“ওটা আবার কি
জিনিস, খায় না গায়ে মাখে? আমরা তো সেই
ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি মুখে মুখেই জন্ম মৃত্যুর সব হিসাব দিব্বি হয়ে যায়। এর জন্য
কাগজ কলম, লেখাপড়া এসব আবার
লাগে নাকি!!” তিনি আরও বলেন,
“গ্রামে
ইলেকট্রিকের খুঁটি আছে অথচ দিনের অর্ধেক সময় আলোই থাকে না। পাশের
পাঁচঘড়া গ্রামের সাথে যোগাযোগ রক্ষা কারি একটা মাইল খানেকের দশ ফুট চওড়া ইঁট সুরকির রাস্তা তৈরি হয়েছিল যে বছর বড় ছেলে সুবলের বিয়ে
দিলাম। এখন সুবলের বড় মেয়ে শিউলিরই বয়স একুশ। তাহলে বোঝো কতদিন আগেকার কথা। আর এখন
তো দেখতেই পাচ্ছ রাস্তার কি
দশা। দিনের বেলাতেই সাইকেল চালানো দুষ্কর সেখানে সন্ধ্যার পরে ঘর ছেড়ে বের হওয়া
মানে নিজের প্রাণ হাতে করে বের হওয়া। ঘর ছেড়ে বের হতে পারবে কিন্তু গ্রামের ধারে
খোলা মাঠের ধারে পরিত্যক্ত গোঁসাই বাবার
ভাঙা চোরা মন্দিরের পাশ দিয়ে রাত বিরেতে পথ চিনে
নিজের বাড়ি ফিরে আসতে পারবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জায়গাটা বেশ থমথমে
এবং জলা জঙ্গলে পরিবেষ্টিত। দিনের বেলাও একা একা যেতে গা ছমছম করবে। আর বর্ষাকালে
তো কোনো কথাই নেই। শক্ত জোয়ান মরদকেও এক কিলোমিটার পথ যেতে কম করে আড়াই থেকে তিন ঘন্টার মতো সময় লাগে। আর কতবার যে জল কাঁদায় পিছলে পড়তে হয়
তার কোনো হিসেব নেই।’’
তাহলে কি প্রচণ্ড
রকমের কোনও প্রয়োজনে এই গ্রামের মানুষজন পাঁচঘড়ায় যাবে না?
“নিশ্চয়ই যাবে।
কারণ যেটুকু সামান্য সুযোগ সুবিধা যেমন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক “রামবিলাস স্মৃতি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়”, কবরেজ বাচস্পতি গুপ্তের “যথার্থ পরিষেবা” দাওয়াখানা কিংবা সরকারি পঁচিশ
শয্যার “নির্মলা” আরোগ্য নিবাস সবই তো পাওয়া যাবে একমাত্র পাঁচঘড়া গ্রামে গেলে
তবেই। তবে একা নয়। দলবল নিয়ে। এবং সেই দলে অবশ্যই এক জনকে থাকতেই হবে। এবং সে হলো আমাদের সকলেরই খুব কাছের দাশু, মানে জলধরের তিন মেয়ের পরে একমাত্র ছেলে দশরথ
দাসের ছোট ছেলে, বছর কুড়ির রাম। ওর মতো ডাকাবুকো লৌহ হৃদয় ছেলে
আশেপাশে দশ কিলোমিটারের মধ্যে সব মিলিয়ে চার চারটে গ্রাম আটচালা, পাঁচঘড়া, দৈবাকি ও
বাসুদেবপুরে হাজার খুঁজলেও আর একটা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। গ্রামের মানুষের যে
কোনও অভাব, অভিযোগ বা
অসুবিধায় একবার শুধু কানে খবর পৌঁছালেই হলো ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে স্বশরীরে সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে হাজির।“
সাঙ্গ পাঙ্গ !!
তারা আবার কারা ??
“গ্রামের জনকের
চায়ের দোকানের পাশের ‘জয় চন্ডী’ ক্লাবঘরটি নিশ্চয়ই এখানে আসার পথে নজর এড়ায় নি? অবশ্য নজর এড়ানো
কোনওমতেই সম্ভবও নয়। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত যা কেত্তন চলে ক্লাবঘরের
ভেতরে। ক্যারামের খটখটাস শব্দ, তাস খেলা এবং নির্ভেজাল গ্রাম্য আড্ডা। আর সাথে জনকের হাতে
তৈরি গরম চা আর বেকারির সুজি বিস্কুট। একবার খেয়ে নিলে পরবর্তী ঘন্টা তিনেক আর
কিছু না খেলেও চলবে। পেট পুরো ফুলে ঢোল অম্বলে আর গ্যাসে। রাজনীতি নিয়ে এখানে
কোনরকমের আলাপ আলোচনা বা সেই সংক্রান্ত মতবিরোধ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কখনও সামান্য
তর্কাতর্কিও কখনও হয়না। ক্লাবঘরের ভেতরে দুটো পালিশ না করা কাঠের বেঞ্চ, একটা ছোট কাঠের
টেবিল, দুটো নতুন এই
বছরের ক্যালেন্ডার- একটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং একটা স্বামী বিবেকানন্দের এবং
একটা একুশ ইঞ্চির পুরনো সাদা কালো অস্কার টেলিভিশন। যখন টিভিতে এশিয়া কাপ ফুটবল বা
বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখানো হয় তখন প্রয়োজনে জেনারেটর ভাড়া করে গ্রামের ছেলে ছোকরা
আর মাঝ বয়সী পুরুষরা কমবেশি প্রায় সবাই সব কাজ ফেলে ক্লাবঘরে এসে ভীড় করে খেলা
দেখে। তবে বিশ্বকাপ ফুটবলে যদি আর্জেন্টিনা বিপক্ষের কাছে হেরে বিদায় নেয় তবে তার
পরের দিন গোটা গ্রামের থমথমে পরিস্থিতি দেখলে মনে হবে যে, গ্রামের কোনো
প্রিয় মানুষ, কাছের মানুষ
বোধধয় গতকাল রাত্রে মারা গেছেন।“
আর এই ক্লাবেরই
সেক্রেটারি হচ্ছে সকলের নয়নের মণি রাম, কলির রামচন্দ্র। ক্লাস এইট পাশ। তারপরে যাতায়াতের অসুবিধা
থাকায় প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে খেজুরিপ্রসাদ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আর পড়তে
যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তার মধ্যে আবার ছোট থেকেই পরসেবা করার অদম্য ইচ্ছা রামকে
গ্রামের সবার কাছে ঈশ্বর তুল্য করে তুলেছিল। ও সবার কাছেই যেন এক নব্য মসীহ
স্বরূপ। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই ওকে ভালোবেসে “দশরথ পুত্র রাম” আখ্যা দিয়েছে।
সবকিছুই মোটামুটি
শান্তিতেই চলছিল। চাষবাস,
গবাদি পশু, হাস, মুরগি প্রভৃতি
প্রতিপালন আর একে অপরের আপদে বিপদে পাশে থাকার অঙ্গীকার। গ্রামের দক্ষিণ দিকে
সমৃদ্ধ রায় বাবুদের বড় দিঘির পাশে যে খোলা মাঠটা আছে ওখানেই রোজ বিকেলে গ্রামের
ছেলে ছোকরারা ফুটবল খেলে। বর্ষাকালে সে এক মজার দৃশ্য। পেছল মাঠে ফুটবলার একদিকে
আর বল আরেক দিকে। লালচে কাঁদা মাখা চেহারাগুলো দেখে চেনার উপায় নেই কোনটা কে। এই
মাঠেই চরম উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে মহা ধুমধাম করে গত পাঁচ বছর ধরে দুর্গা পূজা
পালিত হয়ে আসছে। আবার শীতকালে মঞ্চ খাটিয়ে জয় চণ্ডী ক্লাবের ছেলেদের প্রচেষ্টায়
তিন চারদিন ব্যাপী যাত্রা পালা অনুষ্ঠিত হয়। মূল উদ্যোক্তা সেই সব অগতির গতি কলির
‘রামচন্দ্র’। আশপাশের অন্যান্য গ্রাম থেকে গরুর গাড়ি করে যাত্রার দল আসে। শেষের
দিন নির্দিষ্ট থাকে এই আটচালা গ্রামের নিজস্ব দলের জন্য। তাই দুর্গা পূজার পর
থেকেই জোড় তোর সহকারে মহরা শুরু হয়ে যায়।
তা গ্রামের
পশ্চিম দিকে পাঁচঘড়া গ্রামের দিকের রাস্তার ধারে যে মন্দিরটি আছে, কি যেন একটা নাম
বললেন বেশ-, হ্যা গোঁসাই
বাবার মন্দির। তো ওটার ব্যাপারে একটু বলুন না খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
“দেখো, জানতে তো ইচ্ছা
করতেই পারে তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শোনার পরে ঐ পথ দিয়ে যেভাবে একা একা এসেছো
সেইভাবেই আবার পথ চিনে ফিরে যেতে পারবে তো?”
দেখুন আমি
বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কিছু বুঝিনা। আর আপনি ভালোই জানেন যে বিজ্ঞান
কার্য কারণ ছাড়া কোনও কিছুই বিশ্বাস করেনা। বিজ্ঞানের ভাষায় আত্মা বলে কিছু হয়না, সবটাই সর্বৈব
মিথ্যে। আত্মা, প্রেতাত্মা সবটাই
বুজরুকি। কিছু অসাধু মানুষ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আমাদের
মধ্যেই যারা সহজ সরল মানুষ আছেন, যাদের বিদ্যা বুদ্ধি যথেষ্ট নয় তাদেরকে মিথ্যে ভয় দেখিয়ে
তাদের থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা আদায় করে। আর তাই এই ধরণের ঘটনা
গ্রামেগঞ্জে গেলেই সেখানকার লোকেদের মুখেই বেশি শোনা যায়। কিন্তু আদপে এর সবটাই
ভিত্তিহীন। এটা শুধুমাত্র একটা সাধারণ মানুষের ভয়, ভীতি এবং বিশ্বাসকে সুরসুরি দিয়ে ফায়দা তোলা বা
নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া আর কিছুই নয়।
“বাঃ। তাহলে তুমি
তো দেখছি সবই জানো হে। তাহলে আর শুধু শুধু এইসব আজগুবি বস্তা পঁচা বুজরুকি জেনে বা
শুনে তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করে কি করবে। তার থেকে দুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছো
আত্মীয়ের বাড়ি। ঘুরেফিরে সব দেখো। তোমরা শহরের লোক, এতো কাছ থেকে এইরকম অজ পাড়া গাঁ এর আগে নিশ্চয়ই
কখনও দেখার সুযোগ হয়নি। তাই চারদিক ঘুরে দেখো। এই নির্মল সবুজ প্রকৃতির একটু স্বাদ
নাও। বুক ভরে খাঁটি নিঃশ্বাস নাও। শরীর স্বাস্থ্য ভালো করে দুদিন বাদে আবার যেখান
থেকে এসেছো সেইখানেই পুনরায় ফিরে যাও।এখানে দিনের বেলাটা যথেষ্টই প্রাণবন্ত, রোদ ঝলমলে। তবে
রাতের অভিজ্ঞতা কিন্তু সম্পূর্ণই আলাদা। দুদিন থেকে দেখো, নিজের থেকেই সব
বুঝতে পারবে আশা করি।’’
আপনি বোধহয় আমাকে
ভুল বুঝলেন জ্যাঠা। আসলে এই ভূত-প্রেত ব্যাপারটা নিয়ে ভাববার বর্তমানে সময়ই নেই
শহরের লোকেদের। কারণ তারা দিনের প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। শহরে
সারারাত চতুর্দিকে কৃত্রিম আলো ঝলমল করে। আর সেখানে এইসব প্রত্যন্ত গ্রামে সন্ধ্যা
নামলেই চারদিক প্রায় অন্ধকার। শুধু কাছে দূরে ঘর গুলোতে যেটুকু যৎসামান্য টিমটিমে
আলো। আর যেখানেই অন্ধকার সেখানেই তেনাদের দৌরাত্ম্য। অন্ধকার আমাদের মনের ভেতরে
একটা ভীতির সঞ্চার করে। আধো অন্ধকারে কাছে দাঁড়ানো চেনা মানুষটিকেও কেমন যেন অচেনা
লাগে।
“দেখো তোমার কথা
যথেষ্টই যুক্তি সম্পন্ন। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা আজও ঘটে যা সাধারণ যুক্তি বা বিচার
বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না। আমার বয়স হয়েছে, শিক্ষা দীক্ষাও তোমার থেকে অনেক কম। কিন্তু
বাস্তব অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে তোমার থেকে অনেক বেশি। আমি দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রামে ঘটে
যাওয়া অনেক আজব ঘটনার সাক্ষী। যা আজও আমি আমার বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম
হইনি। আর এর প্রত্যেকটি ঘটনাই ঐ গোঁসাই বাবার জরাজীর্ণ পোড়ো আগাছায় পরিপূর্ণ
মন্দিরকে ঘিরেই ঘটেছে। গোঁসাই কিন্তু যথেষ্টই ধার্মিক লোক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই
এক অমাবস্যার রাতে ও অপঘাতে মারা যায়। কেউ বলে সাপে কামড়েছে আবার কারোর মতে ওকে
নাকি খুন করা হয়েছিল। লাস যেটা পাওয়া গিয়েছিল সবটাই প্রায় পচা-গলা খোবলানো। কিন্তু
কে খুন করবে? আশেপাশের সমস্ত
গ্রামেই তো ওর ভক্তরাই ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতি পূর্ণিমার রাতেই খোল করতাল বাজিয়ে নাম
গান হতো। লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত মাসের ঐ দুদিন। বরই জ্ঞানী মানুষ ছিলেন শঙ্কর
অধিকারী। কিন্তু তার জন্যে কোনও অহংকার ছিলনা, একেবারে মাটির মানুষ। আর ঐ মানুষটা মরার পর থেকেই এই
গ্রামের মোট চারজন ঐ মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হয় চিরতরে হারিয়ে গেছে নয়তো
বীভৎস ভাবে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় তাদের মৃতদেহ মন্দিরের আশেপাশে পাওয়া গেছে। বার
দুয়েক পুলিশও এসেছিল। সবকিছু দেখে শুনে তদন্তের আশ্বাস দিয়ে সেই যে চলে যায় আর
ফিরে আসেনা। পরবর্তীতে দু-এক বার পাঁচঘড়া থানায় গিয়ে জিজ্ঞেসও করা হয়েছিল। কিন্তু
প্রত্যেকবারই সেই একই উত্তর, ‘তদন্ত চলছে’। আসলে উত্তর দেবে কিভাবে। কাজটা তো আর সাধারণ
মানুষের দ্বারা ঘটেনি। কে করেছে সে তো আমরা সবাই জানি। সে আর কেউ নয়, শঙ্কর অধিকারীরই
প্রেতাত্মা। কিন্তু কেন? তার উত্তর আজও
মেলেনি।“
ঠিক আছে জ্যাঠা, বসে আরাম করো।
আমি একটু ক্লাব ঘরে গিয়ে দেখি তোমাদের নব্য রামচন্দ্রকে খুঁজে পাই কিনা।
ক্লাব ঘরের ভেতরে
সে এক প্রায় বিশৃঙ্খল অবস্থা। একপাশে চারজন ক্যারাম খেলছে। খেলছে যতনা বেশি তার
থেকে হৈচৈ হচ্ছে শতগুণে বেশি। খেলছে চারজন কিন্তু জ্ঞান দেওয়া পাবলিকের সংখ্যাই
বেশি। ফলে বিনি পয়সার জ্ঞানও বিকোচ্ছে দেদার। তবে ওদের মধ্যে বছর একুশের, প্রায় আমারই বয়সি
একজনের হাতটা দেখলাম বেশ ভালোই বলতে হবে। এক একবারে তিন চারটে করে গুটি ফেলছে। আর
বাকিরা সেই তুলনায় যথেষ্টই কাঁচা। সামান্য বেসের গুটি গুলোও এক চান্সে ফেলতে
পারছেনা। হঠাৎ করেই সেই ছেলেটি আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বললো, “আরে তুমি অপু’দার
শালা হওনা? কি যেন নামটা
তোমার। দাঁড়াও দাঁড়াও তুমি বলবে না, আমাকে মনে করতে
দাও। ইয়েস, ইয়েস, মনে পড়েছে।
অর্জুন, রাইট? তুমি বীরভূমে
থাকো। বছর পাঁচেক আগে একবার এসেছিলে। কি আমি কি ভুল বললাম?
অবাক না হয়ে
পারলাম না। মেমোরিটা বেশ প্রশংসা করার মতো তো!! বললাম, “হ্যা, ঠিকই ধরেছো।
তুমিই বোধহয় রাম। তবে আমার সেইভাবে বিশেষ কিছু মনে নেই। আসলে দিদির বিয়ের সময় কন্যা
যাত্রী হয়ে সন্ধ্যা নাগাদ এসেছিলাম আর তার পরদিনই বিকেলের আগেই সদলবলে ফিরে
গিয়েছিলাম। অনেকের সাথেই আলাপ হয়েছিল তো ফলে, সেইভাবে আলাদা করে তেমন কিছু মনে নেই।
“বললেই হবে, তাহলে আমায় চিনলে
কি করে?”
আন্দাজে ঢিল
ছুড়লাম আর লেগে গেলো। আসলে মিনিট সাতেক আগেই এদিকে আসার পথে বড় পুকুরটার পাশে বুড়ো
বটগাছটার তলায় একজন বেশ বয়স্ক লোকের সাথে দেখা হলো। অনেকক্ষণ ধরে প্রচুর কথাও হলো।
ওনার মুখেই এই গ্রামের সবথেকে চৌখস ছেলের খুব প্রশংসা শুনছিলাম। কেন জানিনা তোমার
খেলা দেখে মনে হলো তুমিই সেই রাম।
“বাঃ এইজন্যই
তোমরা হলে গিয়ে শহরের ছেলে। আমাদের থেকে অনেক বেশি চালাক চতুর। তাছাড়া পড়াশুনাও
নিশ্চয়ই করেছো অনেক দূর? আমাদের তো ইচ্ছা
থাকলেও উপায় নেই। আজকেই এসেছো বুঝি?”
হ্যা, খুব বেশি হলে আধা
ঘন্টা হবে। একটু হালকা খাবার খেয়েই বেড়িয়ে এলাম তোমাদের গ্রামটাকে ভালো করে ঘুরে
দেখার জন্য। গতবার তো সেই সুযোগ তাড়াহুড়োয় আর হয়ে ওঠেনি।
“খুব ভালো করেছো।
চলো আমি তোমাকে আমাদের এই গ্রামটা ভালো করে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি। জানো, অনেক কিছু ভালো
ভালো সব দেখার জিনিস আছে এখানে। যত দেখবে তত আমাদের এই গ্রামকে ভালোবেসে ফেলবে।
পরে আমার কথা মিলিয়ে নিও”।
তাই বুঝি? তবে হ্যা, গ্রাম কিন্তু
আমার বেশ ভালো লাগে। শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এইরকম বিপুল সবুজের
সমারোহ আমাদের শহরে কোথায়?
শুধুই গাড়ির বিকট
হার্নের হৃদয় বিদারক শব্দ,
ধোঁয়া, দূষণ আর ব্যস্ততা।
দুদন্ড দাঁড়িয়ে কারোর সাথে কথা বলার সময় নেই কারোর হাতে। সবাই যেন শুধুই ছুটছে।
এখানে বিনে পয়সায় খেলাধুলার জন্য বড় মাঠ, সাতার কাটার জন্য কতগুলো পুকুর। আর আমাদের ওখানে এইসব
প্রায় নেই বললেই চলে। এদিকে ওদিকে শুধুই জিম সেন্টার। শেখায় তো ঘোড়ার ডিম, শুধু টাকা
কামানোর এক একটা কুমিরের মতো হা করা ফাঁদ।
“ঠিকই বলেছো। আমি
দু-দুবার তোমাদের বীরভূম শহরে গেছি। প্রথমবার তো বাড়ি ফেরার রাস্তাই হারিয়ে
ফেলেছিলাম। তারপরে কপাল ভালো আমাদের গ্রামেরই জীবন কাকার ছেলে রমেশের সাথে দেখা।
আগে এই গ্রামেই থাকতো। এখন আর থাকেনা। তোমাদের ওখানেই একটা সাইকেলের দোকানে কাজ
করে। ওখানেই থাকে। বছরে এক দুবার আসে। ওই আমাকে পথ দেখিয়ে বড় রাস্তায় নিয়ে এসে
পাঁচঘড়ার বাসে উঠিয়ে দিলো। তাই রক্ষে। নাহলে হারিয়েই গিয়েছিলাম। পরের বার অবশ্য
আর পথ চিনে ফিরে আসতে অসুবিধা হয়নি।’’
রাম, একটা কথা
জিজ্ঞাসা করবো? তোমাদের ক্লাব
ঘরে যাওয়ার পথে ঐ বয়স্ক করে জ্যাঠুই বলছিলেন গ্রামের পশ্চিমে গোঁসাই বাবার পোড়ো
মন্দিরের কথা। তার আশেপাশে নাকি দিনের বেলাতেও তোমরা মানে গ্রামের লোকেরা যেতে ভয়
পাও। ওখানে কি সত্যি সত্যি গোঁসাই বাবার প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়ায়?
“ঐ জ্যাঠুর কথা
ছাড়ো তো। সবাইকেই বলে বলে ভয় দেখাবে। আমি কাউকে না জানিয়ে কতবার গেছি। আরে গতবছর শ্যামল
খুড়োর লাস যখন ওখানেই জলার পাশে পাওয়া গেলো কাঁদার ভেতরে প্রায় অর্ধেকটা ঢোকানো
অবস্থায়, আমি দেখতে
গিয়েছিলাম। মুখটা পুরো বীভৎস রকমের ক্ষতবিক্ষত ছিল। ওখানে ঐ মুহূর্তে হাতে গোনা
গ্রামের মাতব্বর গোছের যে কয়েকজন ছিল সবাই বললো গোঁসাই শ্যামলের মুখটা পুরো
চিবিয়ে খেয়েছে। আমার কিন্তু দেখে মোটেও সেইরকমটা মনে হয়নি জানো। ভারি কিছু দিয়ে
শুধুমাত্র মুখটাকেই থেঁতলে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিল। মনে হবে যেন বহুদিনের পুরোনো
রাগ কেউ উগড়ে দিয়েছে। সবাইকে বললামও সেকথা, কিন্তু বড়রা পাত্তা দিলেতো আমার কথা। ওখানে কোনও একটা রহস্য
তো আছেই আছে। থাকতে বাধ্য। কিন্তু সমবয়সী কাউকেই রাজি করাতে পারলাম না রাতের বেলা
ওখানে আমার সাথে যাওয়ার জন্য। আমি একাই যেতে পারি। আমার অতো ভয় ডর নেই, কিন্তু যদি অন্য
কোনরকম কারণ লুকিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আমার কিছু একটা হয়ে গেলে সেই ঘটনার সাক্ষী তো
কেউ থাকবেনা। ফলে ভূত বা পিশাচেই করেছে এটাই আরও বেশি করে প্রচার হবে”।
রাম, তোমার কি মনে হয়, ওখানে কোনো গুপ্ত
কাজকর্ম চলে? তোমার কাছে কি এর
সপক্ষে কোনো প্রমাণ সত্যিই আছে?
“না অর্জুন, তা নেই বটে।
কিন্তু ঐযে বললাম, শ্যামল খুড়োর
কেসটা আমার কাছে অন্যরকম লেগেছে। একবেলার মধ্যেই লাস অতো পঁচে যায় কি করে?”
আচ্ছা রাম, এই শ্যামল খুড়োর
উপরে কারো প্রচুর রাগ বা ক্ষোভ জমে থাকার কথা বলছিলে না? মানে ওঁর উপরে
মৃত গোঁসাইয়ের কি কোনও রাগ আদপেই ছিল? অবশ্য মৃতই বা বলছি কেনো। গোঁসাই -এর লাস তো যেভাবে পাওয়া
গেছে সেটাই যে আদপে গোঁসাই-এর লাস তার সত্যতাই বা কোথায়? ময়নাতদন্ত কি
আদপেই হয়েছিল? মানে পুলিশকি
এসেছিল সেইসময় গ্রামে? এই ব্যাপারে
তোমার কি জানা আছে কিছু?
“হ্যা, নাম কে বাস্তে
পুলিশ ঐ সময় গ্রামে এসেছিল বটে কিন্তু লাসের যা অবস্থা ছিল তাতে করে ময়নাতদন্তে
কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি বলেই জানি”।
এই শ্যামল খুড়ো
আসলে করতেনটা কি?
”শ্যামল খুড়ো
আসলে বছর পঞ্চাশের একজন বেশ পালোয়ান মার্কা লোক। কাজকর্ম বলতে নির্দিষ্ট করে বলবার
মতো কিছু ছিলনা। এর ওর বিভিন্ন ধরনের কাজে হাত লাগিয়ে যা কিছু পেত তাতেই একার পেট
কোনরকমে চলে যেত। ঐ গোপাল জ্যাঠুই ওনাদের গোয়াল ঘরের পাশের একটা ঘরে ওকে থাকতে
দিয়েছিলেন। সেসব অবশ্য আমার জন্মের আগের ঘটনা। তবে গ্রামে গোঁসাই আসার পর থেকে শ্যামল
খুড়োকে সবসময় গোঁসাই-এর আশপাশ দিয়েই ঘুরঘুর করতে দেখা যেত। লোকে দুজনের সম্পর্ককে
নিয়ে মজা করে বলতো “নিমাই আর নিতাই-এর যুগলবন্দী”। মাঝে গোঁসাই-এর মৃত্যুর কদিন
আগে হঠাৎ করেই পুরো কর্পূরের মতো উবে যায় লোকটা। তারপরে আবার গোঁসাই-এর মৃত্যুর
পরে ঠিক একইভাবে আচমকাই পুনরায় উদয় হয়ে প্রচুর মরা কান্না জুড়ে দেয়। অনেকেই
গোঁসাই-এর ফেলে যাওয়া অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব ‘নিতাই’ মানে শ্যামল খুড়োর উপরেই
অর্পণ করতে চেয়েছিল। দায়িত্ব পেয়েও ছিল কিন্তু বেশিদিন টানতে পারেনি। কারণ বিদ্যা-বুদ্ধি
তো ছিল শূণ্য। ফলে আস্তে আস্তে ভক্তের সংখ্যাও ক্রমাগত কমতে থাকে। বছর দেড়েকের মধ্যেই
মন্দিরের পূজা অর্চনাও বন্ধ হয়ে যায়। এবং তার বছর খানেকের মধ্যেই শ্যামল খুড়োর
ঐরকম বীভৎস থ্যাঁতলানো মুখ যুক্ত লাস, তাও আবার ঐ পোড়ো মন্দিরটার পেছনেই জলার কাঁদার মধ্যে
শরীরের প্রায় অর্ধেকটা গুঁজে দেওয়া। মুখ দেখে অবশ্য বোঝার উপায় ছিলনা যে ওটা শ্যামল
খুড়োই। শুধু পরনের লুঙ্গি আর গেরুয়া ফতুয়া দেখে সনাক্ত করা হয়েছিল, যেটুকু জানি”।
তাহলে তুমিও
বিশ্বাস করো য়ে এই সবকিছুই ভূত বা প্রেতাত্মার কর্ম নয়।
“আলবাত। এবং আমি
এও মনে করি যে এই গ্রামে রাতের অন্ধকারে অসামাজিক কিছু একটা কাজকর্ম তো অতি অবশ্যই
নিত্য ঘটে চলেছে আমাদের সবার অজান্তে। এবং সেইসব অসামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত
মানুষদের মধ্যে কেউতো অতি অবশ্যই সরষের মধ্যেই ভূত হয়ে লুকিয়ে আছে এই গ্রামেই
ভালো মানুষ সেজে। কিন্তু কে বা কারা হতে পারে?”
কাউকে কি তোমার
সন্দেহ হয়?
“শ্যামল খুঁড়োর
মৃত্যুর পর আমি একদিন কথার ফাঁকে ঐ গোপাল জ্যাঠুকেই শ্যামল খুড়োর ব্যাপারে
জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু উনি হঠাৎ করেই চরম রেগে গিয়ে ওনার হাতের ঐ সর্বক্ষণের
সঙ্গী লাঠিটা উুঁচিয়ে এমন ধেয়ে এলেন যে, আমি তো পুরো স্তম্ভিত। লোকটার হলো কি? আমি তো একটা
সাধারণ প্রশ্ন করেছিলাম মাত্র, তাতেই এতো রাগ? আমাকে তো যথেষ্টই ভালোবাসেন। ছোটবেলা থেকেই কাছ থেকে
দেখছেন। লোকের কাছে আমার হয়ে প্রচুর প্রশংসাও করেন। তাহলে হঠাৎ করে কি এমন মহাভারত
অশুদ্ধ হয়ে গেল যে, একটা ছোট্ট
প্রশ্নে এতটা বিস্ফোরণ?”
তার মানে, এমন কোনো রহস্য
আছে যেটা পাছে মুখ ফসকে বেড়িয়ে না পরে তার জন্যই এই হম্বিতম্বি।
“একদমই তাই। দেখো
অর্জুন, তুমি মাত্র
দুদিনের জন্য এসেছো। ফলে যা কিছু করার আমাদের দুজনকেই করতে হবে এবং সেটা যেন
কাকপক্ষীতেও ঘুণাক্ষরেও টের পায়। আর সেটা আজ রাতেই। তুমি মানসিকভাবে তৈরি আছো?”
আমি পুরো তৈরি।
কিন্তু খুব সাবধান কারণ কাজটার মধ্যে মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। প্রাণও চলে যেতে
পারে। কারণ বিপক্ষ কিন্তু দারুণ শক্তিশালী। নাহলে আইনের চোখে ধুলো দিয়ে এতদিন ধরে
একটা মিথ্যেকে টিকিয়ে রাখা অত সহজ কথা নয়। সঙ্গে কি কিছু নিতে হবে? আমার কাছে অবশ্য
শুধু মোবাইল ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন বাজে, মোবাইলে বিকেল চারটে সাইত্রিশ। রাত্রে এগারোটার আগে তো
নিশ্চয়ই বের হবেনা। আমার একজন খুব পরিচিত দিদি আছে। সিউড়ি থানার ওসি, প্রকৃতি ভদ্র।
একদম ডাকসাইটে অফিসার। ক্রাইম ওকে দেখলে ভয়ে কাঁপে। ও আসার আগে সিউড়িতে প্রশাসন
বলে কিছু ছিলনা। ছোট থেকে বড় সবকটা ঘুষখোর। আর এখন গিয়ে একবার দেখে এসো কখনও সুযোগ
পেলে। ‘সিংহম’ বইটা কখনো দেখেছো? একদম ‘লেডি সিংহম’ বস্। আমি দিদিকে তোমাদের এই গ্রামের পরপর
খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা একদিন জানিয়েছিলাম। উনি বললেন সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে।
লোকাল পাঁচঘরা থানা আগে স্টেপ নেবে। এইবার দীর্ঘদিন ধরে যদি কোনও সুরাহা না হয়
তাহলে মৃতের পরিবারের তরফ থেকে উকিলের মাধ্যমে যদি কেউ সিউড়ি থানায় নালিশ করে তবে
সেক্ষেত্রে আমি কেসটা তদন্ত করে দেখতে পারি। প্রকৃতি’দি- কে একটা ফোন করে বলে
দেখিনা যদি আজ রাত এগারোটা নাগাদ ওরাও পোড়ো মন্দিরটার আশেপাশে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে
পারে ওর দলবল নিয়ে। কোনকিছু ঘটলে আজকেই সব বামাল সমেত হাতেনাতে ধরে ফেলা যাবে।
“বাঃ যদি পারো তবে
এটা একটা কাজের মতো কাজ হবে অর্জুন। তবে রামকেও তুমি চেনোনা। আমার কাছে একটা
‘রামগুলতি’ আছে। সঙ্গে ছোটবড় এবড়ো খেবড়ো প্রায় শ’খানেক লোহার টুকরো। লক্ষ্যভেদ
কাকে বলে আজ তুমি নিজের চোখে দেখবে। তুমি তৈরি হয়ে একদম চুপিসারে তোমাদের বাড়ির বাইরের আম গাছটার তলায় এসে দাঁড়াবে। আমি তার
আগেই হাজির হয়ে যাবো।
---------
ওরা দুজনে যা
ভেবেছিল ঠিক তাই। অন্তত গোটা চারেক ছায়া মূর্তি একটা ভারি কিছুকে মন্দিরের ভেতর
থেকে বয়ে নিয়ে এসে ভাঙাচোরা বাঁধানো ইঁট রাস্তার উপরে এনে দাঁড় করালো। অর্জুন
মোবাইল জুম করে ইনফ্রারেড অপশনে দৃশ্যটির পুরো ভিডিওটি তুলছিল। বস্তুটা একটা বড়
স্টীলের বাক্স। লোকগুলোকে অবশ্য অন্ধকারে চেনা যাচ্ছেনা। রাম হঠাৎ আমার হাতটা ধরে
টেনে কানে কানে প্রায় নিঃশব্দে বললো, “ডান দিকের ছবি তোল। দুটো ছায়া মূর্তি এগিয়ে আসছে গ্রামের
দিক থেকে”।
প্রথম চারজনের
একজন বাক্সটির ঢাকনা খুলে কিছু দেখাচ্ছিল। ওদের মধ্যে চাপা স্বরে কিছু কথা হওয়ার
পরে অন্ধকারে মনে হলো সেই বিশেষ লোকটি এই দুজনের একজনের হাতে কিছু গুঁজে দিলো।
টাকাই হবে হয়তো। তার মানে দামি কিছু একটা পাচার হচ্ছে। কিন্তু বেঁচলোই বা কে আর
কিনলোই বা কে?
প্রকৃতি দিদি কি
তার দলবল নিয়ে আদপেই পৌঁছতে পেরেছে এইখানে। ওদের তো টিকিও দেখা যাচ্ছেনা। দুর না
আসতে পারলে একটা দারুণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। বোঝাই যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে কোনো
একটা দামি কিছু, হতেই পারে দামি
মূর্তি পাচার হচ্ছে। কদিন আগেই কলকাতার জাদুঘর থেকে কিছু বহ প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য
ধাতুর মূর্তি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা টিভিতে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। খবরের কাগজেও
ছবিসহ প্রচুর প্রচার হয়েছিল মিউজিয়ামের দ্রব্যাদির সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। সেই
ধরনেরই কিছু নয়তো? ক্যামেরাতে ছবি
তো উঠলো। কিন্তু এই ছায়ার ছবি দেখে তো আসল লেকগুলোকে কোনভাবেই সনাক্ত করা সম্ভব
হবেনা। গ্রামের লোকেদেরকেও বলা যাবেনা। তাহলে আমাদের প্রচেষ্টার কথা জানাজানি হয়ে
যাবে এবং শয়তানরাও সচেতন হয়ে যাবে এবং আমাদের ক্ষতি করার সাধ্যমত চেষ্টা করবে।
গ্রামের দিক থেকে
আসা লোক দুটো গ্রামের দিকে মুখ ফিরিয়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই একটা জোরালো
বাঁশি বেজে উঠলো, মনে হলো যেনো
একদম কানের পাশ থেকেই। সঙ্গে একটা গুরুগম্ভীর মেয়েলি গলা, “আমি তোমার ঠিক
পেছনেই দাঁড়িয়ে আছি অর্জুন,
প্রায় গত আধ
ঘন্টা হলো। তোমার হাতে রয়েছে মোবাইল আর আমার চোখে রয়েছে বিদেশি অত্যাধুনিক
দূরবীন। আমি সবকিছু প্রায় দিনের আলোর মতই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি”।
বাঁশি বাজার সাথে
সাথেই প্রায় জনা কুড়ি রাইফেলধারীকে চারদিক ঘিরে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা
গেলো। ধরা পরলো মোট ছ’জন। শঙ্কর অধিকারী ওরফে গোঁসাই, শ্যামল খুড়ো, রায় বাড়ির দুই
ছেলে কুনাল ও কাঞ্চন। বাকিরা এই গ্রামের নয়। যোগেন ওরফে ‘জগু’ এবং ছেদিলাল, দুজনেই মুঙ্গেরের
লোক। পুলিশের খাতায় নাম আছে বেশ কয়েকটা কেসে। তবে পালের গোদা এদের মধ্যে কেউ নয়।
প্রকৃতি ভদ্রের কথায়, “এগুলোকে সুরসুরি
দিয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে দিলেই সব জলের মতো পরিস্কার হয়ে যাবে”। যতদূর খবর আছে তাতে
করে আসল পালের গোদাটা থাকে দুবাইয়ে। তবে এই গোঁসাই কিন্তু এই বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া আর
ঝাড়খন্ড – এই বিশাল এলাকার নামকরা চোরাচালান দলের মাস্টারমাইন্ড। ছদ্মবেশ ধারণ
করতে যাকে বলে একেবারে জাত শিল্পী। আগে যাত্রাদলের পৌরাণিক পালায় সাধু সন্তের
অভিনয় করতো। ফলে পৌরাণিক কাহিনী গুলো ওর একেবারে মুখস্ত। আর গ্রামের সাধারণ মুখ্য
সুখ্য মানুষ তাতেই ঠকে এসেছে এতদিন। তবে যেটা এই গ্রামের লোক হয়তো জানেনা যে, গ্রামের সকলের
প্রিয় শ্যামল খুড়ো আসলে নেপাল হালদারের আপন সৎ ভাই। মানে সবথেকে প্রবীণ গোপাল
হালদারের দ্বিতীয় পক্ষের একমাত্র সন্তান। ওর মামার বাড়ি পাঁচঘরা গ্রামে। ছেলে
হওয়ার পরে গোপালের দ্বিতীয় স্ত্রী মানে শ্যামল খুড়োর মা ছেলেকে বাপের বাড়িতে
রেখেই হঠাৎ করেই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কিছুটা বাধ্য হয়েই গোপাল হালদার ওকে গ্রামে
নিয়ে আসে যখন শ্যামলের বয়স উনিশ বছর। সেইসময় পুরো উচ্ছন্নে চলে গিয়েছিল সে। এবং
পিতার পরিচয় জানতে পেরে আটচালায় চলে এসে সবকিছু জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তবে
দুজনের মধ্যে শর্ত হয় যে,
সে এই গ্রামে
সবার কাছে ভালো মানুষ হিসেবে মান্যতা পাবে কিন্তু কোনভাবেই পিতৃ পরিচয় কাউকে
জানাতে পারবেনা। আর মাঝখানে গোঁসাই-এর পাল্লায় পড়ে নিজের পুরনো পরিচয় মুছে ফেলার
জন্যই মিথ্যা মিথ্যি লাসকাটার ঘর থেকে লাস যোগাড় করে এনে নিজের পোষাকে সেই
লাসকে সাজিয়ে নিজেকেই মৃত বলে প্রচার করার প্রচেষ্টা। গোপাল হালদার সেটা ধরে
ফেলেছিলেন কিন্তু সবটা বলে নিজের কবর আর নিজেই খুঁড়তে চাননি।
ওদেরকে পুলিশ ধরে
নিয়ে যাওয়ার সময় শুধু শ্যামল খুড়োই রামকে বলে গেলেন, “রাম এটা তুই
মোটেও ভালো করলিনা। নিজের হাতে খুড়োর ভূতকে ধরিয়ে দিলি?”