আমার বুঝতে
অসুবিধা হল না, ভবানীপ্রসাদের ডাকনাম মনা। এও বুঝলাম,
বুড়িমা হলেন ভবানীপ্রসাদের মা। ভবানীপ্রসাদকে দেখার কৌতূহল আরও
বেড়ে গেল। টালির চালের ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলাম। টালির চালাটা এতই নীচু ছিল যে,
মাথাটা একটু নীচু করেই ঢুকতে হল ছোট্ট দাওয়ায়। দাওয়ার একপাশে
রান্নার ব্যবস্থা। দাওয়া পেরিয়ে ছোট্ট একটা ঘর। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটার উত্তরদিকে
একটা কাঠের তক্তপোশ। তার ওপরেই বসে আছেন ভবানীপ্রসাদ মুনি-ঋষির মতো। আমাকে দেখতে
পেয়ে ডাকলেন, “এসো, বসো।”
আমি বসলাম।
আমার পরিচয় দিলাম। আমার একটু ভয় ভয় করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ভয় কেটে
গেল। ভবানীপ্রসাদের সুন্দর মিষ্টি ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করল। এমনভাবে কথা বলছেন যেন
আমি তাঁর কত চেনা, কত কাছের। নিমেষের মধ্যেই আমাকে আপন
করে নিলেন। লেখালেখি নিয়ে অনেক কথা বললেন। পরের রবিবার আবার বাড়িতে ডাকলেন।
বললেন, “অবশ্যই সঙ্গে কয়েকটা লেখা এনো।”
তারপর থেকে
প্রতি রবিবার আমি ভবানীপ্রসাদের বাড়ি যেতাম। আমার মতো অনেকেই যেত। ওখানে পরিচয়
হল উলুবেড়িয়ার ছড়াকার বিশ্বজিৎ মণ্ডল, রামরাজাতলার কবি অংশুমান চক্রবর্তী, কবি তরুণ মিত্র,
আন্দুলের ছড়াকার অশোক প্রধানের সঙ্গে। পুরুলিয়ার কবি মোহিনীমোহন
গঙ্গোপাধ্যায়কে কয়েকবার আসতে দেখেছি। আমরা যা লিখে নিয়ে যেতাম, ভবানীপ্রসাদ তা দেখতেন। ভুল থাকলে সংশোধন করতেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়
প্রকাশ করার ব্যবস্থা করতেন। আমাদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা বসাতেন। কখনও
ডাক্তার গোপাল মণ্ডলের চেম্বারে, কখনও বালটিকুরি রামকৃষ্ণ
আশ্রমে, আবার কখনো-বা শানপুরের বাসুদেব সাহার বাড়িতে।
ভবানীপ্রসাদ
আমাদের কয়েকজনকে ছড়াপাঠ করার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। একবার দক্ষিণ
কলকাতার একটি ক্লাবের অনুষ্ঠানে ভবানীপ্রসাদের সঙ্গে আমার যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল।
সেখানে একই মঞ্চে ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ, অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী, অভিনেত্রী মাধবী মুখার্জি
ও আমি উপস্থিত ছিলাম।
ভবানীপ্রসাদ
শিবশংকর মাজীকে খুব ভালোবাসতেন। সে ‘ফোকলা বুড়োদা’ ছদ্মনামে খুব সুন্দর সুন্দর ছড়া
লিখত। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে সে অকালে ঝরে গেল। সেই সময় ভবানীপ্রসাদ অত্যন্ত
মর্মাহত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তার স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি ‘শিবশংকর
মাজী স্মৃতি পুরস্কার’ চালু করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম ওই
পুরস্কার আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
বাংলায়
আমাদের মতো বহু ছড়াকার ছড়িয়ে আছেন যাঁরা ভবানীপ্রসাদের হাত ধরে উঠে এসেছেন।
ভবানীপ্রসাদের
বাবা নারায়ণচন্দ্র মজুমদারকে আমি চোখে দেখিনি। তবে তাঁর রত্নগর্ভা মা নিরুপমা
দেবীকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। অত্যন্ত স্নেহময়ী ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। আমি যখন
ভবানীপ্রসাদের বাড়ি যেতাম, সকাল সকাল পৌঁছে যেতাম। কারণ,
মা নিরুপমা দেবীর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতাম। ভালো কিছু রান্না হলে
একটা বাটি করে তিনি আমাকে খেতে দিতেন। কাঠের পিঁড়িতে বসে চামচ দিয়ে খেতাম। তারপর
ভবানীপ্রসাদের ঘরে যেতাম। তিনি যখন যা-কিছু লিখতেন, আমাদের
তা পাঠ করে শোনাতেন। যে-কোনো বিষয়কে খুব সুন্দর ছন্দে তিনি বাঁধতে পারতেন।
ছড়াগুলো শ্রুতিমধুর ও শিক্ষনীয় হত। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। আর সেই
লেখাগুলোই লিটল ম্যাগাজিন কিংবা নামিদামি কোনও পত্রিকায় ছাপার হরফে দেখতে পেতাম।
ভবানীপ্রসাদ
শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি ফুল প্যান্টের ওপর
পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করতেন। মুড়ি-তেলেভাজা ছিল তাঁর প্রিয় খাবার। তাঁকে আমি
কোনোদিন বুট পায়ে দিতে দেখিনি। হাওয়াই চপ্পল কিংবা চামড়ার চটি পায়ে সাহিত্যের
আড্ডা-অনুষ্ঠানে যেতেন। আমাদের বাড়িতেও তিনি দু-দু’বার এসেছিলেন অতি সাধারণ সাজে।
ভবানীপ্রসাদ
কয়েক হাজার ছড়া লিখেছেন। দশ-এগারো বছর বয়স থেকে তাঁর ছড়া লেখা শুরু। ছোটো কাকা
যোগেশচন্দ্র মজুমদার তাঁকে সর্বদাই ছড়া লেখায় উৎসাহ দিতেন। তিনি বিভিন্ন ছদ্মনাম
ব্যবহার করতেন। যেমন—সবুজ বুড়ো, ভবানন্দ ভারতী, বেচারাম বাচস্পতি, দুর্গাপ্রসাদ দেবশর্মা, কৃষ্ণস্বামী গোস্বামী
ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভবানীপ্রসাদ
আমাদের কাছে চাঁদের মতো। তাঁর জ্যোৎস্নায় আমরা আলোকিত। তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা
করি।
আমার লেখা
একটি ছড়া দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই—
ছড়ার ছোঁয়ায় দোলায় সবার মন
শানপুরের এক ছড়ার জাদুকর,
সোনার কাঠি কলমটি তার দিয়ে
বইয়ে যে দেয় সবার বুকে ঝড়।
মিষ্টিমধুর তার যে হৃদয়খানা
স্নেহ মায়া মমতার এক ঘর,
তার আঙিনায় সবাই সবার আপন
পর নয়তো, নয়তো কেহ পর।
সবুজবুড়োর অবুঝ মনের কথা
দুগ্গা থেকে দুর্গা সবাই শোনে,
ভবানীপ্রসাদ আলো ভরা চাঁদ তাই
দাগ কেটে যায় সব শিশুদের মনে।