জানা অজানা । ফাল্গুন ১৪৩১



  দর্শন










সুদীপ্ত শেখর পাল

কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ




 

‘দর্শন’ শব্দটির অর্থ যে দেখা, এটা মেনে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয় । কিন্তু এই দর্শনের ইংরাজী প্রতিশব্দ যখন বলি philosophy, তখন সন্দেহ হয়, দর্শন কথার অর্থ কি শুধুই দেখা, না কি অন্য কিছু! 

    দেখা মাত্রেই যদি দর্শন বলি তাহলে প্রথম আপত্তিটা উঠবে দার্শনিকদের পক্ষ থেকেই তাদের কেউ না কেউ অবশ্যই বলবেনসবাই তো দেখেচোখ থাকলেই দেখে। তাহলে আমাদের বিশেষত রইল কীচাষী দেখেকুমোর দেখেশিল্পী দেখে– এদের সবাই কি দার্শনিক নাকি!  প্রশ্ন আমারও

    এটা নিশ্চয় মেনে নেবেন যেমানুষের আদিম চাহিদা অন্নবস্ত্র ও বাসস্থানতবে এই তিনিটি জিনিসের নিশ্চয়তা দিয়ে কাউকে যদি এক যায়গায় বসিয়ে রাখা যায় তাহলে সে কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে পড়বে ‘কিছু’ একটার সন্ধানে। কেউ বলবে শান্তির সন্ধানেকেউ বলবেন সুখের সন্ধানেকেউ বা বলবে জ্ঞানের সন্ধানে তারা বেরিয়ে পড়েছে। কেউ বা নির্দিষ্ট করে কিছু বোঝাতে না পারলেও কিছু একটার সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে। আসলে ঐ তিনিটি অত্যাবশ্যকীয় আদিম চাহিদা নিরসনের পরেও যাদের মনে হয়েছে তাদের জীবনে তখনো কিছু অভাব রয়ে গেছে তখন সে সেই অভাব নিরসনে সচেষ্ট হয়েছে

      সুখশান্তিআনন্দজ্ঞান এগুলি এক একটা শব্দ এগুলির ধ্বনি যখন কারো কানে প্রবেশ করে তখন তার মননে একটি বিশেষ ভাবের সৃষ্টি করে তবে বক্তার যে ভাব থেকে ‘সুখ’ কিংবা সমজাতীয় শব্দ সৃষ্টি হয়শ্রোতার মননে সবসময় ঠিক সেই ভাব সৃষ্টি নাও হতে পারে যার সুখের সঙ্গে কোন পরিচয় নেই অর্থাৎ সুখের কোন অনুভূতি নেই তার কাছে সুখ শব্দটী অর্থহীন। তেঁতুলের নাম শুনলে মুখে তাদেরই জল আসবে যারা আগে তেঁতুল খেয়েছে

    তেঁতুলের উদাহরণ আমি কেন দিলামকারণ আমি যাদের বলছি তারা তেঁতুল কী তা’ জানে। এই হল উপমা দ্বারা প্রমাণের চেষ্টা দর্শন শাস্ত্রের গোড়ার কথা হল প্রমেয় আর প্রমান যা’ প্রমান করতে হবে তাই হল প্রমেয় আর প্রমান করার পদ্ধতি হল ‘প্রমান’

    কোন কিছু প্রমান করতে গেলে আগে উপলব্ধির প্রয়োজন যেমনপড়ার আগে সেটা লেখার দরকার আবার যেটা লেখা হবেলেখার আগে তাকে মনে আসতে হবে যদি প্রশ্ন করা হয়মনেই বা এল কেনউত্তরে বলা যায়যে কারণে জীব-পরিমণ্ডলে বিবর্ত্তন ঘটেছে ও ঘটে চলেছে ঠিক সেই রকম কারণে কারো কারো মনে প্রশ্ন জাগে প্রশ্ন নিরসনের আকূল সম্বেগ সাহায্য করে সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে। 

    সভ্যতার উষালগ্নে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মানুষ জনের মধ্যে প্রায় সমজাতীয় প্রশ্ন জেগেছিল। আর সেই প্রশ্নের নিরসন করতে আবির্ভূত হয়েছে দর্শন শাস্ত্র

    ভারতবর্ষের কথা প্রথম ধরা যাকঋগবেদ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এ নিয়ে দ্বিমত না থাকলেও এর রচনাকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। খৃষ্ট জন্মের ১২০০ থেকে ৫০০০ বছর আগে পর্যন্ত বিস্তৃত সুদীর্ঘ্য কালের মধ্যে এই গ্রন্থের রচনা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেখানে ছিল একটি আদিম প্রশ্নযা’ অপূর্ব কাব্যময় ও দর্শন শাস্ত্রের বীজ

 

তখন না ছিল প্রাণ হীননা ছিল প্রাণী

না ছিল বাতাসনা ছিল আকাশ অপরান্ত

কী ছিল গতিকোথায় কার নির্দেশ মানি?

ছিল কি জলআর গভীর অতল অতলান্ত?

তখন ছিল না মরণনা ছিল অমরণ

দিন বা রাত্রির সাথে না ছিল মিল কিছু

বায়ুহীন রূদ্ধ শ্বাস প্রশান্তি এক এর তাড়নায় সঘন

আর কিছু নয়কিছুই ছিল না এর পিছু

কে সঠিক জানেকে এখানে বলতে পারে

কখন তাঁর জন্মকোথায় এই সৃষ্টির গোড়া পত্তন?

ছিল কি দেবতারা ছিল কি তখন পশরা নিয়ে দ্রষ্টার দ্বারে?

কে জানে তবে কোঠায় তার উদয়ন?

 

    এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই সৃষ্ট হল বহু মতবাদ। এগুলির পরস্পরের  মধ্যে কোথাও মিল আছে কোথাও অমিল আছে। তবুও প্রতিটি  মতবাদ তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য এক একটি নামে পরিচিত। যেমন সাংখ্য দর্শনন্যায় দর্শনবৌদ্ধ দর্শন ইত্যাদি। মতবাদ প্রমাণ করার জন্য যারা বেদের সাহায্য নিলেন তাদের দর্শন কে বলা হল আস্তিক দর্শন আর অন্য গুলি হল নাস্তিক দর্শন। আমাদের আস্তিক দর্শনের সংখ্যা ছয় ও নাস্তিক দর্শনের সংখ্যা তিন।  

    এখনকার ইস্কুল কলেজে যে সমস্ত বিষয়ে পাঠদান করা হয় তার অধিকাংশ বিষয়ের শুরুতে যে মানুষটির নাম উঠে আসেতিনি হলেন এরিস্টটল। এক অনন্য সাধারণ চিন্তা শক্তির অধিকারী এই ব্যক্তির পরিচয় দার্শনিক হিসাবে। খৃষ্ট পূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর সক্রেটিসের (জন্ম ৪৭০ খৃঃ পূঃ) দার্শনিক ভাবনা তাঁর শিষ্য দার্শনিক প্লেটোর মাধ্যমে এসেছিল এরিষ্টটলের মধ্যে। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণঘটে চলা ঘটনাবলী সংশ্লেষন ও বিশ্লেষণ সহকারে দেখার মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজেদের মত প্রকাশ করতেন সাধারণ ভাবে এই মতবাদ গুলোকে দার্শনিক মতবাদ বলে থাকি। পরবর্তীকালে সেই মতবাদ গুলো যখন পরীক্ষাগারে পরীক্ষিত হয়েছেকিংবা অঙ্কের সূত্রে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে তখন তাকে নিয়ে এসেছি বিজ্ঞানের আঙিনায়। সে সব বিষয়কে আর দর্শনের বিষয় বলা হয় নাযেমন বৈশেষিক দর্শনে ঋষি কণাদ পরমাণুর কথা বলেন সে সব ধারণা আধূনিক জ্ঞানের আলোকে অক্ষরে অক্ষরে সত্য নয়যেমন সত্য নয় উনবিংশ শতকে প্রকাশিত  ডালটনের পরমাণুবাদ। তবুও আমরা ডালটনকে মনে রেখেছি বিজ্ঞানী হিসাবে আর ঋষি কণাদকে মনে রেখেছি দার্শনিক হিসাবে পরমাণুবাদের মত দর্শন থেকে বিজ্ঞানের আঙিনায় এসেছে যোগ দর্শনের আসনমুদ্রা ও প্রানায়াম এই দর্শনে চিত্ত বা মন নিয়ে আলোচনা হয়েছেএখন মন সম্বন্ধীয় আলোচনার জন্য মনোবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে।তাই বলা হয়দর্শন হল বিজ্ঞানেরও বিজ্ঞান

    বিজ্ঞান দৈনন্দিন কাজে লাগেদর্শনের যে বিষয় গুলো বিজ্ঞানের আঙিনায় আসেনি সেই সব দর্শন কি বাস্তবে কাজে লাগেএই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের একটু ভাবতে হবেবিজ্ঞানের আবিস্কার দ্বারা আমরা আসলে কী চাই। ক্রমাগত নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে একসময় কোন না কোন ভাবে চলে যাই দর্শনের আঙিনায়। যেমন বিজ্ঞানের আবিস্কারের সাহায্যে আমরা পেতে চাই দেহের আরাম। দেহের আরামের মধ্যে যদি খুঁজি মানসিক শান্তি তবে চলে যেতে হবে দার্শনিকতার মধ্যে কেননা ‘শান্তি’ কিংবা ‘দুঃখ’ বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় নয়। তাকে পরিমাপ করা যায় নাউপাদানে বিশ্লেষণ করা যায় নাতৈরিও করা যায় না। দুঃখের স্বরূপ আর নিরসন করে শান্তির উপায় পাই বৌদ্ধ দর্শনে। এই ভাবে বিজ্ঞানের মতোই দর্শন আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গীভাবে। আজও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোন গবেষণার স্বীকৃতির (PhD) মধ্যে থাকে Philosophy শব্দটিযার বাংলা প্রতিশব্দ ‘দর্শন’ 

 

 


আরও পড়ুন  -


শূন্যের আবিস্কার ও গুরুত্ব


ধীরে ধীরে জ্ঞানের গভীরে


ছবি আঁকার পথে মানুষের বিচরণ


বেচারা তিমি


নানা রকম দেখা


মাধ্যাকর্ষণের পথ ধরে


ইংরাজি ভাষা ও তার অক্ষর পরিচয়