অফিসে প্রশান্তবাবু নিজের ঘরে বসে কাজ করছিলেন। তাঁর অফিস দিল্লীর করলবাগে। অফিসটা যে বিশাল জায়গা নিয়ে তা নয়। তিনজন স্টাফ আর অফিসের মালিক প্রশান্ত বটব্যালের বসবার মতো জায়গা রয়েছে সেখানে। দোল পূর্ণিমার পরের দিন। সেদিন আবার দেশ জুড়ে হোলি। তাই অফিসের স্টাফ কেউ আসেনি। প্রশান্তবাবু একলাই এসেছেন। অফিস খুলে বসে বকেয়া কিছু কাজ সারছিলেন।
আব্জানো দরজায় হঠাৎ ঠকঠক শব্দ। প্রশান্তবাবুর ভ্রু কুঁচকে উঠল। ভাবলেন, আজকের দিনে আবার কে? চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবেন, দরজা খুলে এক ভদ্রলোক সটান ঘরের ভিতর ঢুকে এলেন। লোকটাকে প্রশান্তবাবু চেনেন না।
“আপনি কে?” প্রশ্ন করলেন প্রশান্তবাবু।
“আমায় চিনতে পারবেন না, বাবু, এ তো জানি?”
“মানে?”
“সেই কবে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মনে পড়ে, আপনি যোধপুরে এসেছিলেন ঘোড়া কিনতে?”
প্রশান্ত বটব্যাল এবার যেন কিছু মনে করতে পারছেন। পনেরো বছর আগের ঘটনা। আবছা আবছা মনে রয়েছে। তবু তিনি সরাসরি “না”ই বলে দিলেন ভদ্রলোককে। মানে, ঘটনাটা মনে পড়লেও ওনাকে চিনতে পারছেন না প্রশান্তবাবু।
“হামার কাছ থেকে ঘোড়া কিনলেন। মাড়োয়াড়ি ঘোড়া!” বলে, ভদ্রলোক গড়গড় করে নিজের নাম ঠিকানা বলে যেতে থাকলেন, “বনোয়ারী পুরোহিত, যোধপুরের ঘোড়া মহল্লায় বাড়ি, ঘোড়া বাজারে এসেছিলেন ঘোড়া কিনতে, দরদাম করলেন। নগদে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে ঘোড়া কিনলেন আমার থেকে… বুঝেছি, সেদিন আমার মাথায় পাগড়ি ছিল, আজ নেই; তাই বোধ হয় চিনতে পারছেন না…”
ভদ্রলোক বেশ বাংলায় কথা বলে যাচ্ছেন। তবে তাতে সামান্যই, কিন্তু কানে লাগার মতো টান নেই। সাধারণত অবাঙালীরা বাংলায় কথা বললে যে ধরণের টান থাকে, তার কিছুই প্রায় নেই।
যাক, চিনতে না পারলেও সৌজন্যতার খাতিরে বনোয়ারীজিকে বসবার অনুরোধ জানালেন প্রশান্তবাবু। প্রশ্ন করলেন, “যোধপুর থেকে আসছেন নিশ্চয়ই। বসুন, আগে একটা ঠাণ্ডা পানীয় খান। তারপরে কথা হবে।” এই বলে, তিনি নিজেই উঠে গিয়ে অফিসের ফ্রিজ খুলে দুটো ঠাণ্ডা বোতল বার করে আনলেন। একটা বনোয়ারীবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অন্যটা নিজে নিয়ে বসলেন। দুজনে একসঙ্গে চুমুক দিলেন বোতলের পানীয়ে। “আহ” বলে বনোয়ারীজী একটা শব্দ তুললেন মুখে।
“আরে,” করে প্রশান্তবাবু কথা জুড়লেন, “দিল্লীর গরম বলে কথা। তায় এই মার্চ মাস। … তা বলুন, কী মনে করে এত বছর পরে আপনি আমার কাছে এলেন, বনোয়ারীজী?”
“বাবু, সেই ঘোড়াটা এখনো আপনার কাছে রয়েছে?”
“কেন বলুন তো?”
“না, বলুন না, রয়েছে?”
“আছে। তবে তা আর আমার জিম্মায় নেই।”
“যাক, আছে তাহলে।” বলে, বনোয়ারীজী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। পরে প্রশ্ন করলেন, “কার কাছে, কোথায় রেখেছেন আমার দিলবাগকে?”
“আপনার দিলবাগ! কী বলছেন কী! দিলবাগকে তো আমি কিনেই নিয়েছিলাম! তাছাড়া সে এখন রয়েছে আমার মেয়ের জিম্মায়। দিলবাগ আমার মেয়ের ঘোড়া।”
“মেয়ে… কত বড় মেয়ে আপনার?”
“এসব প্রশ্ন কেন করছেন, বনোয়ারীজী? আমার মেয়ের বয়স আর দিলবাগের বয়স এক। দিলবাগকে কিনে এনে আমি আমার মেয়েকে উপহার দিয়েছিলাম। ওর মালিকীন আমার মেয়ে, অপ্সরা।”
“বাহ, ভালো নাম আপনার মেয়ের। অপ্সরা। বাবু, আমি জানতাম, ঝাঁসিরানী লক্ষ্মীবাঈয়ের ঘোড়া ছিল, নাম ‘পবন’; রানা প্রতাপের ঘোড়া ছিল, নাম ‘চেতক’ আর আপনার মেয়ে অপ্সরা, দিলবাগকে আপনিয়ে নিয়েছে! আশ্চর্য! বাঙালী ঘরের মেয়েরাও ঘোড়া রাখে?”
“রাখে, রাখে বনোয়ারীজী। মেয়ে যদি বেড়াল পুষতে পারে, কুকুর রাখতে পারে, ঘোড়া রাখতে পারবে না কেন? ঘোড়াও তো পোশ মানার পশু…”
“ইস, আমার দিলবাগকে আপনি পশু বানিয়ে দিলেন?”
“তা পশুকে পশু বলব না তো কী বলব, বনোয়ারীজী? দিলবাগ তো গৃহপালিত পশুই। হতে পারে, আমার মেয়ে দিলবাগকে নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা করে, কিন্তু…”
“বাবুজী, আমি দিলবাগকে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি কত টাকা পেলে দিলবাগকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন?”
“কী আবোল তাবোল বকছেন, আপনি? টাকা, ফেরত! দিলবাগকে…! এখন আপনি আসুন তো।” বলে, প্রশান্তবাবু নিজের কাজে মন বসাতে গেলেন। কিন্তু তা পারলেন কই? বনোয়ারীজী এবার কথার ফুলঝুরি ছোটাতে শুরু করলেন। বলতে থাকলেন, “বাবুজী আমার দিলবাগকে আমি নিয়েই যাব। আমি ভী এই পণ করলাম।”
এবার এক কান্ড করলেন তিনি। এক ব্যাগ ভরতি টাকা প্রশান্তবাবুর টেবিলে উপুড় করে ঢেলে দিলেন। সে কত টাকা, না দেখলে বোঝানো যাবে না!
অবাক হয়ে প্রশান্ত বটব্যাল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এর ওর নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। কিন্তু অফিস তো ফাঁকা। চট করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে হাঁফাতে থাকলেন। তার পিছন পিছন বনোয়ারীজীও বেরিয়ে এলেন। পাশে দাঁড়িয়ে প্রশান্তবাবুর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অনুরোধ জানাতে লাগলেন, “বাবু, দিলবাগকে ফিরিয়ে দিন, ফিরিয়ে দিন, বাবু।”
মহা ফাপরে পড়লেন প্রাশান্ত বটব্যাল। ভাবতে থাকলেন, সাতমাস পরে অপ্সরার বিয়ে। মেয়ের সঙ্গে দিলবাগকে উপহার দেবেন, এমন কথা দিয়েছেন পাত্র পক্ষকে। এখন উপায়? অপ্সরাও কী দিলবাগকে ছাড়বে? কী আদর যত্নে সে গড়ে তুলেছে তার ছোট্ট বেলার উপহারকে।
প্রাশান্তবাবু বনোয়ারীজীকে ঘরে ফিরে গিয়ে বসতে বললেন। বনোয়ারীজীও তাঁর কথায় বাধ্য ছেলের মতো ঘরে ফিরে গেলেন। গিয়ে বসলেন। টাকাগুলো তখনও তেমনই টেবিলের ওপরে ছড়ানো ছেটানো অবস্থায় পড়ে।
বনোয়ারীজী চলে যেতে প্রাশান্তবাবু প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বার করলেন। নতুন প্যাকেট। সিলেফোন পেপারের মোড়ক খুলে প্যাকেট উন্মুক্ত করলেন। একটা সিগারেট তুলে আনলেন সেখান থেকে। দামী ফাইভ ফিটটি ফাইভ ব্রান্ডের সিগারেট। অন্য পকেট থেকে লাইটারখানা বের করে এনে সিগারেট ধরালেন। দুটো সুখ টান দিয়ে নীচে তাকাতে দেখলেন, সেখানে উরদিধারী কয়েকটা পুলিশ ঘোরাফেরা করছে। বিস্মিত হলেন প্রশান্তবাবু। এমন অসময়ে এখানে পুলিশ! মনে মনে ভাবলেন, বনোয়ারী লোকটা তো কোনও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি? এক তো মানুষটাকে চিনতে পারলেন না। দ্বিতীয় এত টাকা নিয়ে এসেছে, আবার অসময়ে অফিসের সামনে পুলিশের ঘোরাফেরা! কে জানে বাবা, কী উদ্দেশ্য নিয়ে লোকটার আসা? “যাক, নিজেকে সাবধান রাখলেই হোল,” ভেবে, মুখে সিগারেট লাগিয়ে দঁড়িয়ে রইলেন সেখানে। পুরনো দিনের কথা ভাবতে শুরু করলেন-
অপ্সরার ঠাকুমা তখন বেঁচে। তাও বছর পনেরো-যোল আগের কথা। অপ্সরা তখন দু বছরের। ঠাকুমার প্রিয় নাতনী, ঠাকুমাকে ছেড়ে থাকবে না। “ঠাকুমা গপ্প বলো, ঠাকুমা গপ্প বলো,” দিনরাত এক বায়না। খেতে শুতে বসতে, সব সময় গল্প। ঠাকুমাও একটার পর একটা গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে তাঁর আদরের নাতনীকে। রাক্ষস খোক্ষস, রাজা-উজীর, পরী…, নাহ, কোনও গল্পে মেয়ের মন উঠছে না। ওর চাই শুধু ঘোড়ার গল্প। কিন্তু, কত আর ঘোড়ার গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলবেন উনি? আর সে যুগও তো মোবাইল, টিভির সময় নয়। ঠাকুমা তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই পক্ষীরাজের গল্প শোনাত নাতনীকে।
এই করতে করতে একটা বছর তো কাটল। মেয়ে দুই পেরিয়ে তিনে পড়ল। তখন সে চোখের সামনে জ্যান্ত ঘোড়া দেখতে চায়। ঘোড়ার যে পাখনা থাকে না, পক্ষী হয়ে ঘোড়া উড়তে পারে না, এটা ততদিনে মেয়ের মগজে ঢুকে গেছে। ঘোড়া কোথায় পাওয়া যাবে? দিল্লী শহরে ঘোড়ার গাড়ি চলে না। শহরের বাইরে তবু যা চলে তা, ঘোড়ায় টানা টাঙ্গাগাড়ি। না, “ওইসব ঘোড়ারা ছোট, দুব্বল, ওদের লেজ মোটা নয়, ঘাড়ে বেশি লোম নেই, চোখ ঢাকনা দিয়ে বন্ধ থাকে, মুখ দিয়ে লাল পড়ে…” হাজারটা এরকম কথায় সে ঘোড়া দেখিয়ে মেয়ের মন ভরানো যায় না। বায়না, “ভালো ঘোড়া এনে দাও। আমি সেই ঘোড়ায় চড়ে লক্ষ্মীবাঈ হব। রানা প্রতাপের মতো ঘোড়া নিয়ে ছাদ টপকে ওছাদে যাব। দিল্লী শহরকে দেখব…” কত কথা! সঙ্গে সেই ঘোড়া না পেয়ে মন খারাপ। খাবে না, ঘুমবে না।
অবশেষে ঘোড়া সেই কিনে আনতেই হল প্রশান্তবাবুকে। মেয়ের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের মা, ঠাকুমার মন খারাপ। তাও কাঠের ঘোড়া কিনে এনে দিলেন তিনি। কিন্তু নাহ…, “ওতে করে ঘুত্তে যাওয়া যাবে না…”
শেষমেশ প্রশান্তবাবু ঘোড়া কিনতে ছুটলেন রাজস্থানে। যোধপুরের ঘোড়া, নামে কাজে অতি উচ্চ শ্রেণীর। খোঁজ খবর নিয়ে জানলেন ‘মাড়োয়ারী বা মালানী’ ঘোড়া যেমন দেখতে তেমনই তাগড়াই। লম্বায় নাকি সাত-আট ফুট, উচ্চতা, পাঁচ ফুট ছাড়িয়ে, ঘাড়ের উচ্চতা এক ফুট, ঘাড় শরীরের সঙ্গে পয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণে থাকে, ছয় সাত ইঞ্চির কান, দু কান নব্বুই ডিগ্রী কোণে কুলোর মতো দু প্রান্তে জুড়ে থাকে। গায়ের রং তপ্ত তামার, আবার ওদের ভাষায় ‘চেসনাট’ রং। এতসব শুনে প্রশান্তবাবুর নিজেরই ঘোড়াপ্রীতি গজাতে শুরু করেছিল। তবে, তিনি ভালই বুঝছিলেন, মেয়ের শখ আর ক’বছরের? তাই দেখেশুনে একটা পনি কিনে আনলেই হবে। তা সে মাড়োয়ারি ঘোড়ার বাচ্চা হোক বা অন্য প্রজাতির।
কিন্তু যোধপুরে পৌঁছিয়ে ঘোড়ার বাজারে ঘোড়াদের রূপ দেখে প্রশান্তবাবুর চক্ষু ‘থ মেরে গিয়েছিল। আরে বাস! এক সে বার কর এক ঘোড়া! কি তাদের তেজ, কী জৌলুষ! দুদিন দুরাত যোধপুরে থেকে সারাদিন টৈ টৈ করে এবাজার সেবাজার ঘুরে ঘুরে শেষ একটা পেলেন, যেটাকে দেখে ভাবলেন, ওটাই অপ্সরার জন্যে সঠিক হবে। সাইজে ছোটখাট হলেও হাই ব্রীডের ঘোড়া ছিল। বয়সে ওই নাকি, প্রকৃত মাড়োয়ারি ঘোড়া হবে। এমন কথাই সেই বিক্রেতা প্রাশান্তবাবুকে জানায়েছিল। তবে সেই যে বনোয়ারী পুরোহিত, এটা এখন আর মনে নেই প্রশান্তবাবুর।
পনেরো-ষোলো বছরে সত্যিই সেই ছোট্ট ঘোড়া পেল্লাই হয়ে উঠেছে। বাজার থেকে নেওয়া মাড়োয়ারি ঘোড়ার স্যাস্টিষ্টিক মেনে ও-ই পেল্লায় হয়ে গেছে। অবশ্য এতে নিজের মেয়ের হাত যশও রয়েছে। প্রশান্তবাবুরা যা ভেবেছিলেন যে মেয়ে একটু বড় হলে ঘোড়ার শখ মিটে যাবে। তখন পশুটাকে বিক্রি করে দেওয়া যাবে। কিন্তু ওঁদের ধারনা ভুল পর্যবসিত করে দিয়েছিল মেয়ে। দিন দিন মেয়ের যত বয়স বেড়েছে, ততই দিলবাগের প্রতি মেয়ের মায়া বেড়েছে। তখন আর ওই ঘোড়া ঘোড়া নয়। পুরনো নাম নিয়ে নিয়েছে মেয়ের মুখে। সেও তাকে ‘দিলবাগ’ নাম নিয়ে ডাকে। দিলবাগের দেখাশোনা, আদর যত্ন, তাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, সকাল বিকেল, ফাঁকা মাঠে নিয়ে গিয়ে দৌড় করানো, মায় নিজেরও ঘোড়ায় চড়ে শখ-শৌখিনতা মেটানো সবই চলতে থাকে পুরোদমে।
আর, বছর পনেরো বয়স যখন অপ্সরার, দিলবাগকে নিয়ে রেসের মাঠে নেমে পড়ল মেয়ে। সারা দিল্লী শহর অবাক! রেসের মাঠে মেয়ে জকি! অপ্সরাই হয়তো প্রথম এই কাণ্ড করতে নেমেছে। দু চারবার আছাড়-ফাছাড় খেয়েও অপ্সরা দাঁড়িয়ে গেল মাঠে পরিচিত জকি হিসেবে। রেসও জিততে থাকল। মেয়ে খুশি, মেয়ের বাবা-মা, আত্মীয় পরিজন সকলে খুশি। ছিল না শুধু সেই ঠাকুমা। ততদিনে প্রাশান্তবাবুর মাতৃবিয়োগ ঘটে গেছে। তাঁর আফষোস, মা দেখে যেতে পারলেন না, তাঁর আদরের নাতনীকে কী গুণেই না গুণবতী করে দিয়ে গেছেন!
আঠারো পেরতেই অপ্সরার বিয়ের জন্যে ছেলে ঠিক করে ফেলেছেন প্রশান্তবাবু। তাতে অবশ্য মেয়ের নিজের হাতও রয়েছে অনেকটা। ছেলেও জকি। রাজপুত্রের মতো দেখতে ছেলেকে। এমন ছেলে হাত ছাড়া করতে রাজী নন প্রশান্তবাবু। শুধু তিনিই কেন, গোটা পরিবার অপ্সরার এই বিয়েতে মত দিয়েছে। সাত মাস পরে মেয়ের বিয়ে। উপহার বলে পাত্র পক্ষ কিছুই চায়নি। চেয়েছে শুধু দিলবাগকে।
প্রশান্তবাবু ভেবেছেন, বিয়েতে ছেলেরা কতকিছু উপহার চায়, তাতে মোটরবাইকও থাকে কখনো-কখনো। আর অপ্সরার ক্ষেত্রে কি না, ঘোড়া? অবশ্য অপ্সরা নিজেও দিলবাগকে ছেড়ে যেত না। দিলবাগ ওর প্রাণ। আর এই সময়, কে না কে, এক বনোয়ারী পুরোহিত উদয় হয়ে দিলবাগকে ফেরত নিতে চাইছে? তাও অতগুলো টাকার বিনিময়ে? আশ্চর্য!
প্রশান্তবাবুর সিগারেট শেষ। নিজেকেও তিনি ফিরিয়ে আনলেন বর্তমানে। অফিসের ভিতরে। তাঁর মনে পড়ল, লোকটাকে বসিয়ে রেখেছেন। অফিসে নিজের ঘরে ফিরলেন। বনোয়ারী পুরোহিত তখন টেবিলে ছড়ানো নোটগুলো একটা একটা করে গুণে এক শতের এক একটা বান্ডিল বানাচ্ছেন আর সাজিয়ে রাখছেন টেবিলের এক ধার দিয়ে।
প্রশান্তবাবু তাঁকে বললেন, “বনোয়ারীজী, আপনি বরং কালকে আসুন। আজ বাড়িতে গিয়ে কথাটা মেয়েকে জানাই। ও কথা দিলে, তবে আমি ঘোড়া ফেরতের কথা আগে বাড়াবো, বুঝলেন?”
মুখ ছোট করে বনোয়ারী পুরোহিত প্রশান্তবাবুর অফিস ছেড়ে গেলেন সেদিনের মতো। টাকাগুলো প্রশান্তবাবুর কাছেই রেখে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু প্রশান্তবাবু তাতে বাধ সাধলেন। একবার ভাবলেনও, লোকটা কি পাগল! এতগুলো টাকা অন্যের জিম্মায় ছেড়ে রেখে যেতে চাইছে? নাহ, লোকটার আসল মতলবটা জানতেই হবে।”
বাড়ি ফিরে এসব কথা কিছুই জানালেন না। তিনি তো জানেন, এই কথা পাড়লে, অপ্সরা চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করে দেবে। ঘোড়া তো কিছুতেই ছাড়বে না, শেষে কী কান্ড বাধিয়ে বসে!
পরেরদিন প্রশান্তবাবু অফিসে এলেন। বনোয়ারীজীও এসে হাজির। আজ প্রশান্তবাবু তাঁকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা বনোয়ারীজী বলুন তো, আপনি দিলবাগকে ফেরত পেতে চাইছেন কেন? কি করবেন, ওকে নিয়ে?”
মুখ কালো করে, কিছুটা সময় বসে থাকলেন বনোয়ারীজী। তারপরে যা বললেন তাতে প্রশান্তবাবুর চোখে জল এসে গেল। বনোয়ারীজী তো তখন কাঁদছেন-ই। তিনি বলতে থাকলেন, “অপ্সরার মতো আমারও একটা মেয়ে আছে, বাবু। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমরা মেয়ের বিয়েতে জামাইকে ঘোড়া উপহার দিই। দিলবাগের যমজ একটা বোন ছিল। সেটাকে মানুষ করেছিলাম আমার মেয়ের জন্যে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, মাত্র তিনদিনের জ্বরে সেই ঘুড়ী মারা গেল। এখন আমার মেয়েকে কী দিই? তখনই মনে পড়ল, দিলবাগের কথা। খোঁজ করে করে আপনার ঠিকানা পেয়ে গেলুম। টাকাও আনলুম। যা টাকা লাগে, তাই দিয়ে আমার দিলবাগকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে আপনার কাছে চলে এলুম। এখন বাবু সবটাই আপনার দয়ার ওপর। নাহলে আমার মেয়ের আর বিয়ে হবে না।”
কথা শেষে কান্নার তোড় বেরে গেল বনোয়ারীজীর। প্রশান্তবাবু বললেন, “কেন, আপনি অন্য কোনও ঘোড়া কিনে উপহার দিন না, আপনার মেয়ে-জামাইকে?”
“না বাবু, তা নেবে না ছেলে। সে নিজের ঘরের ঘোড়াই চায়।”
“এতো ভারী আবদার। আরে, আমিও যে আমার জামাইকে কথা দিয়েছি, ঘরের ঘোড়া উপহার দেব...”
প্রশান্তবাবুর কথা শেষ হল না। অফিস বাড়ির করিডোর পেরিয়ে তিনজন পুলিশ “বনোয়ারী পুরোহিত নামকা আদমি হিঁয়া হ্যাঁয়...” করতে করতে প্রশান্তবাবুর অফিসে ঢুকে পড়ল। সোজা প্রশান্তবাবুর ঘরে এস দাঁড়াল। পুলিশ দেখে বনোয়ারীজীর মুখ চুন। কী ব্যাপার? না, বনোয়ারী পুরোহিত হচ্ছে দিল্লীর নামকরা ঘোড়ার রেসের বুকি। ওর কাছে লোকে লক্ষ লক্ষ টাকা লাগিয়ে রেসের বাজী ধরে। সামনের সপ্তাহে দিল্লীতে ঘোড়ার রেসের বাম্পার ড্র হবে। কোটী টাকার বাজি ধরেছে লোকে ওই দিলবাগ ঘোড়ার ওপরে। ওই সেদিনের রেসে জিতবে। তারও সব সেটিং হয়ে গেছে। করেছে বনোয়ারী পুরোহিত। তাই দিলবাগকেই ওঁর চাই। যে কোনও টাকার মূল্যে। তাহলে সেও কয়েক লক্ষ টাকা কামাতে পারবে।
“কিন্তু উনি তো, ওনার মেয়ের বিয়ের কথা বলছেন। সেখানে দিলবাগকে উপহার দিতে হবে!” প্রশান্তবাবু পুলিশকে বললেন।
“সব ঝুট বাত হ্যাঁয়, সাহাব। আপ উসসে রূপয়া-উপয়া তো নেহি লইয়া?”
“আরে না, না। কাল থেকে লোকটা আমাকে টাকা গছাবার জন্যে ঝুলোঝুলি করছে। আমি এক পয়সাও হাত দিইনি।”
“ঠিক হ্যাঁয়। ইয়ে দেখিয়ে,” বলে একজন পুলিশের একটা কার্ড দেখালো প্রশান্তবাবুকে। দূর থেকেই সেটা দেখালো। তারপরেই পুলিশগুলো বনোয়ারীজীকে নিয়ে চলে গিয়েছে।
যাবার আগে বনোয়ারীজী প্রশান্তবাবুকে একটা কথাই শুধু বলতে পেরেছেন, “বাবু, আপনার দিলবাগকে সামলে রাখবেন সঙ্গে আপনার মে...”
ততক্ষণে বনোয়ারীজীর মুখ চাপা পড়ে গিয়েছিল ওদের একজনের হাতের তলায়।
কথাটা ছিল অসমাপ্ত। সেটাই প্রশান্তবাবুকে ভাবাচ্ছে। চুপ বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর অবেলাতেই অফিস ছেড়ে বেরিয়ে মেয়ের কাছে দৌড়লেন।