বৈজ্ঞানিকের রান্নাঘর - ৫ । আশ্বিন - ১৪৩১









 খাবারের গায়ে 
 

 কেন টক টক গন্ধ












অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
দিল্লি, এন সি আর 


 

এসপ্ল্যানেডে আমিনিয়া রেস্তোরাঁর কাচের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে রিয়া অর্ককে বলে, “এই রেস্তোরাঁ কত পুরোনো অর্কদা?”

অর্ক রিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে ওর পছন্দের টেবিলের দিকে দেখে নেয় সেখানে কেউ বসে আছে কি না। রাস্তার দিকে মুখ ফেরানো টেবিলটা আজ ফাঁকা। গোটা রেস্তোরাঁতেই লোক কম। আজ ছুটির দিন নয়। অর্ক রাস্তার দিকে মুখ করে চেয়ার টেনে বসতে বসতে রিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয়, “আজ থেকে পঁচানব্বই বছর আগের। প্রশ্নটা করে ভালো করেছিস। এই রেস্তোরাঁই শুধু নয়, আরও অনেক মোগলাই রেস্তোরাঁ পাওয়া যাবে কলকাতা শহরে। অওধ বা লখনৌর মোগলাই রান্নার স্বাদ পাওয়া যায় এইসব রেস্তোরাঁয়। মোগল শহর দিল্লি থেকে এসেছিস তুই, যে-শহরের আনাচে-কানাচে পাওয়া যায় নানা মোগলাই খানার খাজানা। কিন্তু লখনৌ শহরটাই যিনি উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি হলেন…”

নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ্।”

অর্ক চোখগুলো কৃত্রিম গোল করে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে ওঠে—“ব্রাভো! ছেড়ে দে বিজ্ঞানী হবার ইচ্ছে। তুই বরং ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো কর। একদম ঠিক বলেছিস। তাই আজ শুধু বিরিয়ানি নয়, আরও একটা ডিশ অর্ডার করব তোর জন্য। সেটা একেবারে অওধি।”

কী সেই মহার্ঘ বস্তু? বিরিয়ানি খেলেই কিন্তু আমার পেট ভরে যাবে। আর কিছুই পেটে ঢুকবে না। ওয়াজিদ আলি শাহের লখনৌ থেকে কলকাতা আসবার কারণটা আমি একটা বইতে পড়েছিলাম। আমিনিয়ার মালিকেরা কি নবাবের শাহি হেঁসেলের পাচক ছিলেন?”

বলা মুশকিল। তবে এখন যাঁরা চালান এই রেস্তোরাঁ, তাঁরা হলেন প্রথম দোকানের তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের মানুষ। ইংরেজ আমলে ১৯২৯ সালে জাকারিয়া স্ট্রিটে প্রথম খোলে আমিনিয়ার দোকান। এর বেশ কয়েক দশক আগেই নবাব ওয়াজিদ আলি মারা গিয়েছেন। আমিনিয়ার মালিক হয়তো মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলেই বাস করতেন, তাই তিনি লখনৌ রান্নার স্টাইল রপ্ত করে ফেলেন। তবে আজ এঁদের অনেক প্রতিযোগী এসে গিয়েছে কলকাতার বাজারে। সে যাক গে, তোর চটজলদি নবাবের নামটা সঠিক বলে দেবার জন্য তোর জন্য অর্ডার করব মাটন রেজালা।”

মায়ের কাছে রেজালার নাম শুনেছি। কিন্তু খাইনি কোনোদিন এই পদ।”

অর্ডার নিতে উর্দি পরা মাঝবয়সি ভদ্রলোক টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াতেই অর্ক চিকেন বিরিয়ানি আর মাটন রেজালা অর্ডার করে রিয়াকে বলে, “তাহলে ভালোই হল। খাবারটা অতুলনীয়। খুব সম্ভব দিল্লিতে পাওয়া যাবে না কোথাও। রেজালা শব্দটা নাকি উর্দুভাষার ‘রাজল’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হল নিম্নমানের। কেন এই অসাধারণ খাবারের নাম নিম্নমানের তকমা পেল, জানা যায় না। আসলে নবাব কলকাতায় এসে গরিব থেকে আরও গরিব হচ্ছিলেন ইংরেজদের জাঁতাকলে পিষে গিয়ে—যেমন বিরিয়ানিতে আলু দেওয়া শুরু হয় তাঁর আমলে, লোকে বলে মাংসের অভাবে। কারণ যা-ই হোক, অনেকের মতে, রেজালা এসেছিল পূর্ববঙ্গের ঢাকা থেকে। সেখানকার রান্না ঘরানায় মোগল সংস্কৃতি মিশে যায়। কাজেই নিন্দুকেরা রেজালাকে নিম্নমানের বলে মনে করলেও আমাদের কিছু আসে যায় না। হয়তো অন্য কোনও শব্দের অপভ্রংশ হতে পারে রেজালা।”

অর্কর রেজালার ইতিহাস বর্ণনার মধ্যেই বিশাল দুই প্লেটে এসে যায় সুগন্ধি চিকেন বিরিয়ানি আর মাটন রেজালার দুই সাদা পোর্সিলিনের পাত্র। রিয়া দেখে একটা প্রায় স্বচ্ছ হলুদ ঝোলের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে মাটনের দুটো টুকরো। পাত্রে ভাসছে হালকা ঘি। একটা সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে।

মনে হচ্ছে আজ বিরিয়ানি থেকে রেজালার প্রতি আমাদের বিজ্ঞানীর বেশি মন?”

নতুন খাবার। তাই একটু দেখে নিচ্ছি।” বলেই রেজালার পাত্র থেকে একটুকরো মাটন মুখে পুরে রিয়া বলে, “বেশ দারুণ খেতে। গন্ধটা অপূর্ব। একটা হালকা টক স্বাদও পাচ্ছি।”

হ্যাঁ, রেজালা রান্নায় দই দেওয়া হয় বেশ খানিকটা। আর থাকে বিশুদ্ধ ঘি। যেটা বাটিতে ভাসছে। বেশি খেলে কোলেস্টেরল বাড়তে বাধ্য। টকের ব্যাপারটা এই রান্নাতেই নয়, বহু রান্নার স্বাদের গুণ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের জিভের সংবেদনশীল স্নায়ুগুলো পাঁচটি বিভিন্ন স্বাদ বুঝে নেয়—মিষ্টি, ঝাল, নোনতা, তেতো আর টক। এই পাঁচটা স্বাদ খাবারের মধ্যে পরিমাণমতো মিশেল দিলে রান্নার তারিফ করে থাকি আমরা। মাত্রা কম বা বেশি হলে রান্না মুখে দেওয়া যায় না, রাঁধুনি বদনাম হয়। তবে সাধারণ রাঁধুনিদের পাঁচটি স্বাদের বিজ্ঞান নিয়ে একটুও মাথাব্যথা না হলেও তারা অপূর্ব সব রান্না করে নানা ভেলকি দেখিয়ে দেয় স্রেফ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। টকের কথাই যখন উঠল, তাহলে টকের উপর একটা ‘টক’ দিয়ে দিই, কী বল?”

সেটাই বলতে চাইছিলাম। শুধু যে রেজালা তাই নয়, বিরিয়ানিতেও সামান্য টক আছে লক্ষ করলাম। খাবারের টক ব্যবহারের উপর তোমার ‘টক’ তাই আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

লেবুর রস ব্যবহার করা হয় অনেক রান্নায়, এটা তো জানিস নিশ্চয়ই। সেই টক হচ্ছে সাইট্রিক অ্যাসিড, যা লেবুতে আছে। আবার ভিনিগারও দেওয়া হয় খাবারে। তাতে রয়েছে অ্যাসিটিক এসিড। বাজারচলতি নাম ভিনিগার। এই অ্যাসিডগুলো সব হচ্ছে মৃদু। এক ফোঁটা জিভে ঠেকালে খুব টক লাগে, কিন্তু চামড়ার তেমন ক্ষতি করে না। এরা অরগ্যানিক অ্যাসিড। মাংস রান্নায় এই মৃদু অ্যাসিড ব্যবহার করলে মাংসের শক্ত প্রোটিন ‘ডিন্যাচিওর’ হয়ে যায়, মানে মাংসের লম্বা ফাইবার ভেঙে ছোটো ছোটো টুকরো হয়ে যায়, যার ফলে মাংস নরম হয়।

সব রান্নাতে যে লেবু বা ভিনিগার দিতে হবে, তা কিন্তু নয়। দই দিলেও কাজ হবে। দইতেও পাই অ্যাসিড। সেটা আরও মৃদু, ল্যাক্টিক অ্যাসিড। মাংস রান্নায় দই দিলে মাংস তাড়াতাড়ি রান্না হয় যেমন, স্বাদও হয় চমৎকার। এইসব অ্যাসিডের খেলা বুঝতে গেলে একটু অ্যাসিড আর বেস-এর ব্যাপারে জেনে নেওয়া ভালো। পুরোনো পড়াটা ঝালিয়ে নে। বল, অ্যাসিড আর বেস-এর মধ্যে তফাত কী।”

রিয়া রেজালার পাত্র থেকে চামচে করে একটু একটু করে সুস্বাদু ঝোল তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিল। সে মৃদু আপত্তি করে বলে, “এই রে, আবার পরীক্ষার পড়া ধরছ দেখি! কী জ্বালা! হ্যাঁ, জানি অবশ্য। অ্যাসিড জলীয় দ্রবণে মিশে গেলে মুক্ত হাইড্রোজেন আয়ন দান করে অন্য অণুকে, আর বেস হলে সে দেয় হাইড্রক্সিল আয়ন। হাইড্রোজেন আয়ন হল পজিটিভ চার্জ যুক্ত, হাইড্রক্সিল আয়নে আছে নেগেটিভ চার্জ। মুক্ত হাইড্রোজেন আয়ন থাকার কারণে অ্যাসিড অন্য যৌগ থেকে ইলেকট্রন কেড়ে নেয়, কিন্তু ঠিক বিপরীতভাবে বেস অন্যকে ইলেকট্রন দান করে। কোনও দ্রবণ অ্যাসিড না বেস বোঝার উপায় হচ্ছে তার পি.এইচ ভ্যালু মাপা। অ্যাসিডের পি.এইচ হচ্ছে ০ থেকে ৭ অবধি। বেস-এর পি.এইচ ৭ থেকে ১৪। পি.এইচ হচ্ছে কোনও দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্ব বোঝার মাপকাঠি।”

জোরে জোরে নিশ্বাস নে রিয়া। মনে হচ্ছে পড়া মুখস্থ বলছিস! তবে প্রশংসা করতেই হয়, কম কথায় অ্যাসিড বেস-এর বিবরণ ঠিকঠাক দেবার জন্য। আমাদের জিভের স্বাদ বুঝে ফেলার পিছনে রহস্যও লুকিয়ে আছে ওই পি.এইচ ভ্যালুতে। মুখের লালার পি.এইচ ভ্যালু ৭-এর একটু উপরে। পি.এইচ ৭ হলে নিউট্রাল দ্রবণ। তার মানে মুখের লালা সামান্য বেসিক। তাই টকটক স্বাদ রান্নায় দিলে চট করে জিভ বুঝে নিতে পারে স্বাদটা।

সব খাবারের কাঁচামালে সামান্য তিতকুটে ভাব থাকে, যা অনেকটাই দমিয়ে দেয় টক। যেমন পালংশাক রান্নার সময়ে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস দিলে স্বাদ ভালো হয়। রান্নায় মশলার গন্ধ বাড়ায় অ্যাসিড। মশলায় যে রাসায়নিক পদার্থ থাকে, অ্যাসিডের হাইড্রোজেন আয়ন তাদের সঙ্গে বিক্রিয়া করে এস্টার তৈরি করে, ফলে সুগন্ধ আসে রান্নায়।

মাংস রান্নার সময় ম্যারিনেট করে রাখি আমরা। তাতে মিশিয়ে দিই দই। অবশ্য জল ছাড়া দই ব্যবহার না করলে ভালো ফল পাওয়া যায় না। দইয়ের ল্যাক্টিক অ্যাসিড মাংসে মিশে গিয়ে কড়াইতে চাপানোর অনেক আগেই ধীরে ধীরে রান্না হতে শুরু করে দেয়।”

অর্ককে থামিয়ে দিয়ে রিয়া বলে, “কড়াইতে বসানোর আগেই রান্না! সেটা কী করে সম্ভব?”

মৃদু হেসে বিরিয়ানির প্লেট থেকে চিকেনের ঠ্যাং মনোযোগ দিয়ে চিবোতে চিবোতে অর্ক জানায়, “এই যে বিরিয়ানি আর রেজালা আমরা মহানন্দে খেয়ে চলেছি, এগুলোতে মাংস ম্যারিনেশন করতে হয় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। তবেই মাংস নরম হয়। নুন, মশলা, পেঁয়াজ-আদা-রসুন বাটা, আর সামান্য তেল মিশিয়ে রাখা হয়। তারপরই কিন্তু রান্না শুরু হয় অল্প তাপে, আমরা কড়াইতে গ্যাসের উপর বসাই বা না বসাই। যে-কোনো রান্নায় তাপমাত্রা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, আগেই বলেছি। তাপের প্রভাবে রান্নায় রাসায়নিক বিক্রিয়া হয় দ্রুত। তবে ফ্রিজে যদি ম্যারিনেটেড মাংস দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয়, তবে কিন্তু রান্না না হয়ে মাংস পচে যাবে। কারণ কম তাপমাত্রায় ব্যাক্টিরিয়া আর ছত্রাকেরা জমিয়ে বসে যাবে রান্নায়। বিরিয়ানি দমে রাখলে উপাদেয় হয়, জানিস নিশ্চয়ই, যাকে দম বিরিয়ানি বলে। দম মানে হচ্ছে একটা হাঁড়িতে মাংস, চাল, মশলা ইত্যাদি রেখে দমবন্ধ করে দেওয়া হয়, মানে হাঁড়ির ঢাকনা বন্ধ করে দেওয়া হয় সিল করে। কম আঁচে দমে বসিয়ে রাখা হয় অনেক বেশি সময় ধরে। তাতে মশলার সুগন্ধ বাইরে পালিয়ে যেতে পারে না, মাংস হয়ে যায় তুলতুলে নরম। এখানে কিন্তু তাপমাত্রা বেশি হয়ে গেলে বিরিয়ানির বারোটা বেজে যাবে।”

তাহলে এই হল টকের মাহাত্ম্য? রেজালাতে দই দিয়েছে, তাই এত সুন্দর খেতে লাগছে। আচ্ছা অর্কদা, আমরাও তো রেজালা বানিয়ে দেখতে পারি একদিন। টক মাহাত্ম্যের হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।” রিয়া প্রবল উৎসাহে টিস্যু দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে করতে বলে।

করতেই পারি। সেজন্য অবশ্য একটু রেসিপিতে চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার। তবে সামনের সপ্তাহে রেজাল্ট বেরোচ্ছে তোর বারো ক্লাসের। তারপরই তো দৌড় লাগাবি দিল্লি। রেজাল্ট বেরোলে বাড়িতে নয়, বাইরে কোনও রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া হবে জমিয়ে। বাবা-মাও সঙ্গে থাকবে। তোর ফেরার টিকিট এখনও কাটেনি নিশ্চয়ই পিসি?”

ফেরা? আমি যে কলকাতাকে ভালোবেসে ফেলেছি অর্কদা। তোমার কাছে কত কী শেখার আছে! ভাবছি পড়াশুনোটা এখানেই করি। ভালো হবে না?” রিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অর্কর দিকে তাকায়।

অর্ক মেনু কার্ডে চোখ বুলিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে, “লস্যি খাবি?”

উত্তর দিলে না যে! লস্যি খাওয়ার মতো জায়গা নেই পেটে। বলো না, এখানে পড়লে তোমার আপত্তি আছে?”

একদম নেই। এমন একজন ভালো ছাত্রী পেলে কোন মাস্টার আর তাকে ছাড়তে চায়? আমাদের বাড়িতে জায়গার অভাব? ভালোই তো হবে। কিন্তু বিজ্ঞান পড়ার চাইতে আড্ডা বেশি হবে কলকাতায়, আমার পাল্লায় পড়লে তো আরও। এবার চল বাড়ি ফেরা যাক। ওয়েটার বিল নিয়ে এদিকেই আসছে। এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে গেলেই পেট হালকা হয়ে যাবে। চল, ওঠা যাক।”

(ক্রমশ)



আরও পড়ুন  -



জল শুধু জল


ফ্রাই, কিন্তু ড্রাই নয়


যার নুন খাই, তার গুণ গাই


কুসুমে কুসুমে