একা হাতে
চাষি সবদিক
আর পেরে উঠছে না দেখে একদিন গাঁ-বুড়ো ডেকে বললে, “কাজের কথা বলি শোন। দেখেশুনে একটা বিয়ে কর আবার। নইলে মেয়ে, চাষবাস একা হাতে সামলাবি
কী করে? আমার
নজরে আছে তেমন এক পাত্রী। সেও অসময়ের বিধবা। এক মেয়ের মা। তুই রাজি থাকিস তো কথা চালাই।”
চাষি সবদিক ভেবে আর অমত
করে না। দিন কয়েক বাদেই দ্বিতীয় পক্ষকে ঘরে এনে তোলে।
চাষির এখন দুই মেয়ে।
নাখুতি ছোটো, আর নতুন
বউয়ের মেয়েটি বয়সে বড়ো। নাম তার নাইশি।
মেয়ে দুটো বড়ো হয়ে উঠল
দেখতে দেখতে। চাষি-বউ চাষিকে তাড়া দেয়—“মেয়েদের তো বিয়ের বয়স হয়েছে, নাকি? পাত্র-টাত্র দেখে বিয়ে ঠিক করছ না কেন?”
বুড়ো
ঝাঁঝিয়ে ওঠে—“আরে
ধ্যাত, আমি
কোথায় গিয়ে কার সঙ্গে কথা জুড়ব? ওদের ভাগ্য ভালো হলে পাত্রেরা নিজেরাই খোঁজ করতে আসবে’খন।”
এভাবে চাষি-বউ রোজ চাষিকে
খুঁচিয়ে চলে আর চাষি রেগে কাঁই হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
শেষে একদিন বুড়ো রেগেমেগে
বাঁশকরুলের তরকারি আর এক হাঁড়ি ভাত রেঁধে দিতে বলল বউকে। জামাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে
তা সে খাওয়াবে তাকে।
পরদিন ভোরে
মোরগ ডাকার আগেই চাষি সেই ভাত-তরকারি নিয়ে বনে চলল জামাই খুঁজতে। গভীর বনে গিয়ে
বুড়ো জেদের বশে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল ‘জামাই, ও জামাই’ বলে। জনমানবশূন্য বনে ডাকাডাকি করে ক্লান্ত হয়ে একসময় ভাবল
ভাত-তরকারি সব সে নিজেই খেয়ে নেবে। কারও যখন দেখা নেই তো কী আর করা। অমনি সামান্য
দূর থেকে কে যেন ‘উ-ই-ই’ বলে সাড়া দিল। চাষি খানিকটা এগিয়ে গিয়েই সামনে
পেল উইয়ের এক ঢিবি। নির্ঘাত এখান থেকেই সাড়া দিয়েছে কেউ। খাবারগুলো তাই ওখানেই
ঢেলে দিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। কিছুক্ষণ পর নিশ্চয়ই জামাইয়ের খাওয়া
হয়ে গেছে ভেবে এগিয়ে এল। দেখে, একদল উই ঢিবি থেকে বেরিয়ে এসে খাবার খেতে লেগেছে। আর যাবে
কোথায়? তৎক্ষণাৎ সব উইপোকা চেম্পাইয়ে (ঝুড়ি বিশেষ) তুলে বাড়ি নিয়ে এল
বাড়িতে। উঠোনে পা দিয়েই বুড়িকে হেঁকে বললে, “কই গো, এনেছি তোমার জামাই। বেছে নাও শিগগির।”
সব দেখেশুনে
বুড়ির তো চোখ কপালে উঠল। মিনসে
করেছেটা কী! শেষে কিনা এক দঙ্গল উইপোকা ধরে এনে বলছে জামাই বেছে নিতে? ভীমরতি ধরল, নাকি!
বুড়ি তাড়াতাড়ি বললে, “শিগগিরই লাকড়ি-ঘরে রেখে
এসো চেম্পাইসুদ্ধু। রক্ষে থাকবে না নইলে।” আর মনে মনে ফন্দি আঁটল, দাঁড়াও বুড়ো। আমি জামাই খুঁজতে তাড়া দিই বলে আমার সঙ্গে এই
করলে? আমিও
দেখাব মজা। তোমার মেয়েকেই পাঠাব আমি ওই জামাইয়ের ঘর করতে।
নাখুতি রাতে খেয়েদেয়ে
শোবার উপক্রম করতে বুড়ি জোর করে তাকে লাকড়ি-ঘরে ঢুকিয়ে দরজা এঁটে দিলে। ও-ঘরেই আজ থেকে শোবে ও। সৎ
মার কাছে নাখুতির কোনও কথাই খাটে না। আজও খাটল না। কোনও কাকুতিমিনতিই কাজে এল না
নাখুতির। বাপও চুয়াক (উত্তেজক পানীয় বিশেষ) গিলে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে পড়ে। সুতরাং
বুড়িকে বাধা দেওয়ারও আর কেউ রইল না। নাখুতি অগত্যা লাকড়ি-ঘরেই
বিছানা পেতে ঘুমের তোড়জোড় করল।
রাতে উইপোকা আর লাল
পিঁপড়ের কামড় খেয়ে নাখুতির হাত-পা ফুলে কলাগাছ। জ্বলুনিতে ঘুম ভাঙতেই আঁতকে উঠল
সে। ছোট্ট জানালার ঝাঁপ ফাঁক করে বাইরের আকাশে তাকিয়ে আছে এক সুপুরুষ। নাখুতির গলা
দিয়ে দুর্বোধ্য এক আতঙ্কের শব্দ বেরিয়ে আসতেই ফিরে তাকালে সেই পুরুষ। স্মিত হেসে
বললে, “ভয় পেও
না। আমি রাজার ছেলে। এক দুষ্ট জাদুকরের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে শাপগ্রস্ত হয়ে
উইপোকা হয়ে আছি। কোনও নারী যদি আমাকে বরণ করে নেয় তবেই আমার শাপ কেটে যাবে। তুমি
ভেবো না। আমার শাপমোচনের সময় আসন্ন প্রায়।”
নাখুতি ড্যাব ড্যাব করে
তাকিয়ে রইল সেই রাজপুত্তুরের পানে। কাউকে কিছু জানাল না।
পরদিন সকালে
সমবয়সি মেয়েদের
সঙ্গে জুমে গিয়ে বুড়ির মেয়ে নাইশি উঁচু গলায় বলে ওঠে, “শোন শোন, সবাই শোন। ভারি মজার কথা।
নাখুতির উইপোকা বর হয়েছে। বাবা খুঁজে এনেছে। ও এখন উইপোকার বউ।”
নাইশির কথা
শুনে তো সবাই এ-ওর গায়ে
হেসে ঢলে পড়ে। ঠাট্টা-তামাশায় বিষিয়ে দিল নাখুতির দু-কান। সে লজ্জায়, অপমানে জুমে কাজ শেষ না
করেই ফিরে এল ঘরে।
সেদিনও
লাকড়ি-ঘরেই শুতে গেল নাখুতি। পরদিন সকালে উঠে এসে রান্না চাপাতে গেলে বুড়ির চোখে
পড়ে যায়, মেয়ের
দু-কানে
দুলছে সোনার দুল। ব্যাপারখানা কী? নাখুতির কানে আগে তো কখনও দুল ছিল না। কাল রাতে লাকড়ি-ঘরে
ঢোকার সময়ও তো ছিল না। রাতারাতি এল কোত্থেকে? নজর রাখতে হবে তো।
পরদিন রাতে নাখুতি ঘুমোতে
এলে রাজকুমার বেরিয়ে এল আবার। নাখুতি খানিক ইতস্তত করে বলেই ফেলে, “এভাবে তো বেশিদিন চলতে
পারে না, কুমার।
ঘরসংসার হবে কী করে?”
কুমার উপায়
বাতলায়—“আজ আমি
ঘুমিয়ে পড়লে মাচার খুঁটির সঙ্গে আমার হাত-পা আচ্ছা করে বেঁধে ফেলো। তারপর বাকি
উইপোকাগুলোকে একত্র করে আগুন দিয়ে দিও। তাহলেই আমি মানবরূপ ফিরে পাব চিরতরে।”
নাখুতি তাই করল। কুমার আর উইপোকার
ভেতর ঢুকতে পারল না। রাত ভোর হলে স্বামীর সেবা শুরু করে নাখুতি। পা ধুইয়ে দেয়, জলখাবারের ব্যবস্থা করে।
তারপর দুপুরবেলা পরিপাটি করে রেঁধে-বেড়ে থালায় পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে নিয়ে যায় শোবার
ঘরে।
সৎ মা আশ্চর্য চোখে দেখে
আর ভাবে, নিশ্চয়ই
এর মধ্যে কোনও রহস্য আছে। লাকড়ি-ঘরের বেড়ার ফাঁকে চোখ ফেলে সে। দেখে, মানুষ তো নয়, যেন দেবতা। ভাত মেখে
খাচ্ছে সে। সোনার বরণ ছেলে। তক্ষুনি পাড়া বেড়িয়ে লোকজনদের জানিয়ে এল খবরটা বুড়ি।
ওর কথায় লোকেরা এল গাঁ ঝেঁটিয়ে। সবশেষে এল বুড়োবুড়ির দল। তারা কুমারকে জিজ্ঞেস করে
জানতে পারল তার শাপগ্রস্ত ও শাপমোচনের কাহিনি। আর পরদিনই রাজপুত্র গাঁয়ের মুরুব্বিদের
প্রণাম করে বউকে নিয়ে তার রাজ্যে ফিরে গেল।
সেদিন থেকে চাষি-বউয়ের
হিংসে আর দেখে কে। বুড়োর মেয়ের তো যা-হোক রাজার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু নিজের মেয়ে? তার তো আজও কোনও হিল্লে হল
না। সে আবার বুড়োকে রোজ খোঁচাতে লাগল—“কই গো, আর একজন জামাই
খুঁজে আনবে কবে? আরও একটি মেয়ে রয়ে গেছে না?”
রোজ রোজ বিরক্ত হতে হতে
বুড়ো একদিন বলল, “কালই
যাব একবার আবার। তুমি কিচ্ছু ভেবো না, নাখুতির চেয়েও ভালো স্বামী হবে তোমার মেয়ের।”
বুড়ি তো খুশিতে ডগমগ। বলে, “ভাত-তরকারি রেঁধে দোব, নিয়ে যেও।”
পরদিন সেই তরকারি ও এক
হাঁড়ি ভাত নিয়ে বুড়ো আবার বনে গেল জামাই খুঁজতে। ‘ও জামাই, ও জামাই’ বলে চেঁচিয়ে ডাকল আগের মতোই। সূর্য ডুবু ডুবু হল, কিন্তু সাড়া পেল না কারও।
বাড়ি ফিরে যাওয়ায় মনস্থ
করে এক জুমের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বুড়ো দেখলে মস্ত এক অজগর আরাম করে শুয়ে আছে আলে।
সাপটাকে দেখেই বুড়ো বুঝে গেল, এ-ব্যাটা নির্ঘাত জামাই না হয়ে যায় না। এক মুহূর্তও দেরি না
করে সে অজগরের মুখের সামনে সব খাবার ফেলে দিলে। সাপও বিলম্ব না করে সব খাবার খেয়ে
ফেললে নিমেষে। বুড়ো চেম্পাইতে ভরে সাপকে বাড়ি নিয়ে এলে সকলে জামাই দেখে ভারি খুশি
হল।
রাতে
চাষি-বউ মেয়েকে সাপের সঙ্গে শুতে বললে সেও খুশি মনে লাকড়ি-ঘরেই শুতে গেল। রাতে সেই
অজগর বুড়ির মেয়ের হাঁটু অবধি যখন গিলে ফেললে, মেয়ে আতঙ্কে মাকে ডাকতে শুরু করলে। লোভী মা ও-ঘর থেকে উত্তর
দেয়, “ধৈর্য
ধরে থাক মা, জামাই
নিশ্চয়ই তোকে গয়না পরিয়ে দিচ্ছে।”
একসময় সেই সাপ মেয়েটিকে
সম্পূর্ণ গিলে ফেললে। তারপর পেট ঢোল করে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে রাক্ষুসে সাপ
শুয়ে রইল ঘরের পেছনে কলাবাগানে।
রাত ভোর হল। রোদ চড়ে
যাচ্ছে একটু একটু করে। না মেয়ে, না জামাই—কেউ-ই বেরোচ্ছে না দেখে কেউ কেউ উঁকি দিয়ে দেখল লাকড়ি-ঘরের
বেড়ার ফাঁকে। অজগর থেকে মানুষরূপী জামাইকে
স্বচক্ষে দেখার বাসনায় গাঁয়ের অনেকেই ভিড় করেছে ততক্ষণে উঠোনে। দেখা গেল, কেউ নেই ঘরে—না মেয়ে, না জামাই। বিলাপ শুরু করল বুড়ি।—“ওই হতচ্ছাড়া সাপ নিশ্চয়ই
আমার মেয়েকে জলজ্যান্ত গিয়ে ফেলেছে গো। হায় রে, রাতে কেন মেয়ের কথা আমি বিশ্বাস করলাম না।”
তারপর খোঁজ খোঁজ খোঁজ।
শেষে কলাবাগানে সাপকে পেয়ে দা-কুড়ুল চালিয়ে অজগরের পেট কেটে ফেলতেই বেরিয়ে এল
হাড়-মাংস গুঁড়িয়ে যাওয়া চাষি-বউয়ের মেয়ে নাইশি। চাষি-বউ বুক চাপড়াচ্ছে আর বিলাপ
বকে যাচ্ছে অবিরাম। আর ওদিকে সবাই মিলে অজগরকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলার তোড়জোড় শুরু করেছে।