গল্প - ৪ । কার্তিক ১৪৩১



আশ্রয়  












অজিত ত্রিবেদী
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

নিনিরা পুরনো ভাড়াবাড়ি ছেড়ে একটা নতুন জায়গায় এল। গ্রামটির নাম আমোদপুর। তাই বলে বিশ বছর আগের সেই এঁদো গ্রাম নয়, নতুন গড়ে ওঠা ছিমছাম মফসল। চারদিক ছবির মতো সাজানো। সুন্দর সবুজ প্রকৃতি। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, নতুন নতুন বাড়িঘর, ইশকুল, বাজার, খেলার পার্ক। এককথায় নিনির খুব পছন্দের। 

হলে কী হবে, এটাও তো সেই একই ভাড়াবাড়ি। বাবা ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। বদলির চাকরি। হয়ত বছর গড়াতে না গড়াতেই আবার এজায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। তা হোক, এই বয়সে নিনি বুঝে গিয়েছে জীবন এইরকমই। অবশ্য এই বাসাবদলের জীবনে একটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে। কতরকমের অভিজ্ঞতা হয়। সুতরাং নিনির খুব একটা মন্দ লাগে না। যেখানেই যাক না কেন পাড়ায় নতুন-নতুন আত্মীয়, স্কুলে নতুন-নতুন বন্ধু গড়ে ওঠে।

নিনিরা যে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে তার চারপাশের পরিবেশ, যোগাযোগ, লোকজন খুবই ভালো। এগ্রামে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই সবকিছুই যেন আপন হয়ে গেছে। বাড়িটা মেন রাস্তা থেকে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক ভেতরে, বেশ নিরিবিলি। তবু নতুন জায়গায় এসে সবকিছুর সঙ্গে পরিচিত হতে এবং মানিয়ে নিতে একটু তো সময় লাগবেই। তবে বাবার বদলির চাকরি-সূত্রে সেদিক থেকে নিনি যথেষ্ট এডজাস্ট করে নিতে শিখে গেছে। তাছাড়া কত আর বয়স, সবে তো ক্লাস এইট। সামনে এখন লম্বা জীবন পড়ে আছে।

নিনি যে ইশকুলে ভর্তি হয়েছে তার নাম বকুলবালা বালিকা বিদ্যালয়। দশম শ্রেণী পর্যন্ত। নিনিদের ভাড়াবাড়ি থেকে ইশকুলের দূরত্ব দেড় কিলোমিটার। প্রতিদিনই স্কুলবাসে যাওয়া আসা করে নিনি। তবুও বাবা-মায়ের মনে একটা চিন্তা থেকেই যায়। নতুন জায়গা। নতুন বাসচালক। যদিও স্কুলবাসগুলোর চালক বা কন্ডাক্টরেরা যথেষ্ট দায়িত্বপূর্ণ হয়। এক-দুমাস গেলেই যে-বিষয়ে আর কোনও দুশ্চিন্তাই থাকে না। প্রথম-প্রথম নিনির মা স্কুলবাসে তুলে না-দেওয়া এবং বাস থেকে না-নামা পর্যন্ত অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতেন। এখন অনেকটা সেদিক থেকে কিছুটা চিন্তামুক্ত। তবে বাসে না হয় নিরাপত্তার সঙ্গে যাওয়া-আসা করল, কিন্তু যখন সে স্কুলগেট থেকে বেরিয়ে অপেক্ষমান বাস পর্যন্ত আসবে সেই সময়টুকু নিয়েই একটা খচখচানি মনের মধ্যে থেকেই যায়। তাছাড়া গার্লস স্কুল বলে কথা। রাস্তার মোড়ে ডেঁপোমার্কা কিছু উঠতি যুবক সব জায়গাতেই এক অশুভ আশঙ্কার কারণ হয়ে ওঠে।

২.

দেখতে-দেখতে বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল। এর মধ্যে অনেক বন্ধু হয়েছে নিনির। শুধু ইশকুলে বা বাসে যাওয়া-আসা করতে-করতে নয়, পাড়াতেও। নিনিরা যে পাড়ায় থাকে, সেই পাড়ার অনেকেই তাদের ইশকুলে পড়ে। একই বাসে যায় আসে। সবাই ভীষণ ভালো। বিশেষ করে জিনিয়া, পিয়া, ফতেমা, প্রতনু, প্রতীপ, ইয়াসিন প্রত্যেকেই নিনির প্রিয় বন্ধুর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। একদিন ইশকুলে না গেলে কিংবা নিনিকে কোনওভাবে চোখে হারালে পরদিন সরাসরি বাড়িতে এসে খোঁজ নেয়। নিনিও ওদের খুব ভালোবাসে। এইসব দেখে নিনির মা-বাবা একদম নিশ্চিন্ত। খুব খুশি। ভালো বন্ধু পাওয়াও একটা ভাগ্যের ব্যাপার। আর এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে বন্ধুত্বের বাইরে বড়ো কোনও সম্পর্কই নেই। প্রয়োজনে বন্ধুর জন্য তারা জানপ্রাণ লড়িয়ে দিতে পারে। বন্ধুত্ব এমন একটা নিঃস্বার্থ এবং নিষ্পাপম্পর্ক যা সারাজীবনেও নষ্ট হবার নয়।

নিনির মা এই নতুন ভাড়াবাড়িতে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই একেবারে পাখিপড়ানোর মতো করে কতকগুলো কথা তার মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে --- শোনো নিনি মা আমার, রাস্তায় বেরুলে সাবধানে চলবে। চোখকান খোলা রাখবে। ভেবো না সব জায়গা একরকম। কোনও অচেনা লোক ডাকলে কাছে যাবে না। কিছু দিলে খাবে না। এমনভাবে চলবে কেউ যেন বুঝতে না পারে এখানে তুমি নতুন এসেছ কিংবা আনস্মার্ট। নিনি মায়ের সবকথাই অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলে। তাছাড়া এতদিনে তারও যথেষ্ট বুদ্ধি হয়েছে। খারাপ-ভালো লোক দেখলে ঠিক চিনতে পারে। তবে নিনি খুব নরম মনের মেয়ে। দুঃখী মানুষকে দেখে সহজে গলে যায়। ভিখারী দেখলে হাত বাড়াবার আগেই ঝটপট ব্যাগ থেকে পাঁচ-দশ টাকা বের করে দিয়ে দেয়। এসব সে বাড়িতে এসে তার মা-কে শেয়ার করে। মা জেনে খুবই গর্বিত হন মেয়ের এই মানবিক গুণের জন্য।

নিনি বেশ কিছুদিন ধরে একটা ব্যাপার খুব গভীরভাবে লক্ষ করছে। প্রথমদিকে সে ছুটির পর চার-পাঁচ জন বন্ধুর সঙ্গে স্কুলগেট থেকে বেরিয়ে আসতো। কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা তাদের স্কুলবাসে এসে যে যার সিটে বসে অপেক্ষা করত বাস ছাড়ার জন্য। যদিও এরই ফাঁকে গেটের দুদিকে এবং রাস্তার সামনেটা একপলক জরিপ করে নিত। তাছাড়া তার মা তো বলেই দিয়েছেন চারদিকে চোখকান খোলা রেখে চলবে। তো নিনিরা যখন বেরিয়ে আসে স্কুলগেট থেকে তখন গেটের বাঁদিকের শিমুলগাছের লাগোয়া সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে থাকা আধ ময়লা পোশাক পরিহিত একটা বৃদ্ধকে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। ব্যাপারটা নিনি লক্ষ করছে বেশ কিছুদিন ধরে কিন্তু কোনও বন্ধুকে জানায়নি, এমনকি বাড়িতে মা-কেও। নিনি ভেবেছে হয়তো বৃদ্ধটির কেউ না কেউ স্কুলে পড়ে এবং তারই অপেক্ষায় তিনি প্রতিদিন এসে বসে থাকেন গেটের কাছে। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। নিনি একদিন ইচ্ছে  করেই বন্ধুদের থেকে একটু পেছনে দূরত্ব রেখে গেট থেকে বেরুচ্ছিল এবং খেয়াল রাখছিল বৃদ্ধটির গতিবিধি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল নিনিকেই এতদিন ধরে টার্গেট করছিল বৃদ্ধটি। হঠাৎ কাছে এসে বলল---

“দাঁড়াও, আমি তোমাকে হাত ধরে রাস্তা পার করে স্কুলগাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি। দেখছো না রাস্তায় কি দ্রুত গাড়ি চলছে।’’ নিনি অবাক হয়ে গেল! বলল---

“ঠিক আছে দাদু, কোনও চিন্তা নেই, আমি একাই রাস্তা পার হতে পারবো। ওই তো আমার বন্ধুরা আছে।’’

ততক্ষণে নিনির বন্ধুরা পিছন ফিরে এই দৃশ্য দেখে জোরে-জোরে বলে উঠলো---

“কার সঙ্গে কথা বলছিস, চলে আয়!” নিনি বৃদ্ধটিকে দেখে কিছুটা মায়ায় পড়ে গেল। বয়সের ভারে শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কেমন যেন অসহায় ভাবে তিনি তাকিয়ে আছেন তার দিকে। যেন কতকাল দেখেননি কিংবা বহু-বছর আগে থেকেই নিনি তার পরিচিত। অতঃপর নিনি বলল---

“দাদু, আমাদের বাস ছেড়ে দেবে। তুমি সাবধানে রাস্তা পার হও। আমি ঠিক পৌঁছে যাব আমাদের স্কুলবাসে।’’ নিনি যেই সামনের দিকে পা বাড়াবে অমনি বৃদ্ধটি তার পথ আটকে দাঁড়ালো। তাঁর গর্ত হয়ে বসে যাওয়া দুচোখের ভেতর থেকে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়লো---

“তোমাকেই এতদিন ধরে আমি খুঁজছিলাম। হারিয়ে যাওয়ার পরে আবার যে খুঁজে পাবো এ বিশ্বাস আমার ছিলই, তাই প্রতিদিন এই স্কুলগেটে এসে বসে থাকি।’’ নিনির কাছে ব্যাপারটা এবার আরও রহস্যময় হয়ে উঠলো। বলল---

“বুঝলাম না দাদু। ঠিক আছে, আবার কাল কথা হবে। তখন সব শুনবো, টাটা।” বলেই নিনি তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। ততক্ষণে তার অন্য ক্লাসের বন্ধুরা এসে পৌঁছয়নি বলে গাড়িটি অপেক্ষা করছিল। নিনি পৌঁছনোর আরও পাঁচ মিনিট পর তাদের গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে নিনি দেখতে লাগলো বৃদ্ধটি উদাসভাবে তাকিয়ে আছে তাদের বাসের দিকে। এই ঘটনাটি নিনি তার বন্ধুদের তো নয়ই, এমনকি বাড়িতে এসে মা-কেও জানালো না। গাড়িতে আসার সময় থেকে সারারাত নিনি একটা প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে চলেছে---

“হারিয়ে যাওয়ার পর”। মানে কি?

মনে-মনে নিনি সিদ্ধান্ত নিল আসল সত্যটি তাকে জানতেই হবে এবং তারপরে মা-কে সব বলা যাবে। এরপর দিন থেকে নিনি যখন ইচ্ছে করে একা-একা স্কুলগেট থেকে বের হয় তখন লক্ষ করে রাস্তার বিপরীতে অদ্ভুত স্টাইলে মাথার চুলছাটা কয়েকটি বখাটে ছেলে গুলতানি করছে। অমনি সঙ্গে-সঙ্গে বৃদ্ধটি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা ক্যাডবেরি বের করে বলে---

“বিশ্বাস করো আমি কোনও খারাপ লোক নই। দেখছোনা রাস্তার ওপারের ওই ছেলেগুলো ওরা খুব দুষ্টু। কিন্তু ভয় নেই, আমি তো আছি। তারচেয়ে বেশি ভয় এই ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি চলাচলের জন্য।” বলতে-বলতেই বৃদ্ধ হুহু করে কেঁদে ফেলল। নিনি বলল---

“কাঁদছো কেন দাদু? তুমি থাকো কোথায়? তোমার বাড়িতে কে আছে?” উত্তরে বৃদ্ধটি বলল- “সব জানতে পারবে। শুধু বলবো যাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আজ তাকে খুঁজে পেয়েছি।” নিনি তো বিস্ময়ে অবাক---

“আমি তোমার কথার কোনও মানেই বুঝতে পারছি না দাদু। প্লি-জ---আজ নয়, পরের দিন শুনবো।” বলেই নিনি দ্রুত পা ফেলে তাদের গাড়ির দিকে এগোবে অমনি বৃদ্ধটি খপ করে তার একটা হাত জোর করে ধরে রাস্তা পার করে দিল। নিনি ‘থ্যাংকস’ বলে গাড়িতে এসে বসলো। ততক্ষণে সে দেখে নিয়েছে রাস্তার ওপারের ছেলেগুলো কটমট করে তাদের দিকে তাকাচ্ছে। নিনির মনে কেমন যেন উল্টোপাল্টা ভাবনা শুরু হয়ে গেল। আজও ব্যাপারটি সে তার বন্ধুদের এবং মা-কেও জানালো না। কিন্তু কিছুটা অনুমান করতে পারলো বৃদ্ধটির মাথায় কোনও গন্ডগোল আছে, যার জন্য এরকম এলোমেলো কথা বলছে। এবং তারও একটা কারণ আছে অবশ্যই। এযুগের মেয়ে নিনি, বয়েস কম হলেও অনেক বেশি অ্যাডভান্স।

৩.

এরপর থেকে ইশকুল ছুটির পর নিনি তার বুড়োদাদুর সঙ্গে একদিনও দেখা না করে থাকতে পারে না। দাদুও ঝড়বৃষ্টি যাই হোকনা কেন গেটের কাছে এসে নিনির জন্য অপেক্ষা করেন। আর এ রুটিন তাঁর নতুন নয়, অনেক দিনের, যেটা নিনির জানা না-থাকলেও হয়ত অনেকেই জানে। এখন নিনি আর ইশকুল ছুটির পর বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করে না, একা-একাই গেট থেকে বেরিয়ে আসে। প্রতিদিনই দাদু খুঁজে-খুজে তার জন্যে নতুন-নতুন লজেন্স, বিস্কুট, টফি নিয়ে আসে। কোনওদিন ছবি আঁকার রঙিন পেন্সিল বক্স, ড্রয়িং খাতা। নিনি এসব না নিতে চাইলেও দাদু নাছোড়। নিনি বাধ্য হয়ে নেয় পাছে দাদু মনে দুঃখ পাবে এই ভেবে। কখনও-কখনও বলে---

এসব আমার অনেক আছে বাড়িতে। বাপিকে কিছুই বলতে হয় না, যা-যা দরকার সবই আগে থেকে এনে রেখে দেয়। তুমি বরং এগুলো নিয়ে যাও।” মুহূর্তেই দাদুর মুখটা ভার হয়ে যায়। নিনি বুঝতে পারে দাদু তার কথায় কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু নিনি শুধু দাদুকেই নয়, কাউকেই কষ্ট দিতে চায় না। অগত্যা নিতে বাধ্য হয়। আর নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বুড়োদাদুর চোখমুখ খুশিতে ঝলমল হয়ে ওঠে। দাদু তখন নিনির দুগালে দুহাতের আলতো স্পর্শ আদরের ভঙ্গিতে বলে ওঠে---

“এই না হলে আমার নিনি সোনামনি।” এসব দিনের পর দিন চলতেই থাকে। নিনির বন্ধুরা আস্তে-আস্তে ব্যাপারটা জেনে যায়। কেউ- কেউ বলে ---

“বুড়োদাদু তোকে এত ভালোবাসে কেন নিনি? তাই বলে ভাবিস না আমরা হিংসে করছি। তবে দাদুর মনটা কিন্তু খুব ভালো।” নিনি আর চুপ থাকতে পারে না---

“ঠিক বলেছিস। তাছাড়া আমি আমার ঠাকুরদা-ঠাকুরমাকে কোনও দিনই দেখিনি। ঠাকুরমা আমার জন্মের কয়েকদিন পরেই মারা গেছেন। ঠাকুরদা তারও পাঁচ বছর আগে। বাপির মুখে ঠাকুরদার গল্প শুনে মনের মধ্যে তাঁর একটা ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছে। তারপর এই বুড়োদাদুর সঙ্গে দেখা হতেই সেই ছবিটা যেন মিলে গেল। সেই থেকে কিছুতেই এড়াতে পারিনা, কী করবো বল!” নিনির কথায় তার বন্ধুরা আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে। বলে---

“ঠিক আছে। শুধু তোর একার নয়, আমাদেরও দাদু উনি।” নিনি খুব খুশি হয় এ কথা শুনে। দাদুকে সে কথাটি জানায়ও। তারপর একদিন দাদু সবাইকে ক্যাডবেরি খাওয়ায়। আদর জানায়। ফলে নিনি এখন আর এসব কথা মনের মধ্যে গোপন রাখতে চায় না। যাতে পাছে বন্ধুরা তার মা-কে ব্যাপারটা না জানায়, তার আগেই মিনি সব ঘটনা এক-এক করে খুলে বলে। শুনে নিনির মা খুব খুশি হন। কিন্তু এটাও বলতে ভোলেন না যে লোকটা কোনও মেয়েধরা নয়তো! নিনি অবশ্য মায়ের মুখে ছোটবেলায় ছেলেধরার কথা শুনেছে, কিন্তু মেয়েধরার কথাটি এই প্রথম শুনলো। মা-কে সে বিশ্বাস করার জন্য এটাও বলল যে, “না, মা-- দাদুটা খুব ভালো, আমার কথা বিশ্বাস না হয় আমার বন্ধুদেরকে জিজ্ঞেস করো, ওরাও একই কথাই বলবে। তাছাড়া মাঝে- মাঝে মনে হয় আমার ঠাকুরদাই যেন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন।” শুনে মায়ের মনটা অন্য রকম হয়ে যায়। যদিও নিনির ওপর তাঁর অটুট বিশ্বাস। নিনির মা ঠাকুরদার প্রসঙ্গটি রাত্রে তার বাপিকে জানাতেই তিনি তো ভীষণ খুশি। দ্বিগুণ আবেগ কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলেন---

“সব শুনেছি নিনি মা, জানি, ঠাকুরদাকে দেখতে না-পাওয়ার কষ্টটা তোমার মনের মধ্যে আছেই। আমিও কি কম কষ্ট পাই আমার বাবার জন্যে। তুমি যদি তোমার বুড়োদাদুর মধ্যে আমার বাবাকে, মানে তোমার ঠাকুরদাকে দেখতে পাও তাহলে আমিও খুব আনন্দ পাবো। একদিন না হয় তোমার বুড়োদাদুর সঙ্গে আমরা সবাই দেখা করেই আসবো।” বলেই নিনিকে জড়িয়ে ধরে দুগালে আদরের হামি এঁকে দিলেন তার বাপি। নিনি লক্ষ করতে ভুললো না ঠাকুরদার কথা বলতেই তার বাপির চোখ দুটো আনন্দের অশ্রুতে চিকচিক করে উঠলো।

৪.

বুড়োদাদুর ব্যাপারটি বাড়িতে জানানোর পর থেকেই মনে-মনে খুব খুশি নিনি। টিফিনের সময় যেহেতু স্কুলগেটের বাইরে বেরোনোর নিয়ম নেই, সেহেতু ছুটির পর ওই চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই যতটুকু দেখা ও কথা বলা, আর ওতেই যদি একজন মানুষের মন ভালো থাকে তাতে ক্ষতি কি!

নিনিদের মতো বুড়োদাদুরও মুখস্থ কবে কি কারণে ইশকুল ছুটি থাকবে, ফলে সেই -সেই দিন নিনিদের মতো দাদু নিশ্চয়ই বাড়িতে থাকে। আবার কোনও দরকারে বাইরে বেরোতেও পারে।

পর-পর দুদিন ইশকুল ছুটি থাকার পর আজ নিনিরা ইশকুলে এল। সুতরাং দাদুও যে প্রতিদিনের অভ্যাস মতো ইশকুল গেটের কাছে অপেক্ষা করবে এবিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু না, ইশকুল ছুটির পর নিনি তো অবাক! দাদু আজ আসেনি। কিন্তু কেন? নিনি নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করতে থাকে। নিনি এদিক ওদিক ভালো করে দেখলো, না, দাদুর দেখা নেই। নিনি ভালো করেই জানে এলে দাদু নিজেই এসে তার সঙ্গে দেখা করবে। একমিনিটও এদিক ওদিক হবে না, কারণ নিনিদের স্কুলগাড়ি ছাড়ার নির্দিষ্ট একটা টাইম আছে এবং তার মধ্যেই তাকে গাড়ির কাছে পৌঁছে দিতে হবে। না, গেটের কাছের কাউকেও কিছু জিজ্ঞেস করলো না নিনি। কেননা এক দুটো ফুচকা, আলু কাবলি বা মুড়িমসলার দোকান থাকলেও কেউই পার্মানেন্ট নয়, ফ্লাইং। ফলে প্রতিদিন এক-এক জন চাকা লাগানো দোকান নিয়ে আসে আবার চলে যায়। তো ভারাক্রান্ত মন নিয়ে স্কুলবাসে এসে নিজস্ব সিটে বসে নিনি। এদিকে ওদিকে তাকাতে থাকে যদি দাদুকে দেখা যায়।

বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে টিফিন খাওয়ার সময় নিনির মনমেজাজ কেমন যেন বিষন্ন দেখে মা জানতে চাইলেন কি হয়েছে। নিনি জানায় বুড়োদাদু আজ আসেনি। নিনির মা বলে, “নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধা হয়েছে। এর জন্য চিন্তা কি। এমন তো তোমারও হয় নিনি।” নিনি মায়ের কথায় যুক্তি আছে মেনে নেয়। রাত্রে বাবাকেও জানায় নিনি, তাঁরও একই কথা। কিন্তু নিনির মনের মধ্যে উল্টোপাল্টা কিছু ভাবনা বারবার উঁকি দিতে থাকে।

পরদিনও ইশকুল ছুটির পর গেটের পাশে বুড়ো দাদুর উপস্থিতি লক্ষ করা গেল না। নিনির মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা এবার তীব্র হয়ে উঠল। আর মাত্র কয়েক মিনিট সময় আছে স্কুলবাস ছেড়ে দেওয়ার। নিনি উন্মাদের মতো যাকে পাচ্ছে তাকে জিজ্ঞেস করছে বুড়ো দাদু এসেছিল কিনা। কিন্তু কে আর কার খবর রাখে। অগত্যা বাধ্য হয়ে স্কুলবাসের দিকে পা বাড়াবে এমন সময় একজন আইসক্রিম বিক্রেতা তার চাকা লাগানো গাড়ি ঠেলতে- ঠেলতে নিনির সামনে হাজির, নিনির কিছু বলার আগেই সে বলে উঠলো---

“তুমি যাকে খুঁজছো, আমি তাকে চিনি সোনামণি। কিন্তু তার তো খুব বিপদ। হয়তো মরেই গেছে।” শুনেই নিনির দুচোখ কপালে উঠে এলো---

“আপনি বুড়োদাদুকে চেনেন কাকু, কী হয়েছে দাদুর?” লোকটি বলল---

“ওই যে রাস্তার ওপারে একটা চায়ের দোকান দেখছ, ওখানে বসে আড্ডা দেওয়া কিছু বখাটে ছেলে বুড়োটাকে সেদিন চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে বেদম মারলো। এমন মার মারলো যাতে বুড়োটার কপাল দিয়ে রক্ত পড়ছিল। বুড়োটা “বাঁচাও বাঁচাও” চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে এল না। তাদের বক্তব্য বুড়োটা নাকি মেয়েধরা। রোজ স্কুলছুটির পর একটা মেয়েকে লজেন্স ক্যাডবেরি দিয়ে হাত ধরে ওই বাসগুলোর দিকে নিয়ে যায়। এইভাবে পটিয়ে কোন দিন মেয়েটিকে নিকেশ করে দেবে তার ঠিক আছে। আমরা সাহস করে কিছুই বলতে পারিনি, আমাদের ব্যবসা করে খেতে হয়। এরই মধ্যে একটি চারচাকা এসে থামে এবং ভেতর থেকে কয়েকজন বেরিয়ে আসতেই ছেলেগুলো ছুটে পালায়। তারপর ওই লোকগুলোই বুড়োকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এরপর কি হয়েছে আমি কিছুই জানিনা। তবে লোকটি ভালো, ওই যে গলিটা দেখতে পাচ্ছ মেন রোড থেকে নিচে নেমে বাঁক নিয়ে বাঁদিকে ঢুকে গেছে, ওই দিকে কোথাও থাকে। আমি তাকে ওই দিক থেকে আসতে দেখেছি বহুদিন।” বলেই আইসক্রিমঅলা লোকটি চলে গেল আর নিনি দ্রুত তাদের স্কুলবাসে এসে উঠল।

নিনি ভাবতে থাকে ছুটির দিনে কেন বেরিয়েছিল দাদু? সারাদিন, এমনকি বাড়িতে ফেরার পরেও রাত্রে নিনির মনে একটাই প্রশ্ন---

কেন মারলো বুড়ো মানুষটাকে! তাহলে দাদু তো ঠিকই বলেছিল ওই ছেলেগুলো খুব দুষ্টু। নিনি কাঁদতে-কাঁদতে গোটা বিষয়টাই তার মা- কে জানালো। এমনকি বাপিকেও। তার মায়ের মনের মধ্যে থেকে কয়েক মাস আগের সেই সন্দেহটি যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল এবার---

“তাহলে আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম, বুড়োটি মেয়েধরা।” নিনি মায়ের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলো---

একদম না, বিশ্বাস করো, মেয়েধরা নয়। ওই ছেলেগুলোই ভুল বলেছে বুড়োদাদুকে হিংসে করে। আমরা যে ওদের দিকে ফিরেও তাকাই না। আর বুড়োদাদু তো আমাকেই স্কুলবাসের কাছে পৌঁছে দিত।” নিনির মা এবার বুঝলো ব্যাপারটার মধ্যে একটা রহস্য আছে। নিনি ঠিকই বলেছে। অমনি নিনির বাপি এসে হাজির---

“হ্যাঁ, নিনি ঠিকই বলেছে, বুড়োটি কোনও খারাপ লোক নয়। ঠিক আছে নিনি মা, আমরাই যাব তোমার বুড়োদাদুর খোঁজ নিতে। তুমি শান্ত হও।” নিনি বাপির কথায় আশ্বস্ত হল।

নিনির মনের অবস্থা দেখে তার বাপি আর একদিনও দেরি করলেন না। পরদিনই তাঁরা নিনির বুড়োদাদুর খোঁজে বেরোবেন ঠিক করলেন। নিনি ইশকুল যাবে না। তিনিও অফিসে যাবেন না। কে জানে কোথায় থাকে বুড়োটা। সুতরাং সকাল-সকাল একেবারে অফিস টাইমেই নিনি, তার মা এবং বাপি তিনজন তাদের নিজেদের চারচাকায় বেরিয়ে পড়লো। আজ আর ড্রাইভার নিলেন না বাপি, নিজেই ড্রাইভিং করলেন। নিনির মুখে আইসক্রিমঅলার পথনির্দেশ মতো অনেক গলিঘুঁজি ঘুরতে-ঘুরতে একে-তাকে জিজ্ঞেস করতে-করতে অবশেষে বুড়োদাদুর ডেরায় পৌঁছনো গেল। সত্যিই ডেরা। বহুদিনের ইট খসে পড়া জরাজীর্ণ দেওয়ালের ওপর টালির ছাউনি। চারপাশে আগাছার জঙ্গল। বোঝা যায় এখানে কতকাল সংসারী লোকজন থাকে না। যাইহোক দড়ি দিয়ে আটকানো টিনের দরজায় বার কয়েক শব্দ করতেই ভেতর থেকে কোনওরকমে মাজা তুলে উঠে এসে দরজা খুলে দিলেন জীর্ণ চেহারার ডাঁটি বেঁকে যাওয়া চশমা পরিহিত এক বৃদ্ধ। হ্যাঁ, ইনিই নিনির বুড়োদাদু। হঠাৎ এভাবে তাদের দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন তিনি। চোখদুটো ছুঁয়ে কপাল বরাবর মাথার সঙ্গে কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করা, ফলে বুঝে উঠতে পারছিলেন না কারা। মুহূর্তে নিনি আবেগভরা কন্ঠে বলে উঠল---

“তুমি আমাকে চিনতে পারছ না দাদু, আমি তো নিনি। সঙ্গে আমার মা এবং বাপি। তোমার বিপদের খবর পেয়ে আমরা দেখতে এসেছি।” দিনের বেলাতেও ঘরটায় আলো কম। দাদু এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন---

নমস্কার। আমি চোখে দেখতে পাচ্ছিনা না কদিন। যমের দুয়ার থেকে ফিরে এলাম। নিনিমাকে না দেখতে পেয়ে কি কষ্টই না হচ্ছিল আমার তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।”

নিনির বাপি বললেন----

“সব শুনেছি। আপনার কথা নিনি অনেকদিন আগেই আমাদের বলেছে। তো আপনি এখানে একা থাকেন?” এবার যেন কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়ে গেলেন বৃদ্ধটি। হুহু করে সরল শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন---

“হ্যাঁ বাবা, আমার এই দুনিয়ায় কেউই নেই। যারা ছিল একে-একে আমাকে ফেলে তারা সবাই চলে গেছে।

--- ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না, খুলে বলুন। বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর আরও ভারি হয়ে এল। কান্না জড়ানো স্বরে বললেন,

--- হ্যাঁ, আমার ছেলে, বৌমা, এবং একটি নাতনি ছিল। কিন্তু ঈশ্বর দু’জনকে কেড়ে নিলেন।

--- দু’জন মানে?

--- বলছি।

বৃদ্ধের গলা অব্দি এসে কথাটা যেন আটকে গেল। নিনির বাপির কন্ঠে সান্ত্বনার প্রলেপ,

--- বলুন, আপনি তো আমার বাবার মতো। নিনিও আপনাকে ঠাকুরদার মতোই দেখে।

সঙ্গে-সঙ্গে বৃদ্ধ যেন একটু মনোবল ফিরে পেলেন, বললেন,

--- হ্যাঁ, ছেলেটাকে যে কি এক অজানা রোগে ধরেছিল বড়-বড় ডাক্তাররাও তার কিনারা করতে পারলো না। শরীর দিন-দিন শুকিয়ে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে পড়লো, কিছু খেতেই পারতো না। শেষ পর্যন্ত একদিন আমাদের ছেড়ে চলেই গেল।

এতক্ষণে নিনির মা মুখ খুললেন,

--- কিন্তু আপনার বৌমা?

--- তার কথা কি আর বলবো। বলা নেই কওয়া নেই সেও একদিন পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়েটা রেখে সেই যে কোথায় চলে গেল, আজও ফিরে এল না। বয়স কম তো।

নিনির মা যা বোঝার বুঝলেন, বললেন,

--- কিন্তু মেয়েটি?

বৃদ্ধ আর কথা বলতে পারছেন না বুঝতে পেরে নিনির বাপি তাঁকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। বললেন,

--- একটু জল খান। কাঁদবেন না, আমরা তো আছি।

বৃদ্ধ কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। বললেন,

--- এইঘরে আসুন।

একই ঘরের মাঝখানে টিনের বেড়া দিয়ে আলাদা করা ঘরটিতে তিনজন ঢুকতেই বৃদ্ধ আবার গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলেন। ছোট্ট একটি ভাঙা খাটিয়ার ওপর এলোমেলো ছড়িয়ে আছে বই, খাতা, কালার পেন্সিল, কলম।

নিনির মা বললেন,

--- এই ঘরে আপনার নাতনি পড়াশুনো করে? কিন্তু সে এখন কোথায়?

বৃদ্ধ এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, বুকচাপা কষ্ট যেন বাঁধভাঙা স্রোতের মতো বেরিয়ে এল। ঝুলকালি পড়া ইটের দেওয়ালের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন,

--- ওই, ওই তো আমার নাতনি ঝুম্পা

নিনি, নিনির বাপি ও মা-র আর বুঝতে দেরি হল না তিনি কি বলতে চাইছেন। তবু তাঁর মুখে আসল কথাটি জানার জন্য নিনির মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন,

--- বুঝলাম ওটা আপনার নাতনি, কিন্তু...

--- ও আর এই পৃথিবীতে নেই। ওকেও ওই বকুলবালা বালিকা বিদ্যালয়েই ভর্তি করেছিলাম পঞ্চম শ্রেণীতে। প্রতিদিন আমিই ইশকুলে পৌঁছে দিতাম। ছুটির সময় গিয়ে ওই একই জায়গায় অপেক্ষা করতাম ওকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছুটির পর স্কুলগেট থেকে বেরোতেই কোত্থেকে একটা স্কুটার হঠাৎ এসে ধাক্কা দিয়ে চলে যেতেই মুহূর্তে সব শেষ। নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে গেলাম। ওর মা যদি এসে কোনওদিন মেয়ের খোঁজ নেয় সেদিন কি বলবো সেই ভয়ই আমাকে প্রতি মুহূর্তে তাড়িয়ে বেড়ায়। আর সেই থেকেই এক মুহূর্তও বাড়িতে থাকতে পারি না। পথে ঘাটে সব জায়গায় ওকে খুঁজে ফিরি। প্রতিদিনই ইশকুল ছুটির সময় গেট- এর কাছে গিয়ে অপেক্ষা করি যদি ঝুম্পা আসে এই বিশ্বাসে। ঠিক এভাবেই একদিন ওকে পেয়েও গেলাম নিনির মধ্যে। অনেকটা ওরই মতো দেখতে কিনা নিনি মা-কে।

একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলতে-বলতে বৃদ্ধ যেন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। এতক্ষণ পর নিনির বাপি ও মা তাঁদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন। নিনিও বুঝতে পারল কেন তার বন্ধুদের মধ্যে কাউকে এতটা ভালো না বেসে তাকে ভালবাসে বুড়োদাদু।

সত্যিই মানুষটা এই পৃথিবীতে বড় একা, নিরাশ্রয়। এদিকে সন্ধে নেমে এসেছে। বাড়িটার চারপাশে যেন দ্রুত গাঢ় হয়ে উঠছে অন্ধকার। এবার বাড়ি ফেরবার তাড়া। নিনির বাপিও বৃদ্ধের প্রতি কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে পড়লেন। বললেন,

--- একদম চিন্তা করবেন না। নিজেকে একা ভাববেন না। আমরা তো আছি। মাঝে -মাঝে খোঁজ নেব। আর নিনিকে শুধু আশীর্বাদ করুন ও যেন আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।

নিনির দুচোখের কোণে জলের রেখা নেমে এলো। বলল,

--- হ্যাঁ দাদু, তুমি সব সময় আনন্দে থাকবে। আমার জন্মদিনে অবশ্যই আমাদের বাড়িতে আসবে কিন্তু। জানো দাদু, তোমার মতো আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি।

মুহূর্তে বৃদ্ধের চোখমুখে যেন সব ফিরে পাবার এক অনাবিল আনন্দের ঝলক খেলে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন পৃথিবীতে অন্তত তাঁর একটি আশ্রয় আছে, মনের আশ্রয়, সে হলো নিনি। সঙ্গে-সঙ্গে নিনিকে জড়িয়ে ধরে আদরের হামি এঁকে দিলেন দুই গালে। অতঃপর নিনিরা তাদের চারচাকায় উঠে পড়ল। সেই আলোআঁধারি পরিবেশে গাড়ির কাচ দিয়ে নিনি দেখলো তার বুড়োদাদু তখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে তাদের দিকে ডান হাত তুলে বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে!