বৈজ্ঞানিকের রান্নাঘর - ৬ । কার্তিক ১৪৩১







 অন্ত্র তো নয় যন্ত্র












অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
দিল্লি, এন সি আর 


 

রিয়ার বারো ক্লাসের রেজাল্ট বেরোল। অর্কদের কলকাতার বাড়িতে আজ হইহই বেধে গিয়েছে। শোরগোল পৌঁছল দিল্লি পর্যন্ত। আর তা হবে নাই-বা কেন? রিয়ার রেজাল্ট বেশ ভালো। তাই কলেজে যে-কোনো বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করা সহজ হবে বলেই সকলের ধারণা। রিয়া নিজেও খুব খুশি। রেজাল্টের চিন্তায় চিন্তায় রাতের ঘুম আর দিনের খাওয়া উড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল তার। আজ রিয়ার পিসি ও পিসেমশাই সব কাজ ফেলে দুজনেই বাড়িতে। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে চলছে কলকাতা-দিল্লি দুই বাড়ির মধ্যে ভিডিও বাক্যালাপ। শুধু রিয়ার পিসতুতো দাদা অর্ক থেকে থেকে রিয়ার কাছে এসে তার কানের গোড়ায় বলে চলেছে, “কারও প্ররোচনায় পা দিবি না। যে-যার মতো করে বিষয় নির্বাচন করে চলেছে তোর জন্য। সব ভেবেচিন্তে নিজে সিদ্ধান্ত নিবি। এমনকি আমার কথাও শুনবি না। এই ক’দিনে রান্নাবান্নার বিজ্ঞান নিয়ে নানা গল্প বলেছি। আমার তো মনে হয় তুই নিউট্রিশন নিয়ে পড়। আমারও রান্নাবান্নার জ্ঞান আরও বাড়ুক।”

রিয়া জানে অর্ক তার পিছনে লাগার জন্য নিউট্রিশন নিয়ে পড়তে বলছে। আদপেই সে ওটা চায় না। তার ইচ্ছে বিজ্ঞানের যে-কোনো বিষয় নিয়ে রিয়া গবেষণা করার জন্য মন-প্রাণ লাগিয়ে দিক।

“মা, খিদেয় পেটে ছুঁচো ডাকছে সেই কখন থেকে! এবার আনন্দ উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে রেখে চলো কিছু অর্ডার করি অনলাইনে। বিরিয়ানি উইথ চিকেন চাপ আনলে ভালো হবে। সঙ্গে মিষ্টি দই আর রসগোল্লা।”

অর্কর মা ফোনের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে অর্ককে বললেন, “একদম নয়। এই ক’দিন বোনটাকে বাইরে যত রাজ্যের অখাদ্য কুখাদ্য খাইয়ে ওর পেটের বারোটা বাজিয়েছ, আজ আর নয়। হ্যাঁ, মিষ্টি অবশ্যই আনা যেতে পারে। তুমি নিজেই একটু বাইরে গিয়ে কিনে নিয়ে এস। আর বিরিয়ানি আজ বাড়িতেই হচ্ছে। সকালে রিয়ার রেজাল্ট বেরোবার পর আমি জ্যোৎস্নাকে বাজারে পাঠিয়ে মাংস এনে রেখেছি। সেই মাংস ম্যারিনেট হয়ে রান্নাঘরে এখন বন্ধ হাঁড়িতে রান্না হবার অপেক্ষায়। আমি বিরিয়ানি যা রেঁধে দেব, খেয়ে আর কোনও রেস্তোরাঁর নাম আর মুখে আনবে না তোমরা। কী রে রিয়া, পিসির উপর ভরসা আছে তো?”

রিয়া পিসির কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

এক বিশাল প্লেটে চিকেন টিক্কা এনে বসার ঘরের টিপয়ে জ্যোৎস্না রেখে দিতেই অর্ক চেঁচিয়ে উঠল, “আজ রিয়ার ভালো রেজাল্ট হবার খুশিতে জ্যোৎস্নাদিও শেফ হয়ে গেছে দেখছি! দারুণ গন্ধ বেরিয়েছে!” বলেই অর্ক প্লেট থেকে গরম টিক্কা মুখে তুলে দিয়ে লাফাতে থাকে মুখ গোল করে।

“নাও, এবার জিভ পুড়িয়ে ফেললে! বিরিয়ানি সব আমার পেটেই যাবে দেখছি।” রিয়া হেসে গড়িয়ে পড়ে।

অর্ক রিয়ার মাথায় একটা ছোট্ট চাঁটি মেরে বলে, “তোকে না সেদিন বিরিয়ানি খাইয়েছি! অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর তুই! দিল্লি ফিরে এবার একা একা বিরিয়ানি খাস গিয়ে জামা মসজিদের পিছনের গলিতে।”

“খবরদার রিয়া। অর্কর কথায় কান দিবি না। তোর ডাক্তার পিসি বলছে, সামনে যে জীবন পড়ে আছে, তাতে নিজের গাট ফিলিংকে বেশি গুরুত্ব দিবি, মানে নিজের গাঁটের খেয়াল রাখবি। নইলে কিন্তু গাদা গাদা ওষুধ খেয়ে গাঁটগচ্চা দিতে হবে।”

“মা, গাট ফিলিং কিন্তু অন্য জিনিস।” অর্ক প্রতিবাদ করে।

অর্কর ডাক্তার মা তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, “আজ্ঞে না। আমাদের সব ফিলিং বা অনুভূতির কেন্দ্র হচ্ছে গাট, যাকে সরল বাংলায় বলে অন্ত্র। আর এই গাট কিন্তু মুখ থেকে শুরু করে পায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত। ত্বকের যত্নের চাইতে গাটের যত্ন বেশি প্রয়োজনীয়।”







“গাটের সঙ্গে মনের কী কানেকশন বুঝলাম না ডাক্তারবাবু।” বলে হ্যা হ্যা করে হাসতে থাকেন অর্কর বাবা।

অর্কর মা চোখ পাকিয়ে স্বামীর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে বলেন, “তুমি আর মনের কথা জানবে কী করে? ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, শুধু যন্ত্র নিয়ে কারবার তোমার। যাক গে, রিয়া মা, তুই মনে রাখিস, গাট হচ্ছে আমাদের শরীরের নিয়ন্ত্রক। আমাদের মস্তিষ্ক এবং পাকযন্ত্র পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি বিগড়োলে আর একটির দফারফা। যে-সমস্ত খাবার আমরা খাই, তা আবার রান্না হয় পাকযন্ত্রে গিয়ে। কারণ, আমাদের শরীর সরাসরি যে খাবার থেকে পুষ্টি নিতে পারে না, তা তোর জানা। সব খাবার পেটে গিয়ে ভেঙে যায় সুগারের অণুতে। সেই সুগার শরীরে রক্তের মধ্যে দিয়ে বাহিত হয়ে কোষে কোষে চালিত হয়। তারপর সেই সুগার পুড়িয়ে আমরা পাই শক্তি। কিন্তু খাবার ভাঙার প্রক্রিয়াতে দেহের প্রয়োজনীয় মিনারেল এবং অন্যান্য উৎসেচক তৈরি হলে তবেই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আসে, নানা হরমোন তৈরি হয়, যা নানা কাজে ব্যবহার করে শরীর।

“পাকযন্ত্র বললেও মানুষের শরীরের এই অঙ্গ কিন্তু যন্ত্র আদপেই নয়। পাকযন্ত্রের যেন মন আছে। সে ঠিক বুঝে নেয় কখন কোন উৎসেচক তাকে তৈরি করতে হবে, কোন হরমোন শরীরের কোন জায়গায় সময়মতো পৌঁছে দিতে হবে। অবশ্য এই বুঝে নেওয়ার ব্যাপারে সে সবসময় আমাদের মস্তিষ্কের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। লক্ষ লক্ষ স্নায়ু পাকযন্ত্রে লাগানো আছে, যারা সব সংকেত মাথা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার আর ফিরিয়ে আনার কাজ করে। এই কারণেই পাকযন্ত্রকে বলা হয় দ্বিতীয় মস্তিষ্ক। তাই পাকযন্ত্রের মন নেই, এমন বলা যাবে না।

“মুখ বন্ধ হাঁড়িতে দম বন্ধ হয়ে যেমন দম রান্না হয়, আমাদের পাকস্থলীতেও অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে রান্না হয়ে জারিত হয় খাবার। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে অনেকক্ষণ ধরে। পাকস্থলীতে খাবার জমা হয়, সেখানে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড এবং অন্য উৎসেচক জমা খাবারকে ভেঙে সহজপাচ্য করে তোলে। অনেকটা পেস্টের মতো হয়ে যায় খাবার। তারপর খাবারের যাত্রা শুরু হয় অন্ত্রে।”

“তারপর আছে স্মল ইন্টেস্টাইন—লম্বায় প্রায় কুড়ি ফুট হলেও প্যাঁচানো থাকায় কম জায়গাতেই পেটের মধ্যে জায়গা করে নেয়। এখানে লিভার থেকে আসা বাইল ফ্লুয়িড, প্যানক্রিয়াস থেকে আসা এনজাইম খাবারে মিশে যেতে খাবার আরও সরল হয়ে যায়। খাবারের মধ্যে সুগার এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল এখানেই শুষে নেয় বিশেষ ধরণের ঝিল্লি। তারপরে আছে লার্জ ইন্টেস্টাইন, এখানে খাবারের বর্জ্য পদার্থ জমা হয় এবং সেখান থেকে বাইরে আসে স্টুল হয়ে।” এক নিশ্বাসে বলে রিয়া। 

অর্ক রিয়াকে এক হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলে, “দাঁড়া দাঁড়া, যেসব ইংরেজি শব্দগুলো বলে গেলি, সেগুলোর বাংলা বল দেখি।”

অর্কর বাউন্সার প্রশ্নে রিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ওর হতাশ দশা দেখে অর্কর মা নিজেই আশ্বাস দিয়ে বলেন, “রিয়া ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশুনো করেছে, দিল্লিতে থাকে, কাজেই বায়োলজির বাংলা শব্দগুলো না-ই জানতে পারে। আমি বলছি। ইন্টেস্টাইন—অন্ত্র, বাইল ফ্লুয়িড—পিত্ত, প্যানক্রিয়াস—অগ্ন্যাশয়। পেটের বিভিন্ন অংশের ব্যাপারে এটুকু প্রায় সকলেরই জানা আছে। কিন্তু অন্ত্রকে আমাদের দ্বিতীয় মস্তিষ্ক বলার কারণ হল— অন্ত্রে লক্ষ লক্ষ স্নায়ু লাগানো আছে, যা সরাসরি আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত। এইজন্যই কথাটা চালু আছে, গাট ফিলিং। অর্থাৎ গাট বা অন্ত্র হল আমাদের মনের অবস্থার মাপকাঠি। পেট বিগড়োল, তো বিগড়ে গেল মাথা। আবার আমাদের অন্ত্রে যে অসংখ্য অগুনতি উপকারী ব্যাক্টিরিয়া আছে, তারাও অন্ত্রের সব খবর পৌঁছে দেয় মাথায়। এই স্নায়ুতন্ত্রকে বলা হয় এন্টারিক নার্ভাস সিস্টেম। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম এবং এন্টারিক নার্ভাস সিস্টেমের মধ্যে যে খবরের আদানপ্রদান চলে তার স্নায়ু মাধ্যমকে বলা হয় গাট-ব্রেন অ্যাক্সিস, বা সংক্ষেপে জি.বি.এ।”

“ভেবে দ্যাখ রিয়া, তোর ওইটুকু পেটে কত কোটি কোটি জীব ঘুরে বেড়াচ্ছে! ওদের খিদে পেয়েছে, বরং তুই মায়ের লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে চিকেন টিক্কা খেতে দে বেচারি মাইক্রোস্কোপিক জীবগুলোকে।” নিজের রসিকতায় হাসতে থাকে অর্ক।

রিয়া রেগে যাওয়ার ভান করে বলে, “জানি, ল্যাক্টোব্যাসিলাস ব্যাক্টিরিয়া এদের মধ্যে একপ্রকার। আরও আছে, তাদের নামগুলো বেশ খটোমটো। তবে এরা নানা কাজে আসে। যেসব শক্ত প্রোটিন জাতীয় খাবার আমাদের শরীরে সহজে হজম হয় না, তাদের খেয়ে ফেলে অনেক মূল্যবান রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করতে পারে। বিভিন্ন খাবার থেকে পাওয়া প্রয়োজনীয় ভিটামিন রক্তে মিশিয়ে দিয়ে আমাদের শরীরকে সুস্থ করে রাখে।”

“গুড গার্ল রিয়া। অন্ত্রে প্রায় এক লক্ষ কোটি ব্যাক্টিরিয়া বসবাস করে। এই সংখ্যাটা আমাদের শরীরে যত কোষ আছে তার প্রায় দশগুণ। তবে মনে রাখতে হবে জাঙ্ক ফুডের সঙ্গে উপাকারী ব্যাক্টিরিয়াদের একটুও সদ্ভাব নেই। একদিনে না হলেও ধীরে ধীরে অতিরিক্ত প্রোটিন তেলমশলা ঘি যুক্ত খাবার খেলে উপকারী ব্যাক্টিরিয়া সংখ্যায় কমে যায়। তখন দাপট বাড়ে অপকারী ব্যাক্টিরিয়াদের। বাইরের খাবার থেকে অপকারী ব্যাক্টিরিয়ার শরীরে অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে। তাই যতটা সম্ভব বাড়ির খাবার খাওয়াই মঙ্গল।” বলেন রিয়ার ডাক্তার পিসি।

“আমি জানি পিসি, ই-কোলাই হল এমনই পাজি একটা ব্যাক্টিরিয়া।”

“এই ক’দিন আমার সঙ্গে কলকাতায় যত উপাদেয় স্ট্রিট ফুড খেলি, কত ই-কোলাই যে তোর শরীরে ঢুকে পড়েছে! মায়ের কথা যদি সত্যি হয়, তবে তোর ব্রেনে ঢুকে পড়ে সেইসব ব্যক্টিরিয়া তোকে বিজ্ঞানী হতে দেবে না মনে হয়।”

অর্কর কথার মাঝে জ্যোৎস্না বিশাল হাঁড়িতে রান্নাঘর থেকে বিরিয়ানি নিয়ে এসে খাবার টেবিলে নামিয়ে রাখতেই সুগন্ধে ঘর ম ম করে ওঠে। বিরিয়ানির প্রভাবে মানুষের শরীরের রান্নাঘরের গল্প চাপা পড়ে যায়। অর্কর বাবা, রিয়ার পিসেমশাই চেঁচিয়ে ওঠেন, “অন্ত্র তো নয় যন্ত্র! আজ থেকে বাইরের খাবারের হল অন্ত!”

 



আরও পড়ুন  -









খাবারের গায়ে কেন টক টক গন্ধ

 



জল শুধু জল



ফ্রাই, কিন্তু ড্রাই নয়



যার নুন খাই, তার গুণ গাই



কুসুমে কুসুমে