রানি তখন রাজপরিবারের নিত্য বিগ্রহসেবা করে প্রসাদের থালা নিয়ে রাজামশাইয়ের
কাছে এসে দাঁড়িয়ে তার মাথায় প্রসাদী জবাফুল ছুঁইয়েছেন, শুনেই চোখ বড়বড় করে অস্ফুটে বলে ওঠেন, "রাজবৈদ্যকে ডাকতে হবে বোধহয়।শরীরের মেদ ঝরলেও
মাথার মেদ ঝরেনি, দেখছি।"
"রানি,কি বিড়বিড় করছো।"
চকিতে মন্ত্রীর ক্ষুরধার বুদ্ধির কথা মনে পড়তেই স্বস্তি পান।মন্ত্রীমশাইয়ের
সাথে নিভৃতে শলাপরামর্শ করেই এবারের বিদঘুটে শখেরও নিষ্পত্তি করতে হবে, নইলে আবার কি ঝামেলায় পড়তে হবে কে জানে!আজকাল
রাজামশাইয়ের কোনো শখে বাধা দিলেই উনি ভেউভেউ করে ডুকরে ডুকরে কাঁদেন, চোখ লাল হয়ে যায়, রাজপ্রাসাদে যে কজন থাকে তারাও সেই কান্না শুনে
কাঁদতে বসে, রানির তখন মাথা
খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়। অনবরত কাঁদতে কাঁদতে রাজামশাই বিলাপ করেন, "কেউ আমায় বোঝে না। এতোবড় রাজপুরীতে আমার আপন
বলতে কেউ নেই। মা-বাবা তপোবনে, দুই রাজকন্যে
শ্বশুরালয়ে, কার কাছে মনের
কথা বলি!"
রানি মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলেন, "কেন, আপনার প্রিয় বন্ধু তো
আছে। এই রাজ্যপাট তো তার সুপরামর্শেই চলছে।"
সঙ্গেসঙ্গে রাজামশাই চোখের জল মুছে ফিক করে একগাল হেসে বলেন, "বগলার কথা বলছো! তাকেই তো সব বলি, কিন্তু সর্বাগ্রে রানিকে বলাও যে উচিত, তাই আর কি!"
বাল্যবন্ধু, বগলাচরণই
মন্ত্রীত্ব করছেন, ইতিপূর্বে তার
পিতাও এই কার্যে নিযুক্ত ছিলেন, বর্তমানে তারাও
তপোবনে থাকেন।
রানি মনেমনে বলে, "আমায় বলে উদ্ধার
করেছেন!"
রাজপ্রাসাদের যা হাল! নুন আনতে পান্তা ফুরোয়! আগের মতো ঠাটবাট নেই, মন্ত্রীমশাই কোনোক্রমে সামাল দিচ্ছেন বলেই
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাজ্যপাট চলছে। প্রজারাও সহজ সরল, তেমন ঝামেলা করেনা বরং রাজামশাইকে ভালোবেসে
নিত্যি নানান উপহার দিয়ে যায়। প্রজারাই রাজপ্রাসাদ মেরামত করে রঙ করে ঝকঝক করে রাখে, চাঁদা তুলে রাজপ্রাসাদের যাবতীয় ব্যবস্থা করে, তারা তাদের রাজার রাজত্বে মনের আনন্দে বসবাস
করে।
রাজামশাই প্রসাদ মুখে দিয়ে উঠে পড়েন, "যাই, জলখাবার খেয়ে মন্ত্রীকে মৃগয়ার ব্যবস্থা করতে বলি।"
রানি ব্যাজার হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবেন, তারপর রন্ধনশালায় যান। রাজার প্রাতরাশের
ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে আবার মনের
সুখে অতিরিক্ত ভোজনসামগ্রী নিয়ে ভোজন করতে বসে যাবেন।
রাজসভায় পাশাপাশি রাজা-মন্ত্রী বসে আছেন, এরমধ্যে রানি মন্ত্রীকে আড়ালে ডেকে সংক্ষেপে
রাজার ইচ্ছের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। শুনে মন্ত্রীর কপালে গভীর চিন্তার রেখা
ফুটেছে। জঙ্গল বলতে যা বোঝায় তেমন কিছুই নেই। তপোবন মানে কিছু বয়স্ক মানুষের
আবাসস্থল, থাকাখাওয়া আর
নিরিবিলিতে নিজেদের মনে জীবনযাপন করা, এই পর্যন্ত। হরিণ বা ময়ূর কিছুরই দেখা পাওয়া যায়না, মাঝেমধ্যে রাজ্যের চাষাভুষোরা গোরু, ছাগল চড়াতে যায়। ধোপারা গাধা নিয়ে যায়।
সেখানে রাজা কি শিকার করবে! ঘোড়াশালে একটিমাত্র ঘোড়া, সে-ও বৃদ্ধ হয়েছে তার পিঠে চড়লে
পঞ্চত্বপ্রাপ্তি অবশ্যম্ভাবী।
"মৃগয়ায় যাওয়া মানে তরবারি, ঘোড়া, লোকলস্কর, সর্বোপরি শিকারের
জন্তু তো চাই। সেসব কিভাবে জোগাড় হবে? "মন্ত্রী রাজাকে জিজ্ঞেস করেন।
"ওসব আমার ভাবার কথা নয়, মন্ত্রী আছে কেন?" নেপালচন্দ্র ত্যারছা নজরে মন্ত্রীর পানে চায়।
"এই ভাঙা সিংহাসনে, পুরনো রাজপোশাক পরে বসে আর রাজা সেজে কি
হবে! রাজসভাও তো ফাঁকা!" বলতে বলতেই মন্ত্রী দেখে রাজা "উ:" করে
সিংহাসন থেকে লাফিয়ে উঠে তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছেন আর সর্বাঙ্গে চুলকাচ্ছেন, "রাজসিংহাসনে বসে রাজ্যের বিভিন্ন ব্যাপারে
আলোচনা করাও কি যাবে না!"
`মন্ত্রী অবাক, "হোলো কি!"
"নির্ঘাত ছারপোকা! অস্থানে কুস্থানে কামড়ালে
মানসম্মান থাকে কিকরে! ভাগ্যিস প্রজারা কেউ রাজ সন্দর্শনে আসেনি।"
মন্ত্রী খিকখিক করে হাসে, "ছারপোকারও বুদ্ধি আছে, দেখছি! নইলে
রাজার অনাবশ্যক দীর্ঘ আলোচনায় মন্ত্রীর
প্রাণ যে ওষ্ঠাগত হয়। প্রজাদের কাজকম্ম আছে, অকারণ তারা কবে আর আসে! মন্ত্রী ব্যতীত শুধু বসে বসে পাগলের প্রলাপ শুনতে কেউ
কি আর আসে!"
রাজা কটমট করে মন্ত্রীর দিকে চেয়ে রাজসভা থেকে উদ্যানের দিকে চলে যান।
জ্যৈষ্ঠের শেষ হলেও উদ্যানে আমগাছে এখনো বেশ কিছু পাকা আম ঝুলছে, টুপটাপ ঝরে ঘাসের মধ্যে পড়ে থাকে, রাজামশাই
খুঁজেপেতে কুড়িয়ে নিয়ে গাছতলায় বসে আপনমনে তার আস্বাদন করেন।
রানিও তক্কেতক্কে ছিলেন রাজামশাই উদ্যানে যেতেই মন্ত্রীর কাছে আসেন,
"মন্ত্রীমশাই, কি স্থির করলেন?"
"চিন্তা করবেন না, উপায় বের করে নেবো।" মন্ত্রী রানিকে আশ্বাস
দিয়ে চলে যান।
কদিন চলে যেতেই রাজা মন্ত্রীকে তাগাদা দেন, "এখনো মৃগয়ার ব্যবস্থা হয়নি? আমি কিন্তু আর বিলম্ব করতে রাজি নই।"
"তরোবারিতে তেল দিয়ে জং পরিষ্কারের ব্যবস্থা হয়ে
গিয়েছে কিন্তু অশ্বপৃষ্ঠে নয় অশ্বপার্শে পায়ে হেঁটে মৃগয়ায় যাত্রা করতে হবে। নইলে মৃগয়া অসম্ভব। "
"অগত্যা।" রাজাও জানেন, রাজ্যে আর দ্বিতীয় ঘোড়া নেই।হাতিঘোড়া পোষার মতো
সামর্থ এ রাজ্যের কারুরই নেই। সবাই সাদাসিধে জীবনযাপন করে।
মৃগয়ায় যাওয়ার দিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, প্রাতঃভ্রমণ আজ স্থগিত। ঘোড়াকে বেশ পরিচ্ছন্ন
সুসজ্জিত করে বল্গা ধরে মন্ত্রী চলেছেন, পাশে উষ্ণীষ পরে রাজামশাই। বেশ কিছু লোকজনকে
আগেভাগেই বলা ছিল, তারাও সঙ্গে
চলেছে।
"বেশ রাজকীয় ভাব আসছে, এখন দেখা যাক মৃগয়ায় কটা মৃগ পাওয়া
যায়।" রাজা গম্ভীর চালে চলেন।
মন্ত্রীর গোঁফের ফাঁকে মৃদু হাসি ফোটে, "রাজার দেখছি নিজের রাজ্য সম্পর্কে সামান্যতম
ধারণাও নেই। আপনার পিতাও কখনো শিকারে যান নি। বনাঞ্চল আর আছে নাকি! নেহাত আপনি
আবদার করলেন, তাই এসব ঝুটঝামেলা! রাজা অযোগ্য হলেও মন্ত্রী তো
নয়!"
"বগলা, চুপ কর। এখন এসব কথা নয়, কে কখন শুনতে
পাবে!" নেপালচন্দ্র ধমক দেয়।" ঠিক আছে ন্যাপলা। "মন্ত্রীও কম যায়
নাকি!কতবার প্রকাশ্যে "বগলা" বলতে বারণ করেছে, তাও! রাজার মানসম্মান আছে, মন্ত্রীর নেই বুঝি!
আশেপাশে প্রজারা শুনেও না শোনার ভান করে খানিক হেঁটে অগভীর এক জঙ্গলে প্রবেশ
করে। অনেকক্ষণ খুঁজেও কোনো জন্তুর দেখা পাওয়া যায় না। আচমকাই এক প্রজা অদূরে আঙুল
দেখায়, "ওই ঝোপের আড়ালে
কিছু নড়াচড়া করছে!"
রাজা কোমরের তরবারিতে হাত রাখতে মন্ত্রী আবারও চাপা গলায় বলে, "সাবধানে বের করিস, জং পড়ে গিয়েছে, অতি কষ্টে মেরামত করে কোমরে ঝুলিয়েছি।"
রাজা আর তরবারি বের না করে শুধু তার হাতলে হাত রাখে।
সন্তর্পণে জন্তুর দিকে এগিয়ে যায়, দুটি মৃগই মনে হয়, সেরকমই
গাত্রবর্ণ! কিন্তু চোখ দুটো কেমন ছাগলের মতো! তাছাড়া মৃগের শিং নেই কেন!
"এগুলো কোন জাতের মৃগ!" রাজাও অবাক।
"এই রাজ্যের বিশেষ মৃগ, অন্যত্র এ জাতের দেখা পাওয়া
যাবেনা।" মন্ত্রীর মুখ গম্ভীর।
কয়েকজন প্রজা উল্লসিত, "আরে, ওদিকে যে এক নীলগাই দাঁড়িয়ে আছে!"
রাজাও সেদিকে তাকায়, "আকারে বেশ
ক্ষুদ্র! কিন্তু নীলগাই এখানে কিকরে!"
"মৃগ যেমন করে!" মন্ত্রী তখন আকাশের দিকে
তাকিয়ে, বৃষ্টি নামলো বোধহয়।
"কিন্তু এই জন্তুরা মানুষের পদশব্দ পেয়েও নড়াচড়া
করছে না বা পালাচ্ছে না কেন!" রাজার বোধগম্য হয়না।
"মনে হয়, সকালে জলখাবারে ভাং খেয়েছে। কিন্তু যেভাবে মেঘ করেছে, বৃষ্টি এলো বলে, ফিরতে হবে নইলে পঙ্খিরাজের ঠান্ডা লাগবে।আর
ঠান্ডা লাগলে তার হাঁচি থামানো দায়।"
বলতে না বলতেই ঘোড়া ফ্যাচফ্যাচ করে হেঁচে দেয়।
"কিন্তু মৃগ শিকার!"রাজা তখনো কোমরে
তরবারিতে হাত দিয়ে আছেন।
আচমকা বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামতেই হরিণ আর নীলগাই এদিকে ফিরে চায়, টলমল পায়ে পালাতে গিয়েও পারেনা। ধীর পদক্ষেপে
চলে যায়, রাজাও পেছন
ফেরে। শুধু মন্ত্রী আর একজন লোক দাঁড়িয়ে থাকে।
দূরে চলে যাওয়া রাজা ও অন্যান্য লোকেদের দিকে চেয়ে সেই লোকটি বলে ওঠে, "মন্ত্রীমশাই, এবার আমি আমার দুই ছাগল আর গাধাটাকে নিয়ে ওদিক
দিয়ে ঘুরপথে বাড়ি যাই। আপনিও ফিরে যান।"
"পরে তুই রঙের টাকা নিয়ে নিস!"
"ওই দেখুন, রঙ তো ধুয়েই গিয়েছে! এই সামান্য কাজের জন্যি
ট্যাকা লিতে পারবো না। এখনো বুড়ো রাজামশাই বেঁচে আছেন, তপোবনে গেলেই এটাসেটা হাতে দেবেনই। এমন ভুলোমনের
সরল রাজামশাই আর কোন রাজ্যে আছে!" সে-ই মানুষটির গলা বুজে আসে। মন্ত্রীমশাই তার
পিঠে হাত রাখে, "ভাং বেশি খাস না।
জন্তুদেরও খাওয়াস না।"
"ওদের মহুয়া ফল খাইয়েছি! ঘোর কাটতে কিছু সময় তো
লাগবে!" লোকটি ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসে।
ততক্ষণে রাজা পিছু ফিরে মন্ত্রীর দেখা না পেয়ে কখন যে আড়ালে এসে সব শুনেছে
দুজনের কেউ টের পায়নি। লোকটি তার পোষ্যদের নিয়ে চলে যেতেই গাছের আড়াল থেকে আওয়াজ
আসে, "হ্যাঁচ্চো!"
মন্ত্রী পেছন ফিরতেই রাজা বলেন, "চল, একসাথেই ফিরবো।"
দুই বন্ধু, রাজা-মন্ত্রী
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাত ধরাধরি করে প্রাসাদ অভিমুখে রওনা দেন।