গতকাল রাতের উড়ানে
ছেলেটা পোষ্ট-ডক্টরেটের জন্য ইসরায়েল চলে গেছে। শুভময় বাড়ীতে একা হয়ে গেছে। সকালে
ঘুম থেকে উঠে আলসে ভাবেই বিছানায় শুয়ে আছে। স্মৃতির দৃপ্তপটে ভেসে উঠলো নিজের
ছেলেবেলাকার নানা কথা।
বাড়ীতে কত লোকজন।
দাদু-ঠাকুমা-কাকা-জ্যেঠু-বাবা-মা-কাকিমা-জেঠিমা-জেঠুর মেয়ে সোনালী-জেঠুর ছেলে
প্রীতম-ওর বোন সায়ন্তনী-কাকার ছেলে শান্তনু। একসাথে কত মজা। অভাব ছিলো। কিন্তু
একসাথে থাকার কত আনন্দ। গ্রীষ্মের দুপুরে আমবাগানে মিছিমিছি পুতুল বিয়ের আয়োজন,
বর্ষায় চাটুনি জালে পুঁটি
মাছ ধরা, শরৎকালে পাশের
গাঁয়ে একসাথে দুর্গাপুজো দেখতে যাওয়া, শীতে গরুর গাড়িতে করে ধান আনতে যাওয়া মাঠে আর সাথে গামছার পুঁটুলিতে নিয়ে আসা
মুড়ি ভাগ করে খাওয়া কত আনন্দ। সুমিত-নীলু-সামলী-নন্দিতা-পাঁচু-ভোম্বল আর নয়নতারা।
সকলে মিলে পিটু খেলা, লুকোচুরি,
মাছ ধরা, বউ-বসন্ত, খোলাম কুচি নিয়ে টিকিট খেলা আরও কত নাম না জানা
খেলা। সকালে বাড়ির উঠোনে দুলে দুলে সুর করে সরবপাঠ, তারপর দশটা বাজলেই পাশের শিকদারদের দীঘিতে
সাঁতরে সাঁতরে স্নান করা। ফ্যান-ভাত আর আলুসিদ্ধ কোনোদিন সাথে মাছমোয়া দিয়ে খেয়ে
সোজা হেঁটে হেঁটে ইস্কুল। ব্যানার্জীদের পুকুরপাড় দিয়ে, পালেদের ছোট মাঠ পেড়িয়ে আজগর চাচার আমবাগানের
মাঝ দিয়ে কিছুটা হেঁটে শুভময়দের ইস্কুল চারুবালা প্রাথমিক বিদ্যালয়। সাধনবাবু
হেডস্যার। কঠিন শাস্তি। অংক না পারলে টেবিলের নীচে মাথা গলিয়ে পিঠে বেতের মার।
মারের কথা বাড়িতে বললে আবার মার না হলে ভীষণ বকা। পড়া না করলে মাস্টারমশাই মারবে
না তো আদর করবে। ফলে শাস্তি পেয়ে চেপে যাওয়া ছিলো সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। শুভ
কোনোদিন মার খায়নি। শুভময় কে সকলে শুভ বলেই ডাকতো। ভীষণ বুদ্ধি ওর অংকে। ফলে
সাধনবাবুর প্রিয় ছাত্র। সাধনবাবুর হাতে মার না খাওয়ায় অন্য বন্ধুদের কাছে কম কথা
শুনতে হতো না শুভকে। সবার অনুযোগ ছিলো শুভর সামান্য ভুল হলেও সাধনবাবু মাফ করে
দিতেন। বাকিদের বেলায় সেটা ছিলো না।
শুভময় বিছানা থেকে উঠে
বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এলো। নিজেই একটু কফি বানিয়ে বসলো দক্ষিণদিকের ঝুল
বারান্দায়। খবরের কাগজের কয়েকটা পাতা উল্টে ভাঁজ করে রেখে দিলো। বারবার নিজের গাঁ
সুন্দরপুরের কথা মনে ভাসতে লাগলো। মনে পড়লো সাধনবাবুর কথা। সরকারী বৃত্তি পরীক্ষায়
অংকে একশো পেয়েছিলো শুভ। তাই একটা ঝর্ণা কলম উপহার দিয়েছিলেন সাধনবাবু। আজও যত্ন
করে তুলে রেখেছে শুভ। তারপর সুন্দরপুরে হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক। তারপর সোজা
কলকাতা। শুভর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর সাধনবাবুর জোড়াজুড়িতে শুভর বাবা কলকাতা
পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। চাষের জমি বিক্রী করে শুভর পড়াশোনা চলতে লাগলো। সাধনবাবু
কলকাতা আসার সময় প্রচুর বই দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন সুন্দরপুরের সম্মান রাখিস শুভ।
কলকাতার প্রতিযোগিতার দৌড়ে শুভ গ্রামের কথা ভুলতে থাকে।
দাদা-দিদি-ভাই-বোন-পরিবার-বন্ধুবান্ধব-এমনকি সাধনবাবুর সাথে যোগাযোগ কমতে থাকে।
বারো ক্লাসের পরীক্ষা দিয়ে বেশ কয়েকদিন গ্রামে ছিলো শুভ। ফিরে পেয়েছিলো আবার সেই
শৈশব অনুভূতি। কিন্তু জেঠুর মৃত্যুর পর বাড়ির শোকের আবহে সব কিছু থমকে গেলো। আবার
শহরে ফিরে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়
তারপর রিসার্চ। ড.শুভময় ব্যানার্জী হয়ে ওঠার পিছনে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরোতে হয়েছে।
দিদি-বোনের বিয়ের পর টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। বাবাও রোগভারে জর্জরিত হয়ে যায়।
ঠাকুমা-দাদু একেএকে ইহলোক ত্যাগ করেন। ফলে আনন্দের ব্যানার্জী বাড়িতে ধীরে ধীরে
বিষাদের ছায়া নেমে আসে। শুভ ওইসময়ে গৃহশিক্ষকতা করে নিজের খরচ চালায়।
শুভর মনে আছে একবার
সাধনবাবু চোখ অপারেশনের জন্য কলকাতার হাসপাতালে এসেছিলেন। যোগাযোগ করেছিলেন শুভর
সাথে। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলেন ছানি অপারেশন করে। শুভ প্রতিদিন
বিকেলে দেখা করতে যেতো। সাধনবাবু বিয়ে করেন নি। স্কুলকেই পরিবার ভাবতেন। সারাদিন স্কুলের
উন্নতির জন্য লাগামছাড়া পরিশ্রম। নিজের হাতেই স্কুলে ফুল-ফলের বাগান, বাঁশের প্রাচীর, আর পঞ্চায়েতকে ধরে ছেলেমেয়েদের জলপানের জন্য
নলকূপ বসিয়েছিলেন।
যেদিন সাধনবাবু সুন্দরপুরে ফিরে যাবেন সেদিন
হাওড়া স্টেশনে শুভ সাধনবাবুকে তুলতে এসেছিলো। শুভর হাতে সঞ্চিত চারশ নব্বই টাকা
তুলে দেন সাধনবাবু। শুভ নিতে অস্বীকার করে কিন্তু সাধনবাবু বলেন তুই বড় হয়ে যখন
অনেক উপার্জন করবি তখন সুদসহ ফিরিয়ে দিবি গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুলের জন্য। শুভ
তারপর আর না করেনি। তখন ওর টাকার খুব প্রয়োজন। কিন্তু টাকার পরিমান তখনকার
বাজারদরে অনেক বেশি। বাড়ির টাকা না পাঠানোর ঘটনা হয়তো সাধনবাবুর কানে গিয়েছিলো।
তাই একপ্রকার জোর করেই টাকাটা দিয়েছিলেন।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে
চাকরী নিয়ে শুভ চলে গিয়েছিলো দিল্লী। গ্রামে ফোনের চল ছিলো না। তাই মাকে চিঠি লিখেই চাকরীর খবর
জানিয়ে দিয়েছিলো। তারপর শুভকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। সেমিনার, ক্লাস, মিটিং, বিদেশে বিভিন্ন
ইউনিভার্সিটিতে লেকচার এসব করে আর গাঁয়ে ফেরা হয়নি। বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাতো।
একসময় সে প্রয়োজন বন্ধ হয়ে গেলো। মাস দুয়েকের ব্যবধানে শুভর মা-বাবা দুজনেই মারা
যান। শুভ বাবার শেষকৃত্যে যেতে পারেনি। তখন ও অক্সফোর্ডে। মায়ের সেরিব্রাল
এট্যাকের খবর পেয়েই ও দিল্লী থেকে ছুটে আসে। গ্রামের হাসপাতাল থেকে সোজা নিয়ে আসে
কলকাতার বেসরকারি নার্সিংহোমে। কিন্তু পনেরদিনের চেষ্টা ব্যর্থ হলো। শুভর মা চলে
গেলেন না-ফেরার দেশে। একদিন শুভর মা কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শুভ কিছু বুঝতে
পারেনি। হয়তো বা শুভর স্ত্রী আর আদরের নাতিকে দেখতে চেয়েছিলো। দিল্লিতেই মারাঠী
মেয়ে স্বপ্না পাতিলকে বিয়ে করে শুভ। স্বপ্না জে এন ইউর লেকচারার। ফলে ব্যাস্ত
জীবনে আর আগামীর শিখর সাফল্যের পিছনে ছুটতে গিয়ে গাঁয়ের সাথে সব সম্পর্কই ছিন্ন
হয়ে যায়। তারপর একমাত্র ছেলের এডুকেশনের পিছনে দৌড়াতে গিয়ে সুন্দরপুর একেবারে আবছা
হয়ে যায়। শুভ মানসিক দ্বন্দে ভুলে যায় সুন্দরপুরের প্রাইমারী শুভকে এতদূর এনেছে,
তাহলে এতো ইঁদুর দৌড়
ছেলের জন্য কেন?
আসলে উচ্চতার শিখরে পৌঁছে খুব নীচে দৃষ্টি
পৌঁছয় না। বছরখানেক আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পর শুভ ভেবেছিলো একবার সুন্দরপুরে যাবে।
কিন্তু যাওয়া হয়নি। খুব কম বয়সে স্ত্রী বিয়োগে ভীষণ একাকী হয়ে যায় শুভ। আর আজ আরও
একা। ছেলেটা চলে গেলো বিদেশে।
পরেরদিন শুভ সকালের
ফ্লাইটে কলকাতায় নামলো। তারপর গাড়ি ভাড়া করে সোজা সুন্দরপুর। প্রথমেই সাধনবাবুর
বাড়ি। বিরাশি বছরের বৃদ্ধ শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন। বার্ধক্যের ছোঁয়া সারাঅঙ্গ জুড়ে।
তবুও বই পড়ে চলেছেন। একজন পাশের বাড়ির নাতবউ দুবেলা দুমুঠো রেঁধে দেন। বাকি সবকাজ
নিজে নিজেই করেন। প্রনাম করে কাছে বসলো শুভ। পরিচয় দিতেই শুভকে জড়িয়ে ধরলেন
সাধনবাবু। একনাগাড়ে কেঁদেই চললেন। পাশের বাড়ির নাত-বউ ছুটে এলো। শুভকে কোনোদিন না
দেখা ওই অল্পবয়সী মেয়েটি বললো আপনি কি শুভবাবু?
শুভ অবাক। বুঝতে পারলো না
ওই বাইশ বছরের গৃহবধূ কিভাবে চিনলো ওকে...
মেয়েটি একনাগাড়ে বলে চললো
শুভর কথা। বললো মাস্টারদাদু সবসময় আপনার কথা বলেন, আপনি ভীষণ ভালো, ভীষণ বুদ্ধিমান.....আরোও কত কি?
শুভ এবার লজ্জিত হলো।
ভাবলো, নেওয়া ছাড়া ও কি করেছে এই
গাঁয়ের জন্য, এই স্কুলের জন্য
বা সাধনবাবুর জন্য... কিছুই না।
তবুও এইভাবে এত মনে রাখা
কেন? একজন তরুণী শুধু বর্ণনা
শুনে চিনে ফেললো আমায়....
দুপুরে সাধনবাবুর কাছে
খাওয়াদাওয়া করলো। তারপর বিকেলে পৌঁছলো সাধের চারুবালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সাথে
সাধনবাবু। গাঁয়ের লোক জড়ো হয়ে গেলো। কংক্রিটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ভীষণ সুন্দর
স্কুল। কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না শুভ। সব বদলে গেছে। উত্তরদিকে ফলবাগানে চোখ পড়লো
শুভর। ওই তো কাঁঠাল গাছটা। তৃতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞান পড়াতে পড়াতে একদিন সাধনবাবু ওই
গাছটি শুভকে দিয়ে লাগিয়েছিলেন। আর বলছিনেন গাছের প্রাণ আছে, দেখবি ও তোদের মতো বড় হয়ে যাবে আর কাঁঠাল ফলবে।
আজ গাছে কাঁঠালে ভরা। অনেক বড় হয়ে গেছে সেই ছোটো গাছটি। একেবারে বৃক্ষ।
পাশাপাশি অনেক ছেলেমেয়ে
চলে এসেছে। ওরাও সাধনবাবুকে চেনে। ডাকে মাস্টারদাদু বলে। সাধনবাবু মাঠে বসলেন।
সকলে গোল করে বসলো। শুভ বসলো সাধনবাবুর কাছে। খবর পেয়ে বর্তমান প্রধান শিক্ষক
এলেন।
সাধনবাবু কাঁপা গলায়
বললেন এই সেই শুভ..আমার প্রিয় ছাত্র। দেখো আজ ও সুন্দরপুরের নাম উজ্জ্বল করেছে।
এবার সাধনবাবুর অনুমতি
নিয়ে শুভ বলতে শুরু করলো ওর কথা। ছত্রে ছত্রে ও বুঝিয়ে দিলো সাধনবাবুর স্কুলের
প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আর ওর নিজের ব্যর্থতার কথা... নিজের গ্রামকে ভুলে যাবার
ধৃষ্টতার কথা। শুভর চোখে জল।
শুভ এবার গাড়ি থেকে বার
করে আনলো বিরাশিটি ছোটদের গল্পের বই। তুলে দিলেন বিরাশি বছরের মাস্টারদাদুর হাতে।
আনন্দে গ্রহণ করলেন বর্তমান প্রধান শিক্ষক। এরপর একটি ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর দিলেন
স্কুলের জন্য আর দিলেন কুড়িটি কম্পিউটার কেনার রশিদ। কলকাতা থেকে আসার পথে ল্যাপটপ,
প্রজেক্টর ও বইগুলি
এনেছেন আর কুড়িটি কম্পিউটারের দাম মিটিয়ে এসেছেন। ওরা আগামীকাল স্কুলে ডেলিভারী
দিয়ে দেবে। সকলে ভীষণ খুশি।
পরেরদিন স্কুলের সময়ে
সাধনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে শুভ আবার স্কুলে এলো। ছেলেদের সাথে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা সংগীত
গাইলো। ভীষণ ফ্রেস লাগছে নিজেকে।
আজই ফিরে যাবে শুভ। ভীষণ
মন খারাপ। কর্মজগতে ও ভীষণ ডেডিকেটেড। তাই থাকার উপায় নেই। ইতিমধ্যে কম্পিউটার
সেজে উঠেছে একটি বড় ক্লাস রুমে। এখন ওগুলি টেবিলে আছে। তার জন্য যাবতীয় ফার্নিচার
অর্ডার করে দিয়েছে। পাশের গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার এসেছেন স্কুলে। ওনার হাতে
দশলক্ষ টাকার চেক দিয়ে একটা একাউন্ট খোলার অনুরোধ করলেন। এই টাকার সুদে মেধাবী ও
দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার খরচ চলবে। আর এটার নাম হবে "রামানন্দ আদক
স্মৃতি স্কলারশিপ"। সাধনবাবু চমকে গেলেন। রামানন্দ আদক সাধনবাবুর বাবার নাম।
শুভ সাধনবাবুকে প্রনাম করে বললো, "আজ যা কিছু হয়েছি আপনার জন্য, আর আপনার কথায়
আপনি যা হয়েছেন আপনার বাবার জন্য, তাই আগামীর
দুঃস্থ ও মেধাবীরা আপনার বাবার আদর্শে এগিয়ে চলুক সাফল্যের পথে"।
নমস্কার প্রতিনমস্কার
শেষে গাড়িতে ওঠার মুখে বর্তমান প্রধানশিক্ষকের হাতে সাধনবাবুর দেওয়া ঝর্ণা কলমটা
তুলে দিলো শুভ। অনুরোধ করলো এই শক্তিশালী হাতিয়ারটি কোনো বলবান যোদ্ধার হাতে তুলে
দিতে। প্রধান শিক্ষক হাসিমুখে গ্রহণ করলেন।
সুন্দরপুর ছাড়িয়ে গাড়ি
উঠলো বড়ো পাকা রাস্তায়। পিছনে পড়ে রইলো একরাশ ছেলেবেলা.....