গঙ্গাস্নানের দিন ভোর থেকেই জমজমাট গোটা সমুদ্রতট এলাকা। শীতের মধ্যেও পুণ্যের আশায় পুণ্যার্থীরা এসে জড়ো হয়েছে সমুদ্রস্নানে। পরিধেয় বস্ত্র যে যার নিজের লোকেদের কাছে গচ্ছিত রেখে স্বল্পবেশে নেমে পড়েছে সাগরে। কেউ কেউ বাছুরের লেজ ধরে বৈতরণী পার হবার মনোবাসনা চরিতার্থ করছে। পুলিশ ফোর্স কড়া নজর রেখেছে, যাতে কোনো অঘটন না ঘটে। আস্তে আস্তে পুবাকাশে উদয় হল সূর্য। ক্রমশঃ বেলা বাড়তে থাকল। সেই সাথে বাড়তে থাকল গঙ্গাস্নানের ঢল।
মেলার শেষদিনে একটু ভালো বিক্রিবাটা হয়। বিক্রেতারা সেটা জানে। ক্রেতারা ভাবে, শেষ দিনে সস্তা দামে মালামাল সব বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা বাড়ি ফিরবে, তাই কেনাকাটার হিড়িক পড়ে যায়। সেটা বুঝেই ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাট সব খুলে বসে থাকে।ব্যবসায়ী সতীশ আগরওয়ালাও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি তাঁর কর্মচারীদের বলে রেখেছিলেন খুব সকাল সকাল দোকানটা খুলতে। সেইমত কর্মচারীরা সকাল সাতটায় 'অঞ্জলি স্বর্ণমন্দির' খুলে রেখেছিল। পুলিশ কন্ট্রোলরুমের কাছে দোকানটা হওয়ায় বুকে ভরসা পেয়েছিল সতীশবাবু। আর যাই হোক এখান থেকে চুরি ডাকাতি করা কোন মতেই সম্ভব নয়। এই দৃঢ় বিশ্বাসটা ছিল মালিকের মনে। অঞ্জলির পাশে আরও বেশ কয়েকটি সোনার দোকান ছিল। তবে গুণমানের দিক থেকে অঞ্জলির সোনার গহনার কদর আছে খুব। সেই কারণে সকাল থেকে দোকানে ভিড় ক্রমশঃ বাড়ছিল। আর ভিড় বাড়লেই নানান বিপদ। সেই বিপদ এড়াতে দোকানের ভিতরে ভিড় কমাতে প্রবেশপথে কিছুটা বাধ্যবাধকতা করে রেখেছিল সতীশ আগরওয়াল। দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল কয়েকজন রক্ষী। যাতে প্রাণঘাতী জাতীয় কোন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কোনো অবাঞ্চিত লোকজনরা সহজে ঢুকতে না পারে। তাছাড়াও দোকানের ভিতরে লাগিয়ে রেখেছে সি সি ক্যামেরা। যাতে কোন অঘটন ঘটলেও সহজে অপরাধীদের চিহ্নিত করা যায়।
দুপুর বারোটা নাগাদ এক দম্পতি গিয়ে হাজির হল অঞ্জলি স্বর্ণমন্দিরের সামনে।সুট কোট পরা ভদ্রলোক। গলায় ঝুলছে ম্যাচিং করা টাই।পায়ে চকচকে কাল জুতো। মহিলার পরনে ম্যাচ করা দামি বেনারসি শাড়ি ব্লাউজ। মাথায় সিঁদুরের সড়ক। গা ভর্তি গয়না। ইমিটেশনের কিনা কে জানে? তাদের দেখে মনে হল স্বামী স্ত্রী। দোকানে ঢুকতে যেতেই তাদের পথরোধ করে দাঁড়ালো রক্ষীরা। কাউন্টারে বসেছিলেন সতীশ আগরওয়াল। হঠাৎ তার চোখ দুটো আছড়ে পড়লো দম্পতির দিকে। মহিলাকে তিনি চেনেন না। দেখেনি কখনো। কিন্তু সঙ্গে আসা ভদ্রলোককে….. ভাবতে গিয়েই তার মনে পড়ে গেল কাশি বাবু নয়তো?
কাশীনাথ বসুর সঙ্গে সতীশবাবু পরিচয় বহু বছরের। তার দোকানের একজন নামকরা খরিদ্দার। বহু টাকার সোনা, রুপো, হীরের গহনা কেনেন। তার গড়িয়া হাটের দোকান থেকে। কিন্তু গত দু'বছর তিনি দোকানে আসেননি। লোকমুখে জেনেছেন গলার চিকিৎসা করাতে ভেলোরে গিয়েছেন। দু'বছর পরে তাকে দোকানে আসতে দেখে স্বভাবতই উৎফুল্লিত হলেন তিনি। সাথে সাথে তিনি চিৎকার করে বললেন-- ওনাদের ভিতরে আসতে দাও।
রক্ষীরা আর চেক করার সময় পেল না। স্ত্রীকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন কাশিবাবু। গিয়ে দাঁড়ালেন সতীশ আগরওয়ালার সামনে। হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন-- ধর্ম করতে গঙ্গাসাগরে চলে এলাম। আপনার বৌদি তার কর্মে লেগে পড়ল। চলে এলাম আপনার দরবারে। এখন আপনি ওর আশা মেটান।
- আশা অবশ্যই মেটাবো। তবে তার আগে একটু কফি হোক। বহুদিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা। বৌদিকে এই প্রথম দেখলাম। আপনাদের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার। কিন্তু আপনার গলার স্বরটা একটু অন্যরকম লাগছে।
সতীশ বাবুর কথা শুনে চকিতে নিজেকে একটু সামলে নিলেন কাশিবাবু।ব্যাখ্যা দিতে তিনি বললেন--আর বলবেন না দাদা! কলকাতার ডাক্তার বাবুরা তো বলে দিয়েছিলেন গলায় ক্যান্সার হয়েছে। ভেলোরের ডাক্তারবাবুরা বললেন--ক্যান্সার নয়, সর্দি জমে এটা হয়েছে। শুনে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। গলার স্বর একটু-আধটু উল্টো পাল্টা হলেও বিপদের হাত থেকে বেঁচে এসেছি।
- ভালো। খুব ভালো। সতীশবাবু বললেন-- তা বৌদির জন্য কি ধরনের গহনা বার করব?
- যা মনে হয় তাই বার করুন। আজ আর কোন কিছুতেই না করবোনা। আজ মরলে কাল হয়ে যাবে দুদিন। চোখদুটো বুজলে তো আর টাকা পয়সা সাথে নিয়ে যেতে পারবো না।
সতীশবাবুর কর্মচারীরা এক এক করে সোনা, রুপা, হীরার গহনা বার করে। বাক্স সমেত সেগুলো খুলে সতীশবাবু সেগুলো দেখাতে থাকেন। পছন্দের গহনার বাক্সগুলো এক এক করে পাশে সরিয়ে রাখেন কাশিবাবু। পছন্দ হয়েছে বুঝে আবার নতুন নতুন ডিজাইনের গহনা বার করে দেখান সতীশবাবু। মনটা খুশিতে ভরে ওঠে।প্রায় বিশ পঁচিশ লক্ষ টাকার গহনা। কম কথা নয়। গত তিনদিনের মেলায় এত টাকার গহনাপত্র তিনি বেচতে পারেননি। একজন খদ্দেরই তাই কিনে নিচ্ছে। এতে আনন্দ হবে না তো, কি হবে?
হঠাৎ কাশিবাবু বললেন--থাক সতীশবাবু! আর নয়।
বৌদি গহনাগুলো একপলক করে দেখে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। তা দেখে সতীশবাবু শুধালেন-- বৌদি আর কিছু লাগবে নাকি?
বৌদি মুখে কিছু বলল না। শুধুমাত্র মাথা নেড়ে জানালো, আর কিছু লাগবে না।
কাশিবাবু শুধালেন-- কত দাম হল?
সতীশবাবু এক একটা বাক্স খুলে গহনাগুলো দেখে দাম লিখে বাক্সগুলো ফেরত দিলেন কাশি বাবুর হাতে। কাশিবাবু সেগুলো কাউন্টারের এক পাশে সাজিয়ে রাখলেন। সতীশবাবু দাম হিসেব করে বললেন-- ঊনিশ লাখ পঁচাশি হাজার।
কাশিবাবু পকেটে হাত ধরে চেক বইটা বার করতে গিয়ে দেখেন চেক বই নেই। তাই চোখ দুটো কপালে তুলে কাশিবাবু বললেন-- চেকটা বোধহয় ফেলে এসেছি গাড়িতে। আপনার বৌদি এখানে বসে থাকুক। জিনিসপত্রগুলো এখানে থাক। আমি চেকটা নিয়ে আসছি গিয়ে।
একথা বলে দোকান থেকে বার হলেন কাশিবাবু। পরিচিত লোক।বহুবছরের খদ্দের।বৌদি বসে আছেন দোকানে।পাশে সোনার গহনার বাক্সের ঢাল।তাই মনে কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না সতীশবাবুর।তার উপরে কখনো কাশিবাবুর কোন চেক বাউন্স হয়নি আগে।তাহলে আর সন্দেহের অবকাশ থাকেকোথায়? তাই চুপচাপ ছিলেন সতীশবাবু।
কাশিবাবু বার হয়ে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই আর একজন ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন সতীশবাবুর দোকানে। তার পরনে অন্য রঙের স্যুট কোট। তার মুখের দিকে তাকিয়ে সতীশবাবু অবাক হয়ে গেলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে কোথা থেকে কাপড় চোপড় পাল্টে এলেন কাশীবাবু? কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে কাশি বাবু হতবাক হয়ে মহিলাকে শুধালেন-- এখানে তুমি চুপচাপ বসে আছো, ছেলে কোথায়?
মহিলা আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন- গঙ্গাপাড়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে কোথায় চলে গেলে? তোমাকে তো খুঁজে পেলাম না। ছেলেটাকে…. বলতে বলতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল মহিলার।
আক্ষেপের সুরে ভদ্রলোক বললেন-- তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি পরিশান হয়ে গেছি। কোথাও তোমাকে খুঁজে না পেয়ে মিসিং ডায়েরি করতে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ঢুকে ছিলাম। ভাগ্যিস সেখান থেকে এখানে এসে ঢুকেলাম। না হলে তোমাকে খুঁজে বার করতে আমার কালঘাম নিগড়ে যেত। তা এতক্ষণ তুমি ছিলে কোথায়? ছেলে কোথায়?
একথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন মহিলা। কাঁদতে কাঁদতে একসময় বললেন-- গঙ্গা স্নান করার সময় একজনের হাতে ছেলেকে দিয়ে সাগরে স্নান করতে নামলাম। ডুব দিয়ে ফিরে এসে দেখি ছেলে নেই। লোকটা তাকে নিয়ে পালিয়েছে। আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। তখন তোমার মত একটা লোক এসে আমার কাছে দাড়াল। আমাকে অভয় দিয়ে বলল-- আপনার কোন ভয় নেই। ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবে। চলুন পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়ে আসি। এ কথা বলে আমাকে সঙ্গে করে এই দোকানে নিয়ে এলো।
স্বামী-স্ত্রীর এই কথোপকথনে টনক নড়ল সতীশ আগরওয়ালার। তাহলে আগের ব্যক্তিটি কে? যাকে তিনি কাশিবাবু ভেবেছিলেন! যাকে তিনি প্রায় কুড়িলাখ টাকার সোনারগহনা দেখিয়েছন? সন্দেহের দানাটা মাথার মধ্যে চেপে বসতেই বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে কাউন্টার ছেড়ে বের হয়ে এলেন সতীশবাবু। তাকে দেখতে না পেয়ে আবার দোকানে ঢুকলেন। পাগলের মত সোনা রূপার গহনার বাক্সগুলো খুলে দেখলেন।একটা সোনার রূপার গহনাও খুঁজে পেলেন না বাক্সে। তার মধ্যে একটা বাক্সে খুঁজে পেলেন একটা রুপোর টাকা। যে টাকাটা তার নয়। নিশ্চয়ই টাকাটা ছদ্মবেশী কাশীবাবুর।ইচ্ছে করে বাক্সের মধ্যে রেখে গেছে। দুঃখ,অনুশোচনায় তার দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। একসময় সেই দুঃখ সহ্য করতে না পেরে, 'হায় আমার কি সর্বনাশ হল' বলে পাগলের মত মাথার চুল ছিড়তে শুরু করলেন সতীশবাবু।
কাশিবাবু ততক্ষণে বুঝে গেছেন সমস্ত ব্যাপারটা। তিনি সতীশ আগরওয়ালাকে বললেন-- এভাবে দোকানে বসে মাথার চুল ছিঁড়লে কোনো সুরাহা হবে না। প্রলাপ না করে আগে চলুন পুলিশ কন্ট্রোলরুমে যাই। ওখানে গিয়ে অভিযোগ জানাই।
ব্যাপারটা অনুধাবন করে তিনি সাথে সাথে বের হয়ে এলেন দোকান থেকে। পাশেই পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ঢোকার মুখে একটা বাচ্চা ছেলের চিৎকার করে কাঁদতে দেখে সে দিকে চেয়ে দেখলেন সকলে। ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কাশিবাবু ও তাঁর স্ত্রীর মুখ। আনন্দে উল্লাসে স্বগোতক্তি করার মত কাশিবাবু বললেন-- ওই তো আমাদের ছেলে।
কাশিবাবুর স্ত্রী দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলেন ছেলেটিকে। মাকে কাছে পেয়ে কান্না থেমে গেল ছেলের। ছেলেকে ফিরে পেয়ে দুজনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
কন্ট্রোলরুমে তখন বসেছিলেন অলক মিত্র, ডিএসপি সিআইডি, যতীন দারোগা, এবং আরো অনেকে। সতীশবাবু, কাশিবাবুর কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন তারা সকলে। নিঃশব্দে, নীরবে এরকম একটা ডাকাতি করা তো যার তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া খালি সোনার বক্সের মধ্যে যখন একটা রূপোর টাকা পাওয়া গেছে, তখন তারা নিশ্চিত হয়ে গেলেন এ কাজ পলাতকের। ডাকাতি করার পরে সে প্রতিবারই অকুস্থলে রেখে যায় এই রুপোর টাকা। তাই দেরি না করে সমস্ত পুলিশকে সঙ্গে সঙ্গেএলার্ট করে দিলেন। খবর দিলেন বড় সাহেবকে। তারপর কম্পিউটার নিয়ে বসলেন। আধ ঘন্টা আগের সমস্ত ছবি রিভিউ করতে বসলেন। কম্পিউটারের পর্দায় সে ছবি ভেসে উঠল কিছুক্ষণের মধ্যেই। উন্মুখ হয়ে ছবি দেখতে থাকলেন অলোক মিত্র, যতীন দারোগা কাশীবাবু, সতীশবাবু এবং আরো অনেকে।
গঙ্গার নদীতটে সুটকোট পরা কাশীনাথ বেশি ছদ্দবেশী পলাতককে দেখেই সকলে চিনতে পারলেন এই সেই লোক।সেই লোকটি কাশীনাথ বাবুর স্ত্রী সাথীর সাথে এগিয়ে গেল। তাকে কি বোঝাতে বোঝাতে সোজা চলে এল গীতাঞ্জলি স্বর্ণমন্দিরে। রক্ষী ঢুকতে তাদের বাধা দিল। তারপর তারা ভিতরে গেল। লোকটার গায়ে ছাই রঙের সুটকোট। গলায় টাই। ওটাই পলাতক। কিন্তু পলাতকের সন্ন্যাসী বেশি যে ছবিগুলো বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার লিফলেট করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার মতো নয়। মনে সন্দেহ হওয়াতে ছদ্মবেশী কাশীনাথের ছবিটাকে দাঁড় করিয়ে অলক মিত্র যতীন দারোগাকে শুধালেন-- ইনি কি আপনার সেই পলাশ ওরফে পলাতক?
শুকনো দুটো ঢোক গিলে যতীন দারোগা বললেন-- হ্যাঁ স্যার! সেরকমই তো মনে হচ্ছে।
ঠিক সেই সময় কন্ট্রোলরুমে খবর এলো-- কপিলমুনি মন্দিরের বেশ কিছু প্রণামিতে পাওয়া সোনা রুপার গহনা নিয়ে পালিয়েছে দুজন সেবক। অলক মিত্র কম্পিউটারের স্ক্রিনে পলাতকের ছবিটাকে একপাশে সরিয়ে মন্দিরের ছবিটা নিয়ে এসে রিভিউতে সেট করলেন। সেই দুই সেবকের ছবি দেখে যতীন দারোগা বললেন-- এতো স্যার অনন্ত আর সুশান্তের ছবি। এরা দুজনে পলাতকের অন্যতম সাগরেদ। তাই সাগ্রহে সবকিছুর উপর নজর রেখে চললেন অলোক মিত্র এবং আরও সকলে। অনন্ত আর সুসান্ত মন্দির থেকে বার হয়ে ব্যাগভর্তি সমস্ত মালামাল নিয়ে সোজা চলে এলো পুলিশ কন্ট্রোল রুমের পিছনে। পলাতকও স্বর্ণমন্দির থেকে বার হয়ে সেখানে পৌঁছাল। একজন লোক হোগলাতে ঘেরা ছোট্ট ছাপরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা তিনজন সেখানে পৌঁছাতেই চারজন একসাথে ঘরের ভেতর ঢুকল। সেখান থেকে আর কেউ বার হলো না।
অলক মিত্র ফোনে রাউত সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলেন।মেলাতেই ছিলেন রাউত সাহেব। সংবাদ পেয়ে তিনি জলদি চলে এলেন। পলাতকের হদিশ পাওয়া গেছে শুনে খুব খুশি হলেন তিনি। পলাতকের সব বৃত্তান্ত শুনে তিনি বললেন--মিত্র! দেখো, আমরা পলাতকের ধরার জন্য সারা গঙ্গা সাগর মেলা চষে বেড়াচ্ছি, অথচ সে এসে বাসা বেঁধে আছে আমাদের পুলিশ কন্ট্রোলরুমের পেছনে।এ তো বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার মত অবস্থা। মিত্রবাবুর কোন মন্তব্য শোনার আগেই একদল স্ট্যান্ডবাই ফোর্সকে নির্দেশ দিলেন কন্ট্রোলরুমের পিছন দিকটা কর্ডণ করে রাখতে। তারপর মিত্র সাহেব ও যতীন দারোগার সাথে শলাপরামর্শ করতে বসলেন রাউত সাহেব।
সেই শলাপরামর্শে ঠিক হল,কর্ডন করা জায়গাতে আরো ফোর্স অফিসার বাড়িয়ে দিতে হবে। কোনো তাড়াহুড়ো করবে না পুলিশ। কোথাও কিছু হয়নি এমন একটা ভাব দেখাতে হবে। ওই ছাপরা থেকে কেউ বার হলে তাকে ধরতে হবে। এমনভাবে তাদের হেফাজতে নিতে হবে যাতে পুণ্যার্থীরা বা দর্শনার্থীদের মধ্যে কোন আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি না হয়। আর পুলিশ যদি জোর করে ওই ছাপরার মধ্যে ঢুকতে যায় তাহলে ক্যাজুয়ালিটির সম্ভাবনা থেকে যায়। শত্রুদের হাতে কি ধরনের অস্ত্রশস্ত্র আছে তা কারোর জানা নেই। প্রাণ বাঁচাতে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে শত্রুরা। সেই হিসাবে অ্যাডিশনাল ফোর্স নিয়োগ করা হলো। দায়িত্ব দেয়া হলো অনুজ ভার্মাকে। ঠিক হল বড়সাহেবের সাথে পরামর্শ করে তবেই শুরু করা হবে অপারেশন।
পুলিশের এই সাজ সাজ রব দেখে উৎসুক জনতা আশেপাশে অনেক ভিড় জমাল। বেলা ক্রমশ গড়াতে থাকল। কিন্তু ছাপরা ঘরের মধ্য থেকে কোন লোকজন বেরিয়ে এলো না। রাউত সাহেব তখন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। তার অনেকদিনের স্বপ্ন আজ সফল হতে চলেছে। আজ এই ছাপরা ঘর থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা অ্যারেস্ট করতে সক্ষম হবে বাংলার ত্রাস, ডাকু পলাতককে এবং তার সঙ্গী সাথীদের। সমস্ত দৈনিকে বড় বড় হরফে ছাপা হবে তার ছবি। পলাতকের ছবি। লোকে বাহবা দেবে তাকে। মুখে মুখে ফিরবে তার নাম।কিন্তু কিছুতেই তো ছাপরা থেকে বার হচ্ছে না পলাতক এবং তার সঙ্গী সাথীরা। তারা কি তাহলে বুঝতে পেরেছে, পুলিশ তাদের ঘিরে রেখেছে। বাইরে বের হলেই তাদের বিপদ। হলেও তা হতে পারে। ছাপরা ঘরের বাইরে থেকে ভেতরে কিছু দেখা না গেলেও ভেতর থেকে বাইরেটা ভালই দেখা যায়। তারা অবশ্যই বুঝতে পেরেছে তাদেরকে পুলিশ ঘিরে রেখেছে। তাই তারা সাহস করে বাইরে বার হচ্ছে না কেউ। আর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে পুলিশ প্রশাসনের। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগছে এত ফোর্স অফিসার নিয়ে কেন আমরা মিছেমিছি বাইরে অপেক্ষা করছি?
দেখতে দেখতে সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। সন্ধ্যা নামলেই কেলোর কীর্তি হবে। ছুঁচো গেলা সাপের মত অবস্থা হবে। সুতরাং যা করার তা দিনের আলোর মধ্যে করতে হবে। একথা ভেবে জুনিয়রদের সাথে আবার একপ্রস্থ আলোচনা করে নিলেন রাউত সাহেব। ফোনে জানিয়ে দিলেন উপরওলা সাহেবদের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে। সাহেবকে তারা বলে দিলেন গুলিগোলা না চালাতে। রাউত সাহেব ভাবলেন, চারজন লোককে ধরতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।
সেইমতো ছাপরর চারপাশের গোলাকার বৃত্তকে ধীরেধীরে ছোট করতে শুরু করল মোতায়েন থাকা পুলিশ অফিসাররা। একসময় তারা ছাপরার পাঁচ হাত দূরত্বে পৌঁছে গেল। আর ঠিক সেইসময় দুম দুম করে দুটো বোম ফাটার আওয়াজ হল। সেই আওয়াজে খুব ভয় পেয়ে গেল পুলিশ ফোর্সরা। তারা তাদের বন্ধু উঁচিয়ে ধরল। এভাবে বেশ কিছুক্ষন নিস্তব্ধতায় কাটল। আওয়াজটা বোম ফাটার না পটকার,তা অনুমান করতে পারল না কেউ। কয়েকজন অতি সাহসী ফোর্স অফিসার আরও কিছুটা এগিয়ে গেল। একেবারে হোগলায় ঘেরা ছাপরার কাছে। আর তখনই কালী পূজার পটকা ফাটার মত দুমদাম করে আওয়াজ হতে শুরু করল। সেই কারণে কেউ হতাহত না হলেও আগুন ধরে গেল গোটা ছাপরায়। চোখের সামনে ভষ্মিভূত হয়ে গেল গোটা ছাপরা ঘরটা।
দৃশ্য দেখে কপালে হাত রাউত সাহেবের। অন্যান্য সাহেবরাও চিন্তিত।কনস্টেবলদের মুখে হাসি।শালা মরেছে ঠিক হয়েছে এমন ভাব। জীবিত অবস্থায় পলাতকদের ধরতে পারা গেল না ভেবে আক্ষেপে ভরে উঠল সাহেবদের মন। দুঃখে ম্রিয়মান যতীন দারোগা।শেষ পর্যন্ত এইভাবে আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেল পলাতকের জীবন!
কিন্তু পলাতক যে মারা গেছে, সেইসাথে আরও তিনজন তার সাগরেদ মারা গেছে, এ ঘটনা চোখের সামনে ঘটলেও তার প্রমাণ কোথায়? লোকগুলির পরিচিতি বা কি? এসব প্রশ্ন উঠবে আদালতে। জনতার দরবারে। সুতরাং লাসগুলো আইডেন্টিফাই করা দরকার। ছবি তুলে রাখা দরকার। ডি.এন.এ পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু তার আগে ছাপরা ঘরের ভষ্মিভূত স্তুপ পরিষ্কার করা দরকার। তা অত্যন্ত সাবধানতার সাথে। কে জানে ওই স্তূপের মধ্যে আরো কোন বোম অক্ষত অবস্থায় আছে কিনা! তাই রাউত সাহেব স্নিপার ডগ দিয়ে আগে তদন্ত করিয়ে নিলেন। সন্দেহমুক্ত হয়ে তিনি জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য লোক নিয়োগ করলেন। তারা সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলল। কিন্তু কোথাও কোনো লাস দেখা পেল না। তাহলে লাসগুলো গেল কোথায়? সবদিকে তো পুলিশ মোতায়েন ছিল। পালিয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল না। তবুও সাহেব জিজ্ঞেস করে নিলেন। তারা দৃড়তার সাথে জানিয়ে দিলো তাদের ঘেরাটোপ থেকে কেউ পালিয়ে যাইনি। সাহেবের মনে শঙ্কা জাগল। ব্যাপারটা বোঝার জন্য যে জায়গাটায় ছাপরার ঘরটা ছিল সেখানে গেলেন। আর সেখানে যেতেই তার একটা পা ঢুকে গেল বালির ভিতরে। কোনক্রমে পুলিশেরা তাউকে টেনে তুলল। ঘটনাটা মাথায় স্ট্রাইক করল রাউত সাহেবের। তিনি বললেন--এখান থেকে আলগা বালিগুলো সরাবার ব্যবস্থা করুন তো।
যা মনে সন্দেহ করেছিলেন, সেটাই বাস্তবে দেখা গেল। বালি সরাতে সরাতে তারা লক্ষ্য করলেন সেটা আসলে একটা সুরঙ্গ। ছাপরার মধ্য দিয়ে সেই সুড়ঙ্গটি চলে গেছে গঙ্গাসাগরের দিকে। রাউত সাহেব বুঝতে পারলেন এটা পলাতকেরই কারবার। পালিয়ে বাঁচার আগাম পরিকল্পনা আগেই করে রেখেছিল পলাতক। বিপদের মধ্যে পড়েও সুরক্ষিত পথ দিয়ে সবার অলক্ষ্যে পালিয়েছে। যাতে পুলিশ প্রশাসনের দৃষ্টি ছাপড়া ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকে তার জন্য বাজি পটকা ফাটিয়ে আগুন লাগানো হয়েছে ছাপরা ঘরে। কিন্তু পালিয়ে গেলে তাদের তো জলপথে যেতে হবে। তাই সাথে সাথে রাউত সাহেব তাকিয়ে দেখলেন গঙ্গাসাগরের দিকে। বাইনাকুলার চোখে লাগিয়ে এদিক ওদিক খুঁজে দেখলেন। কিন্তু ঠাওর করতে পারলেন না। শতাধিক ভেসেলের মধ্যে কখন, কিভাবে পালিয়েছে তা খুঁজে বার করা খুব দুষ্কর। এমন সময় রাউত সাহেবের মোবাইল ফোনটা মিষ্টি সুরে বেজে উঠল। অচেনা নাম্বার। তবুও ফোনটা ধরলেন রাউত সাহেব। কে জানে, যদি কোন সোর্স ইনফরমেশন দেয়।
'হ্যালো' বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে শুনতে পেলেন এক আগন্তুকের গলা।
- ধন্যবাদ স্যার! আমি পলাতক বলছি। আমার মিশন সাকসেসফুল। আমরা আমাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছি। আর মিছিমিছি খোঁজাখুঁজি করে লাভ নেই। আশাকরি খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে আমাদের।
এ কথা বলেই ফোন কেটে দিল পলাতক। কিছু বলার অবকাশ পেলেন না রাউত সাহেব। আক্ষেপে, অভিমানে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে থাকলেন। এভাবে পলাতক যে তার সব আশা-আকাংখা, স্বপ্ন নস্যাত করে দিয়ে যাবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি তিনি।
মিত্র সাহেব এবং যতীন দারোগা মুখে কিছু বলুন না বলুন, মনে মনে খুব সন্তুষ্ট হলেন।