সদ্য তিন সপ্তাহের আফ্রিকা ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরার ডাকে গভীর রাতে তল্পি-তল্পা সহ
বায়ুযানে উঠে বসা। ছুটি শেষ মানেই বাড়িমুখো পথে ফিরে দাঁড়াতেই হয়, এটাই নিয়ম। "হোম ইজ হোয়ার দ্য হার্ট ইজ"- লাইনটি মনে আসতেই কেন জানি না নিজেকে নিজেই থামিয়ে বললাম, "জানি, জানি!" কিন্তু সত্যি বলতে কী ওই সময়টুকুতে মন যেন অন্য
কথাই বলছিলো।
আমার
মন-প্রাণ জুড়ে তখন মাসাই মারার বিস্তীর্ণ মাঠের শেষে দিগন্তরেখার গায়ে হেলান দেওয়া
নীল রঙের আকাশটির কথা, গোধূলির আলোয় সন্ধ্যাতারার মিটিমিটি
হাসির আলোর ঝিলিক। দূরে একা দাঁড়িয়ে থাকা ওই অ্যাকাশিয়াটির (Acacia) কথাও খুব মনে পড়ছিল আমার। যেন সেটি আমারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এদের ফেলে আজ
আমি চলে যাচ্ছি ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন ভারি ঠেকছিলো। আমি চলে গেলেও অনেকেই
ওদেরকে দেখবে জানি। কিন্তু আমার মতো করে ওদের কথা কী কেউ মনে রাখবে? হয়তো রাখবে ---কে জানে? প্লেনে ছোট্ট দেয়াল তোলা সীটের আরেক পাশে বসা হাজব্যান্ড
স্বপনের, আমার আলো নিভে যাওয়া মুখ নজর এড়ায়নি। প্লেন টেক অফ করতেই আমি যখন কেবিন crew কে ডাকলাম আমার বিছানাটা রেডি
করে দিতে, ও শুধু জিজ্ঞেস করলো, "এখনই?"
কোনো জবাব না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ভাবলাম একটু। সত্যিই তো,
বাইশ ঘন্টার জার্ণিতে শুরু থেকেই ঘুমালে, পরে
জেগে বসে প্লেনের বাকিদের নাসা-গর্জন শুনতে হবে বৈ কি ! আফ্রিকান সময় তখন রাত দু'টো। গত তিন
সপ্তাহে এই সময়ের নিয়মে চলে এতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাই, আমি
আর জেগে থাকতে পারছিলাম না। সেই সাথে বিদায়ের ব্যথা আমার চোখের পাতাকে আরও ভারি
করে তুলছিলো। ভ্যাকেশন শেষে বাড়ি ফেরার সময়ের চেহারা সে-ই ছেলেবেলা থেকেই আমার এক
রয়ে গেছে। এর কোনো পরিবর্তন নেই। বেড়াতে যাবার নামে একমাস আগে থেকেই চেহারায় হাই
পাওয়ারের লাইট জ্বললেও, বাড়ি ফেরার সময় সব ফিউজ উড়ে যায়।
বেড়ানোটা এতোই পছন্দের! এখনো মনে পড়ে ছোটবেলায় শুধু রবিবারের একবেলা কোনো বেড়ানোর
প্ল্যান বাতিল হলে বাড়িতে কেঁদে কেমন বন্যা বইয়ে দিতাম, তা
আজও আমার বাড়ির লোকেরা মনে রেখেছে। যাইহোক, বিছানা তৈরী হতেই নাকে-মুখে কম্বল চাপা
দিয়ে আমি শুয়েই পড়লাম। ওপাশ থেকে স্বপন জানতে চাইলো আমি ঘুমিয়ে পড়িনি তো? বললাম, "না"l ভেবে
দেখলাম এভাবে ঘুমিয়ে পড়াটা ঠিক হবে না। খিদেও পেয়েছে অনেক। বিমানসেবীরা আবার
ঘুমিয়ে পড়লে খাবারের জন্য ডেকে দেয় না। জ্বালা অনেক! অগত্যা মুঠোফোন অন করে সিটটা
একটু রিক্লাইন করে উঠে বসলাম। আজকাল আমাদের ওই এক রোগ - সময়ে-অসময়ে মুঠোফোনের
পর্দায় তাকিয়ে থাকা। ফোন আন-লক হতেই শুরু করলাম ফেলে আসা ছুটির একের পর এক দিনের
ছবি দেখা। মুঠোফোনের শেষের ক'টা ছবি দেখতেই
মনটা কেমন অ্যাম্বোসেলীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। দেখলাম, ড্রাইভার
চার্লস আর আমাদের গাইড মুই পেই'কে সাথে নিয়ে আমরা ঘুরে
বেড়াচ্ছি। খুঁজে চলেছি ওই জঙ্গলের সবচে' বড় হাতিকে। ভোরের
আলো তখন সবে ছড়াচ্ছে। আশপাশটা তখনও তেমন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু গাইড
জানে কোথায় গেলে সবচে' বড় হাতিটিকে পাওয়া যাবে। Guide
মুই পেই ড্রাইভার চার্লসকে তাড়া দিয়ে চলেছে। সূর্যোদয়টা হয়ে গেলেই
জঙ্গলের পশুদের অ্যাক্টিভিটি শুরু হয়ে যাবে। তার আগে আমাদেরকে জঙ্গলের বিশেষ কোনো
জায়গায় পৌঁছে যেতে হবে। চার্লস আরও একবার সোজা হয়ে বসে অ্যাক্সেলারেটরে বেশ জোরে
পা দিয়ে চেপে ধরলো l আমাদের
ময়ূরপঙ্খী সাফারি ভেহিক্যাল তখন জনহীন, পথহীন 'জংলী ঝোপ-ঝাড় মাড়িয়ে পথ বানিয়ে চারদিকে ধুলোর ঝড় তুলে এগিয়ে চলেছে হাতির
সন্ধানে। গাড়ির শব্দে ভয় পেয়ে বিভিন্ন গাছ থেকে সদ্য ঘুম-ভাঙা পাখিরা
কিচির-মিচির ডাকতে ডাকতে উড়ে গেলো। চমকে উঠে একদল ইম্পালাও ছুটতে লাগলো। দাঁড়িয়ে
থাকা দু'টো জিরাফ দু'চার পা দৌড়েই বুঝলো ভয়ের কিছুই নেই। ধীর
পায়ে আবার ওরা আপন মনে হাঁটতে লাগলো। এভাবে জঙ্গলের পশুদেরকে দেখতে আর নিজের মতো
করে ভাবতে আমার বেশ লাগে। কিন্তু এখন আর দাঁড়ানো যাবে না। এখন আমাদের প্রথম কাজ
সবচে বড় হাতিটিকে খুঁজে বের করা। আরও মিনিট দশ'এক চলার পর
গাইড মুই পেই গাড়ি থামাতে বললো। ফিসফিস করে বললো, "পেয়ে
গেছি!" আমাদের উৎসাহী চোখ ভোরের নরম আলোয় খুঁজতে লাগলো
অ্যাম্বোসেলীর জঙ্গলের সবচে বড় হাতিকে। ক্রেইগ (Craig)
বর্তমানে অ্যাম্বোসেলীর বিশাল দুই দাঁতবিশিষ্ট সবচে বড় হাতি
হলো ক্রেইগ (Craig) l গতবছর এমনি দিনে আমাদের দ্বিতীয়বারের আফ্রিকা ভ্রমণের
সময় অ্যাম্বোসেলীতে প্রথমবার আমরা ক্রেইগকে দেখি। তার এক একটি দাঁতের ওজন আনুমানিক
একশ' পাউন্ড বা তারও একটু বেশি। ক্রেইগের বয়স এখন একান্ন
বছর। গতবছরের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি সে শান্ত, ধীর এবং
বন্ধুত্বপরায়ণ। গাইডের সাহায্য থাকায় আমরা অনেক কাছে থেকে গত বছর ওকে দেখেছি আর
সেই অভিজ্ঞতা আমি হয়তো কখনো ভুলতে পারবো না। সবচে মজার কথা হলো আগের বছর যখন আমরা ক্রেইগকে দেখতে
গেছিলাম, আমাদের তখনকার ড্রাইভার মুই পেইকেই গাইড হিসেবে আমাদের সাথে নিয়ে গেছিলো।
এবারও তাকেই আমাদের গাইড হিসেবে পেয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। কারণ মুই পেই হলো
এই ন্যাশনাল পার্কের একজন অভিজ্ঞ গাইড। বিখ্যাত সব ফোটোগ্রাফাররা এই জঙ্গলে হাতির
ছবি তুলতে একেই সঙ্গী করে। অবশেষে আমাদের গাড়ি সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্রেইগের সামনে
গিয়ে দাঁড়ালো। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম শান্ত, ধীর চোখে
তাকানো বিশাল এই প্রাণীটির দিকে। একবার সে খাওয়া বন্ধ করে আমাদের সকলের দিকে
তাকালো। তারপর নিশ্চিন্ত মনে আবার গাছের পাতা খেতে শুরু করলো। হাতির শুঁড় অনেকটা
আমাদের হাতের মতো কাজ করে। ওই শুঁড় দিয়ে প্যাঁচিয়ে নিখুঁত ভাবে ওদের পাতা ছিঁড়ে
খাওয়া অথবা জল খাওয়া- সত্যিই দেখার মতো। পরপর তিনদিন ভোর থেকে ঘন্টা চারেক সময় আমরা কাটিয়েছি
ক্রেইগের আশেপাশে। একটিবারের জন্যও এতো বড় পশুটির
সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ভয় লাগেনি আমাদের কারোর। আমার বর স্বপন দু'দিনে যতটা সময় ওই জঙ্গলে কাটিয়েছে, মন ভরে ছবি
তুলেছে ক্রেইগের। হাতির স্মৃতিশক্তি নিয়ে অনেক পড়েছি। জেনেছি, একবার কাউকে দেখলে ওরা ঠিক মনে রাখে। একবার ওদের বন্ধুর লিস্টে নাম তুলে
ফেলতে পারলে পৃথিবীর সেরা বন্ধু হবে সেই হাতিটি। উল্টোটাও সমান ভাবে বিপজ্জনক। দু'বছরে এতগুলো ঘন্টা ক্রেইগের সামনে
কাটিয়ে আমার নিজেরও কেমন আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। নিজের মনেই নিজেকে ক্রেইগের বন্ধু
ভাবতে শুরু করেছি। যেখানটায় দাঁড়িয়ে ক্রেইগ আপনমনে পাতা খেয়ে যাচ্ছিলো তার মাত্র
কয়েক ফুট দূরে মাটিতে পা ছড়িয়ে আমি বসে স্বপনকে বললাম একটা ছবি তুলে দিতে। মনের
খুশিতে একের পর এক পোজও পাল্টাচ্ছিলাম আমি। হঠাৎ শুনলাম আমাদের গাইড চিৎকার করে বলছে "গেট আপ -গেট আপ!" মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম
বিশাল পাহাড় আকারের ক্রেইগ হেঁটে আসছে। আর তখন,
আমার থেকে মাত্র তিন/চার ফুট দূরে। বসা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম।
এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আমি। চারদিকটা কেমন অন্ধকার মনে হলো - আর মনে হলো মাথা থেকে
গড়িয়ে পড়ছে বরফের মতো ঠান্ডা জল। আমি কিচ্ছুটি বলার আগেই মনে হলো কেউ একটা
"সরি -সরি" বলে যাচ্ছে। পাশের সীট
থেকে হাত বাড়িয়ে স্বপন আমাকে কাঁধে হালকা ঝাঁকুনি দিচ্ছে আর বলছে, "কী হলো? অমনি করে লাফিয়ে উঠলে কেন?" বুঝলাম, বেশ দীর্ঘ সময় ধরে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। আর,
যখনি ক্রেইগ চলে এসেছে ভেবে লাফিয়ে উঠেছি -আমারই জন্য নিয়ে আসা জুস্
আমার ধাক্কাতে কেবিন ত্রু'র ট্রে থেকে আমারই মাথায় পড়েছে।
বিমানসেবীটি কিচ্ছু না বুঝে "সরি" বলে চলেছে আর আমিও ততক্ষণে সবটা বুঝে "সরি"
বলছি। একটা কথা না বলেই পারছি না- আফ্রিকা ভ্রমণের আগে পশুদের
সম্বন্ধে অনেক পড়েছিলাম। জেনেছিলাম, হাতি শব্দে
রেগে যায়। তাই হাতির সামনে চুপ করে থাকাটা খুব জরুরি। ভাগ্যিস স্বপ্নেও সেটি আমার মনে ছিল - না হলে আমার চিৎকারে প্লেনের অন্য যাত্রীদের কী হতো,
তা একমাত্র ভগবানই বলতে পারেন!
ছবি - স্বপন চৌধুরী
|