লোকে বলে, চোখ মনের আয়না। আমিও তা বিশ্বাস করি। তবে সাহিত্যের আঙ্গিকে
ভাষার স্বচ্ছতাও যে পাঠকের সঙ্গে অদেখা লেখকের পরিচয় ঘটায়, তা
আমার জীবন থেকেই জানা।
আজ এমন একজন ছড়াকারকে নিয়ে
লিখতে বসেছি যিনি তাঁর প্রতিটি লেখায় নিজের পরিচয় রেখেছেন তাঁর সহজ, সাবলীল ভাষার ব্যবহারে। যিনি আমাদের জীবন আর যাপনের ধারায়
জুড়ে দিয়েছেন রসবোধ। প্রত্যক্ষে আর পরোক্ষে আমাদের সকলের মনের কথা নিয়েই যাঁর লেখা,
তিনিই আমার প্রিয় ছড়াকার ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।
সাত-সাগরের দূরত্ব পেরিয়ে তাঁকে জানতে অনেকটা দেরি হলেও তাঁর মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখার
সামনে আমি বিনম্র শ্রদ্ধায় অবনত। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আমার ভালোবাসা আমার
প্রবাসী জীবনকে বাংলার কাছেই ধরে রেখেছে সবসময়। আজ আমার নিজস্ব কিছু কথায় লেখার
চেষ্টা করছি। ছড়াকার ভবানীপ্রসাদকে জানার কথাও।
একটা জীবনের অর্ধেক থেকে
বেশি সময় বিদেশের মাটিতে কাটানোর পর দেশের মাটির বৃষ্টি শেষের সোঁদা গন্ধ ভুলে
যাবারই কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। সাহেবিয়ানা দেখতে দেখতে তারই মাঝে মনে এক ছোট্ট
খুশির জানালায় একদিন উঁকি দিল বাঙালিয়ানা। নিজেকে ফিরে পাবার আনন্দে মন ভালোবাসতে
শুরু করল তা-ই। সেই থেকে যাপনের নিজস্বতার সীমানায় আমার বিদেশের ঘরে বাংলার অবাধ
আনাগোনা।
বয়স আমাদের পূর্ণ পরিণত
হতে শেখায়। ভালো-মন্দের বিচার করতে শেখায়। এভাবেই হয়তো কোনও একদিন আমার নিজের মনেই
স্থায়ী হয়ে বসেছিল নিজের শেকড়কে ভালোবাসার আনন্দ।
নিউইয়র্কে একজন বিদেশি
ছাত্র তার পরিবার নিয়ে প্রতিদিন সংগ্রাম করে এক জনসমুদ্রে নিজের ঠাঁই খোঁজে, এ কোনও বড়ো কথা নয়। কিন্তু পায়ের নীচের মাটি শক্ত করতে গিয়ে
সে যখন তার ‘আমিত্ব’-কে, তার মাতৃভাষাকে ধরে রাখার চেষ্টাকেও সঙ্গী করে, তখন
নিঃসন্দেহে সেই পথের গুরুত্ব অনেকটা বড়ো হয়ে সামনে দাঁড়ায়।
এভাবেই আমি এবং হাজব্যান্ড
বত্রিশ বছর আগে শুরু করি আমাদের বিদেশের জীবনের প্রথম পর্ব। প্রথম সন্তানের জন্মের
পর আর কী কী ভেবেছিলাম সবটা আজ আর মনে পড়ে না তেমন। কিন্তু সন্তানকে বাংলা শেখাব, সেই ইচ্ছেটা মনে ছিল পূর্ণমাত্রায়। আমরা স্বামী-স্ত্রীতে
আমাদের মেয়ের জন্মের পর প্ল্যান করে প্রথম তিন বছর বাড়িতে শুধু বাংলাতেই কথা বলতাম,
শুধু মেয়েকে বাংলা শেখাব বলেই।
বরের চাকরি সংক্রান্ত
কারণে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় আমাদের থাকতে হয়েছে। তবে ভাগ্যক্রমে সব জায়গাতেই
কমবেশি বাংলা সংস্কৃতির অথবা নিদেনপক্ষে দেশিয় সংস্কৃতির চর্চা আমরা পেয়েছি। শুধু
অ্যালাবামা স্টেটের জ্যাসপার নামে এক ছোট্ট শহরে আমাদের বেশ কিছুদিন থাকতে হয়েছিল, যেখানে দেশি লোকজন প্রায় ছিল না বললেই চলে। ততদিনে আমাদের
ছেলের জন্ম হয়েছে। আমাদের বাচ্চাদের কথা ভেবে তাই ওরা ছোটো থাকতেই বহু সংস্কৃতিতে
সমৃদ্ধ শহর আটলান্টাকে আমরা আমাদের ঠিকানা বানাই।
মনে পড়ে, আটলান্টায় মুভ করার পর বাড়িতে আমরা বাংলা বইয়ের একটা
লাইব্রেরি বানাই। একটা পুরো ঘর জুড়ে বইয়েদের নিয়ে যত্নে সাজানো ঘর। ততদিনে মেয়ে
আমাদের বাংলা পড়তে পারে বলে দেশে গেলেই বই কেনাটা আমাদের নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন।
আজও কত ছড়ার বই তাকে সাজানো। আজ ছড়াকার ভবানীপ্রসাদকে নিয়ে লিখতে বসে হঠাৎ করে মনে
হল একবার আমাদের লাইব্রেরিটা দেখে আসি। দৌড়ে গেলাম দোতলায়। দেওয়ালের পাশ ঘেঁষে
শেলফের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত দু-বার খোঁজার পর ঠিক বেরিয়ে পড়ল ‘শ্রেষ্ঠ ছড়া সমগ্র’। বইটি ২০১২ সালে উপেন্দ্রকিশোর পুরস্কার-প্রাপ্ত। বইটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম
কিছুক্ষণ। উলটে গেলাম পাতার পর পাতা। সহজ-সরল শব্দের সমারোহতে মনোগ্রাহী সব ছড়া যা
বোঝার জন্য অভিধানের প্রয়োজন হয় না। জীবনের কথা রম্যরসে এরকম উপস্থাপন ছড়া সম্রাট
ভবানীপ্রসাদের দেওয়া আমার মতো প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এক অমূল্য উপহার।
আমাদের বিদেশের জীবনে
দেশের মতো আশেপাশে পরিবার পরিজন ছিল না ঠিকই, তবু
চেষ্টা ছিল আমাদের বাড়িকে দেশের আঙ্গিকে সাজাতে। মেয়ে আর ছেলেকে বাংলা শেখাতে গিয়ে
তাদের শৈশবে জুড়ে দিলাম এক নতুন দিক। আর সেই নতুন দিকটিকে অনেকটা ভালোবেসে ফেলাম
আমি নিজেও। বাচ্চাদের বাংলা গান, কবিতা শেখাতে গিয়ে তাতে
জুড়ে দিয়েছিলাম কিছু ছড়াও। দেশের একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো হতে হতে মা-কাকিমাদেরকে
কতশত বার গাইতে শুনেছি ঘুমপাড়ানি গান ইত্যাদি। নিজে যখন মা হলাম, সে-সবই যেন ফিরে এল আমার কাছে। আর এই সুযোগে আবার ফিরে দেখার সুযোগ এল
নিজের শৈশবকে আবারও একবার। শৈশব আমাদের জীবনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ
সময়।
খুবই আনন্দের সঙ্গে আজ
এটাও বলতে পারি, পুরোনো দিনের অর্থাৎ আমার
ঠাকুমা-দিদিমাদের আমলের প্রচলিত গ্রাম্য ছড়া আমার আমেরিকায় জন্ম এবং বড়ো হওয়া
সন্তানদের কাছে আজ অজানা নয়। জানি, এ তেমন বড়ো কিছু নয়।
কিন্তু এরই মধ্যে আমি খুঁজে পাই বংশানুক্রমে চলে আসা নিজস্বতার পরম্পরা। সার্বিক
অর্থে এটাই আমার বাঙালিয়ানা, আমার গর্ব।
বছর পাঁচেক আগের কথা।
আটলান্টায় আমাদের বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের দুর্গাপূজার সেটা ছিল শেষ দিন। আমেরিকায়
দুর্গাপূজা উইকেন্ড-সর্বস্ব। দিন, ক্ষণ,
তিথিকে সাক্ষী করে চলা আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমি মনে করি,
বিদেশে থেকে শুধু দেশি কালচার চর্চা করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি নিজস্বতা ছেড়ে শুধু বিদেশি কালচার নিয়ে চলাও অসম্ভব। তাই ফিউশন
কালচারের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা করে বনিবনা টিকিয়ে রাখতে হয় বইকি!
সে যা-ই হোক, পুজোর শেষ দিনে মনখারাপটা বেশ জাঁকিয়ে ধরে। দুর্গা মাকে
সিঁদুর পরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সিঁদুর খেলা শেষে মনে একটা শূন্যতা তোলপাড় করতেই
থাকে। মাকে চলে যেতে দেওয়া সত্যিই কঠিন—তা সে যে-দেশের বাসিন্দাই হই না কেন আমরা।
সেসব নিয়েই নানা
কথাবার্তার মধ্যে তৃষা আর তুতাই (আমাদের মেয়ে, ছেলে) ছুটে এসে জানাল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সব
শেষে একটি নাটক ছিল, আর তাতে নাকি একটি দারুণ কবিতা ছিল।
তৃষা বলল, “দারুণ একটি কবিতা, মা!
তোমাকে শুনতেই হবে!”
ছেলে তুতাই ওর ফোনে ভিডিও
করে নিয়ে এসেছিল আমার জন্য। বলল, “দেশে
গেলে ঠিক যে-ধরনের কথা বলতে শুনি লোকেদের, ঠিক যেন তাই!”
আমি হাসলাম। মনে পড়ল, ইন্টারনেটের যুগ শুরু হবার আগে নিজের কলম ভেঙে কত চেষ্টাই না
করেছি নিজের সন্তানদের জন্য ছড়া লিখতে। খুব দুঃখ হয় এখনও এই ভেবে যে, ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে কত জ্ঞানী-গুণীদের জানার সুযোগ হারিয়েছি সেইসব
দিনগুলোতে।
কবিতাটি জানার উৎসাহ বেড়ে
গেল আমার। শুনলাম সবটা। ওই ভিডিও থেকে একটাই কথা বার বার কানে এলো—‘বাংলাটা ঠিক আসে না’। বুঝতে পারলাম না কার কবিতা ওটা। বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করেও জানা গেল না। পরদিন
গুগলে সার্চ করে জানলাম কবির নাম। সে-ই প্রথমবার কবি, ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে জানা। তারপর ক’দিন ঝড়ের গতিতে ওঁর প্রচুর লেখা পড়লাম। কিছু ছড়া পড়ে শোনালাম আমাদের ছেলে
আর মেয়েকেও।
এত এত সম্মান আর পুরস্কার
পাথেয় করে যাঁর জীবনপথ উত্তরণে বাংলা সাহিত্য তার ঐতিহ্যের পথে সাফল্য নিয়ে আরও
অনেকটা পথ এগিয়েছে, তিনিই নিঃসন্দেহে ‘সম্রাট’ বিশেষণের যোগ্য। ছড়াকার ভবানীপ্রসাদের
সুনিপুণ লেখনী, তাঁর দয়ালু মনের চৌকাঠ পেরিয়ে বাস্তবের নানা
ছবি এঁকেছেন রম্যরসে। সেই লেখাগুলোতে যেন নানাভাবে আমাদেরই কথা—টক, ঝাল, মিষ্টিতে সাজানো। সহজ-সরল ভাষায় তাঁর লেখা
আমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য এক উপহার। বিশেষ করে প্রবাসীরা বাংলা জানলেও কঠিন
বাংলা অনেকেই বুঝে উঠতে পারে না বলে উৎসাহ হারায়। আজকের সময়ের কঠিন বাস্তবে বাস
করেও শ্রদ্ধেয় ছড়াকার ভবানীপ্রসাদের লেখা সমাদরে ঘুরেফিরে আমাদের সমৃদ্ধ করে;
আমাদের প্রবাসী জীবনকে ঠিক পৌঁছে দেয় আমাদের শেকড়—গর্বের
বাঙালিয়ানায়।