উৎপলকুমার ধারা



   ছোটোদের বন্ধু  ভবানীপ্রসাদ








উৎপলকুমার ধারা

 

আমার প্রিয় মানুষটির সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখতে বলেছে ভাই রজতবরন

ভবানীদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। ওঁর লেখার সঙ্গে পরিচয় অবশ্য আরও এক দশক আগের থেকে। আমার একটি শিশুকিশোর উপযোগী সাহিত্য পত্রিকা ‘কিশলমন’ ও বন্ধু অরূপ হালদারের ‘সবুজমন’ পত্রিকায় লেখার জন্য আমাদের দুজনের ওঁর বাড়িতে যাওয়া এবং তখনই হল ভবানীদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তখন থেকেই ইচ্ছে হলেই দাদার বাড়িতে যখন-তখন ছুটে যাওয়া শুরু হল। যেদিন কথায়-বার্তায় দুপুর হয়ে যেততখন দাদা আমাকে ডিমের ঝোল-ভাত খাইয়েই তবে ছাড়তেন। পরবর্তী সময়ে আমার সঙ্গে ভবানীদার বাড়িতে যাওয়ার সঙ্গী হয়েছে শিশুসাহিত্যিক পবিত্র চট্টোপাধ্যায়

ভবানীদা ওঁর বাড়ির প্রায় কাছাকাছি কালীতলা প্রাইমারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। থাকতেন মা আর ছোটো বোনকে নিয়ে একটি টালির ছাওয়া ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে। পাশের একটি কামরায় থাকতেন ওঁর ভাই ও ভাইয়ের পরিবার। বউদি ওই বাড়িতে থাকতেন না (যতদিন আমি গিয়েছি একটি দিনও বউদির দেখা পাইনি)। বউদির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে অনেক পরেনতুন বাড়িতেবর্তমানে ভবানীদা যে-বাড়িতে থাকেন

ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে আমি ।

পুরোনো বাড়ির টেবিলে স্তূপাকার করে থরে থরে সাজানো নানান জেলা থেকে আসা বিভিন্ন জনের চিঠিপত্রআর সেটিই ছিল ওঁর লেখার টেবিল। গর্বের সঙ্গে বলতে পারিভবানীদার হাত ধরেই আমি শিখেছি ছড়া লেখার কলা-কৌশল। দাদা বলতেন, ‘উৎপলভালো ছড়া লেখার চেষ্টা চালিয়ে যাওদেখবে একদিন এই ছোটোদের কবিতাই তোমাকে অনেক-অনেকদূর পৌঁছে দেবে।

তাই তাঁর কথামতোই আমি এখনও কিশোর কবিতাকে সঙ্গে করেই এগিয়ে চলেছি

একদিন দাদা যখন বললেন, ‘উৎপলআমার বেশ কয়েকটি ভালো লেখা চাইদু-একদিনের মধ্যে দিয়ে যেও’; তখন আমার মনে মনে যে কী ভীষণ আনন্দ হয়েছিল তা বলে বোঝানো যাবে না

পরের বার যখন ভবানীদার কাছে গেলামদাদা হাসতে হাসতে কয়েকটি খবরের কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “দেখোএগুলিতে তোমার লেখা ছাপা হয়েছে।

ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে আমার  কন‍্যা ।

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। পাতা উলটে দেখি সত্যিই তো তাই। সেগুলি ছিল ‘ওভারল্যান্ড’ দৈনিক সংবাদপত্র—তাতে ছোটোদের বিভাগসম্ভবত বিভাগটির নাম ছিল ‘সোনার কাঠি। দাদা বললেন, “বিভাগটি আমি দেখছি সবুজবুড়ো ছদ্মনামে। তুমি এই কাগজের জন্যে নিয়মিত লেখা দিও।

ওই কাগজে লেখার জন্যে লেখক সাম্মানিক হিসেবে কিছু অর্থও পেয়েছি

এত বড়ো মাপের প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিককিন্তু কত নরম প্রকৃতির সহজ-সরল নিরহংকারী শিশুসুলভ মানুষ—সেটা সাক্ষাৎ না হলে বুঝতেই পারতাম না। নতুন লেখকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারতাদের লেখা নানান পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করার চেষ্টা তিনি সবসময়ই করতেন। বর্তমান সময়ে অনুজদের লেখা নামকরা পত্রিকায় প্রকাশ করে দেওয়ার মানুষ এখন খুবই কম দেখা যায়। উনি কোনোদিনই আমাকে ওঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে দেননি। দেখা হলেই এখনও বুকে জড়িয়ে ধরেন। এত বড়ো একজন গুণী ব্যক্তি সবসময় আমার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেন এখনও। এমনকি কোনও অনুষ্ঠানে বক্তব্যের মধ্যে ভাই নয়সবার সামনে আমাকে ওঁর বন্ধু বলেই পরিচয় দিয়েছেন। এত বড়ো প্রাপ্তি আমি কোনোদিনই ভুলতে পারব না

ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে আমি এবং আমার স্ত্রী ও কন‍্যা  

একদিন আমায় বললেন, “উৎপলবিকেলের দিকে সময় পেলে তুমি কলেজ স্ট্রিটের ‘মামু’-র দোকানে (এখন যেখানে বর্ণপরিচয় বিল্ডিং হয়েছে) চলে এসো।” আমি অফিস ছুটির পর যখনই সময় পেয়েছি সেখানে গিয়েছি। মামুর দোকানে অনেক পত্রপত্রিকার সম্পাদক ও অনেক গুণী মানুষের কাছে আমার সামনেই আমার লেখার প্রশংসা করতেন। ব্যসতখন থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গড়গড় করে আমার লেখা ছাপা হতে লাগল

ভবানীদার জন্যে প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গ তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তর আয়োজিত শিশুকিশোর উৎসবে আমি ছড়া পাঠের ডাক পেতাম। তবে ভবানীদা কিন্তু ‘ছড়াকার’ কথাটি একদমই পছন্দ করতেন না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওঁকে বলতে শোনা গেছে যেছোটোদের জন্যে ছোটোদের কবিতা যারা লেখে তারা সবাই-ই কবি

প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ভবানীপ্রসাদ মজুমদার পেয়েছেন নানান জায়গা থেকে প্রচুর পুরস্কারসরকারি সম্মান ও সংবর্ধনা। ১৯৮৮ সালের ২রা এপ্রিল কলকাতার অবন মহলে সুকুমার রায়ের পুত্র কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায় যখন ভবানীদার গলায় সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কারের স্বর্ণপদকটি পরিয়ে দিলেন তখন দাদা বলেছিলেন যে আমার জীবনে এইটিই হল সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি

শিশুসাহিত্যের পথপ্রর্দশকনতুন শিশুসাহিত্যিকদের অভিভাবকনির্দেশকশিশুসাহিত্যে আলোর পথ সৃষ্টিকারকআমার ছড়া লেখার প্রেরণাদাতা আমার গর্ব প্রিয় ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের নির্বিঘ্ন জীবন ও সুদীর্ঘায়ু কামনা করি

সহজ-সরল নিষ্পাপ শিশুসুলভ মনের মানুষ ভবানীদার সম্পর্কে অভিজ্ঞতার কথা লিখতে বসলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যায়। এই সংকলনে অনেকেই তাঁদের নানান অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করবেন। তাই স্বল্প পরিসরে যেটুকু না লিখলে আমার মন বিদ্রোহ করতসেইটুকুই লিখে পরিশেষে জানাই যে এই সুহৃদয় ব্যক্তি সম্পর্কে সামান্য দু-চারটি কথা লেখার সুযোগ পেয়ে এবং প্রিয় মানুষটির স্নেহ ও সান্নিধ্য পেয়ে আমার জীবন ধন্য




শিশুসাহিত‍্যিক কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের বাড়ির ছাদে শ্রদ্ধেয় কবির পাশে আমি  ।

 

 

ছ ড়া  লে খা র  প্র থ ম  গু রু
উৎপলকুমার ধারা

আলোয় ভরা ছড়ার কাঁড়ি ছড়ায় আঁকাআঁকি,
কথায় কথায় ছড়া হয়ে যায় ছন্দে মাখামাখি
মজার ছড়া ছন্দে গড়া ছড়ার ছড়াছড়ি,
হাতের কাছে পেলেই আমি তাঁর ছড়াটিই পড়ি

যাঁর কলমে কুঁড়ির থেকে ফুটছে ফুলের ছড়া,
হচ্ছে পশু পাখির ছড়া মধুর ছন্দে গড়া
হাসির ছড়ার ফুলঝুরিটি ফুটছে নিরবধি,
ছড়ার ছন্দে নাচতে নাচতে ছুটছে স্রোতের নদী

ছন্দে বেঁধে লিখতে পারেন কিশোর মনের কথা,
নিখুঁত গড়ন ছড়ার ধরন সরল নিপুণতা
সবুজমনের রঙ কুড়িয়ে স্বপ্নলোকের থেকে,
কিশোর মনের স্বপ্ন যত ঠিক দিয়ে দেন এঁকে

যাঁর কলমে মেঘের কোলে রকেটবাজি ছোটে,
শব্দ-ছবির শব্দগুলো দুম ফটাফট ফোটে
বন্দি শিশুর দুখ মুছিয়ে ভরায় অঢেল সুখ,
দুই বাংলার সবাই পাতে সুসম্প্রীতির বুক

আঁকেন যিনি ছন্দ-কথায় সবুজ পাহাড়-চুড়ো,
সেই ভবানীপ্রসাদ যিনি সেই-ই তো সবুজবুড়ো
যাঁর ছড়া সব কিশোর মনের ঘোচায় অন্ধকার,
তিনিই হলেন ছড়ার রাজা ভবানী মজুমদার!

যাঁর প্রেরণায় আমার মিঠেল ছন্দ বোনা শুরু,
তিনিই আমার সর্বপ্রথম ছন্দ শেখার গুরু
সেই যে প্রিয় মানুষছড়ায় ভোরের ছবি আঁকেন
সেই গুরুজি হাওড়া জেলার শানপুরেতে থাকেন
   

 


ভবানীপ্রসাদ মজুমদার সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন - 



 

 

  

<