আশিসকুমার মুখোপাধ্যায়

লেখালিখির শুরুর সময়ে
যাঁর সান্নিধ্য আমাকে সমৃদ্ধ করেছিল









আশিসকুমার

মুখোপাধ্যায়





 

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের মধ্যেই নিউস্ক্রিপ্ট প্রকাশনার ঘর। নিউস্ক্রিপ্ট মূলত লীলা মজুমদার, নলিনী দাস এবং সত্যজিৎ সম্পাদিত সন্দেশ পত্রিকার বিপণনের প্রাণকেন্দ্র। প্রখ্যাত গল্পকার, আমার প্রাণের মানুষ, জেলার (বীরভূম) মানুষ অশোককুমার সেনগুপ্তের হাত ধরেই আমার যাওয়া সেখানে

প্রতি সন্ধ্যায় এই নিউস্ক্রিপ্টেই বসত বাংলা সাহিত্যের সুখ্যাত সাহিত্যিকদের জমজমাট আড্ডা। কে ছিলেন না এখানে—শিশিরকুমার মজুমদার, ধীরেন্দ্রলাল ধর, মঞ্জিল সেন, প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাহুল মজুমদার, শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য-সহ একদল নিখাদ সন্দেশী। আর এই আড্ডা আলো করে থাকতেন বাংলা ছড়ার একটি বিশেষ ঘরানার স্রষ্টা, অসম্ভব জনপ্রিয় ছড়াকার, কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার

কাজে-অকাজে কলকাতা এলে এই আড্ডার শরিক হতাম আমিও। কেননা ১৩৯৩ সালের অগ্রহায়ণ সংখ্যার সন্দেশ পত্রিকায়হেমন্তের দুঃখনামে একটি ছড়া লিখে সন্দেশীদের খাতায় নাম লিখিয়েছিলাম। ১৩৯৪-র বৈশাখেইছয় ঋতুনামে আমার আরও একটি ছড়া ছাপা হয় সন্দেশেই। ভবানীদা খ্যাত-অখ্যাত সবার লেখাই খুঁটিয়ে পড়তেন। পড়েছিলেন আমার সেই ঋতু বিষয়ক ছড়া দুটিও। এটা মনে রেখেই একদিন নিউস্ক্রিপ্ট-এর আড্ডায় ভবানীদা বাকি সন্দেশীদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। যোগ করলেন মজার একটি উপাধি, ‘ঋতু স্পেশালিস্টআসলে এ-কথা বলা এই জন্যই, যে একজন নবিশ লেখককেও যথেষ্ট মর্যাদার উচ্চতায় তুলে আনার ক্ষেত্রে তাঁর কোনও তুলনা ছিল না

আদ্যন্ত শহুরে মানুষ হলেও তাঁর গায়ে ছিল না শহুরে পালিশ। নিজে পরিচালনা করতেন নানা দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার ছোটোদের বিভাগ। সেখানেও খুঁজে আনতেন বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরের অনালোকিত কলমগুলিকে। তাঁর ছায়ায় নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেত জল-মাটি ছোঁয়া কলমগুলি। সেই কলমগুলির কিছু কলম আজও তাঁর লেখার আদলটিকে অনুসরণ করে বাংলা ছড়ার অঙ্গনটিকে আলোকিত করে চলেছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, যে আমি ব্যক্তিগতভাবে  তাঁর ছড়ার অনুসারী কোনোদিনই ছিলাম না

অবশ্য বাংলা ছড়ার বিস্তৃত উঠোনটিতে কান পাতলেই ভবানীদার ছড়ার আঙ্গিক, শব্দ নির্বাচন, বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ইত্যাদি বিষয়ে নানাবিধ অসতর্ক কথা শোনা যায়। কথার পিঠে কথা চলতেই থাকে। আজও। কেউ কেউ একে নিন্দুকের ঈর্ষার প্রকাশ বলেও মনে করেন। তবে এই একটি বিষয়ে কারও কোনও দ্বিমত নেই, যে শুধু এই সময়ের নয়, একটি সুদীর্ঘ সময়কে সূচক হিসেবে ধরলে বলা যায়, যে জনপ্রিয়তার নিরিখে সুকুমার রায়ের পর ভবানীদাই ছিলেন সবার থেকে এগিয়ে

মূলত সন্দেশ পত্রিকার অঙ্গন জুড়েই তাঁর আলোকিত অবয়বটি দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানেই দেখেছি বাংলা ছড়ায় মজার বিষয়গুলিকে কী আশ্চর্য কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তিনি। যা চেষ্টাকৃত মনে হয়নি। আরোপিতও নয়। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হল, এইসব মজার বিষয়গুলি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। যা কিনা প্রথম আবিষ্কারেই বাজিমাত করেছিল। হেসে গড়িয়ে পড়েছিল আট থেকে আশি। বলতে কী, এমনলোক হাসানোকাজ ভবানীদা ছাড়া এই সময়ের আর কেউই সেভাবে করতে পারেননি

ছড়াকে নানা আঙ্গিকে প্রকাশের কৌশলটিও ভবানীদা আয়ত্ত করেছিলেন বেশ। হাসি হই-হুল্লোড় ছাড়াও মিলের কারুকাজ, মা-ঠাকুমার শ্রুতি ছড়ার চিরকালীন আদল, লিমেরিক এমনকি বড়োদের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিষয়টিকেও ছড়ার আদলে প্রকাশ করেছিলেন দক্ষতার সঙ্গেই। তাঁর অনুগামীদেরও তিনি উৎসাহিত করেছিলেন ছড়াকে নানা ভাবনায়, নানা কৌশলে প্রকাশের

ভবানীদা তাঁর ছড়ায় বিষয়-নির্বাচনে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছেন বার বার। শিশুকিশোর, পশুপাখি, জন্তুজানোয়ার, নদী-পাহাড়, গ্রহ-তারা—সবকিছুই তাঁর ছড়ায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিল

বিজ্ঞাপনের পরিসরেও তাঁর চলাচল ছিল অবাধ। এ-বিষয়ে তাঁর অনন্য দক্ষতা আমরা লক্ষ করেছি বার বার। পণ্যসামগ্রী বিপণনে বিজ্ঞাপন হিসাবে তাঁর ছড়ার ব্যবহার ছিল বেশ মজাদার। তাঁর যে-কোনো বিজ্ঞাপনের ছড়ায় চোখ রাখলেই এ-কথার সত্যতা প্রমাণ হয়। বলা যায়, বিজ্ঞাপনে ছড়ার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর সমসময়ে তিনিই ছিলেন পাইওনিয়ার। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। জবাকুসুম তেলের বিজ্ঞাপনে তাঁর ছড়ার ব্যবহার ছিল এইরকম—

 

শিব এসেছেন শ্বশুরবাড়ি চড়তে পাতাল রেল

ভিড় দেখে তাঁর চক্ষু চড়ক, হয় বুঝি হার্ট ফেল!

হঠাৎ শিবের পড়ল মনে

দুর্গাদেবী বিদায় ক্ষণে

বলেই ছিলেন, এই গরমে ফাটবে মাথায় বেল

চার বেলা তাই মাখবে মাথায় জবাকুসুম তেল!

(অংশ – সন্দেশ, বৈশাখ ১৩৯৩ থেকে)

 

তবে ভবানীদা তাঁর অসংখ্য অনুগামীর মধ্যে উজ্জ্বল কলমটিকে খুঁজে নিয়ে তাঁকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করেননি কোনোদিন। দীর্ঘ সঙ্গ-যাপনের পরই এ উপলব্ধি হয়েছে আমার। আবার আমার ডাকে বার বার এসেছেন বীরভূমে। আত্মীয়ের ভালোবাসায় তাঁকে গ্রহণ করেছিল বীরভূমের মানুষ। তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছিলাম সবার সঙ্গে এই আমিও। তাঁর অজস্র স্মৃতি-সান্নিধ্য জড়িয়ে রয়েছে আমার এই ছোট্ট জীবন পরিক্রমায়। যা আমাকে সতত আলোকিত করেছে। উদ্ভাসিত করেছে

ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন ভবানীদা। সবার সঙ্গে আমারও এটুকুই প্রার্থনা আজ

  

<