স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথেই দেখা হল হাবুলের
সাথে। কালকের ঝড়-ঝাপটার স্পষ্ট ছাপ বেচারার চোখে মুখে।
“কাল কি হয়েছিল রে, হাবুল?” প্রশ্ন শুনে
হাবুলের চোখ ছল ছল। কাঁদো কাঁদো হয়ে হাবুল সব খুলে বলল।
কাল দুপুরে সেতুকাকার মিষ্টির দোকানে গিয়েছিল
হাবুল। সেতুকাকার দোকানের কমলা রঙের, ঘি মাখা লাড্ডুগুলো
দেখলে সবারই জিভে জল আসে। হাবুলও সেই অমোঘ আকর্ষণ সামলাতে পারেনি। পরে টাকা দেবে বলে সে গোটা কয়েক লাড্ডু পেটে চালান
করে দিয়েছিল। এইদিকে তার পকেট গড়ের মাঠ।
টাকা না পেয়ে,
সেতুকাকা অন্যান্য
খন্দেরদের সামনে তাকে বেদম বকাঝকা করেছেন। তারপর আবার
বিকেল বেলায় হাবুলের বাবার কাছে নালিশ। যার ফলে কাল সন্ধ্যায় হাবুলের ওপর চলেছিল
উত্তম মধ্যম। হাবুলের এই অপমান মানে আমাদের অপমান।
পিকলু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল "একটা শাস্তি
তো দিতেই হবে। এমনিতে ছাড়া যাবে না।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম "কাকে?" হাবুল পিকলুর ইশারা
বুঝে নিয়েছিল । সে বলল, “সেতুকাকাকে।”
সেতুকাকার মত মানুষকে শাস্তি দেবো আমরা? অবাক হয়ে পিকলুর
দিকে তাকালাম আমি।
পিকলু ছিল আমাদের মধ্যে বুদ্ধির শিরোমনি। এমনিতে সাধাসিধে, চুপচাপ কিন্তু এইসব ব্যাপারে তার পাকা বুদ্ধি। সে স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বলে উঠল "সেটা আমার উপর
ছেড়ে দে।”
এই কথা শুনে হাবুলের সব অপমান যেন এক লহমায়
কোথায় উড়ে গেল। সে বলল, "প্ল্যানটা কি?"
পিকলু হেসে বলল “ক্রমশ প্রকাশ্য। আগে আমি যা যা
চাই তা সব নিয়ে আয়।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম "আমরা কবে অ্যাকশন
নিচ্ছি?"
পিকলু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, "আজই, আজ শনিবার রাত, সবকিছু যুতসই
হবে।"
আমি আর হাবুল দু'জন দু'জনের দিকে তাকালাম।
হঠাৎ যেন পিকলু আমাদের তিনজনের টিম লিডার
হয়ে উঠলো। সে গন্তীর হয়ে বলল, “এর জন্য জোগার যন্ত্র দরকার।” তার আদেশ মোতাবেক আমরা
ছুটলাম। পিকলুর দেওয়া লিস্ট অনুসারে কিছু পুরনো পত্রিকা, কাগজ, আলকাতরা, কিছু পুরনো কাপড়
নিয়ে হাজির হলাম আমি।
স্কুল মাঠে উত্তরদিকের পুরনো হোস্টেলবড়ির একটা
ভাঙ্গা ঘরে শুরু হল আমাদের প্রাথমিক কাজ। ভাঙ্গা মেঝেতে বসে খুব গন্তীরভাবে পিকলু
একটি পত্রিকা কাগজকে পুরু খুলে নিয়ে বসলো। তার উপর বাঁশের কঞ্চি ও কাপড় দিয়ে
তৈরি বড় তুলি দিয়ে কালো রং মাখতে শুরু করলো। আমি আর হাবুল পাশে বসে শুধু হা করে
দেখছি। পিকলুর গুরুগন্তীর মনোযোগ দেখে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছিলাম না।
কিছুক্ষণ পড় বুঝতে পারলাম আমাদের জীববিদ্যা বই
এর কঙ্কালতন্ত্রের ছবি আঁকছে সে। কঙ্কালের হারগুলোকে
বাদ দিয়ে বাকি সবটা জায়গা কালো আলকাতরা দিয়ে ভরিয়ে দিল সে। তার ফলে কঙ্কালটার
সাদা সাদা হাড়গুলো সত্যি সত্যি কঙ্কালের মতো ফুটে উঠল। তরতর করে সে এরকম দুটো কঙ্কাল
বানিয়ে নিল। হাবুল বলে উঠল “পিকলু! তুই কি পাগল হয়েছিস? সেতুকাকাকে এসব
দিয়ে কি শাস্তি দিবি?”
আমি মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম পিকলু কি
তন্ত্র-মন্ত্র সাধনা করে শাস্তির ব্যবস্থা করবে? কঙ্কালের পুজো
দিয়ে সেতুকাকাকে কুপোকাৎ করার ফন্দি আঁটছে নাকি সে? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস
করলাম “এইসব দিয়ে কী করবি? বল না।”
পিকলু হাবুলের দিকে তাকিয়ে শুধু উত্তর দিল
"সন্ধ্যার সময় তোদের বাড়ির পেছনের পুকুরের ধারে চলে আসবি।"
হাবুলদের পাশের বাড়িই সেতুকাকার বাড়ি।
সেতুকাকার বাড়ির সামনে গাছপালা ঘেরা বড় একটা পুকুর। হাবুলদের বাড়ির পেছন দিয়ে
ওই পুকুরের ধারে যাওয়া যায়। সেই পুকুরের আরেক পাড়েই আমাদের বাড়ি।
পরিকল্পনা শেষ করে আমরা দুজনে বাড়ি যাওয়ার
জন্য উঠে পড়লাম। পিকলু বলে উঠলো “দাঁড়া! তুই এইসব সাবধানে লুকিয়ে নিয়ে যা। কেউ
যেন না দেখতে পারে” আমি দুটো কষ্কালের ছবিকে আরেকটা পত্রিকা কাগজ দিয়ে মুড়ে
জামার মধ্যে পুরে বাড়ি চললাম।
তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কথামত আমি উপস্থিত
হলাম পুকুর পাড়ে। ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠলো। পুকুর
ধারের গাছপালা,
ফুল-ফলে ভরা
পরিবেশটা অপূর্ব লাগছিল। সেতুকাকাদের বাড়ির রান্নাঘর থেকে একটু একটু আলো কলাগাছের পাতার মাঝ দিয়ে এসে
পড়ছিল আমাদের দিকটায়। তখন পাড়ার চৌমাথার শনিমন্দিরে চলছে ঘটা করে শনি পূজা। ধ্বনি
ও শাঁখের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ পিকলু এসে উপস্থিত “কিরে? সব এনেছিস?” আমি বললাম “হ্যাঁ।
কিন্তু হাবুল কোথায়?”
“সে আসবে।” বলে পিকলু আমার দিকে হাত বাড়িয়ে তার জিনিসগুলো
চাইল। আমার কাছে তখনো ব্যাপারটা পরিষ্কার না। পিকলু কি করতে চায় বোঝা যাচ্ছিল না।
আজ জানি কি হয় ভাবছি, এমন সময় হাবুল
পেছন থেকে এসে হাজির। পিকলু বলল "দে, দড়ি দিয়ে দুটোকে
ঝুলিয়ে দে তাড়াতাড়ি।” জায়গাও দেখিয়ে দিল। হাবাগোবা হাবুল যেন পিকলুর কথায়
সম্মোহিত হয়ে সব কাজ করছে। পুকুরের উপর আধ বাঁকানো পেয়ারা গাছের ডালে একটা
কঙ্কাল ঝুলিয়ে দিল। এর পেছনে থাকা আম গাছটার ডালে আমি আরেকটিকে ঝুলিয়ে দিলাম।
এতক্ষনে আমি আর হাবুল পিকলুর ষড়যন্ত্র বুঝতে পারলাম। হেসে বললাম, "আজ সেতুকাকা টের
পাবে!”
প্রতিদিন রাতে এই দিক দিয়েই বাড়িতে ঢোকে। অল্প
আলোতে কঙ্কাল দুটোকে বেশ দেখাচ্ছিল। একদম
মনে হচ্ছিল সত্যিকারের দুটো কঙ্কাল বাতাসে ভাসছে। হাবুল পুকুরের কোনায় জংলা মতো
জায়গাটা দেখিয়ে বলে উঠল, "পিকলু, জামতলার ওই খানটায়
নাকি ভূত আছে সবাই বলে।” সাথে সাথে পিকলু বিজ্ঞের
হাসি হেসে বলল,
"তাই তো এই জায়গাটা ঠিক করলাম। ব্যাপারটা জমবে ভালো।” হাবুল আবার বলল, "যদি আমাদের নকল ভূত
দেখে আসল ভূতেরা রাগ করেন।” পিকলু বিরক্ত হয়ে বলল, “ধুস! ভূত আবার হয়
নাকি?" আমি লজ্জায় আর কিছু
বললাম না। তাছাড়া পিকলু যা বলে তা ঠিকই বলে।
একটু দূরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে আমরা তিন বন্ধু
সেতুকাকার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের পেয়ে যেন মশাদের ডিনার পার্টি শুরু হল।
এইদিকে আওয়াজ হওয়ার ভয়ে তাদের মারতেও পারছিলাম
না। অপেক্ষা দীর্ঘতর হচ্ছিল। সেতুকাকার দেখা নেই।
সন্ধ্যা হতেই সেতুকাকার বাড়ি থেকে ভেসে আসতে
লাগল নানা রকম আওয়াজ। কাশি ঘন্টা সহযোগে সন্ধ্যাবাতি দেওয়ার শব্দ। এরপর শুরু হলো
সেতুকাকার ছেলে অন্তুর জোরে জোরে বই পড়া -সিন্ধু সভ্যতার উত্থান। বছর বছর ফেল করলেও অন্তু সময় করে
সূর্যাস্তের সাথে সাথেই পড়তে বসে যায়। ঘড়ির কাটা এগিয়ে চলছে। ইতিহাসের ইতি
দিয়ে অন্ত শুরু করল সুনির্মল বসুর কবিতা - সবার আমি ছাত্র।
মনে হচ্ছিল অন্তু আজই সব পড়ে শেষ
করে ফেলবে। কাল পরীক্ষা হলে অন্তু ঠিক পাশ করে যাবে। আমরা অসহায়ের মত ঘাপটি মেরে অন্ধকারে
বসে রইলাম। হাবুল হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল “সাবধান বন্ধুগণ! সেতুকাকা বাড়ি ফিরছে।
এখন পুকুর পাড় দিয়ে বাড়িতে ঢুকবেন।"
কি হয় দেখার জন্য আমরা নড়েচড়ে বসলাম। পিকলু খুব
বিজ্ঞের মত বলে উঠল “চুপ করে থাক। ধৈর্য
ধর।”
আলোআঁধারীতে দেখলাম সেতুকাকা দুলে-দুলে, গুন্-গুন্ করে
গান গাইতে গাইতে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
পেয়ারা গাছের সামনে এসে সেতুকাকা কি যেন ভেবে উপর দিকে তাকালেন। তখনই মৃদুমন্দ বাতাসে কাগজের কঙ্কালগুলো দুলে উঠল। তা দেখে
সেতুকাকা বিস্ফারিত চোখে চিৎকার করে উঠলেন, “মাগো! ভুত! ভূত!
বাঁচাও আমাকে! ওই অন্তু, কে কোথায় আছিস? ভূত! ভুত!” সাথে সাথে জলে পড়ার আওয়াজ- ঝপাস। আশেপাশের কুকুরগুলো শোরগোল
করে উঠল। আমি উঠতে যাচ্ছিলাম পিকলু আমার হাত ধরে আটকালো, বলল “দাঁড়া, আমরা একটু পরে যাব।
না হলে ধরা পড়ে যাবো।” সাথে সাথে কয়েকজন এসে জড়ো হয়ে গেল।
আমি আর পিকলু কিছুক্ষণ পর সামনে গেলাম। গিয়ে
দেখি অন্তু চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে রাম-রাম জপ করছে। অন্তুর মা পুকুর পাড়ে
দাঁড়িয়ে সেতুকাকাকে তোলার চেষ্টা করছে। পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে
পারার আরো কয়েকজন। সেতুকাকা ভারী পেট ও লুঙ্গির জন্য জল থেকে উঠতে পারছিলেন না।
হারুকাকা জিজ্ঞেস করলেন "কোথায় ভূত?” সেতুকাকা ভীতু
স্বরে বলে উঠলেন “হারু-রে! একটা না, দুটো এসেছিল-রে।”
আংগুল দিয়ে দেখালেন কোথায়-কোথায় ছিল।
হারুকাকার লম্বা ভারি বিদেশি টর্চের আলোটা
সেতুকাকার মুখ থেকে সরিয়ে ওইদিকে ফেলতেই দেখা গেল
পত্রিকা কাগজের কঙ্কাল। ঠান্ডা হালকা হাওয়ায় তখন সেটা দুলছে। পাশেই দেখা গেল আরেকটা কঙ্কাল। সবাই তখন হো-হো করে হাসলো। আমরা তিনজন একদম
হাসলাম না। পাছে না ধরা পড়ে যাই। হারুকাকা বলে উঠলো “ওই, হোস্টেলের ছেলেদের
কাণ্ড হবে। আজ ছেলেগুলো এদিক দিয়ে বিকেলে ঘোরাঘুরি করছিল।”
আমাদের তিনজন নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করলাম
ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সেতুকাকার এই
অবস্থা দেখে আমাদের কিন্ত ভিতরে ভিতরে বেশ আনন্দ হচ্ছিল। অন্তুর মুখেও যেন মুচকি হাসি দেখলাম। সেতুকাকা, ছোট্ট বাচ্চাদের মত
অন্তুর হাত ধরে জল থেকে
উঠে মাথা নুইয়ে ঘরে চলে গেল। এ যাত্রায় ভালই একটা শিক্ষা দেওয়া গেলো।
সবাই চলে যাওয়ার পর আমরা তিন বন্ধু পুকুর পাড়
ধরে হেঁটে ফিরছি, হঠাৎ বিদুৎ চলে গেল। কোন কারণে বিদ্দুৎ বিভ্রাট হয়েছে মনে
হয়। আমরা তখন পুকুরের কোনায় জাম গাছের নিচে। চারিদিকে
একদম মিশমিশে অন্ধকার। আমরা তিন বন্ধু দাঁড়িয়ে পড়লাম। সবদিকে তখন নিঝুম। এক টানা ঝিঁ-ঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে। এইবার মুখটা
পাংশু করে হাবুল বলল, “আমার কিন্তু ভয় করছে রে।”
পিকলুর মুখে কোন কথা নেই। আমারও বুকের ভেতরটা
ধড়ফড় করে উঠল। চারপাশটা কেমন রহস্যময় হয়ে উঠল। গা ছমছম করে উঠল। আওয়াজ পেলাম, ছপ-ছপ করে কে যেন পুকুরের জলে হেঁটে যাচ্ছে। আমি আতংকিত হয়ে চিৎকার দিতে
গিয়েও মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। হাবুল আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে। পিকলু
বলে উঠল, “উপরে দেখ।”
আমি উপরে তাকাতেই দেখলাম দুটো কঙ্কাল পা
ঝুলিয়ে বসে আছে জাম গাছের নিচের বাঁকানো ডালটায়।
এই আঁধারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পা দুলিয়ে দুলিয়ে দুটো কঙ্কাল নিজেদের একবার
দেখছে আরেকবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। দুটো কঙ্কালই ফিকফিক করে হাসছে। আমার আর হাবুলের চিৎকার তো দূরের কথা, চলার ক্ষমতাও নেই।
মনে হচ্ছে এক্ষনি আমাদের তিন জনের
ঘাড় মটকে দেবে। তার মধ্যে হাবুল কান্না জড়ানো নাকি সুরে বলল, “ভুতেরা আমাদের উপর
রাগ করেছে রে।” পিকলু তার মধ্যে ঝপাং করে ঝাঁপ দিল
পুকুরে। আমার আত্মারাম তখন খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। দুটো হঠাৎ খিলখিল
করে হেসে উঠল। তারপর আমি আর কিছু বলতে পারিনা। জ্ঞান ফিরল যখন তখন অন্তুদের ঘরের বারান্দায়। সবাই আমাদের উপর ঝুঁকে
আছে। সেতুকাকা আমার মাথায় একবার আরেকবার হাবুলের মাথায় হাওয়া করে যাচ্ছেন। জামা
কাপড় ভেজা পিকলু পেছন থেকে ইশারা দিচ্ছে আমাদের কিছু না বলার জন্য৷ হারুকাকা
হে-হে করে হেসে বললেন, “ভূত দেখলেন সেতুদা, আর অজ্ঞান হলি
তোরা।" গুরুর ইশারায় আমরা আর কিছু বললাম না। ঘটনা গোপন রয়েই গেল।