রণজিৎ সরকার

     

  ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ              মজুমদার









রণজিৎ সরকার




 

এখন জীবন কাটে পুরোনো দিনের স্মৃতি আঁকড়ে। ফেলে আসা কত মধুর স্মৃতি হাতছানি দেয়। এমন সময় নাতি বুবাই লাফাতে লাফাতে এসে হাজির। এবারে বাৎসরিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে ক্লাস সেভেনে উঠেছে বুবাই। আজ তাদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ছিল। পুরস্কার হিসেবে দুটো বই পেয়েছে। একটি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের মিঠেকড়া শ্রেষ্ঠ ছড়া। অপরটি ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দার প্রথম খণ্ড। ওর আনন্দে আমরও আনন্দ হল। ও জিজ্ঞেস করল, “দাদু, তুমি এঁদের চেনো?”

মৃদু হেসে বললাম, “চিনি তো।

বুবাই উত্তেজিত।—কী করে চিনলে?”

সে এক মজার গল্প দাদুভাই।

বলো না, বলো না দাদু।

সে অনেক কাল আগের কথা। ধুবুলিয়া নামে একটা অঙ্গরাজ্য আছে কৃষ্ণনগরের। এই অঙ্গরাজ্যের রাজা ছিলেন শ্যামাপ্রসাদবাবু। তিনি আবার ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। তাঁর আবার তিতলি নামে একটি ছোটোদের পত্রিকা ছিল। উনি একবার সাহিত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কথা ভাবলেন। চতুর্দিকে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ জানিয়ে। আমন্ত্রণ পত্র পাঠালেন দেশে-বিদেশের বড়ো বড়ো রাজরাজড়াদের। পাত্র-মিত্র সহযোগে অনেকেই আসবেন কথা দিলেন। সেই সাহিত্য অনুষ্ঠানে আমিও বহরমপুর রাজ্য থেকে পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট দিনে সামান্য সাধারণ প্রজার মতো। এলাহি আয়োজন, দাদুভাই। অনুষ্ঠান স্থলের অনেক আগেই ছ্যাকড়া গাড়ি থেকে নামতে হল যানজট এড়ানোর জন্য। বড়ো বড়ো রথের ঘড়ঘড় আওয়াজে চারদিক চকিত। তাদের যত্ন করে সভাস্থলে পৌঁছে দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। দূর থেকে দেখলাম ছড়ার রাজকুমার ভবানীপ্রসাদবাবু স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছেন সভাস্থলের দিকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায়। পাশে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের রথের ধ্বজা পতপত করে উড্ডীন। সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থাকি। ভিড়ের ভেতর ঠোক্কর খেতে খেতে কোনোক্রমে এগিয়ে চলেছি।

তারপর, তারপর দাদু? তুমি নিশ্চয়ই ছড়ার রাজকুমারকে ধরে ফেললে?”

দাদুভাই, আমার সে-ক্ষমতা কি আছে! একসময় ওঁরা আমার চোখের আড়ালে চলে গেলেন। সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠান শুরু হল একসময়। প্রথমেই দুই রাজকুমার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার আর ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়কে পুষ্পস্তবক দিয়ে বরণ করে নেওয়া হল। পরে শুরু হল অনিন্দিতা পাল স্মৃতি সাহিত্য প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। আমার নাম ডাকা হচ্ছে প্রথমেই। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ছোটোদের গল্প লিখিয়ে হিসেবে এই পুরস্কার প্রাপ্তি। তাও আবার প্রথম পুরস্কার। ভিড় সরিয়ে যখন মঞ্চে এলাম, আমার বাহ্যজ্ঞান লোপ পাবার জোগাড়। সামনে ছড়ার রাজকুমার। আমি তখন হাওয়ায় উড়ে চলেছি।

দাদু, তুমি ছড়ার রাজকুমারকে ছুঁয়ে দেখলে?”

জানি না দাদুভাই। আমার তখন মনের অবস্থা বোঝানোর ক্ষমতা নেই। শুধু তাঁকেই দেখছি মুগ্ধ হয়ে। এ আমার পুরস্কারের চেয়েও বড়ো প্রাপ্তি। মঞ্চ থেকে নেমে এলাম ঘোরের ভেতর।

তারপর?”

তারপর শুরু হল ছড়াপাঠ। ছড়ার রাজকুমার ছড়া পড়লেন—জুতোর গুঁতোচারদিকে করতালির ধ্বনি বুঝিয়ে দিল তাঁর জনপ্রিয়তা। একে একে ছড়া পড়লেন বিখ্যাত অখ্যাত ছড়াকারেরা। এ-পর্বও মিটল শেষে। শুরু হল তাৎক্ষণিক ছড়া লেখা প্রতিযোগিতা। বিষয় উন্মুক্ত।

তুমি ছড়া লিখলে?”

আমি তো ছড়া লিখি না দাদুভাই। কিন্তু ওই যে ছড়ার রাজকুমার, উনি কী যে জাদু করলেন আমায় কে জানে। আমি লিখে ফেললাম আমার প্রথম অন্ত্যমিলযুক্ত ছড়া মাত্রাবৃত্তে।

তারপর?”

এরপর মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতি। বিরতি শেষে শুরু হল শেষ পর্বের অনুষ্ঠান। তাৎক্ষণিক ছড়া গড়া প্রতিযোগিতার ফলাফল।

তুমি এবারেও...

হ্যাঁ, এবারেও। এবারে অবশ্য তৃতীয় হিসেবে পুরস্কার জুটল। আশি জনে মতো ছড়াকার ছড়া লিখেছিলেন। প্রধান জাজ কে ছিলেন বলো তো? হ্যাঁ, উনিই।

বুবাই হাততালি দিয়ে উঠল

অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা হল সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে। এবার ফেরার পথ। গোধূলি বেলা বয়ে যায়। আমি দাঁড়িয়ে ছ্যাকড়া গাড়ি স্ট্যান্ডে। আমায় বিস্মিত করে ছড়ার রাজকুমারের রথ থেমে গেল আমার সামনে। দুই দিকপাল নেমে এলেন রথ থেকে। আমি বিহ্বল। এঁরা এতটাই সরল সাদাসিধে আর উদারমনস্ক মানুষ যে ভাবাই যায় না। আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। সে গল্প আর শেষ হয় না। আমি যেন ওঁদের কতকালের চেনা। ছ্যাকড়া গাড়ি একে একে যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে। আমাদের গল্প চলতেই থাকে। ফুরোয় আর না। বেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে। উশখুশ করে উঠি। বাড়ি ফিরতে হবে। মুখ ফুটে বলতেও পারছি না সে-কথা। কী করেই-বা বলি! শেষে বলব না বলব না করে বলেই ফেললাম সংকোচে। উনি ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, ‘আরে যাবে যাবে, অত তাড়া কীসের?’ আমার শেষ গাড়িটাও ছেড়ে গেল। এবার কী করে ফিরব!

সেদিন তুমি তাহলে ফিরতে পারলে না?”

পারলাম না।

সেদিন তবে তোমার খুব কষ্ট হয়েছিল, তাই না দাদু?”

তা একটু হয়েছিল বইকি। অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেই শারীরিক কষ্ট গৌণ হয়ে গেছিল দাদুভাই তাঁর সান্নিধ্যের অনুভবে। তুমি জানো, সেই ছড়ার রাজকুমার আজ ছড়া সম্রাট। তাঁর বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দাদা বলে ডাকার ছাড়পত্র দিয়েছিলেন। আমার যাওয়া হয়নি। একজন নগণ্য মানুষ আমি। কীভাবেই-বা যেতাম বলো! উনি আজ অসুস্থ। এসো, ভবানীদার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি।

  

<