড়ায়
গণশা-কেতো গড়ের মাঠে গিয়েই ঘুড়ি ওড়ায়
যদি দুর্গা আসেন ঘোড়ায়।...’
পরে পড়েছিলাম কবির সেই
কালজয়ী কবিতা ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’।—
‘ছেলে আমার খুব সিরিয়াস কথায় কথায়
হাসে না
জানেন দাদা, আমার
ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।’
রম্য কবিতায় উন্নাসিক
বাঙালিকে বুদ্ধিদীপ্ত খোঁচা দিয়েছেন। দূরদর্শনের পর্দায়, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ও আবৃত্তির প্রতিযোগিতায় বহু
বাচিক শিল্পীকে এই কবিতাটি আবৃত্তি করতে দেখেছি। ওঁর অধিকাংশ ছড়াতেই রম্যের জাদু।
চমৎকার দুলুনি। ‘বিশ্বযুদ্ধের জবর খবর’, ‘হোক ভরপুর সুর সুমধুর’, ‘আশায় হাসায়, ভাষায় ভাসায়’—ছড়াগুলি যেন ছন্দের ঝরনাধারা।
রেলস্টেশনের একটি ঘটনা নিয়ে ‘যা ঘটেছে তাই’ মজাদার ছড়াটি এককথায় অনবদ্য। ‘দুর্গা যাবেন বাপের
বাড়ি’ ছড়াটিও অসাধারণ। শুধু মজাদার ছড়াই নয়, সমাজ জীবনে গরিব মানুষের কঠিন জীবনযাত্রার কথাও ভবানীবাবুর লেখনীতে বহুবার
উঠে এসেছে। ‘শিশুরা কেমন আছে’, ‘সব
দুর্গাই থাকুক সুখে’ ছড়াগুলি উল্লেখযোগ্য। চিড়িয়াখানার
পশুপাখিদের নিয়েও অজস্র চমৎকার ছড়া-কবিতা লিখেছেন।
দশ বছর আগে হাওড়া
দাশনগরের নবীন ক্রীড়া সংসদে ‘নবীন আলো’
পত্রিকার সাহিত্যসভায় ভবানীবাবুর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। সেদিনই
প্রথম প্রিয় কবির সামনে ওঁরই লেখা ছড়া ‘পুজোর পাঁচালি’
আবৃত্তি করলাম। আবৃত্তিটা আকর্ষণীয় করার জন্য শেষের দুটি লাইন
একাধিকবার বলে শেষ করলাম। উনি শুনে খুশি হয়েছিলেন। মঞ্চ থেকে নেমে প্রণাম করলাম।
অটোগ্রাফ নিলাম। উনি মোবাইল নম্বরও দিলেন। এরপর হাওড়া ও কলকাতার বহু অনুষ্ঠানে
একাধিকবার দেখা হয়েছে। অনেক গল্প-আড্ডা, এমনকি একসঙ্গে
খাওয়াদাওয়াও হয়েছে। শিক্ষকতা করতেন। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে বা ক্লাসের বাইরে
বিভিন্ন সময়ে যে-সমস্ত কথাবার্তা বলত, সেগুলিই নাকি ওঁর
ছড়া-কবিতায় উঠে আসত। এত বড়ো মাপের একজন শিশুসাহিত্যিক হয়েও ওঁর মধ্যে কোনও
আত্ম-অহংকার দেখিনি। আমার পরিচিত সাহিত্যিক বন্ধুরা ওঁকে ‘দাদা’
বলে ডাকতেন। আমিও তাই দাদা বলতাম। মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। ওটাই
হয়তো ওঁর অসুস্থতার একটি কারণ।
ভবানীদাকে অনেকেই ‘ছড়া সম্রাট’ আখ্যা দিয়েছেন। আমাদের
সেই প্রিয় ছড়া সম্রাট বর্তমানে খুব একটা ভালো নেই। অসুস্থতায় জর্জরিত। তবুও
সবসময় মনেতে আশা রাখি একটা মিরাকল হোক। ভবানীদা আবার ভরা সাহিত্যসভায় পাশে এসে,
কাঁধে হাত দিয়ে বলুন, ‘ভয় কী তোমাদের! আমি তো
আছি।’