গল্প - রক্তের লিখন - অনন্যা দাশ । ফেব্রুয়ারি - ২০২৪


  রক্তের লিখন








অ ন ন্যা
দা শ 






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

    রিন্টি আর গুগাইয়ের বাবার বন্ধু অনিমেষ জেঠু পুলিশে কাজ করেন। ওদের বাড়িতে বেড়াতে এলেই নিজের কাজের জায়গা থেকে পেঁচালো রহস্য ঘটনা বলে ওদের পরীক্ষা নেন

    জেঠু বলেন, “মগজ জিনিসটা না ঠিক লোহার মতন বুঝলি রিন্টি-গুগাই। ব্যবহার না করলেই মরচে পড়ে যায়! সেই জন্যেই সুযোগ পেলেই তোদের ব্রেন সেলগুলো ঠিক মতন কাজ করছে কিনা পরীক্ষা করে দেখি!

    রিন্টি আর গুগাই অবশ্য গল্প শুনতে পেয়েই খুশি

    যেমন সেদিন এসেই বললেন, “আজ একখানা তাগড়াই রহস্য গল্প আছে তোদের জন্যে! দেখি তোরা সমাধান করতে পারিস কিনা! তবে দাঁড়া আগে চা টা আসুক।

    গুগাই জেঠুকে খুশি করার জন্যে চট করে বলল, “জেঠু আপনি আসবেন বলে মা আজ আলুর চপ বানিয়েছে।

    তাই শুনে জেঠু বললেন, “আহা! এই বৃষ্টির দিনে চা আর চপ জমবে ভালো।

    চা আর চপ পেয়ে জেঠু শুরু করলেন

    বিচারপতি সুবিমল গুহ খুব নামকরা লোক। ডাকসাইটে জজ আর সবসময় সুবিচার করার চেষ্টা করে বলেই লোকে জানে। কিন্তু মুশকিল হল ওই রকম পদে থাকলে মানুষের অনেক শত্রু তৈরি হয়ে যায়। সুবিমল বাবুরও তাই হয়েছিল। কাউকে জেলে পাঠালেন তো তার আত্মীয় স্বজনরা খেপে গেল। কাউকে প্রাণদন্ড দিলে তো আরো বিপদ! সেই রকম কিছু রেগে যাওয়া লোকজনের কাছ থেকে নিয়মিত হুমকি চিঠি পেতেন সুবিমলবাবু। প্রথমের দিকে ততটা তোয়াক্কা করতেন না কিন্তু তারপর প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি চিঠি আর ইমেল আসতে পুলিশের কাছে গেলেন তিনি। পুলিশ বলল শহরে অসংখ্য লোক নাকি ওই রকম চিঠি পায়। পুলিশের অত লোকবল নেই যে সবাইকে সুরক্ষা দিতে পারে। তাই শুনে সুবিমলবাবু নিজেই একজন দেহরক্ষী ভাড়া করলেন স্থানীয় এক কোম্পানি থেকে। বছর পঁচিশেকের একজন ছেলে। ভালো স্বাস্থ্য। ক্যারাটে ইত্যাদি জানে। নাম পুলকরাজ মেহতা। সুবিমলবাবুর একমাত্র ছেলের নামও পুলক তাই এই ছেলেটিকেই বিশেষভাবে পছন্দ হয়ে গেল ওঁর। এর পর ছেলেটা সব জায়গায় যেত জজ সাহেবের সঙ্গে

    তারপর একদিন জজ সাহেবের বিশিষ্ট বন্ধু রাজকুমার অগ্রওয়ালের বাড়িতে একটা পার্টিতে আমরা সবাই গেলাম। অগ্রওয়াল সাহেবের ছেলে প্রদীপ ডাক্তারি পাশ করেছে সেই উপলক্ষে পার্টি। প্রদীপ আবার তোদের বুবলাইদার ভালো বন্ধু, সেই সূত্রেই আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজন। তা খাবার শেষ করে আইসক্রিমটা সবে খেতে শুরু করেছি এমন সময় রাজকুমার অগ্রওয়াল হন্ত দন্ত হয়ে এসে হাজির। আমাকে বললেন, “এখুনি আমার সঙ্গে আসুন। সাংঘাতিক কান্ড ঘটে গেছে!

    ডিউটির তাড়া তাই আইসক্রিমের কাপ নামিয়ে রেখে রাজকুমার অগ্রওয়ালের পিছন পিছন গেলাম। একতলার একেবারে শেষ প্রান্তের একটা ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পরে রয়েছেন জজসাহেব। রক্তে ভেসে যাচ্ছে কার্পেট। ভারী কিছু দিয়ে ওঁর মাথার পিছনে বাড়ি মারা হয়েছে। মৃতদেহের পাশের দেওয়ালে রক্ত দিয়ে ইংরেজিতে লেখা ‘Raj K’জজসাহেবেই লিখেছেন সেটা তাতে সন্দেহ নেই। খুনির পরিচয় জানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।

    এতটা বলে অনিমেষ জেঠু একটা কাগজে ওদের লিখে দেখালেন লেখাটা। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “পুলক আমার পাশেই দাঁড়িয়ে হায় হায় করছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে আমার লোকজনকে ডেকে পাঠালাম। সবাইকে ওই ঘর থেকে সরিয়ে অন্য ঘরে নিয়ে গেলাম। রাজকুমার অগ্রওয়ালকে জিগ্যেস করলাম, “কে দেখল ওঁকে প্রথম?”

    তিনি পুলকের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালেন। পুলক হাঁউ মাঁউ করে কেঁদে উঠে বলল, “শুধু আমি ছিলাম না। আমার সঙ্গে ক্যাটারারের একজন লোক ছিল। আসলে স্যার বলছিলেন ভিড়ের মধ্যে থাকতে ভালো লাগছে না। শরীরটা কেমন করছে। ‘একটু নিরিবিলিতে বসতে চাই’ বলে নিজেই ওই ঘরটাতে গিয়ে বসলেন। আমাকে বললেন, ‘আমার যা বয়স হয়েছে তাতে এই সব পার্টি ইত্যাদি আমার আর ভালো লাগে না। যাক এখানে বসে ভালো লাগছে। তুমি বরং একটা কাজ করো। আমার জন্যে এক বোতল ঠান্ডা জল আর কিছু খাবার এনে দাও।‘ আমি বললাম, ‘কিন্তু স্যার, আপনাকে একা ফেলে যাব?’ তাই শুনে উনি বললেন, ‘ধুস্‌। এত লোকের মধ্যে কে আবার কী করবে?’ আমি তাই ওঁকে একা ফেলে রেখে জল আর খাবার আনতে চলে গেলাম। সেটাই আমার সব চেয়ে বড়ো ভুল হয়ে গেল! ফিরে এসে দেখলাম ওই দৃশ্য। হায় হায়!

    কতক্ষণ পরে ফিরেছিলে তুমি?”

    ঠিক বলতে পারব না। দশ পনেরো মিনিট তো হবেই। আসলে উনি ঠান্ডা জল চেয়েছিলেন বলে সময় লেগে গেল। ক্যাটারারের লোকজনকে বলে বোতল বার করাতে হল। তাতেই দেরি হয়ে গেল। কেউ মনে হয় নজর রাখছিল। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ঘরে ঢুকে…। আমি বোতল নিয়ে এলাম আর ক্যাটারারের ছেলেটা আমার সঙ্গে খাবারের প্লেট নিয়ে এল। আমরা ঢুকেই দেখলাম স্যার পড়ে রয়েছেন। আমরা তখন গিয়ে অগ্রওয়াল সাবকে ডেকে নিয়ে এলাম।

    অগ্রওয়ালও রক্ত দিয়ে লেখাটা দেখেছেন। তাঁর মুখ ফ্যাকাসে। আমাকে বললেন, “আপনার তো আমাকেই সন্দেহ করবেন বুঝতে পারছি! হায় হায়, এমন খুশির দিনে এটা কী হয়ে গেল!

    আমার সাঙ্গপাঙ্গরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ল। দেখা গেল সারা পার্টিতে এমন তিনজন রয়েছে যাদের নাম মিলে যাচ্ছে। রাজকুমার অগ্রওয়াল ছাড়াও রাজকিশোর মেহতা বলে নিমন্ত্রিত একজন আর রাজকমল ঝা ক্যাটারারদের সঙ্গে এসেছে

    রাজকিশোর মেহতাকে জিগ্যেস করতে তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি জজ সাহেবকে বিলক্ষণ চিনি। অনেকদিন আগে আমাদের কোম্পানিতে জালিয়াতির একটা ঘটনা ঘটেছিল তখন উনি বিচারক ছিলেন। তবে সেই কেসটার সমাধান হয়ে গেছে এবং আসল দোষী শাস্তিও পেয়ে গেছে।

    রাজকমল ঝা তো ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিল। সে আমাকে বলল, “আমি কিছু জানি না সাবজি। উনি কে? আমি তো রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। মহেশ আমার সঙ্গে ছিল সব সময়। আপনি ওকে জিগ্যেস করে দেখুন, আমি ওখান থেকে নড়িনি।

    ক্যাটারারদের যে ছেলেটা পুলকের সঙ্গে ঘরে ঢুকেছিল তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। তার অবস্থাও ভয়ে একাকার। তার নাম বলাই। তাকে তো নির্দোষ বলেই মনে হল

    এদিকে রাজকুমার অগ্রওয়াল সম্পর্কের বরঞ্চ খবর ভালো পাওয়া গেল না। জানা গেল যে তাঁর সঙ্গে সুবিমলবাবুর বেশ খিটিমিটি চলছিল। রাজকুমার অগ্রওয়াল ব্যবসায় কারচুপি করছিলেন আর সুবিমলবাবু সেই খবর পেয়ে খুব রেগেছিলেন। নেহাৎ ছেলের ডাক্তারি পাশের পার্টি তাই এসেছিলেন নাহলে ওঁর আসার কোন ইচ্ছেই নাকি ছিল না। রাজকুমার অগ্রওয়ালের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করেছিলেন জজসাহেব এবং বলেছিলেন অগ্রওয়াল কারচুপি বন্ধ না করলে চেম্বার অফ কমার্সে ওর নামে রিপোর্ট করে দেবেন। এদিকে খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল রাজকিশোর মেহতাদের অফিসের জালিয়াতির কেসটাও নাকি আবার রিওপেন হয়েছে নতুন কিছু প্রমাণ পাওয়ার দরুন। প্রমাণ কার দিকে ইঙ্গিত করছে জজসাহেব সেই সব কথা জানতেন কিন্তু কোম্পানির অন্যরা কেউ মনে হয় জানত না। শুধু মাত্র রাজকমল ঝার সঙ্গে কোন ডায়রেক্ট যোগাযোগ পাওয়া গেল না। সে সত্যিই পুরো সময়টা রান্নাঘরেই ছিল। এবার তোরা তোদের মগজের রশদ খাটিয়ে বল দেখি সুবিমলবাবুকে কে মেরেছিল?”

    রিন্টি সব নামগুলোকে কাগজে লিখে ফেলেছিল। সেগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ জিগ্যেস করল, “আচ্ছা জেঠু এমনও তো হতে পারে যে পুরো কথাটা জজ সাহেবের লেখা নয়?”

    জেঠু শুনে বললেন, “মানে?”

    মানে জজ সাহেব হয়তো রাজ কথাটা লিখে আর লিখতে পারেননি, পরে কেউ কে অক্ষরটা জুড়ে দেয়!

    জেঠুর ঠঁটে একটা হাল্কা হাসি দেখা দিল, “ওই কথা কেন বলছিস?”

    রিন্টি বলল, “জজসাহেব নিজের বডিগার্ডকে কী বলে ডাকতেন? ওকে যদি উনি রাজ বলে ডাকতেন তাহলে সব হিসেব মিলে যাচ্ছে! খুব সম্ভব পুলকরাজকে উনি রাজ বলেই ডাকতেন কারণ ওঁর নিজের ছেলের নামও পুলক। যে কারণেই হোক পুলক বডিগার্ড জজসাহেবকে মেরে জল আনতে বেরিয়ে যায়। ওর উদ্দেশ্য ছিল অন্য একজন কাউকে সঙ্গে করে আনবে যাতে ওর ঘাড়ে দোষ চাপার সম্ভাবনা আরো কমে যায়। বলাইকে নিয়ে ও যখন ঘরে ঢোকে তখনই সে দেখতে পায় লেখাটা। বলাই খুবই বিচলিত ছিল তাই ওর দৃষ্টি এড়িয়ে চট করে কে লিখে ফেলাটা কঠিন কাজ ছিল না। নিজেকে বাঁচাতে ওই কাজটা করতে হল তাকে। কে লিখে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়েছিল তার। পুরো লেখাটাকে মুছে ফেলতে গেলে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদিও অন্যদের নামে কে অক্ষরগুলো জের ঠিক পরেই, কোন স্পেস নেই, বোঝাই যাচ্ছিল ওটা এমন কেউ লিখেছে যার সেই দিকে খেয়াল নেই। এ ছাড়া রাজকমলের সঙ্গে জজসাহেবের কোন সম্পর্ক ছিল না আর সে রান্নাঘর থেকে বেরোয়নি তাই সে খুনি হতে পারে না। রাজকিশোর মনে করছিলেন কোম্পানির কেসের সমাধান অনেকদিন আগেই হয়ে গেছে। তাই তাঁর জজসাহেবকে মারার কোন কারণ নেই। রাজকুমার অগ্রওয়ালের বাড়িতে পার্টি, তিনি নিজের ছেলের অত বড়ো একটা মুহূর্ত কেন শুধু শুধু নষ্ট করতে যাবেন জজসাহেবকে খুন করে?”

    জেঠু শুনে বললেন, “ঠিক ধরেছিস! সেটাই ঘটেছিল। বডিগার্ড পুলককে নিজের ছেলের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলার জন্যেই জজসাহেব তাকে রাজ বলে ডাকতেন। তাই রাজ লেখাটা দেখে পুলকের ভয় পেয়েছিল। নিজের ওপর থেকে সন্দেহ সরাবার জন্যেই সে কে অক্ষরটা লিখে দিয়েছিল সবার নজর বাঁচিয়ে। ওর বাবাকে নাকি প্রাণদন্ড দিয়েছিলেন জজসাহেব, সেই থেকেই ওঁর ওপর রাগ পুলকের। যাই হোক সে এখন আমাদের হেফাজতে, জেলের ঘানি টানছে। তবে সব থেকে বড়ো আশ্চর্যের ব্যাপার হল মাথায় অত ভয়ঙ্কর বাড়ি খেয়েও জজসাহেব মারা যাননি! পুলক ভেবেছিল ওঁকে শেষ করে ফেলেছে কিন্তু ডাক্তার এসে দেখেন খুব ক্ষীণ হলেও নাড়ি চলছে! হাসপাতালে বেশ কিছুদিন কোমায় থাকার পর জজসাহেবের জ্ঞান ফেরে এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন

    যাক রিন্টির মগজে তো মরচে ধরেনি বোঝা গেল। এখন গুগাইয়েরটা কী অবস্থায় আছে সেটাই প্রশ্ন!