জ্ঞান বিজ্ঞান । অগ্রহায়ণ ১৪৩১




পিচার প্ল্যান্ট (ঘটপত্র উদ্ভিদ, Nepenthes)          
  প্রকৃতির ফাঁদ 












ড. সৌমিত্র চৌধুরী
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

‘উচ্চিংড়েটা এদিক-ওদিক লাফিয়ে গাছটার পাতার উপর বসল এবং বসতেই তৎক্ষণাৎ পাতাটা মাঝখান থেকে ভাঁজ হয়ে গিয়ে পোকাটাকে জাপ্টে ধরল। অবাক হয়ে দেখলাম যে, দু’দিকের দাঁত পরস্পরের খাঁজের উপর বসে যাওয়ায় এমন একটি খাঁচার সৃষ্টি হয়েছে যার থেকে উচ্চিংড়ে বাবাজীর আর বেরোবার কোন রাস্তাই নেই। প্রকৃতির এমন বীভৎস ফাঁদ আমি আর কখনও দেখিনি।’

    বীভৎস ফাঁদের গল্প আমাদের শুনিয়েছেন স্বনামধন্য চিত্র পরিচালক, লেখক, শিল্পী শ্রীসত্যজিৎ রায়। উপরের কথাগুলোসেপ্টোপাসের খিদেগল্পের অংশ। পতঙ্গভুক গাছ কেমন করে নরমাংস শিকারি হয়ে উঠল, এ নিয়েই তাঁর বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান কাহিনী। গল্পের এক চরিত্র প্রশ্ন করছেন, ‘পোকাটা যে ঐ পাতাতেই বসবে তার কোন গ্যারান্টি আছে কি?’

    গ্যারান্টি আছে। কল্প কাহিনী সরিয়ে বিজ্ঞান-আলোচনায় আসি। প্রথম প্রশ্ন, অন্ধকারেও কেমন করে উচ্চিংড়ে লাফিয়ে গাছের পাতায় এসে বসে? রহস্যে ঢাকা বহুদিনের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছে বিজ্ঞান। 

গাছ মানে আমাদের আলোচনায় এক বিশেষ ধরণের উদ্ভিদ। তারা অনেক রকমের। সাধারণ ভাবে তাদের বলা হয়, পতঙ্গভুক উদ্ভিদ। বাঁচবার প্রয়োজনে তাদের পোকা মাকড় খেতে হয়। টিকে থাকবার প্রয়োজনীয় উপাদান নাইট্রোজেন। পতঙ্গভুক উদ্ভিদ সেটি গ্রহণ করে পোকা মাকড়ের শরীর থেকে। পোকা ধরে কেমন করে? উদ্ভিদ তো দৌড়ে গিয়ে কীটপতঙ্গ ধরতে পারবে না। তাহলে

বিভিন্ন উপায়ে এরা পোকা ধরে। কিছু কিছু পতঙ্গভুক উদ্ভিদ আলো বিকিরণ করে পতঙ্গকে নিজেদের কাছে আকর্ষণ করে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, পতঙ্গভুক উদ্ভিদের কিছু প্রজাতি উজ্জ্বল নীল আভা বিকিরণ করে। এই আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পতঙ্গ গাছের পাতায় এসে বসে। 

এই ধরণের পতঙ্গভুক উদ্ভিদ অনেক রকমের। সূর্য শিশির, ফ্লাইট্র্যাপ, ড্রসেরা, ব্লাডারওয়ার্ট, বাটারওয়ার্ট, পিচার প্ল্যান্ট (ঘটপত্র উদ্ভিদ)। 

পিচার প্ল্যান্ট (ঘটপত্র উদ্ভিদ, Nepenthes) কলসির মত দেখতে। কলসির মুখ (Peristome) বরাবার পতঙ্গ ধরবার ফাঁদ হিসাবে কাজ করে নীলাভ আলো (চিত্র 1)এই আলো নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘের (366 nm) অতিবেগুনী রশ্মি। মানুষের চোখে দেখা না গেলেও রাতের অন্ধকারে এই আলো পোকা মাকড়ের চোখে ধরা পড়ে। পতঙ্গ আকর্ষণকারী এই আলো। এই আলোর ফাঁদে কলসির মুখে একবার এসে বসলেই ভয়ঙ্কর পরিণাম। কলসির ভিতর আটকে যায় পতঙ্গ। তারপর দমবন্ধ হয়ে ঘটে মৃত্যু। পতঙ্গ ভক্ষণ করে নেয় উদ্ভিদ। লাভ করে পুষ্টি। 

          পিচার প্ল্যান্টের কলসির মুখে আলোক রশ্মির জ্বলজ্বল করে ওঠা প্রক্রিয়াটির নাম প্রতিপ্রভ, ইংরাজিতে ফ্লোরেসেন্স (Fluorescence) সহজ কথায়, প্রতিপ্রভ এক ধরনের আলোর স্ফুরন। বস্তুর গায়ে আপতিত আলোক রশ্মির চাইতে কম শক্তি মাত্রার বিকিরণ। 

জলে স্থলে অন্তরীক্ষে, প্রকৃতির সর্বত্র নজরে আসে প্রতিপ্রভ মাছ এবং বহু জলজ প্রাণীর শরীর থেকেও বিচ্ছুরিত হয় প্রতিপ্রভা (Fluorescent light) অনেক গাছের ফুলে পাতায় পাওয়া যায় আলো বিচ্ছুরণকারী পদার্থ। অন্ধকারে হীরা মাণিক জ্বলে। আর অন্তরীক্ষে আকাশ ভরা সূর্য তারায় বিচ্ছুরিত হয় ফ্লোরেসেন্স। দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় ফ্লোরেসেন্সের ব্যবহার দেখি আমরা। রাস্তার দুপাশে, ট্র্যাফিক গার্ডদের পোষাকে, আধুনিক যোগাযোগ এবং সিগন্যাল ব্যবস্থায় রঙিন প্রতিপ্রভা বিকিরণকারী পোশাক এবং খেলনাও বহুল জনপ্রিয়। টাকা (কারেন্সি) জাল না সঠিক, চিনতে শেখায় ফ্লোরেসেন্স। আলোর নিচে রাখলে সঠিক নোটের বিশেষ স্থান জ্বলজ্বল করে ওঠে। 

          প্রতিপ্রভা বর্তমান আলোচনার বিষয় নয়। তবে ফুলের বা পাতার প্রতিপ্রভা বিচ্ছুরণ কীট-পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে। আর পতঙ্গভুক গাছ সেই কীট ভক্ষণ করে জীবন নির্বাহ করে। একটা প্রশ্ন জাগে। পতঙ্গ একবার ফুলের উপর এসে বসলে উড়ে পালিয়ে যেতে পারে না কেন?   

     সাধারণত পতঙ্গভুক উদ্ভিদের রংচঙে ফুলে মাখানো থাকে এক ধরণের আঠা। প্রকৃতির তৈরি সেই আঠা। একবার বসলে আঠায় আটকে যায় পতঙ্গের পা বা শরীরের অন্য অংশ। তখন পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। 

পতঙ্গভুক উদ্ভিদ যেমন বহু ধরণের, তাদের পাতা ফুলেরও অনেক রকমারি। পাতা ফুলের গায়ে মাখানো আঠার চরিত্রও ভিন্ন ভিন্ন। একটি বিশেষ পতঙ্গভুক উদ্ভিদের কথ বলি। তার নাম সূর্যশিশির (চিত্র 2)প্রায় দুশো ধরণের প্রজাতি এদের। আমাদের দেশেও বহু ধরণের সূর্যশিশির (Drosera sp.) পাওয়া যায়। শিলং পাহাড়ে দেখেছি সূর্যশিশির। এর ফুলের গায়ে লেগে থাকে আঠাল পদার্থ।  

আঠাল পদার্থটি নিয়ে দেশ বিদেশে গবেষণা চলছে প্রচুর। কী দিয়ে তৈরি হয়? গবেষণা জানান দিয়েছে, পলিস্যাকারাইড অনু দিয়ে তৈরি এই আঠা। অনু গুলোর মাঝখানে থাকে ক্যালসিয়াম আর ম্যাগনেসিয়াম আয়ন। আর আঠার বেশির ভাগটাই (96 শতাংশ) জল। 

প্রাকৃতিক এই আঠাকে কি আমাদের কোনো কাজে ব্যবহার করা যায়? চেষ্টা চলছে সেই উদ্দশ্যে। অনেক বিজ্ঞানী ভাবছেন, সেল কালচার প্রক্রিয়ায় এই আঠা ব্যবহার করা যেতে পারে।  

মানুষ, অন্য প্রাণীর কোষ বা জীবাণু ল্যাবরেটরিতে পালন করা হয়। ওষুধ-গবেষণা এবং বহু কাজে কোষ-পালন (cell culture) দরকার হয়। প্রায় সমস্ত জীববিজ্ঞানের গবেষণাগারই সেল কালচার কাজটি করে থাকে। কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে নিতে পেট্রি ডিসে (Petri dish) প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান (nutrient) দিয়ে সঠিক তাপমাত্রা বজায় রেখে কালচার করা হয়। পেট্রি ডিস (পেট্রি প্লেট, বা সেল কালচার ডিস) আদতে ঢাকা দেওয়া প্লেট। প্লাস্টিক নয়ত কাঁচের তৈরি। আবিষ্কারকের নামে নামকরণ। উদ্ভাবন করেছেন জার্মান বিজ্ঞানী পেট্রি (Julius Richard Petri)পেট্রি ডিসে আঠা হিসাবে লাগানো থাকে কিছু প্রোটিন (কোলাজেন, ফাইব্রোনেকটিন)। এদের কাজ কোষকে পেট্রি ডিসে আটকে রাখা। অবশ্য আরও অনেক গুণাবলীও থাকে। 

উন্নত গবেষণা, বিভিন্ন রোগের ওষুধ অন্বেষণ ইত্যাদি কাজে দুনিয়া ব্যাপী পেট্রি ডিশের ব্যাপক চাহিদা। ইউরোপ আমেরিকার বহু কোম্পানি তৈরি করে পেট্রি ডিস। ভারতের কয়েকটি কোম্পানিও দক্ষতার সঙ্গে উৎপাদন করছে। 

আলোচনা হচ্ছিল সূর্যশিশির বা অন্য পতঙ্গভুক উদ্ভিদ নিয়ে। সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। পতঙ্গভুক উদ্ভিদের শরীরে থাকে পিচ্ছিল আঠাল পদার্থ। বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক উপাদান। সেই উপাদান কি কোষ আটকে রাখবার কাজে (cell adhere) বানিজ্যিক ভাবে পেট্রি ডিসে ব্যবহার করা যায়?  

বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন অনেক বিজ্ঞানী। ব্যবসায়ীরাও অপেক্ষায় আছেন। প্রাকৃতিক আঠা ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ কমে যাবে। 

পরিশেষে আরেকটি কথা। কল্পবিজ্ঞান কাহিনীতে যেমন লেখা হয়, পতঙ্গভুক উদ্ভিদ কিন্তু বস্তবে তেমন নয়। মানুষ কিংবা বড় প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিপদজনক নয় পতঙ্গভুক উদ্ভিদ। ছোট পতঙ্গের ক্ষেত্রে বিপদজনক।  কারণ, পতঙ্গভুক উদ্ভিদের খাদ্য, ছোট পোকা মাকড়। কীট পতঙ্গের দেহের প্রোটিন।



সূর্যশিশির

 


আরও পড়ুন  -



বিজ্ঞান দিবস ও ভারতের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী


হাড়গিলা কি বিলুপ্ত পাখি


মাইক্রোবায়োলজি আর মাইক্রোস্কোপ


রহস্যে মোরা গিরগিটি


হাঁস নিয়ে অন্য কথা