সি.বি.এস.ই বা আই.সি.এস.ই
বোর্ড ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ সহজে বোঝাবার জন্য
এটাকে দিল্লি বোর্ডও বলেন। সেই বোর্ডের পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন
ক্লাসের সিলেবাস তৈরি করার ভার যে গুটিকতক লোকের কাঁধে পড়েছিল তার মধ্যে আমি
ছিলাম একজন।
না, আমি শিক্ষাবিদ হিসেবে নয়। আমি ছিলাম কবি এবং সাহিত্যিক
হিসেবে। বাংলা বইয়ের সিলেবাসে কোন কোন লেখকের কোন কোন লেখা কোন ক্লাসে পাঠ্য
হওয়ার জন্য আদর্শ, সেটা বাছাইয়ের দায়িত্ব ছিল আমার।
যেহেতু একক এবং যুগ্মভাবে
বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক, যেমন লীলা
মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ
চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর,
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়,
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য,
নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণকুমার চক্রবর্তী, শুভঙ্কর সিংহের সঙ্গে প্রায়
সাতশোর ওপর সংকলন সম্পাদনা করেছি, সম্পাদনার সঙ্গে
ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে, তার ওপরে
আমি যেহেতু যৎসামান্য লেখালেখিও করি, দেখতে দেখতে প্রকাশিত
হয়ে গেছে ৩১৬টি বই। ফলে সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব আমার উপরেই বর্তে ছিল।
সাধারণত এই ধরনের
পাঠ্যসূচিতে কোনও সাহিত্যিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করার সময় অনেকগুলো জিনিস মাথায়
রাখতে হয়। তার প্রথম এবং প্রধান হল, যে
সাহিত্যিকের নাম নির্বাচন করা হবে তিনি যেন সর্বজন স্বীকৃত হন। তাঁকে নিয়ে যেন
পরবর্তীকালে কোনও বিতর্ক কিংবা কোনও সমস্যার সৃষ্টি না হয়।
আজ থেকে বছর পনেরো আগে
পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ক্লাস ফাইভ-সিক্স-সেভেনে যখন আমার গল্প পাঠ্য হল, তখন তা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। বিতর্ক বাধিয়েছিলেন মূলত আমার
সমসাময়িক লেখক বন্ধুরাই। যদিও সেই সিলেবাস কমিটিতে আমি ছিলাম না। শুধু যে ছিলাম
না তাই নয়, সেই সিলেবাস কমিটির কারও সঙ্গেই আমার কোনও
যোগাযোগ ছিল না।
আর পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্য
হওয়া আমার যে গল্পটি নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল, সেই ‘ঈশ্বরের মতো দেখতে’ গল্পটি
পরবর্তীকালে আমাকে দিয়ে নাট্যরূপ করিয়ে বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী সতীনাথ
মুখোপাধ্যায় শিশির মঞ্চে মঞ্চস্থ করেছিলেন নাটক। সে-নাটক শেষ পর্যন্ত কত রজনী
হয়েছিল আমার আর মনে নেই। তবে সেই নাটকটি যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, প্রতিটি শো শুরু হওয়ার অনেক আগেই হাউস ফুল বোর্ড ঝোলানো দেখেই আমি তা টের
পেয়েছিলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নাটকটির উচ্চ প্রশংসা দেখে বুঝেছিলাম গল্পটি
মন্দ নয়।
সেই নাটক দেখতে এসেছিলেন
বাংলা সাহিত্যের তাবড় তাবড় লেখকরা। এসেছিলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদারও। যাবার সময়
হরিদার চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে বলেছিলেন, “যাক, তোমার সৌজন্যে একটা ভালো নাটক
দেখা গেল। গল্পটা খুব ভালো।”
আমি বলেছিলাম, “ঠিক আছে, মূল গল্পটা আমি আপনাকে পড়ার
জন্য দেব।”
খুব উৎসাহ দেখিয়েছিলেন
তিনি। যাবার সময়ে বলেছিলেন, “আমারও বেশ কয়েকটি লেখা আছে,
যেগুলো স্কুলে পাঠ্য হতে পারে।”
কথাটা আমার কানে লেগেছিল।
তাই সে-বার যখন সি.বি.এস.ই বা আই.সি.এস.ই বোর্ডের বাংলা সিলেবাস তৈরি করার ভার
পেলাম, আমি প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, এতদিন
ধরে চলে আসা সিলেবাস তৈরির চিরাচরিত নিয়মকানুন আমি ভাঙব। কৈফিয়ত এড়ানোর ভয়ে আর
পাঁচজনের মতো বহু যুগ আগে গত হওয়া শুধু সাহিত্যিকদেরই রাখব না, রাখব এমন দু-চারজনকে যাঁরা এখনও সশরীরে বর্তমান। ফলে কবি হিসেবে যেমন
শ্যামলকান্তি দাসের নাম আমি রাখলাম, ছড়াকার হিসেবে রাখলাম
ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের নাম।
এ দুজন ছাড়াও ছিলেন
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে।
শুধু সাহিত্যিকদের
নির্বাচন করলেই তো হল না, কোন ক্লাসের জন্য তাঁর কোন লেখাটা
রাখা যেতে পারে, সেটা বাছাই করার পর্বটিও অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। সে-সব পর্বের পরে থাকে আরও একটা কাজ। যে লেখাগুলো শেষ পর্যন্ত বাছাই
হল, সেই লেখাগুলোর রচয়িতার বাড়িতে গিয়ে তাঁদের লিখিত
অনুমতি নিতে হয়। যে সাহিত্যিকদের কপিরাইট উঠে গেছে, তাঁদের
অনুমতি নেওয়ার কোনও দরকার নেই। কিন্তু তার বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁদেরটা তো জোগাড় করতে হবে। তাই তাঁদের নাম-ঠিকানা জোগাড় করা শুরু হল।
সেই তালিকায় যেমন ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সন্তোষকুমার
ঘোষেরা; তেমনই ছিলেন শ্যামলকান্তি দাস এবং ভবানীপ্রসাদ
মজুমদার।
হাওড়ায় ভবানীদার বাড়িতে
যখন ঢুকলাম আমি প্রথমেই খুব শক খেলাম। অনেকদিন আগেই শুনেছিলাম, কিন্তু কানে শোনা আর নিজের চোখে দেখার মধ্যে যে আকাশপাতাল
ফারাক তা আর একবার টের পেলাম।
হ্যাঁ, ভবানীদার একটা পা বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনও উপায়
ছিল না। অনিয়ন্ত্রিত সুগার যে একটা মানুষকে কোন জায়গা নিয়ে যেতে পারে, ভবানীদাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। শুধু যে একটা পা বাদ দিতে হয়েছে
তা-ই নয়, শরীর একদম ভেঙেচুরে গেছে। বুঝলাম, স্মৃতিশক্তিও লোপ পেয়েছে। না-হলে যাঁর সঙ্গে আমার এত বছরের সম্পর্ক তিনি
আমাকে দেখেও চিনতে পারেন না!
বছর পঁচিশ-তিরিশ কিংবা
তারও আগে ভবানীদা যখন নিয়মিত কলেজ স্ট্রিটে আড্ডা দিতে আসতেন, আড্ডা মারতেন সন্দেশ পত্রিকার আউটলেট নিউস্ক্রিপ্টের সামনে
অথবা কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের ভেতরে ঘোষ কেবিনে। তখন দেখা হলেই হাত ধরে টেনে বসাতেন
তাঁর পাশে। মাঝে-মাঝেই হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সঙ্গে যেতে হত শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের
শেষ এবং বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের শুরুর সংযোগস্থলে, যার
পাশ দিয়ে ঢুকে গেছে দে বুক স্টোরের গলি, সেই গলির মুখে একটি
তেলেভাজার দোকানে। কারণ আর কিছুই নয়, শুধু বেগুনি। না,
আর কোনও তেলেভাজা নয়, একমাত্র বেগুনিই ছিল ভবানীদার
সবচেয়ে প্রিয়। তাঁর বাড়িতে যদি মিষ্টি নিয়ে যেতাম তিনি ক্ষুণ্ণই হতেন। বলতেন,
“এগুলো নিয়ে আসো কেন? বেগুনি আনতে পারো না?”
তখন তিনি বকলমে ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ পত্রিকাটি
সম্পাদনা করতেন এবং নিয়ম করে শুধু পুজো সংখ্যাতেই নয়, সাধারণ
সংখ্যার জন্যও ছড়া চাইতেন। আমি একবার বলেছিলাম, “আমি তো
সেইভাবে ছড়া লিখি না। গল্প লিখব?”
ভবানীদা বলেছিলেন, “আগে ছড়া দাও, তারপর গল্প। যে এত ভালো
কবিতা লেখে সে যদি ছড়া লেখে, তার ছড়া ভালো হবেই।”
ভবানীদার আমন্ত্রণে ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’-এ ছড়া লিখতে
লিখতে এত ছড়া লিখে ফেলেছিলাম যে শুধু সেই ছড়াগুলোকে নিয়েই বিকাশ গ্রন্থ ভবন
প্রকাশ করেছিল আমার ‘ছড়া ছবি ৬০খানা’ বইটি।
যে বইটিতে সুন্দরবনের জ্যোতিষপুর হাই স্কুল থেকে কলকাতার সাউথ পয়েন্ট
স্কুল—পশ্চিমবঙ্গের মোট ৬০টি স্কুলের প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মোট
ষাটজন ছাত্রছাত্রী ৬০টি ছড়ার সঙ্গে ৬০টি ছবি এঁকেছিল। সেই বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠান
হয়েছিল রাসবিহারী মোড়ের কাছে মুক্তাঙ্গন রঙ্গালয়ে। সেখানে এসেছিলেন কিংবদন্তি
বাচিক শিল্পী প্রদীপ ঘোষ, ভাষাবিদ পবিত্র সরকার, শিশুসাহিত্যিক অশোককুমার সেন থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় বিশিষ্টজনেরা।
বিশেষ অতিথি ছিলেন ভবানীদা। সেখানে উপচে পড়া কচিকাঁচাদের ভিড় এবং বিভিন্ন মুদ্রিত
এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার হামলে পড়া দেখে ভবানীদা বলেছিলেন, “এটা তোমার পক্ষেই সম্ভব।”
সেই আড়াই ঘণ্টার
অনুষ্ঠানে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল তিনশো কপি ‘ছড়া ছবি
৬০খানা’। বিক্রির বহর দেখে প্রকাশকও চমকিত হয়েছিলেন। ভবানীদা তখন ওইভাবে প্রশ্রয় না
দিলে আমার হয়তো আর ছড়া লেখাই হত না।