আজ একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে রিয়া। এবার দিল্লির বাড়ি তাকে টানছে। কিন্তু প্লেনের টিকিট ক্যান্সেল হয়ে যাবার পর এখনও টিকিট কাটতে গড়িমসি করছে অর্ক। কেন কে জানে।
বসার ঘরে ঢুকে রিয়া দেখে সোফায় বসে অর্ক মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে আর পাশে রাখা একটা ঢাউস প্যাকেট থেকে পটাটো চিপস খাচ্ছে আনমনে। ‘এল’ শেপের সোফার আর এক দিকে বসে পড়ে রিয়া বলে, “আমার টিকিটের কী হল অর্কদা? তোমার তো কোনও বিকার নেই দেখছি! কড়মড় করে চিপস খেয়ে চলেছ শব্দ করে। মাথা ধরে গেল একেবারে!”
রিয়ার বিরক্তিতেও কাগজ পড়তে পড়তে হাঁটু নাচাতে লাগল অর্ক; কিন্তু না থামল তার কাগজ পড়া, না থামল চিপস খাওয়া। রিয়া অর্কর উপর খানিক রেগে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “তোমার কান নেই? আমি যে দিল্লি যাব, তুমি সে-কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছ দেখছি!”
“কান আছে বলেই তো চিপস খাচ্ছি। না থাকলে কি এত মজা আসত?”
“মানে? তুমি আজকাল কান দিয়ে চিপস খাচ্ছ নাকি?” ব্যঙ্গ করে বলে রিয়া।
“যদি কানে কালা হতাম, তাহলে কড়মড় করে চিপস খাবার মজাটাই নষ্ট হত। এই যেমন প্রবল খিদে পেয়েছিল সকাল সকাল, আর তোর মুণ্ডুটাই খুঁজছিলাম চিবিয়ে খাব বলে।”
“এই অখাদ্য মাথাটা না খেয়ে বরং প্লেনের টিকিট কেটে দাও, বাড়ি যাই।” গলায় আশঙ্কা ফুটে ওঠে রিয়ার।
“তোদের টিকিট কেটে নিয়েছিস অর্ক? এ কি! সাতসকালে আলু চিপস খাচ্ছিস যে খালি পেটে?” অর্কর মা বসার ঘরে এসে চেয়ার টেনে বসে সরু চোখে ছেলেকে দেখতে থাকেন।
“তোদের মানে পিসি?” বিস্মিত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে রিয়া।
“কেন, অর্ক তোকে বলেনি যে ও তোর সঙ্গে দিল্লি যাচ্ছে!”
রিয়া আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে, “এক নম্বরের বদমায়েশ তোমার এই ছেলেটা। আমাকে কিচ্ছু বলেনি।”
“তুই সময় দিলি? কান ঝালাপালা করে দিলি সকাল থেকে। হ্যাঁ, যাচ্ছি। একটা সেমিনার আছে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে। আমার গাইড আমাকে দিল্লি পাঠাচ্ছেন অ্যাটেন্ড করতে। তিনদিনের সেমিনার। আমার একটা পেপারও আছে। তোদের বাড়িতেই বডি ফেলব। তারপর ফিরব ভাবছিস? মোটেই না, আরও জ্বালাব তোকে। হপ্তা খানেক তো বটেই। আসলে তুই তো এখনও বাচ্চা, একা একা গেলে যদি হারিয়ে যাস, তাই তোকে সঙ্গে নিয়েই পরশু যাচ্ছি দিল্লি।”
অর্কর শ্লেষটা গায়ে না মেখে রিয়া বলে, “কী মজা অর্কদা! এবার তোমাকে আমি দিল্লির সব জায়গায় ঘোরাতে নিয়ে যাব।”
অর্ক রিয়ার মাথায় চাঁটি বসিয়ে দিয়ে বলে, “আমি এই প্রথম দিল্লি যাচ্ছি। তুই হচ্ছিস আমার গাইড। এবার নে, গুরুপ্রসাদ মনে করে একটু চিপস ভক্ষণ কর।”
“নিজে পেটের বারোটা বাজাচ্ছিস, আবার বোনেরও? তোরা চটপট কিছু খেয়ে নে এবার। আজ আমার ছুটি আছে, একটু নিউ মার্কেট যাব, দাদা-বউদির জন্য কিছু কিনে পাঠাতে হবে।” তাড়া লাগান অর্কর মা।
“তাহলে দুপুরে না-হয় সাবির হয়ে যাক?” অর্ক মন্তব্য করে।
“আচ্ছা আচ্ছা, হবে’খন। ওখান থেকেই বিরিয়ানি খাওয়াব। নে, তৈরি হয়ে নে।” উঠে যান অর্কর মা।
হাতের খবরের কাগজ পাশে নামিয়ে প্যাকেট থেকে চিপসের বাকি গুঁড়ো মুখে চালান করে দেয় অর্ক।
রিয়ার মাথায় চিপস নিয়ে প্রশ্নেরা ভিড় করে আছে। সে জিজ্ঞেস করে, “চিপস খাবার সঙ্গে কানের সম্পর্কটা কী বলো তো!”
অর্ক টেবিল থেকে জলের বোতল তুলে এক ঢোঁক খেয়ে নিয়ে বলে, “তাহলে কান খোল কর সুন লে। চিপসে জল থাকে না। তাই মুচমুচে খেতে হয়। স্বাদের ব্যাপারটা ছাড়া চিপস মুখে ভেঙে যাবার শব্দ শোনার সঙ্গে যোগ আছে আমাদের মস্তিষ্কের। দাঁতে চিপস ভাঙল, শব্দ হল, সেই ক্রাঞ্চি শব্দটা আমাদের ব্রেনের স্নায়ুতন্ত্রে একটা মধুর অনুভূতি তৈরি করে। কিছুক্ষণ প্যাকেট থেকে বাইরে রেখে চিপস খেয়ে দ্যাখ, একটুও ভালো লাগবে না। কারণ, বাতাসের জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে এসে চিপস নেতিয়ে যাবে, মুচমুচে ব্যাপারটা চলে গেলে আর কি মজা থাকবে?”
“ঠিক, ঠিক। চিপস খেতে আমারও খুব ভালো লাগে। কিন্তু চিমসানো চিপস খেতে অবশ্যই ভালো লাগবে না। কিন্তু চিপস বানাবার কায়দাটা আমাকে খুব অবাক করে। আবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস যতই বাড়িতে বানাতে যাই, রেস্তোরাঁর মতো কিছুতেই হয় না।”
“এর জন্য একটু বিজ্ঞান জানা খুব দরকার। ধরা যাক চিপস বানাচ্ছি। প্রথমে আমরা আলুর পাতলা পাতলা টুকরো কেটে নেব। ভালো করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিতে হবে আগে। তারপর নুন মাখিয়ে আলুর চাকাগুলো একটা পাত্রে ফ্রিজে অন্তত ঘণ্টা কয়েক রেখে দিতে হবে। এর ফলে আলুর টুকরোর বাইরের দিকে জল প্রায় শুকিয়ে যাবে। একটা কড়াইতে তেল গরম করতে হবে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের একটু বেশি তাপমাত্রায়। এর চাইতে বেশি গরম হলে আলু পুড়ে যাবে, কম হলে আলুর টুকরোর ভিতরে তেল ঢুকে গিয়ে পুরো চিপসের বারোটা বাজিয়ে দেবে। বেশি তাপমাত্রায় কড়াইতে আলু ছেড়ে দেওয়া মাত্র তাপের প্রভাবে আলুর টুকরোর উপরে একটা আস্তরণ পড়ে যায়। এর কারণ হল সেই স্টার্চ আর সুগারের মধ্যে মেইলার্ড রি-অ্যাকশন। আবরণ শক্ত হয়ে গেলে কড়াইয়ের তেল আলুর ভিতরে ঢুকতে পারবে না। ভাজার সময় আলুতে যে প্রোটিন থাকে, সেই প্রোটিন ডিন্যাচিওর হয়ে, বা নিজের গুণ পরিবর্তন করে শক্ত হয়ে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, যেন অনেক আলুর টুকরো একসঙ্গে কড়াইতে না ফেলা হয়। কারণ, আলুর টুকরো বেশি হয়ে গেলেই তেলের তাপমাত্রা কমে যাবে, তখন চট করে শক্ত হয়ে যাবার ব্যাপারটা আর থাকবে না।”
রিয়া প্রশ্ন করে, “আচ্ছা দাদা, ফিঙ্গার চিপসের বেলাতেও একই পদ্ধতি নিশ্চয়ই?”
“একেবারেই। এখানে আঙুলের সাইজের আলুর টুকরো কাটা হয়। তাই ভাজার পর উপরটা মুচমুচে হলেও আলুর ভিতরটা নরম থাকে। একটা ব্যাপার লক্ষ করবি, ফিঙ্গার চিপস ভাজার পর সেই চিপসগুলো একটা প্লেটে পেপার ন্যাপকিনের উপরে রাখা হয়। কড়াইতে আলুর টুকরো ফেললে বাইরের আবরণ শক্ত হয়ে গেল, কিন্তু জল তখনও আলুর টুকরোর ভিতরে থেকে গেছে। সেই জল বাষ্প হয়ে ভিতরটা নরম করে রাখে, কিন্তু শক্ত আবরণ ভেদ করে বাইরে আসতে পারে না। এবার ভেবে দ্যাখ, বাষ্প থাকলে তার একটা চাপও থাকে। চিপস গরম তেল থেকে বেরিয়ে এসে বাষ্প ঠান্ডা হয়ে আবার জলের অণুতে বদলে যায়। ফলে চিপসের ভিতর চাপ কমে যায় এবং চিপসের বাইরে যে তেল লেগে থাকে সেই তেল ভিতরের কম চাপের দিকে চলে যেতে থাকে। অর্থাৎ, এবার ভাজা আলুর টুকরোয় তেল ঢুকে পড়ে চিপসকে নরম করে দেয়। পেপার ন্যাপকিনে ভাজা আলু তুলে রাখলে তেল ন্যাপকিন শুষে নেবে। তাই আলুর ভিতর তেল ঢোকার ব্যাপার থাকবে না। এইসব বিজ্ঞান মাথায় রেখে তবেই চিপস তৈরি করতে নামতে হবে। তবেই না মুচমুচে চিপস মুখে ভেঙে গিয়ে একটা অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করবে!”
রিয়া চিন্তিত মুখে বলে, “বাড়িতে আলুভাজা হলে সবসময় যে মুচমুচে হবেই তার কিন্তু মানে নেই। অনেক সময় দেখি আলু ভেজে তোলার পরই নরম হয়ে যায়। তখন আর আলুভাজা খেতে ভালো লাগে না।”
“ঠিক জায়গাটায় ঘা দিয়েছিস। সব আলু কিন্তু চিপস বা ফ্রাই করার জন্য উপযুক্ত নয়। এর সবটাই নির্ভর করে আলুতে কতটা জল আছে তার উপর। যদি ৮০ শতাংশ জল থাকে আলুতে তবেই ফ্রাই করার জন্য সেটা একেবারে পারফেক্ট। এ ছাড়াও আলুতে কার্বোহাইড্রেট এবং সুগারের পরিমাণও ভালো কোম্পানিগুলো লক্ষ করে থাকে। আমাদের রাজ্যে চন্দ্রমুখী নামে যে আলু বিক্রি হয়, চিপস কোম্পানিগুলো সেই ধরনের আলু ব্যবহার করে। অন্যত্র নানা নামে এই আলু বিক্রি হয়ে থাকে।”
“তাহলে যে-সে আলু বাজার থেকে এনে কেটে ধুয়ে চিপস বানানো যাবে না বলছ?” রিয়া জিজ্ঞেস করে।
“এই আলু নির্বাচন নির্ভর করে অভিজ্ঞতার উপরে। এবার চল, তৈরি হয়ে নে। বাজারে গিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার জন্য।”
“আমরা তো আর আলু কিনতে বাজার যাচ্ছি না। যাচ্ছি জামাকাপড় কিনতে, যেটা আমার একটুও ভালো লাগে না।”
“তাতে কী? সবশেষে মা আমাদের ট্রিট দিচ্ছে বলল যে!” চিপসের খালি প্যাকেটটা দুমড়ে মুচড়ে ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেলতে গিয়ে অর্ক বলল, “আর একটা জিনিস লক্ষ করেছিস রিয়া? এই যে প্যাকেটটা হাতের মুঠোয় পাকিয়ে নিয়ে গিয়ে বিনে ফেলতে গেলাম, খড়মড় শব্দ শুনতে পেলি?”
“সে তো যে-কোনো চিপসের প্যাকেটেই হয়! এতে আর অবাক হবার কী আছে?”
“আছে তো! চিপস খেতে গেলে যেমন কড়মড় শব্দ হয়, ভালো কোম্পানি হলে তারা প্যাকেটগুলো এমনভাবে বানায় যাতে একই ধরনের আওয়াজ সৃষ্টি হয়। এর ফলে চিপস খাওয়ার জন্য আমাদের মাথায় একটা সিগন্যাল যায়, যা খাওয়ার ইচ্ছেটা আরও বাড়িয়ে তোলে।”
“সত্যি অর্কদা, তোমার কাছে কত কী শেখার আছে! এমনভাবে লক্ষ করিনি তো আগে!” প্রশংসার দৃষ্টিতে দাদার দিকে তাকিয়ে বলে রিয়া।
“এই দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে তবেই তুই একজন যথার্থ বিজ্ঞানী হয়ে উঠতে পারবি। যদিও আমি নেহাতই একটা কাঠখোট্টা অর্থনীতিবিদ হয়ে উঠছি ধীরে ধীরে। যাক, এবার তৈরি হয়ে নে, নইলে মায়ের বকুনি খেতে হবে।”
রিয়া উঠে যেতে যেতে বলে, “তুমি আমার সঙ্গে দিল্লি যাচ্ছ ভাবতেই এত আনন্দ হচ্ছে যে, কোনও বকুনিই আর আমার খারাপ লাগার কথা নয় দাদা।”
“আর একটা ব্যাপার জানলে আরও মজা পাবি। এই চিপসের উপর গবেষণা করে ইগ–নোবেল পুরস্কার পান একজন বিজ্ঞানী।”
“কী নোবেল?”
“ইগ-নোবেল রে বাবা! এই পুরস্কার চালু হয় নোবেল পুরস্কারকে ব্যঙ্গ করে। আসলে ইংরেজি শব্দ ignoble থেকে ধার নেওয়া হয় শব্দটা। কিন্তু দুটোর মানে আলাদা। মজার সব অদ্ভুত গবেষণার জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার দেবার সময়েও যথেষ্ট হাসিঠাট্টা করা হয়। যাই হোক, ২০০৮ সালে চিপসের উপর গবেষণা করার জন্য একজন ইতালিয় এবং আর একজন ইংরেজ বিজ্ঞানীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। তাঁরা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীকে নেতানো বাসী চিপস খেতে দেন, কিন্তু তাদের কানে হেড ফোনের সাহায্যে যন্ত্রের মাধ্যমে চিপস ভাঙার আওয়াজকে বদলে দেন এমনভাবে যাতে মনে হয় যেন তারা টাটকা ভাজা মুচমুচে চিপস খাচ্ছে। তাঁরা প্রমাণ করে দেন, শুধু স্বাদই নয়, কানে শোনা আওয়াজও খাবারের গুণবত্তা বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ।”
“দারুণ মজার তো! তাহলে ইগ-নোবেল নিয়ে পড়তে হবে দেখছি।” বলে রিয়া।
“হ্যাঁ, নোবেল না পেলেও বিজ্ঞানে অন্তত ইগ-নোবেল পাবার জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারিস। তবে এই গবেষণাগুলোও কিন্তু বেশ পরিশ্রমের কাজ এবং প্রচুর অভিজ্ঞতা ও পড়াশুনোর দাবি রাখে। ইগ-নোবেল পুরস্কারের প্রথম শর্ত হল, আগে গবেষণার বিষয়বস্তু দিয়ে প্রচুর হাসাতে হবে, তারপর লোককে ভাবাতে হবে। কী মজার না?”
রিয়া মনে মনে ইগ-নোবেল, ignoble আওড়াতে আওড়াতে বসার ঘর থেকে চিন্তিত মুখে ভিতরে যায়।
(ক্রমশ)