গল্প - ৪ । আষাঢ় ১৪৩১



 ছদ্মবেশী মুখোশ












বাণীব্রত গোস্বামী 
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

এটাই  সেই বটতলা বুড়ো বটতলা সবাই বলে এই নসীবপুর গ্ৰামে নাকি যত বটগাছ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো এই বটগাছটা তাই এরনাম বুড়ো এটাকে মাঝখানে রেখে দুদিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে দুটো রাস্তাই আবার গিয়ে মিলেছে রেল স্টেশনের দিকে তবে ডানদিকেরটা দিয়ে একটু বেশি ঘোরা হয় বাঁদিকেরটা শর্টকাট্ তবু সন্ধের পর কেউ ওদিকে খুব একটা মাড়ায় না বহুদিন ডানদিকটা দিয়েই যাতায়াত করে গ্ৰামে একটা গুজব আছে রাস্তায় নাকি ভূত আছে

           চিরকাল এই সমস্যা ছিল না সূত্রপাত বছরখানেক ধরে অথচ ওদিকেই এই নসীবপুর গ্ৰামের পুরোনো জমিদার বর্ধনদের বাড়ি যদিও এখন আর কেউ বাড়িতে থাকে না ওদের বংশের বেশিরভাগই মরে গেছে দুএকজন শোনা যায় নাকি বিদেশে থাকে আর থাকবেই বা কী করে! সারা বাড়ি তো গাছপালা আর ঝুরিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জঙ্গল বাদুড়ের আঁতুড়ঘর পায়রাও কিছু থাকে ভগ্নদশা দিনেরবেলাই ওদিকটায় যেতে বরাবর ভয় লাগত সবার তবে সেটা ভূতের নয়, ছিল সাপের ভয় শেয়াল- দেখা যেত মাঝেমধ্যে এই আতঙ্কের উৎপাত চালু হয়েছে গতবছর থেকে প্রথম ভয় পায়, গ্ৰামের হরিচরণবাবু সে গল্পে আসছি

বটতলার এই বাম দিকের রাস্তাটা স্টেশন পেরিয়ে সোজা জাতীয় সড়কে গিয়ে উঠেছে তাই এই রাস্তাটা একটু চওড়া আর মসৃণ সরকারি পিচের প্রলেপ একটু বেশি পড়ে এই রাস্তার ওপর তাই সেদিন ট্রেন থেকে সন্ধের পর নেমে সাইকেল নিয়ে এই রাস্তাটাই ধরেছিল হরিচরণ সাইকেল চালাতে সুবিধে ডানদিকের রাস্তাটা অসমান আবার ঘোরাও পড়বে বেশি ঠিক বর্ধনদের জমিদার বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখলেন রাস্তার পাশে জঙ্গলের মধ্যে দুটো চোখ জ্বলছে প্রথমে মনে হল শেয়াল তারপর চোখদুটো ক্রমশ উঁচুতে উঠছে মনে হচ্ছে বড় কোনও জন্তু তাহলে কি বাঘ? দূর! এখানে বাঘ আসবে কী করে! তারপর দুচোখের মধ্যে ফাঁক- বাড়তে লাগল তাহলে জন্তুর মুখটা কি অনেক বড়! আর এগোবার সাহস পেলেন না হরিচরণ! সাইকেলের মুখ ঘোরালেন জ্বলন্ত চোখ দুটো যেন তার দিকে ক্রমাগত এগিয়ে আসছে উনি পড়িমরি করে সাইকেলে উঠলেন আর পিছনে তাকালেন না প্রাণ হাতে নিয়ে প্রাণপনে জোরে সাইকেল চালাতে লাগলেন একেবারে এসে থামলেন স্টেশনের সামনে সেদিন ডানদিকের রাস্তা দিয়ে ঘুরেই বাড়ি ফিরলেন 

গ্ৰামে এসে তো রঙ চড়িয়ে বেশ ভালোই গল্প ফাঁদল হরিচরণ তবে তখন ভয়টা ভূতের ছিল না, ছিল অজানা জন্তুর সবাই মোটামুটি ভয় পেল পেল না শুধু নবকৃষ্ণ হেলা ব্যাটা বরাবরই একরোখা দুধের ব্যবসা করে তাগড়াই চেহারা রোজ সকালে মুগুর ভাঁজে জেদ করেই একদিন আতঙ্কের রাস্তা দিয়ে সন্ধেবেলা ফিরতে লাগল হঠাৎ ঠিক জমিদার বাড়ির সামনে একটা ছায়ামূর্তি দিল পিঠে ঠ্যালা সাইকেল নিয়ে পড়ল রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে দুধের ড্রাম গড়াগড়ি পড়ে গিয়ে চাক্ষুষ দেখল, ভূত একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাইকেলটা তোলার আর সাহস হল না নবকৃষ্ণর অন্ধকারে চটি কোথায় লোপাট! খালি পায়েই এক দৌড়ে একেবারে দুগ্গাদালানের সামনে হাপরের মত হাঁফাচ্ছে 

পরদিন সকালে গ্ৰামের কিছু জোয়ান ছেলে মিলে দিনেরবেলা জায়গাটায় গেল দুধের ড্রামগুলো পাওয়া গেলেও সাইকেলটা আর পাওয়া গেল না ভূতে বা জন্তুতে তো আর সাইকেল নেবে না! তাহলে কী কোনও চোর! কিন্তু সে ধারণাও ভুল প্রমাণিত হল পরের ঘটনায় নিবারণ চক্রবর্তী শহরে থাকে এসব ঘটনার কিছুই জানত না সে গ্ৰামে ফিরছে বেশ কিছুদিন পর সন্ধে হয়ে গেছে তখন পায়ে হেঁটেই শর্টকাট রাস্তা দিয়ে ঠিক ভাঙা বাড়ির কাছে আসতেই জঙ্গলের ভেতর থেকে খোনা গলায় আওয়াজ, “খঁবরদাঁর এদিঁক দিঁয়ে আঁর কোঁনদিন যাঁবিনা!”

উনি চমকে উঠলেন ব্যাগে মাসের মাইনে মোটা টাকা হাতে ঘড়ি, আঙুলে আংটি শহুরে থাকা শিক্ষিত মানুষ ভূতে ভয় নেই বললেই চলে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ি চলে এলেন তবে গল্পটা ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্ৰামে বোঝা গেল জন্তু বা চোর নয়, অবধারিত ভূত কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে হাই স্কুলে পড়া বিলকু বা তার বন্ধু বিলটু এই কথা মানবে কেন? ওদের কথায় পরে আসছি

বিজ্ঞানের দুই ভালো ছাত্র হিসেবে ওদের পক্ষে এই বুজরুকি গল্প কিছুতেই‌ মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না ওরা তখন সবে দশ ক্লাসের পরীক্ষা দিয়ে ছুটিতে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা গোপনে একটা ফন্দী আঁটল আসলে উপরের এই তিনটে ঘটনার পুরো বর্ণনা শুনে ওদের মনে একটা সন্দেহ দানা বেঁধেছিল ওরা ঠিক করল দুজনে একদিন গোপনে ঢুকবে ভাঙা জমিদার বাড়ির ভেতর মনে হচ্ছে যেন ঐখানেই লুকিয়ে আছে যাবতীয় রহস্য

একদিন নিঝুম দুপুরে ওরা পৌঁছল ভাঙা বাড়ির সামনে দোমহলা বাড়ি দোতালা কিন্তু এখনকার চারতলা বাড়ির সমান উঁচু বট অশ্বথ্থে ঘেরা দিনের বেলাতেও বাড়ির ভেতর আলো ঝাপসা আলো আঁধারি চারদিক ভেজা-ভেজা দেওয়ালে শ্যাওলা একটা তক্ষক ডেকে উঠল সাপখোপ থাকাটাই স্বাভাবিক ডালপালা সরিয়ে ঘরের দিকে এগোতেই টা পায়রা ডানা ঝাপটে উড়ে গেল নিস্তব্ধতা খানখান করে সিলিং- প্রচুর বাদুড় উল্টো হয়ে ঝুলছে কয়েকটা জায়গা দেখে মনে হল যেন মানুষের হাঁটাচলা আছে এখানে নীচের ঘাসে জুতোর দাগ খানিকটা এগোতেই একটা থামের পাশে কিছূ সিগারেটের টূকরো ওরা নিশ্চিত হল, এখানে মানুষ আসে কিন্তু এখন নেই তো! তাহলেই বিপদ হবে তবে এলেই বা কেন আসে! খুব সতর্ক হয়ে গেল বিলকু আর বিলটু তবে মনে তো হচ্ছে, এখন কেউ নেই তারপর উঁকি দিল পিছনের একটা ঘরের দিকে উঁকি দিতেই ওদের চক্ষু চড়কগাছ! মেঝেতে রাখা রয়েছে বেশ কিছু কাঠের পেটি কয়েকটা টর্চ ঘরের কোণে ছড়িয়ে আছে একটা ভূতের মুখোশ ওরা আর এক মুহূর্তও ওখানে অপেক্ষা করল না একেবারে দ্রুত পায়ে থানায় বড়বাবু গঙ্গাপদ সরকার তখন টিফিন করছে একটু বসতে বলল ওদের

গঙ্গাপদ বাবুর কাছে সবটাই খুলে বলল ওরা গঙ্গাপদ বাবু ঠিক করলেন, এখনই ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না যারাই বাড়িতে ঢোকে, তারা তাহলে সতর্ক হয়ে যাবে তাদের কাজকর্ম, উদ্দেশ্য কিছুই জানা যাবে না যেতে হবে রাতের অন্ধকারে তাতে বামাল পাকড়াও করা যাবে 

সেদিন একটু রাত গড়াতেই গঙ্গাপদবাবু দলবল নিয়ে ঘিরে ফেলল বর্ধনদের‌ রাজবাড়ি চারজন ছিল দুজন ধরা পড়ল আর দুজন তখন জঙ্গল দিয়ে পালালেও, পরে ধরা পড়ে গিয়েছিল জানা গেল ওরাই টর্চ বা ভূতের মুখোশ দিয়ে সবাইকে ভয় দেখাত যাতে এদিকটায় কেউ খুব একটা না আসে ওদের ঐসব বাক্স থেকে মাদক পাওয়া গেল ওরা মাদকের চোরাকারবারি বড় চক্র এই রাস্তা দিয়ে সারা উত্তরপূর্ব ভারতে মাদকের ব্যবসা করে সবার ভয় কেটে গেল বিলকু আর বিলটু শুধু এতদিন গ্ৰামে ভালো ছেলে হিসেবেই পরিচিত ছিল এবার ওরা গ্ৰামের দুই হিরো হয়ে উঠল শুধু তাই নয়, থানা থেকেও জুটল সাহসিকতার জন্য পুরস্কার