প্রবন্ধ । ভাদ্র ১৪৩১

হায়দার এল আলি  |  ক্রেডিট-উইকিমিডিয়া কমন্স

এক ম্যানগ্রোভ
অরণ্য প্রহরীর কথা










ইন্দ্রনীল মজুমদার
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ





 

পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগালের কাসামাঞ্চে দ্বীপ।

এখানে দেখা যাবে একজন বৃদ্ধ মানুষকে যিনি এক-একটি ম্যানগ্রোভ চারাকে জলের নীচে কাদার ভেতরে পুঁতে চলেছেন। একটি ম্যানগ্রোভের চারা পুঁতছেন আবার তার ঠিক দু’পা দূরে আরেকটি ম্যানগ্রোভের চারা পুঁতছেন। এভাবেই ম্যানগ্রোভের চারা জলের নীচে কাদার ভেতরে পুঁতেই চলেছেন ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, আজ নয়, দীর্ঘ দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ব্যাপারটা বিস্ময়কর তাই না!  ব্যাপারটা বিস্ময়কর তো বটেই, তার চেয়েও বিস্ময়কর এই যে, ভদ্রলোক মহাশয় কেবল একশো-দুশোটা নয়, বরং ১৫ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি ম্যানগ্রোভের চারা পুঁতে দক্ষিণ সেনেগালের কাসামাঞ্চে দ্বীপে গড়ে তুলেছেন আস্ত একটি ম্যানগ্রোভ অরণ্য! আচ্ছা, ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের নাম কি? আজ্ঞে, তিনি হলেন হায়দার এল আলি (জন্মঃ ১৯৫৩ সাল)। তিনি কিন্তু যে-সে ব্যক্তি নন। তাঁর পরিচয় হল তিনি হলেন সেনেগালের বর্তমান মৎস্যমন্ত্রী আবার বাস্তুতন্ত্রের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু হায়দার আলির প্রধান নেশা হল এভাবেই ম্যানগ্রোভের চারা পোঁতার মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়ে ম্যানগ্রোভকে বাঁচিয়ে রাখা। পরিবেশপ্রেমী হায়দার এল আলি ‘সেনেগালিজ গ্রিন পার্টি’ নামে এক পরিবেশ সংগঠনের প্রেসিডেন্টও।


ম্যানগ্রোভ মুকুল রোপণ করছেন হায়দার আলী। ক্রেডিট-অ্যালচেট্রন ইমেজ

 

   এবারে আসা যাক এই ম্যানগ্রোভকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ের কাহিনীতে। একসময় ওই এলাকায় নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ গাছ কাটা হত যার ফলে ওই জায়গাটি ম্যানগ্রোভ-শূন্য হয়ে গিয়েছিল। আর এই ম্যানগ্রোভ-শূন্য হয়ে যাওয়ার ফল হয়েছিল মারাত্মক কেননা ধানের জমিতে বেড়ে চলতে থাকত নুনের পরিমাণ। আর এর ফলে নষ্ট হতে থাকত ফসল। এই ঘটনা দাগ কেটেছিল হায়দারের মনে। তখনি তিনি ঠিক করেন যে, যেভাবেই হোক না কেন, ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে তাঁকে বাঁচাতেই হবে। শুরু হয় তাঁর অসম্ভবকে সম্ভব করার লড়াই, অবিশ্বাসের মাঝে বিশ্বাস যোগানোর লড়াই। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্যে, তাঁদের সাথে দীর্ঘ দশ বছরের বেশি সময় ধরে পনেরো কোটিরও বেশি ম্যানগ্রোভের চারা বুনেছেন হায়দার আলি। আর এর ফলেই, ম্যানগ্রোভ-শূন্য অঞ্চলটি আবার ম্যানগ্রোভে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এভাবেই সদিচ্ছায়, নিরলস প্রচেষ্টায় ও স্থানীয়দের সাহায্যে বিলুপ্ত ম্যানগ্রোভ অরণ্যকেও ফেরানো যায়! দক্ষিণ সেনেগালের কাসামাঞ্চে দ্বীপ এখন হয়ে উঠেছে আস্ত একটি ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এর আয়তন সম্পর্কে বলা যায় যে, এই অঞ্চলটি ম‍্যানগ্রোভের অন‍্যতম প্রজাতি অ্যাভিচেনা গাছের অরণ্যগুলির মধ্যে এই পৃথিবীতে অন্যতম বৃহত্তম। অ্যাভিচেনা গাছের পাতা জল থেকে নুন শুষে নেয়। এর ফলে, অনায়াসেই বনের পাশে করা যায় ধানচাষ। ম্যানগ্রোভের শিকড়ে বাসা বাঁধে শামুক যা মাছেদের প্রিয় খাদ্য। আর এই প্রিয় খাদ্য পাওয়ার ফলে ম্যানগ্রোভের আশেপাশের নদীতে বেড়ে চলেছে মাছেদের সংখ্যা। আর ওইসব মাছ ধরেই জীবিকা ধারণ করে চলেছে স্থানীয় মানুষরা। এভাবেই ওই অরণ্যে তৈরি হয়েছে এক সুন্দর বাস্তুতন্ত্র আর যাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে মানুষের জীবিকা। আর এভাবে বেঁচে আছে এবং সবাইকে বাঁচিয়ে রেখেছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। আর যিনি এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মূল কান্ডারী সেদেশের সেই প্রাক্তন বাস্তুতন্ত্রের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও বর্তমান মৎস্যমন্ত্রী হায়দার এল আলি একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন–“কাটার পর এক-একটি ম্যানগ্রোভের বেড়ে উঠতে যতটা সময় লাগে, আমরা আসলে ততখানি সময় হারিয়ে ফেলেছি। এখন প্রতিটা মুহূর্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রহের অনেক অনেক গাছ দরকার, বন দরকার।” সত্যিই, আমাদের গ্রহ পৃথিবীকে বাঁচাতে অনেক অনেক গাছ দরকার আর বন দরকার। তাই, দীর্ঘজীবী হোক ম্যানগ্রোভ অরণ্য আর আমাদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসুক হায়দার এল আলির মতো ম্যানগ্রোভ অরণ্য রূপকার ও অরণ্য প্রহরীরা। 

হায়দার এল আলির মতে, “মানুষই পারে পুনরুদ্ধার করতে যা সে ধ্বংস করেছে।” তাই, ধ্বংস হওয়া প্রকৃতির অংশও পুনরুদ্ধার লাভ করে হায়দার এল আলির মতো প্রকৃতি-প্রেমী মানুষদের হাত ধরেই।