ভবানীপ্রসাদ মজুমদার ও কিছু স্মৃতি
| | বাংলা এখন দেশগতভাবে দুই
ভাগে বিভক্ত, কিন্তু বাঙালি জাতীয় সত্তা মনে হয়
আজও একইরকমভাবে একক সত্তা হিসেবেই বিরাজ করছে। স্বভাবতই বাংলা ভাষাও তাই।
লেখালেখির সূত্র ধরেই দুই দেশের দুই বাংলাতে আমার যাতায়াতের সুবাদে আমি মিলিত হতে
পেরেছিলাম বর্তমান সময়কালের বিদগ্ধ কথাসাহিত্যিক, কবি,
ছোটো গল্পকার প্রমুখের সঙ্গে। ভারতে পশ্চিমবাংলাতে কবি শঙ্খ ঘোষ,
ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য, কবি, ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, কিশোর
সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়, কবি
মন্দাক্রান্তা সেন প্রমুখ এবং বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক জনাব ইমদাদুল হক মিলন, কল্পবিজ্ঞানের লেখক অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় জনাব জাফর ইকবাল, কবি নির্মলেন্দু গুণ, প্রাবন্ধিক নুরুল হাসান,
হুমায়ুন আহমেদের পত্নী শ্রীমতী শাওন আহমেদ প্রমুখ। আজকে খানিক গল্প
আসুক বিশিষ্ট ছড়াকার ও কবি শ্রী ভবানীপ্রসাদ মজুমদার সম্পর্কে।
মালদহ জেলা থেকে প্রকাশিত
ছোটো পত্রিকা ‘ফজলি’-র
সম্পাদক শ্রী নির্মলেন্দু শাখারুর মাধ্যমে প্রথম পরিচয় শিশুসাহিত্যিক শ্রী
ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে তাঁর হাওড়ার বাসভবনেই। আমার সম্পাদিত ‘মনন’ লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে প্রাথমিক আলাপ
হলেও ক্রমশ সে-আলাপের গণ্ডি এসে দাঁড়ায় দাদা-ভাই সম্পর্কে। আমি ব্যক্তিগতভাবে
প্রবন্ধ লেখক ও বিভিন্ন গবেষণাধর্মী পুস্তকের কাজ করলেও শিশুসাহিত্য রচনায় আমার
বিশেষ কিছুই অবদান যে নেই, এই সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতে কোনও
অসুবিধা অন্তত আমার নেই। আসলে শৈশব ছেড়ে যৌবনে বা প্রৌঢ়ত্বে এসে শিশুমনের মধ্যে
প্রবেশ করে তাদের ভাষায় কথা বলাটা অত্যন্ত এক কঠিন কাজ। শিশুকে তুষ্ট করতে একটা
লজেন্স বা বিস্কুট দিলেই তো হয়, কিন্তু সেই শিশুমনকে তুষ্ট
করতে কবিতা বা ছড়াও যে দামি লজেন্স বা বিস্কুটের চেয়ে কম কিছু নয়, সে-কথা নিজের বয়স ভুলে শিশু না হলে সম্ভবত অনুভব করা সম্ভব নয়। আর এই
অনুভূতিসম্পন্ন মানুষগুলোই মনে হয় হয়ে উঠতে পারেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে।
ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের আগে এর প্রমাণ আমরা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় বা সত্যজিৎ রায়ের কাছে পেয়েছি; আর
বয়সকালেও নির্মল আনন্দে অভিভূত হয়েছি। তাঁর বাড়িতে বসে দীর্ঘ সময় বিভিন্ন বিষয়
নিয়ে কথা হয়েছে, যদিও আজকের এই নিবন্ধে শুধুই শিশুসাহিত্য
নিয়েই অল্প গল্প করা যাক।
আমি একেবারে শিশুর মতোই এক
অর্বাচীনের প্রশ্ন করে বসলাম কবিকে, কী করে
বোঝেন শিশুমন কোন শব্দে সশব্দে হেসে উঠবে? কী করে করেন
শব্দের বিন্যাসের মাঝে তাদের মনকে তুষ্ট করে তুলতে?
শিশুর মতোই সরল কবি উত্তর
দিয়েছিলেন, এ এমন কোনও শক্ত কাজ নয়। আসলে ফিরে
যেতে হয় নিজেকে সেই নিজের মনে থাকা পর্যন্ত শৈশবে। সেখানে আমার রাগ, অভিমান, কিছু না পাওয়ার যন্ত্রণা এসে আমাকে তাড়িত
করে। তখন আমি আমার মধ্যের সেই শিশুকে ভোলানোর চেষ্টা করি ‘আবোল-তাবোল’
ছড়ার মধ্যেই।
এভাবেই ক্রমশ গড়ে উঠেছে
ভবানীপ্রসাদের শিশুসাহিত্যের সাম্রাজ্য।
কথা বলতে বলতে জানা হল, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তিনি দেখা করে বলেছিলেন কিছু কাজ দেওয়ার
জন্য। সত্যজিৎবাবু তাকে দিয়েছিলেন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের (অবশ্যই শিশু খাদ্য বা শিশু
সম্পর্কিত বিষয়াদি) কিছু কাজ। সেগুলো তিনি অনায়াসেই করেছিলেন। সত্তর দশকে যদিও
বিজ্ঞাপনের ছড়া বা কথা লিখে বিশেষ কিছু উপার্জন হত না, কিন্তু
ক্রমশ কাজের গণ্ডি অবশ্যই বাড়তে থাকে, চর্চাটা চলতে থাকে
অবিরত।
জীবনভর স্কুলের শিক্ষকতাও
তাঁকে যে বিশেষভাবে শিশুমনমুখী করে তুলতে সাহায্য করেছিল, এ-কথা ভুলতে তিনি বৃদ্ধ বয়সেও নারাজ। প্রায় কুড়ি হাজারের বেশি
ছড়া ও কবিতা তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে, বাংলা সাহিত্যে অবশ্যই
যা এক অমলিন স্মৃতি হিসেবেই বিরাজ করবে। আমি যখন তাঁর একটি লেখা আমার লিটল
ম্যাগাজিনের জন্য চাইলাম, সেখানে বসে থাকতে-থাকতেই এবং গল্প
করতে-করতেই তাঁর কলম যে চলছিল, সেদিকে আমার খেয়াল ছিল না
একেবারেই। তিনি একটি কাগজে ততক্ষণে লিখে ফেলেছিলেন ‘মনন’
পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য একটি অত্যন্ত সুন্দর এক ছড়া, যা অবশ্যই দুর্লভ এক প্রাপ্তি হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘মনন’
পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে।
কর্মজীবনের বঙ্কিম পথে
আমাদের বাঁকে বাঁকে এমন করেই দেখা হয় সাহিত্যজগতের অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রদের সঙ্গে।
কিছুটা কালযাপন। হয়তো মিলনের অবসর আর আসে না, জাগতিক
চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডিতে আটকে থাকে পরবর্তী মিলন। সময় ধরে রাখে সকল স্মৃতি খাতার
পাতায় অথবা বইয়ের কোনও পাতাতে। এমন করেই কোনও এক সময় তা হয়ে ওঠে অমূল্য সম্পদ,
কখনো-বা সে-লেখা সময়ের গতির সঙ্গেই খেয়ে যায় পোকায়।
<
|