গল্প - ৪ । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

 ইকি রে বাবা











দেবাশিস দন্ড 
মেদিনীপুর, পশ্চিম বঙ্গ




 

ভোলানাথ গাঁতাইত টাকে হাত দিয়ে থেবড়ে বসে রইলেন। পাশে গিন্নি অনিমা। তাঁর পানপাতা মুখখানা চাপে-চিন্তায় চৌকো হয়ে গেছে। ওরা যেন লাস্ট ব্যাটসম্যান, ৭ বলে ৩৭ রান করতে হবে। চোখের সামনে ছড়ান ১৮৯টা বিয়ের চিঠি। পালকির ভেতর নববধূ এক হাত ঘোমটা টেনে বসে আছে। একে একে সবকটা চিঠিই ফেরত এসেছে। ইকি রে বাবা! ফনি মাস্টারকে ব্যাপারটা খুলে বলা হয়েছে। উনি মস্ত জ্ঞানী লোক। গোটা গোটা বাদামের মত হাতের লেখা। নিজের হাতে ঠিকানাগুলো লিখে দিয়েছেন। ভোলানাথ যাচাই করে দেখেন নি। অত বিদ্যেবুদ্ধি তাঁর নেই।

ফনি মাস্টার বললেন- খামে স্ট্যাম্প লাগিয়েছিলে তো?

: কি যে বলেন মাস্টারমশয়, লন্ঠনকে পোস্টাপিসে পাঠিয়ে হাজার টাকার স্ট্যাম্প আনিয়েছি। তারপর কাকা ভাইপো মিলে প্রত্যেকটা খামে সেঁটেছি। অত কাঁচা ভোলানাথ কাঁঠালবালা নয়। এরপর ফনি মাস্টার বিস্তর ভাবলেন। ভেবেচিন্তে বললেন- পোস্টম্যান নির্ঘাত ওইসব ঠিকানায় সঠিক ব্যক্তিদের খুঁজে পায় নি। খুঁজে না পেলে পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট ফেরত দিয়ে যায়।

কেউ থাকে আড়ংঘাটা, কেউ আগরতলা। কেউবা ডিব্রুগড়। বাকি যারা তারাও একেকজন একেক দিকে। ১৮৯টা ঠিকানার কেউ কোত্থাও নেই? ইকি রে বাবা!

ভোলানাথের প্রথম মেয়ের বিয়ে। সব কুটুমবাটুমদের টার্গেট ছিল ময়নার বিয়ের দিকে। তখনও পাত্রপক্ষর সঙ্গে ফাইনাল রফা হয় নি, কে কি কব্জি ডুবিয়ে খাবে একটা করে চুটকুল্লা দিয়ে গেছে। ভোলানাথ সেসব মাথায় রেখে মেনু সাজিয়েছেন। কেষ্টনগরের সরভাজা। গোপীবল্লভপুরের গলদা চিংড়ি। কেটেছেঁটেও একচল্লিশটা আইটেম। এতগুলো লোকের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। হাতে আর মাত্র দুদিন। কোথায় লোকজন আসবে তা নয়, কার্ডগুলো ড্যাং ড্যাং করে ফেরত চলে এল। ইকি রে বাবা!

ফনি মাস্টার বললেন- অত চিন্তা কোরো না ভোলাদা। একে একে ফোনে সবাইকে খবরটা দিয়ে দাও। বুঝিয়ে বললে সবাই বুঝবে।

ফোন দু চক্ষের বিষ ভোলানাথের। ফোন আবার কি? নবাব সিরাজদৌলার ফোন ছিল? রানি রাসমণির ফোন ছিল? এখন ফোন গজিয়ে একটার পর একটা কেলেংকারি। হুলো বেড়াল দুধের হাঁড়িতে মুখ চুবিয়ে বসে আছে, হুঁশ নেই। রাস্তায় চলতে ফিরতে পিক আপ ভ্যান ঠুকে দিয়ে চলে যাচ্ছে, হুঁশ নেই। যত্তসব। ভোলানাথ কারও নম্বর রাখার প্রয়োজন বোধ করেন নি।

নাহ, একবার পোস্টাপিসে গিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে আসা দরকার। এটা পরিষেবা? মানুষের মান ইজ্জত নিয়ে এরা টানাটানি করে কোন সাহসে?

১৮৯টা চিঠি বান্ডিল করে ভোলানাথ চললেন পোস্টাপিসে। সাব পোস্টমাস্টার হলধর হালদার তখন রেজিস্ট্রি চিঠির ওপর ঠক ঠক করে সিল ঠুকছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন- কি চাই?

ভোলানাথ বললেন- ন্যায্য বিচার।

: কোর্টে চলে যান। সোজা গিয়ে বাঁদিকে।

: এখানে না পেলে তখন যাব।

: অ। তা, কি কমপ্লেন আছে শুনি?

: আমার ১৮৯টা বিয়ের কার্ড ফেরত চলে এসেছে।

: কোত্থেকে?

: বজবজ, বাদকুল্লা, আড়ংঘাটা, আগরতলা, ডিব্রুগড়, কোয়েম্বাটোর কত নাম বলব?

: এ আবার কি কথা?

: সেটাই তো কথা। সারা দেশের চাদ্দিকে আমার আত্মীয় কুটুম ছড়ান। সবাই একসঙ্গে উধাও হয়ে গেল? ইকি রে বাবা!

: অ্যাড্রেস ঠিকঠাক লিখেছিলেন?

: ইয়েস স্যার।

: বুঝেছি, আর বলতে হবে না। এইরকম কেস আগেও একবার হয়েছিল। টু-এর জায়গায় ফ্রম আর ফ্রমের জায়গায় টু লিখে দিয়েছিল। সব চিঠি তার বাড়িতেই ঘুরে চলে গেছিল।

: আপনার হেড। আই মিন আপনার মুন্ডু।  ফনি মাস্টার বিদ্বান লোক। তিনি এসব উল্টোপাল্টা করতে পারেন না।

: স্ট্যাম্প লাগিয়েছিলেন?

: ইয়েস স্যার। খাম পিছু পাঁচ টাকা।

: তাহলে বলছেন সব দোষ পোস্টাপিসের?

: ইয়েস স্যার।

: আপনি সিওর আপনার কোথাও ভুলচুক নেই?

: হান্ড্রেড পারসেন্ট স্যার।

: খামগুলো এনেছেন?

: ইয়েস স্যার। এই দেখুন।

হলধর বান্ডিলটা হাতে নিয়ে বললেন- কি করেন?

: সিজন বিজনেস। কাঁঠালের সময় কাঁঠাল, ফুলকপির সময় ফুলকপি।

: কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা বলব?

: ইয়েস অফকোর্স স্যার।

: পড়াশুনো কদ্দুর?

: নো স্যার।

: ভুলটা পোস্টাপিসের নয়। আপনার। স্ট্যাম্পগুলো ঠিক নেই।

: কমপ্লিট নকল? ইকি রে বাবা!  কিন্তু লন্ঠন, আই মিন আমার ভাইপো এখান থেকেই স্ট্যাম্প নিয়ে গেছে।

: নকল স্ট্যাম্প কেন হবে?

: তবে?

: সবগুলোই রেভিনিউ স্ট্যাম্প।