শশাঙ্ক সরকার

 রামকৃষ্ণ মিশনে একদিন









শশাঙ্ক সরকার




 

পুরোনো কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের গলি ঘুরে ঘুরে পৌঁছে গোলাম নিউস্ক্রিপ্ট-এর সামনে। কয়েকজন লোক বসে আছে। সকলকে তো একইরকম লাগছে। সাজপোশাকে, কথাবার্তায় কাউকেই আলাদা করে চোখে পড়ছে না। হ্যাঁ, এটাই সন্দেশের কার্যালয়। কিন্তু চিনব কীভাবে?

লাবণ্য পুস্তক বিপণি ও দেজ ঘুরে আসতেই পৌনে সাতটা। ভিতরের দিকে ভয়ে ভয়ে চোখ ফেলে একজনকে শুনতেই পাশের জন প্রশ্ন করলেন, “তোমার সঙ্গেই কি কাল ফোনে কথা হয়েছিল?”

আপনিই কি ভবানীবাবু?”

প্রথম পরিচয়ের এটাই ছিল কথোপকথন

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে প্রতিমাসে একটা শনিবার বরাদ্দ থাকে কিশোর সাহিত্যসভার জন্য। সেই সভায় অনেক বড়ো বড়ো সাহিত্যিক এসেছেন। মিশন বলেই তো। না খুব একটা কেউ বলতেন না, একমাত্র তারাপদ রায় ছাড়া। তাঁর উপায়ও ছিল নাবিদেশ থেকে ফেরার পর ব্যবস্থা কোরো, যাববলা ছাড়া। এদিকে তপনদা (স্বামী যুগেশ্বরানন্দ) আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন—তুমি ভালো বোঝো এমন কাউকে নিয়ে এসো।তখনই আঁতিপাঁতি করে খুঁজে পেলাম; সাহস করে ফোনও করলাম—ভবানীপ্রসাদ মজুমদার বলছেন?’

হ্যাঁ, বলছি।

আমি একে একে কিশোর সাহিত্যসভা কাদের জন্য, সভার উদ্দেশ্য বিধেয়, তার পরিসর—সব বলে থামলাম। বুঝলাম, তিনি মুখিয়ে ছিলেনহ্যাঁ যাববলার জন্য। মুখিয়ে ছিলাম আমিও—শোনার জন্য

পরদিন স্কুল টাইমে তপনদাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বসলাম খুঁতখুঁতে মানুষটার সামনে। অশোকদা, হেডমাস্টার মহারাজ।—কী হবে?’ ‘উনি কী পরিবেশন করবেন?’ ‘ছড়া দিয়ে কি এই বয়সের ছেলেদের মন জয় করা সম্ভব?’

সব প্রশ্নের একটাই উত্তর দিয়ে গেলাম, ‘হ্যাঁকিছুটা সময় গেল এ-কথায় সে-কথায়। তারপর তিনি বললেন, “ঠিক আছে। তুমি ওঁর ঠিকানা ডেসিগনেশন জোগাড় করো, আমি চিঠি রেডি করছি।

পরদিন আবার ওঁকে ফোন করলাম—আপনার ঠিকানা বলুন।

ঠিকানা কী হবে? কলেজ স্ট্রিট নিউস্ক্রিপ্টে এসো, দেখা হবে।

না, তবু আপনি বলুন। যেদিন আসবেন সেদিন গাড়ি নিয়ে যাব আপনাকে আনতে।

ঠিক আছে। বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে হাওড়া শানপুর কালীতলা।

 

শনিবার দুপুর খেয়েদেয়ে দুপুর আড়াইটা নাগাদ রওনা দিলাম গাড়ি নিয়ে। পৌঁছতেই চারটে প্রায়। কলিং বেল চাপতেই স্বয়ং দরজা খুলে ভিতরে নিয়ে বসতে দিলেন।—বোসো। প্রস্তুত হতে যেটুকু সময় লাগবে।

কেন তা বুঝলাম মিনিট দশেক পরে যখন দুজনেই প্রস্তুত হয়ে বাইরে এলেন। পতির পুণ্যের সাথী। সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। দুজনকে নিয়ে আমি নরেন্দ্রপুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। শুরু হল দীর্ঘ পথের আলাপন। দু-চার কথার পর ম্যাডাম নিজেও সাবলীল হলেন কথাবার্তায়। শুরু হয়েছিল মিশন ও মিশনারি নানা কৌতুহল নিবৃত্তির মাধ্যমে। তারপর এল লেখালেখির বিষয়

ফিরতেও প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগল। ছেলেরা তখন প্রেয়ার হলে। ওঁদেরকে নিয়ে বসালাম আমার রুম অখণ্ডানন্দ ভবনের এক নম্বরে। ছেলেরা প্রেয়ার শেষে টিফিন সেরে বিদ্যালয়ের সেন্টার কোর্ট-ইয়ার্ডে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ আগে অশোকদা, তপনদাও ঘুরে গেছেন পালা করে। দু-চার কথা বলে অশোকদাও বলে গেলেন, “ছেলেরা বেরিয়ে গেলে ওঁদের নিয়ে চলো।

ওঁদের চা-টিফিনের ব্যবস্থাও এখানেই করা হল

ঠিক সময়ে সুনীতিদা এসে হাজির।—চলুন আমরা এগোতে থাকি।

বেরিয়ে সারদানন্দ ভবনের কাছে আসতেই দেখি তপনদা, শুভেন্দু ও প্রবীরদা

যথাবিহিত আশ্রমিক অতিথিবরণের রীতি সম্পন্ন করা হল। অশোকদার অভ্যর্থনা ভাষণের পর খুব সম্ভবত বিপ্রদাসদা ভবানীবাবুর বিশাল ব্যাপ্তি ও পরিচিতি খুব সংক্ষেপে তুলে ধরেন ছাত্রদের কাছে। এরপর যখন উনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন, প্রথম ছড়াটা বলেছিলেননিজের ঢাক’, দ্বিতীয়টানিজের ঢোলছেলেদের চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক—এমন আরও চাই ভাব। উনিও মজা পেয়ে একের পর এক মজার ছড়া থেকে, যাতায়াতের কড়চা থেকে—নানা বিষয়ে বলতে থাকলেন। ছেলেরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে, যেখানে হাসার হাসছে, যেখানে গম্ভীর থাকার থাকছে। পত্রে-পুষ্পে-শাখা-প্রশাখার বিস্তারে তিনি বুঝিয়ে দিলেন কেন তিনি বাংলা ছড়ার জগতে ব্যাপ্ত মহিরুহ

কোথা দিয়ে উনি দেড় ঘণ্টারও উপরে সময় পেরিয়ে গেলেন বোঝা গেল না। অশোকদাকেও দেখলাম খুশি খুশি ভাব মুখে। সভা শেষ। এবার ফেরার পালা। সম্ভবত রাতের খাবারটা ওঁরা কিছুতেই খেতে চাইলেন না রাত হয়ে যাওয়ার ভয়ে। তবে চোখে-মুখে তাঁর ফুটে উঠছে উৎফুল্লতা ও উচ্ছ্বাস। সরল আবেগের কিছু মুহূর্ত পেরিয়ে গাড়ি আবারও ছুটল হাওড়ার উদ্দেশে। আমি বসে আছি বর্তমান বাংলা ছড়ার জীবন্ত কিংবদন্তির সঙ্গে এক গাড়িতে

একদিন এসো শুক্রবার সন্ধ্যায় নিউস্ক্রিপ্টে। আসার আগে ফোন করবে। তোমাকে কিছু বই উপহার দেব আমার।

গাড়ি এসে গেল বাড়ির দোরগোড়ায়। আমাকে নামতে নিষেধ করলেন।—নামার দরকার নেই, অলরেডি দশটা বেজে গেছে। তোমার ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।

ফেরার পথে গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে আমি ছাড়া কেউ নেই। কোনও কথা নেই। আছে শুধু পিছনের সিটে বটবৃক্ষের শূন্যতা

  

<