বিশেষ - হিজ মাস্টার্স ভয়েস - কালীপদ চক্রবর্ত্তী । ফেব্রুয়ারি - ২০২৪

   


হিজ মাস্টার্স ভয়েস







কা লী প দ 
চ ক্র ব র্ত্তী






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

        অনেককেই হয়তো ছেলেবেলায় একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে, সেটি হল, “বলতো – হিজ মাস্টার ভয়েসের কুকুরটা স্ত্রী না পুরুষ”? সঠিক উত্তর হল পুরুষ। ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ কথাটির অর্থ হল ‘তার মনিবের কণ্ঠস্বর’। সেহেতু হিজ কথাটি পুংলিঙ্গ-বাচক, তাই এই কুকুরটিও পুরুষ। কুকুরটি নারী হলে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ না হয়ে ‘হার মাস্টার্স ভয়েস’ হত। কুকুরটির নাম ছিল নেপিয়ার। কুকুরটির ছবি এইচ এম ভি-র মনোগ্রামে কি ভাবে স্থান পেল তা নিয়ে একটি গল্প আছে।

        নেপিয়ার নামে একটি কুকুর ছিল। নেপিয়ারের মালিক ছিলেন ইংল্যান্ডের একজন নামকরা সঙ্গীত শিল্পী। হঠাৎ রোগাক্রান্ত হয়ে সেই ভদ্রলোক মারা যান। মনিবের মৃত্যুতে নেপিয়ার এমন ভেঙ্গে পড়ল যে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল। সেই মৃতশিল্পীর ভাই ছিলেন একজন আলোকচিত্র শিল্পী (আবার অনেকে বলেন তিনি ছিলেন একজন চিত্রকর। সাইনবোর্ড এবং অন্যান্য আঁকার কাজ করতেন)। তিনি যখন দেখলেন যে নেপিয়ার খাওয়া দাওয়া ছেড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে তখন তিনি তার ভাইয়ের গাওয়া একটি গানের রেকর্ড চালিয়ে দিলেন। নেপিয়ার সাথে সাথে উঠে গিয়ে বসল গ্রামোফোনের চোঙটার সামনে। প্রিয় মনিবের কণ্ঠ শুনে অঝোরে অশ্রু ঝরতে লাগল নেপিয়ারের দু’চোখ বেয়ে। এই করুণ এবং অদ্ভুত দৃশ্য সেই আলোকচিত্র শিল্পীর মনে দাগ কাটল। তিনি তার পুরানো মডেলের ক্যামেরাটা দিয়ে নেপিয়ারের ছবি তুলে ফেললেন। এই ছবিটাই তখন ‘ভিক্টর টকিং মেশিন’ নামে একটি রেকর্ড কোম্পানি কিনে নেয় তাদের মনোগ্রাম বানানোর জন্য। শুধুমাত্র তাই নয়, কুকুরটা সম্পর্কে সব শুনে কর্তৃপক্ষ এতই প্রভাবিত হয় যে তাদের কোম্পানির পুরানো নাম বদলে নতুন নাম রাখে – হিজ মাস্টার্স ভয়েস। এভাবেই নেপিয়ার স্থান পেয়েছিল গ্রামোফোনের রেকর্ডে রেকর্ডে।

        এর পর অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প আর  রূপকথাও লেখা হল সেই প্রভুভক্ত নেপিয়ার কে নিয়ে। এর একটি হল – বহুকাল আগে এক পাহাড়ের কাছে মায়ের সঙ্গে বাস করত ছোট্ট ছোট্ট দুই ভাই-বোন। বোনের বয়স ভাইয়ের থেকে বড়। তার নাম ছিল পাপিয়া। আর ভাইয়ের নাম ছিল কোয়েল। দু’জনেরই নাম ছিল পাখির নামানুসারে। তাদের বাবা দূর দেশে কোথাও চাকরী করতেন। দু’ভাই বোন মিলে একদিন ঝর্ণার ধারে খেলা করতে যায়। খেলা করতে করতে এক সময় কোয়েল কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলো না তার দিদিকে। সে জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলো – দিদি, দি...দি ..., দি.........দি বলে। অবাক কাণ্ড হল এবার। ঠিক একই ভাবে কে যেন আড়াল থেকে ডেকে উঠলো - দিদি, দি...দি ..., দি.........দি বলে। কোয়েল যতবার চিৎকার করল, আড়াল থেকে ততবারই কে সেন একই ভাবে চিৎকার করে উঠলো। অন্যদিকে পাপিয়াও যতবার তার ভাইকে ডাকতে লাগল, ততবারই কে যেন তার মত গলায় একই ভাবে ডেকে উঠল। দু’জনেই খুব ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে ছুটতে ছুটতে তারা বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরেই মাকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে মা বললেন – ‘দেখ বাছারা! আমার মা-বাবা আসলে মানুষ নয়। তারা পরী। পরীর দেশেই তাদের বসবাস। আমিও সেখানেই ছিলাম। কিন্তু আমি তোমার বাবাকে বিয়ে করাতে পরীর দেশের রাজা আমাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরীর দেশে এখনও আমার মা-বাবা থাকেন। আমার এক বোন ও সেখানে আছে। তার ছেলে-মেয়েরাও আছে। আমার বোনকেও দেখতে ঠিক আমারই মত। আর তার ছেলে-মেয়েরাও তোমাদের মতই দেখতে। তোমরা মানুষ, তাই ওদের দেখতে পাচ্ছনা। আজ যাদের গলা তোমরা শুনেছ, ওরা আসলে তোমার মাসতুতো ভাই-বোন। ওরা আড়াল থেকেই তোমাদের সাথে খেলা করছিল’। মেয়েটি বলে উঠলো – কোথায় থাকে তারা? আমরা কিভাবে যাবো আমাদের দাদু-দিদিমার কাছে? মা বললেন – ‘ওই যেখানে আকাশটা মাটির সঙ্গে মিশেছে, ওখানে রামধনুর সাত রঙে রঙ্গিন একটা ছোট সেতু দেখতে পাবে। ওটা পেরলেই তার ওপারে পরীদের দেশ। ওখানেই তোমাদের মামা বাড়ি। কিন্তু এখন নয়। বড় হয়ে তোমরা যেও। এমনিতে তোমরা ওখানে ঢুকতে পারবেনা। তবে আমাদের উঠোনের পাশে যে কলমি ফুলের গাছটা আছে, সেটা থেকে একটা ফুল তুলে নিয়ে যেও, তাহলে তোমরা রামধনু সেতু পার হতে পারবে। ওটা আমি পরীর দেশ থেকেই এনে লাগিয়েছিলাম’।

        এর পর দু’ভাই-বোন খালি সুযোগ খুঁজতে লাগল যে কবে পরীর দেশে যাওয়া যায়। একদিন সুযোগও পেয়ে গেল। মা দূরের ঝর্ণায় স্নান করতে গিয়েছিলেন। তারা ভাবল, অনেক সময় তো লেগে যাবে। দু’ভাই-বোন বেড়িয়ে পড়ল ঘর থেকে। সঙ্গে নিলো তাদের প্রিয় কুকুর টম কে। দূরে, বহু দূরে যেখানে আকাশটা মাটিতে মিশেছে, সেখানে দু’জনে চলে গেল হাঁটতে হাঁটতে। আশ্চর্যের ব্যাপার, মা-র কথা মত সত্যি সত্যি একটা সাতরঙের সেতু দেখতে পেল তারা। তারা সহজেই সেতুটা পেরিয়ে গেল কিন্তু তাদের কুকুরটা পেরোতে পারলো না। কুকুরটা কাছে যেতেই সেতুতে ওঠার পথ বন্ধ হয়ে গেল। শেষে কুকুরটাকে সেতুর কাছে বসিয়ে রেখে তারা চলে গেল পরীর দেশে। সেখানে গিয়ে দেখল, তাদের মা ঘুরে বেড়াচ্ছেন ফুলের বাগানে। ‘মা’ ‘মা’ বলে তারা ছুটে গেল। কিন্তু দেখল, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দু’টি ছেলে মেয়ে। একজনকে দেখতে ঠিক পাপিয়ার মত আর অন্যজনকে একেবারে কোয়েলের মত। এসব দেখে ওদের আর বুঝতে বাকী রইল না যে উনি ওদের মা নয়, মাসী। ওদের দেখে মাসী আনন্দে ওদের জড়িয়ে ধরে। দাদু, দিদিমাও খুব খুশী হলেন কিন্তু তারা যেহেতু মাকে না বলে চলে এসেছে তাই দাদু-দিদিমাও তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য বলতে লাগলেন। নয়তো ওদের মা চিন্তায় থাকবেন। দাদু-দিদিমা তাদের হাতে একটা ছোট্ট বাক্স দিয়ে বললেন – এটা নাও তোমার দাদুর দেশের একটা খেলনা। তোমাদের দেব বলে কতদিন ধরে ঘরে রেখে দিয়েছি। তবে খুব সাবধান। বাড়িতে মায়ের কাছে পৌঁছানোর আগে এটা খুলো না কিন্তু’।

        পাপিয়া আরে কোয়েল সেই বাক্স নিয়ে আবার সেই সাতরঙা রামধনু সেতু পেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। সেতুর কাছেই বসে ছিল তাদের আদরের কুকুর টম। দু’ভাই-বোন টমকে দেখতে পেয়ে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। তাদের আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছিল না। তারা রাস্তার ধারে বসেই খুলে ফেলল সেই দাদুর দেওয়া বাক্স। তার তখনই ঘটল অঘটন। টমের চোখের সামনে দু’ভাই-বোন অদৃশ্য হয়ে গেল। টম দেখতে লাগলো, দু’ভাই-বোন তার চোখের সামনে থেকে ক্রমশ: অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আর তাদের হাতের কলমি ফুলটা ক্রমশ: বড় হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই বিরাট কলমি ফুল আর সেই বাক্সটা জুড়ে গিয়ে তৈরি হল একটা আশ্চর্য যন্ত্র। তাতে ভেসে আসতে লাগল পাপিয়া আর কোয়েলের গলা। তারা বলতে লাগল, “ টম! আমাদের আর মায়ের কাছে যাওয়া হল না। তুইই মায়ের কাছে ফিরে যা। দাদুর কথা শুনিনি বলে এমন হল। আমরা আর কখনো পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবো না”। টম সেই বিরাট কলমি ফুলের মত যন্ত্রটার সামনে বসে তার প্রিয় পাপিয়া আর কোয়েলের কথা শুনতে লাগল আর তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো। সে পথ দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা কুকুরটাকে এমনভাবে কাঁদতে দেখে, তাকে পৌঁছে দিয়ে এলো তার বাড়ি। যন্ত্রটা দেখে পাপিয়া ও কোয়েলের মা সব বুঝতে পারলেন। কাঁদতে লাগলেন তিনি। যন্ত্রটার ভেতর থেকে ভেসে এলো পাপিয়া আর কোয়েলের গলার আওয়াজ। তারা বলতে লাগলো – ‘আমাদের তুমি ভুল বুঝোনা মা। আমাদের ক্ষমা করে দিও। আর টমকে দেখে রেখো। আমরা আর তোমার কাছে ফিরে যেতে পারবো না। তবে এই যন্ত্রটা দিয়ে গান আর গল্প শোনাতে পারব তোমাকে আর টমকে”। এর পর থেকে টম স্নান, খাওয়া ত্যাগ করে সারাক্ষণ ঐ যন্ত্রটার সামনেই বসে থাকতো আর তার প্রিয় মানুষ দু’জনের কথা শুনত, গান শুনত। সেই যন্ত্রটাই পরে সবার কাছে গ্রামোফোন নামে পরিচিতি লাভ করে।