গল্প - অপূর্ব কোপি - কিশোর ঘোষাল । ফেব্রুয়ারি - ২০২৪



   অপূর্ব কোপি







কি শো র
ঘো ষা ল  






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

    আমরা তখন তোমাদের মতোই ছোট্ট, থুড়ি বড়ো; আসলে ক্লাস-এইট পর্যন্ত আমরা নিজেদের বাচ্ছাই মনে করতাম, আর ক্লাস নাইন থেকেই বেশ বড়ো। তোমরাও নিশ্চয়ই তাই মনে করো। তবে আমাদের তুলনায় তোমরা এখন অনেকটাই বড়ো, কারণ আমাদের দৌড় ছিল রেডিওতে গান আর খবর শোনা। সে তুলনায় তোমরা ছোট্ট থেকেই টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল দেখতে দেখতে আমাদের থেকেও কত্তো বড়ো যে হয়ে ওঠো তার হদিস তোমরাও জানো না। তাও আমরা সেই রেডিও ছুঁতে পেরেছিলাম, আরো অনেক বড়ো বয়সে। আমরা যখন ক্লাস নাইনে উঠলাম, আমাদের বাড়িতে রেডিও চালানোর দায়িত্ব ছিল মাত্র তিনজনের, জ্যেঠু, বাবা আর মা। আমার জ্যেঠিমা ছিলেন সরল আলাভোলা মানুষ, তিনি ওই নব ঘুরিয়ে রেডিও চালু করা, কিংবা অন্য নব ঘুরিয়ে স্টেশন খুঁজে বেড়ানোটাকেও খুব জটিল এক কর্মকাণ্ড ভাবতেন। অতএব, বাড়ির বড়োরা অফিসে চলে গেলে, জ্যেঠিমা আমার মাকে ডাকতেন, “অ মেজো, রেডিওটা একটু চালু করে দিয়ে যা তো”। আমার মা ছিলেন আমাদের বাড়ির মেজবৌমা। 

    স্কুলে গরমের ছুটি পড়তে তখনো বেশ কটা দিন বাকি, তবে গরম পড়েছিল বেজায়। গলায় ঘাড়ে, পিঠে ঘামাচি বেরোচ্ছে বিস্তর। খেলার মাঠ থেকে বিকেলে বাড়ি ফিরে, আমরা ঠাকুমার শরণাপন্ন হতাম। তাঁর ছড়ানো দুই পায়ের ওপর মাথা রেখে আমরা অবলীলায় শুয়ে পড়তাম। ঠাকুমাকে কিছু বলতে হত না, তিনি তাঁর বুড়ো আঙুলের ভোঁতা নখ দিয়ে, পিট পিট শব্দে ঘামাচি গেলে দিতেন, আর হাত বুলিয়ে দিতেন বুকে পিঠে। সেই আরামে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসত। মনে হত ভাগ্যিস গরম পড়ে, তা নইলে কী আর ঠাকুমার হাতের এমন পরশ বুঝতে পারতাম। তবে “বাব্বাঃ কী গরম পড়েছে”, বললেই ঠাকুমা বেশ রেগে যেতেন, বলতেন, “মুখপোড়া, গরম না পড়লে খাবি কি? আম, জাম, কাঁঠালই বা পাকবে কী করে?” তা ঠিক, পাকা এবং আধপাকা আমের নাম শুনলেই তখন জিভে জল আসত। আর আমাদের দিদিরা সর্ষেবাঁটা, তেল, নুন, লংকার গুঁড়ো দিয়ে কুষ্টি আম মেখেই মুখপোড়া গরমের তাপকে আবাহন করত। 

    মুখপোড়ার কথায় হনুমানের কথা মনে পড়ল। আমাদের সেই মফস্বল শহরে মাঝে মাঝেই বিস্তর হনুমান আসত। তারা দল বেঁধে সকাল সকাল হাজির হত, ঘুরে বেড়াত পাড়ার সবার বাড়ির গাছে গাছে। কাঁচা হোক পাকা হোক সব ফলেই দাঁত বসিয়ে দেখাটা তাদের রেওয়াজ ছিল। পেয়ারা, কাঁচা আম, কাঁচা সবেদা, সবুজ জাম, জামরুলের কুশি কিছুই তারা ছেড়ে দিত না। আর ছোট ছোট ইঁচড়গুলোকে গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেলে দিত মাটিতে। তাদের দৌরাত্ম্যে বিরক্ত হয়ে উঠত মানুষজন। পাড়ার লোকেরা থালাবাটি আর খালি ক্যানেস্তারা বাজিয়ে তাদের তাড়িয়ে বেড়াত। সে আওয়াজে আমাদেরই কান ঝালাপালা হয়ে উঠত, হনুমানদের কথা না বলাই ভাল। 

    স্কুলে সেদিন ফোর্থ পিরিয়ডটা ছিল সংস্কৃতর ক্লাস। প্রত্যেকদিন ফোর্থ পিরিয়ডটা ছিল আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা পিরিয়ড। কারণ এরপরেই আমাদের টিফিনের ঘন্টা পড়ত, আধ ঘণ্টার বিরতি। এই ফোর্থ পিরিয়ড চলার সময়েই দিবাকরদা প্রত্যেক ক্লাসরুমে টিনের ট্রেতে আমাদের মাথা গুণে টিফিনের প্যাকেট রেখে যেত। তেলে ভিজে ওঠা বাদামি সেই প্যাকেট থেকে খাবারের গন্ধ বেরিয়ে, আমাদের নাকগুলোকে সচল করে তুলত, যেভাবে কাঠবিড়ালি বা ইঁদুররা খাবারের গন্ধ পেলে নাক চুলবুল করে, অনেকটা সেরকম। তার মধ্যে সহদেব স্যারের সংস্কৃত শ্লোক, আমাদের মাথা-কান-মন সব ঘেঁটে একসা করে তুলল।

    সেদিন সহদেব স্যার যে শ্লোকটা পড়াচ্ছিলেন, সেটি ছিল একটি চাণক্য শ্লোক, “অপূর্ব কোঽপি ভাণ্ডারস্তব ভারতি দৃশ্যতে, ব্যয়তো বৃদ্ধিমায়াতি ক্ষয়মায়াতি সঞ্চয়াৎ”। খুব সহজ করে বললে, শ্লোকটির মর্মার্থ হল, “হে সরস্বতি, তোমার ভাণ্ডারটির মতো অপূর্ব আর কীই বা দেখা যায়? যা খরচ করলে বেড়ে ওঠে আর সঞ্চয় করলে কমে যায়”! এই ভাণ্ডারটি হল আমাদের বিদ্যা বা জ্ঞানের ভাণ্ডার, বিদ্যাচর্চা বা আলোচনা করলে আমাদের জ্ঞান বেড়ে ওঠে। কিন্তু চর্চার অভাবে আমাদের সেই জ্ঞানই হারিয়ে যায়, তার মানে আমরা ভুলে যেতে থাকি। এই শ্লোকের “ভারতি” হচ্ছেন মা সরস্বতী। ভারতী মা সরস্বতীর আরেকটি নাম, সে কথা নিশ্চয়ই জানো। তাঁর ভারতী নামটিই এখানে সম্বোধনে “ভারতি” হয়েছে – সংস্কৃতে সেটাই নিয়ম।  সরস্বতী বানানটাও একই নিয়মে সরস্বতি লিখতে হয়েছে। সে যাই হোক, এই শ্লোকটির মানে আজ যত সহজে তোমাদের বলতে পারলাম, সেদিন আমাদের সেটা বুঝতে কিন্তু বেজায় বেগ পেতে হয়েছিল। 

    শ্লোকটি বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করে, সহদেব স্যার আমাদের জিগ্যেস করলেন, “‘কোঽপি’ শব্দের অর্থ তোদের মধ্যে কে বলতে পারিস?” আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয়, সব স্যারদের চোখের মণি, পুলক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হনুমান, স্যার”। এখানে ছোট্ট করে বলে রাখি, এই ঘটনার পর পুলকের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘পুলকপি’।

    সহদেব স্যার, অদ্ভূত এক মুখভঙ্গি করে বললেন, “তোরা যে সবাই এক একজন কপি, সে বেপারটা বুঝতে আমার বাকি নেই। এই ‘কোঽপি’ সে কপি নয়, কঃ অপি সন্ধি হয়ে কোঽপি, অর্থ হল ‘আর কে’? কিংবা ‘আর কী?’” দীর্ঘ শব্দে নাকে নস্যি নিয়ে সহদেব স্যার, সামান্য নাকি স্বরে বললেন, “সংস্কৃত হল ভাষার রাজা, প্রত্যেকটি শব্দের মধ্যে রহস্য লুকোনো থাকে, সে সব খুঁজে বের করাতেই আসল মজা”। 

    আমি অবিশ্যি সে সব মজার কিছুই টের পেলাম না। চিন্তা করতে লাগলাম, কপি মানে আমি এতদিন জানতাম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি। শীতকাল হলেই ভুদেবকাকা বাজার থেকে আনে। আরেকটা কপি জানি, সেটা ইংরিজি - কপিবুক, কপি করা। কিন্তু কপি মানে বাঁদরও হয়? যসিও সহদেবস্যারের কথায় আমার মন ছিল না, ভাবছিলাম কতক্ষণে টিফিনের ঘন্টা পড়বে, আর আমরা টিফিনের প্যাকেট হাতে নিয়ে দৌড়ে নেমে যাবো স্কুলের মাঠে। 

    এমন সময় ক্লাশের বাইরে হঠাৎ খুব দুপদাপ হুপহাপ আওয়াজ উঠল। আমাদের জানালার পাশেই একটা বড়ো তেঁতুলগাছ ছিল, দেখলাম তার ডালপালাগুলোয় ভীষণ ঝাঁকুনি উঠেছে। সহদেব স্যার জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার? এই অসময়ে ঝড় উঠল নাকি?” ওপাশে জানালার ধারেই বসে দীপক, সে বলল, “ঝড় নয় স্যার, হনুমান। একদল হনুমান হানা দিয়েছে”।

    সহদেব স্যার বললেন, “অর্বাচীন কোথাকার, হনুমান কী ডাকাত না মারাঠিসেনা? যে হানা দেবে?” কিন্তু তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমাদের ঘরের সামনের বারান্দায় একদল হনুমানকে দৌড়োদৌড়ি করতে দেখা গেল। তাদের মধ্যে কয়েকজন বারান্দার দিকের খোলা জানালায় মুখ রেখে আমাদের দিকে লক্ষ্যও করতে লাগল। জানালায় গ্রিল ছিল, তাই আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, ওরা কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু তারপরেই তারা যা ক্ষতি করল, সে কথা মনে পড়লে, আজও আমার মন দুঃখে হু হু করে ওঠে।

    হনুমানের দলের বেশ কয়েকজন প্রথমদিকে একটু ইতস্ততঃ করলেও, একটু পরেই তারা স্যারের অনুমতি না নিয়েই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। তারপর সহদেব স্যারের টেবিলের কোণায় রাখা টিফিনের ট্রে থেকে আমাদের খাবারের প্যাকেটগুলি নিমেষের মধ্যে হাতিয়ে নিল এবং আগের মতোই ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আমরা সত্যি বলতে নিঃস্ব হয়ে গেলাম তৎক্ষণাৎ। ঘরের মধ্যে আমরা সকল ছেলেরা এবং সহদেব স্যারও স্তম্ভিত হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। আমাদের ক্লাসের শ্যামল গোটা স্কুলেই বিখ্যাত ছিল। হেডস্যার থেকে শুরু করে সব স্যারেরাই মনে করতেন শ্যামলের মত ফক্কোড় আর ইঁচড়ে-পাকা ছেলে ভূ-হুগলি জেলায় আর একটিও নেই। ক্লাসের সবাইকে বেশ কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ থাকতে দেখে, শ্যামল অত্যন্ত নিরীহ মুখ করে, বলল, “স্যার এটাকে কী, ‘কোপি দৃশ্যতে মারাঠীসেনাবৎ ইদৃশ কপিসেনা’ বলা যাবে?  যার অর্থ হতে পারে - মারাঠী সেনার মতো এমন কপিসেনা আর কে দেখেছে? শ্যামলের ভুল-ভাল সংস্কৃত বাক্য শুনে সহদেবস্যার খুব রেগে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিবতু তার আগেই একতলা থেকে বেজে উঠল স্কুলের ঘন্টা, একটানা। এই ঘন্টা টিফিনের ঘন্টা নয়, এমার্জেন্সি ঘণ্টা – কোন বিশেষ কারণে, সবাইকে একত্র হওয়ার সংকেত দিতেই এমন একটানা ঘণ্টা বাজানো হয়। বুঝতে পারলাম, বইখাতার ব্যাগ গুছিয়ে তাড়াতাড়ি নিচেয় নামতে হবে। 

    তোমাদের হয় কিনা জানি না, আমাদের সময়, স্কুলের একতলায় ঘন্টা বাজলেই আমাদের মাথায় যেন পোকা নড়ে উঠত। সে ক্লাস শেষের ঘন্টা হোক, কিংবা টিফিনের অথবা ছুটির। আর এমন জরুরি ঘন্টা হলে তো কথাই নেই। মূহুর্তের মধ্যে ব্যাগের মধ্যে বই-টই ঢুকিয়ে আমরা দৌড়ে বেরোতে লাগলাম বারান্দা দিয়ে। এক একটা ক্লাসরুম থেকে নানান বয়েসের ছেলের দল বন্যার মতো বেরিয়ে আসছিল। তারপর বারান্দার নদীতে মিশে গিয়ে জলপ্রপাতের মতো সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে আমরা নেমে এলাম একতলায়।

    নিচের বারন্দাতে এসেই আমাদের আচমকা দাঁড়িয়ে পড়তে হল, কারণ হেডস্যারের ঘরের সামনে, হেডস্যার নিজে এবং মাষ্টারমশাইদের অনেকে গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের সঙ্গে আরও দাঁড়িয়ে আছেন থানার বড়োবাবু এবং শহরের বেশ কিছু গণ্যমান্য ভদ্রলোক। ওঁনারা সকলেই যেন আমাদেরই অপেক্ষা করছিলেন। ওপর থেকে নেমে আসা ছেলেদের-স্রোতের বেগ কিছুটা শান্ত হতে, থানার বড়োবাবু বললেন, “মনে হচ্ছে, সকলেই নেমে এসেছে”? হেডস্যার বললেন, “হুঁ, তাই তো মনে হচ্ছে”। 

    মস্ত ভুঁড়ির ওপর ট্রাউজারটা টেনে তুলতে তুলতে বড়োবাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কারো হাতে পায়ে খিমচে-খামচে দেয়নি তো?” আমাদের মধ্যে কেউই কোন উত্তর দিলাম না। 

    আমরা তো বুঝতেই পারলাম না, কে আমাদের খিমচে দেবে, আর সেটা জানার জন্যে আমাদের নিচেয় ডাকাই বা হল কেন? শ্যামল একটু পিছনের দিকে ছিল, আমাদের ধাক্কা দিয়ে আর গুঁতিয়ে সে একটু সামনে এগিয়ে হাত তুলে বলল, “স্যার, অপূর্ব কোপি দৃশ্যতে মারাঠিসেনাবৎ ইদৃশ কপিসেনা”। আমরা তো বটেই স্যারেরা এবং উপস্থিত মানী মানুষেরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শ্যামলের দিকে। বড়োবাবু আতঙ্কিত স্বরে হেডস্যারকে বললেন, “ও ওসব কী বলছে? কী ভাষা? স্যার এই ছেলেটিকে মনে হয়, হনুমান খিমচে বা আঁচড়ে দিয়েছে। জলাতঙ্ক হওয়ার আগেই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার”।

    “তোর কী হয়েছে, শ্যামল? হঠাৎ সংস্কৃত বলা শুরু করলি কেন?” হেডস্যার বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। তবে তিনি শ্যামলকে ভরসা না করে, আমার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ফার্স্টবয় পুলকপিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোদের ক্লাসে হনুমান ঢুকেছিল?”

    “হ্যাঁ, স্যার দশ-বারোটা”। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দুজন বলে উঠলেন, 

    “সর্বনাশ। হনুমানের বিশাল দলটাকে আমরা এই দিকে আসতে দেখে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম, গোলোকবাবু। স্কুলের ছেলেদের ওপর এরা কী না কী দৌরাত্ম্য করে বসে”। গোলোকবাবু থানার বড়োবাবু, এমন সার্থক নামের মানুষ খুব কমই দেখা যায়। প্রকাণ্ড ভুঁড়ি সহ গোলগাল মানুষটির নাম গোলক ছাড়া আর কী হতে পারে? অবশ্য আরও বড়ো হয়ে জেনেছিলাম – গোলোক মানে বৈকুণ্ঠ বা বিষ্ণুলোক; তার সঙ্গে গোল বা গোলকের কোন সম্পর্ক নেই। 

    যাই হোক, গোলোকবাবু ট্রাউজারটা আরেকবার টেনে তুলে বললেন, “আপনাদের আশঙ্কার কথা শোনা মাত্র আমরাও তো থানা থেকে চলে এসেছি, স্যার”।

    “আঃ, আপনারা একটু শান্ত হবেন?” হেডস্যার বিরক্ত স্বরে বললেন, “কী হয়েছে ঘটনাটা শোনাই যাক না। পুলক, হনুমান ঘরে ঢুকে কী করেছে?”

    “আমাদের সবার টিফিনের প্যাকেট লুঠ করে নিয়ে গেছে, স্যার”। পুলকের স্বরে হাহাকার, আমাদের  মনের কথাই সে বলল। আমরা সকলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখে-শোকে মাথা নিচু করলাম। 

    “কী ছিল টিফিনে? হনুমানরা আজকাল কলা-বেগুন ছেড়ে দিয়ে টিফিন খাচ্ছে?” অবাক গোলোকবাবু নেমে যাওয়া প্যান্ট আবার টেনে তুলে নিয়ে বললেন। 

    “টিফিনে কী ছিল জানি না, স্যার। আমরা দেখার আগেই তো ওরা...” পুলক কথা শেষ করতে পারল না, স্বাভাবিক, এমন দুঃখের কথা মুখ ফুটে বলাও শক্ত বৈকি!

    “ঠিক আছে, ঠিক আছে, সে আমি দেখছি। কিন্তু শ্যামল সংস্কৃত শ্লোক বলছে কেন?” হেডস্যার জিজ্ঞাসা করলেন। পুলক বলল, “আমাদের ওই পিরিয়ডে সংস্কৃত পড়াচ্ছিলেন সহদেব স্যার। চাণক্য শ্লোক। অপূর্ব কোপি ভাণ্ডারস্তব। আমি বলেছিলাম কোপি মানে হনুমান। কিন্তু স্যার বললেন, এই কোপি সেই কপি নয়”। 

    “এই কপি ফুলকপি বা বাঁধাকপিও নয় স্যার। এ কোপি অন্য কোন কপি”। আমিও ফোড়ন দিলাম পুলকের সঙ্গে। স্যারেরা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমাদের দিকে। গোলোকবাবু, আরও একবার প্যান্ট টেনে তুলে বললেন, “স্কুলে এত রকমের কপি নিয়ে আলোচনার দরকারটা কী, স্যার? হনুমানরা কী জানে, কোন কপি মানে হনুমান আর কোন কপিতে হনুমান নয়? খামোখা ওরা খেপে গিয়ে ছেলেদের টিফিন নিয়ে চলে গেল? তোমাদের সংস্কৃত কোন স্যার পড়ান, খোকা?” গোলোকবাবু পুলকপিকে জিজ্ঞাসা করলেন। পুলকপি উত্তর দিল, “সহদেবস্যার, স্যার”। 

    নিজের নাম শুনে সহদেবস্যার এগিয়ে এলেন, বললেন, “আমিই সহদেব, সহদেব চক্রবর্তী, ছেলেদের সংস্কৃতের টিচার। সংস্কৃতে ওরকম থাকলে পড়াবো না?” “আহা, পড়াবেন না কেন? একশবার পড়াবেন। কিন্তু এদিকটা বিবেচনা করবেন না? দেখছেন শহরে হনুমানের উপদ্রব। এইসময় ওই কপি-টপি উচ্চারণ করে মিছিমিছি ওদের কোপে পড়ার দরকারটা কী?” সহদেববাবু বেশ রেগেই গেলেন এবার, বললেন, “থানার বড়োবাবু হয়ে, এই কটা হনুমান সামলাতে আপনি হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন গোলোকবাবু? আর আমরা যে বছরের পর বছর এতগুলো হনুমানকে মানুষ করে তুলছি?” 

    গোলোকবাবু একটু থতমত খেয়ে কী উত্তর দেবেন ভেবে পেলেন না। ওদিকে স্যারেরা এবং শহরের মান্যিগণ্যি লোকেরা হেসে উঠলেন হো হো করে। আমরাও, যদিও সংস্কৃতস্যার আমাদেরই হনুমান বললেন, রাগ করব কিনা ভাবতে ভাবতেই, হি হি করে হেসেই ফেললাম। গোলোকবাবুও এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝে, খুব হাসলেন খানিকক্ষণ, তারপর বললেন, 

    “কথাটা মন্দ বলেননি, স্যার। আমরাও কী ছোটবেলায় কম বাঁদরামি করেছি? হে হে হে হে। যাকগে হনুমান হানা দিলেও তেমন কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, সেটাই রক্ষে। আপনারা আপনাদের হনুমান সামলান, আর আমি চলি শহরের হনুমান সামলাতে”। গোলোকবাবু সহদেবস্যারের থেকে নস্যির ডিবে নিয়ে নাকে একটিপ নস্যি নিলেন জোরসে। ওদিকে আমাদের হেডস্যার ঘোষণা করলেন, “ছেলেদের টিফিন যখন হনুমান নিয়ে চলে গেছে, তখন আজকে আর স্কুল হবে না, আজকে হাফ-ছুটি। ছেলেরা, সব বাড়ি যাও”।

    রতনমণিদা আমাদের স্কুলের ঘন্টা বাজাতেন, তিনি ঘন্টা বের করে, ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন ঢং ঢং করে। আমরাও সকলে একসঙ্গে হৈ হৈ করে দৌড় দিলাম স্কুলের মাঠ পেরিয়ে মেন গেটের দিকে। 

    নস্যি ভরা নাকের জন্যে খোনা স্বরে গোলোকবাবু বললেন, “আঁহা, আঁমাদেরও যদি এমন একজন হেডস্যার থাকতেন, এমন মজার হাঁফ ছুটি হয়ে যেঁত – আর আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম।”