লেখালিখির শুরু সেই কৈশোরের আঙিনায়। সবুজ স্বপ্নে মোড়া সেই দিনগুলোয় প্রথম
লেখা গল্প প্রকাশ পেয়েছিল ‘শুকতারা’-র
পাতায়। তারপর কর্মজীবন এসে থামিয়ে দিয়েছিল কয়েকটি বছর। এরপর দ্বিতীয় পর্ব
শুরু হয়েছিল ভবানীদা তথা ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের অনুপ্রেরণায়। এক
অর্থে এ হল সেই পরিবর্তিত জীবনের কাহিনি।
১৯৯২ সাল। প্রোডাকশন, ইন্সপেকশন, মালিকের খিটখিটানি দূরে
সরিয়ে রেখে চার বছরের চাকরি-জীবনে ইস্তফা দিয়ে শুরু করলাম নতুন ছাত্রজীবন।
সরকারি চাকরির আশায় যোগ দিলাম দাশনগরের অ্যাডভান্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের
ইন্সট্রাক্টর ট্রেনিং কোর্সে। সেই সঙ্গে শুরু করলাম লেখক-জীবনের দ্বিতীয় পর্ব।
সেই সময় ‘ওভারল্যান্ড’ পত্রিকার বুধবারের পাতায়
‘সোনার কাঠি’ নামে ছোটোদের বিভাগটি পরিচালনা
করতেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার ‘সবুজবুড়ো’ ছদ্মনামে। ছোটোদের জন্য একটি গল্প পাঠালাম ‘ভালো মা’
নাম দিয়ে। যথাসময়ে প্রকাশিত হল। তারপর আরও একটি। ওই সময় ‘ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরি’-র এক বন্ধুর মাধ্যমে
জানতে পারলাম ভবানীদা আমার ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। পরদিন ছিল শনিবার। শানপুর
কালীতলা প্রাইমারি বিদ্যালয়ে গিয়ে ভবানীদার সঙ্গে দেখা করতেই পরদিন তাঁর কলাবাগান
অঞ্চলের বাড়ির ঠিকানায় সাহিত্য আড্ডায় আসতে বললেন। সেদিন ছিল রবিবার। তাঁর ঘরে
গিয়ে দেখি কত নবীন-প্রবীণ লেখক-লেখিকার সমাবেশ! ছোট্ট ঘরটিতে বসবার জায়গা কম
হলেও সাহিত্য আড্ডার পক্ষে তা যথেষ্টই ছিল।
এরপর শুরু হল প্রায় প্রতি
রবিবারের যাতায়াত। লেখা প্রকাশিত হলেই তাঁকে দেখতাম। তিনি বলতেন, ‘আরও নতুনত্ব আনতে হবে।’ বলতেন,
‘একজায়গায় নয়, বিভিন্ন পত্রিকায় লিখে মনে
আস্থা জন্মাতে হবে।’ সেইভাবেই শুরু করলাম। নতুন মোড়কে
যুগান্তর পত্রিকার প্রকাশ ঘটল। প্রতি মঙ্গলবার ছোটোদের বিভাগটিতে গল্প-কবিতা লিখে
পাঠিয়ে দিতে লাগলাম। প্রকাশিত হল আমার লেখা। সংবাদ প্রতিদিন-এর বুধবারের ‘পড়াশুনো’-র পাতায় গল্প-ছড়া লিখে পাঠিয়ে দিতাম।
ভবানীদার উৎসাহে লেখা প্রকাশিত হল ‘কিশোর ভারতী’-র পাতায়। তাঁর অনুপ্রেরণায় আমার লেখক-জীবনের দ্বিতীয় পর্ব দারুণ গতিবেগ
লাভ করল।
১৯৯৬ সালে নরেন্দ্রপুর
রামকৃষ্ণ মিশনের কারিগরি বিভাগের শিক্ষক রূপে চাকরিতে যোগদান করলাম। প্রতিদিন
হাওড়ার কদমতলা থেকে নরেন্দ্রপুর যাতায়াতের ফলে আর তাঁর সঙ্গে সাহিত্য-আড্ডা
দেওয়ার সুযোগ রইল না। মাঝে-মধ্যে যেতাম। ২০০৪ নাগাদ মিশনের আচার্যপল্লিতে চলে
যাওয়ার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হল। ২০১২ সালে নরেন্দ্রপুর বিদ্যালয়ের পরিচালক
মহারাজ স্বামী যুগেশ্বরানন্দজি আমার মারফত ভবানীদার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে বাড়ি
থেকে নিয়ে এসে ‘গুণীজন সংবর্ধনা’ দিয়েছিলেন। দারুণ ভালো লেগেছিল সেই সময়।
২০২০ সাল এল করোনার অভিশাপ
নিয়ে। লক-ডাউনে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, সেই সময়
ভবানীদার পায়ের ক্ষত তীব্র আকার ধারণ করল। বাঁ-পায়ের হাঁটু পর্যন্ত বাদ দিতে হল
বেসরকারি হাসপাতাল অ্যাপোলোতে। সর্ষে পায়ে ঘুরতেন যে কবি, যাঁর
কলমের জোরে জেগে উঠত শৈশব-কৈশোরের মধুর দিনগুলো, তাঁর এখন
সারাদিন কাটে হুইল-চেয়ারে বসে-বসেই। যাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমার মনে লেগেছিল
পরিবর্তনের রঙ, তাঁর এই স্থবির করুণ জীবন দেখতে ভালো লাগে
না। অশ্রু সংবরণ করাই দায় হয়ে পড়ে।