গল্প - ৫ । মাঘ ১৪৩১

বিলুর মনুয়া 











দীনেশ সরকার

মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ



 

বিলুদের গ্রাম থেকে চার-পাঁচটা গ্রাম পরে ভবানীপুর স্কুল মাঠে চৈত্র সংক্রান্তিতে বিরাট গাজনের মেলা বসে। দূর-দূর গ্রাম থেকেও লোক সমাগম হয়। দৈনন্দিন জিনিস যেমন ঝুড়ি-কুলো থেকে কোদাল-বঁটি, মাটির হাঁড়ি-কলসী, বাহারী ফুলদানি থেকে ধুতি-শাড়ি-গামছা, জামা-কাপড়, পুঁথির মালা থেকে সিটি গোল্ডের গয়না, খেলনাপাতি, তালপাতার ভেঁপু, হাতপাখা সব পাওয়া যায়।  
বসে নাগরদোলা, পুতুল নাচ, ম্যাজিকশো। গাজন পর্ব একদিনে শেষ হলেও মেলা চলে এক সপ্তাহ ধরে। গ্রামীন অর্থনীতিতে এই মেলার অবদান অনস্বীকার্য। বিলু আর ওর বোন রিমলি প্রত্যেক বছর বাবার হাত ধরে এই মেলায় আসে। কত কি কেনে। বিলুর মা খুব একটা আসতে চায় না। সবাই এলে হেঁশেল ঠেলবে কে।

গতবারের মেলাতেও বিলু-রিমলি ওর বাবার হাত ধরে এসেছিল। মেলা ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু কেনার পরে এক জয়গায় দেখে খাঁচা সমেত ময়না পাখির বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে। বিলু বায়না ধরে, ‘দাও না বাবা, একটা ময়নার বাচ্চা কিনে। আমরা পুষবো।’ 

রিমলিও বায়না করতে থাকে, ‘দাও না বাবা একটা কিনে। আমরা পুষবো।’

অগত্যা ছেলে-মেয়ের মুখ চেয়ে যত দামই হোক বাবাকে কিনে দিতে হ’ল। সন্তানের খুশিতেই তো বাবা-মার খুশি। দুই ভাই বোন মনের খুশিতে খাঁচা সমেত ময়নার বাচ্চা নিয়ে ঘরে ফিরল।  

বিলু আদর করে বাচ্চাটার নাম রাখল মনুয়া। বিলুই দেখাশোনা করে, খাবার খাওয়ায়। যখন তখন আদর করে। খাঁচার দরজা খুলে বিলু হাতটা পেতে দেয়, মনুয়া গুটি গুটি পায়ে বিলুর হাতে চলে আসে। বিলু ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে, বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। মনুয়া খুব আরাম পায়। আবার খাঁচার দরজার কাছে নিয়ে ‘যা’ বললে মনুয়া খাঁচার ভিতর ঢুকে যায়। রিমলি মনুয়াকে ভালোবাসে কিন্তু দাদার মতো অত ঘাঁটাঘাঁটি করে না। যখন দাদার হাতে থাকে তখন রিমলি এসে মনুয়াকে আদর করে। কয়েক মাসের মধ্যেই মনুয়া পোষ মেনে গেল। বিলু খাঁচার কাছে গেলেই বাইরে আসার জন্য ছট্‌ফট্‌ করতে থাকে। বিলুর আদর পেলে তবেই তার শান্তি। মনুয়ার জন্য বিলুরও মনটা কেমন করতে থাকে। যতক্ষণ স্কুলে থাকে মাঝে মাঝেই মনুয়ার কথা মনে পড়ে। দেখতে দেখতে মনুয়া বেশ বড় হয়েছে, ডাকতে শিখেছে। বিলু আর রিমলিকে দেখলেই ডাকতে থাকে।

বিলুর সহপাঠী সুমন দু-তিন দিন স্কুলে যায় নি। তাই বিলুর কাছে পড়া জানতে এসেছিল। তখন বিলু মনুয়াকে খাঁচা থেকে বার করে আদর করছিল। সুমনও মনুয়াকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। পরের দিন সুমন স্কুলে গিয়ে অন্য বন্ধুদের মনুয়ার গল্প করল। সবাই বিলুর কাছে মনুয়ার গল্প শুনতে চাইল। ক্লাসে বিলুর মান যেন অনেকটা বেড়ে গেল। ছুটির পর দল বেঁধে বিলুর বন্ধুরা এল মনুয়াকে দেখতে। বিলু খাঁচা থেকে মনুয়াকে বের করে বন্ধুদের দেখাল। কেউ কেউ আবার মনুয়ার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মনুয়াকে আদর করল। বন্ধুদের কাছে বিলু যেন হিরো বনে গেল।  বিলু স্কুলে গেলে সবাই মনুয়ার খোঁজ নেয়।  

সেদিন অবনীবাবু ক্লাসে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন, ‘আমাদের দেশে বহু বন্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যারা এখনও আছে সেই সব বন্যপ্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনে বনের পশু-পাখি শিকার করা, বাড়িতে এনে পোষা বা খাঁচায় বন্দি করে রাখা দন্ডনীয় অপরাধ।‘

সঙ্গে সঙ্গে পিছনের বেঞ্চ থেকে অমল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার, বিল্ব তবে অপরাধী স্যার। ওর শাস্তি পাওয়া উচিৎ।’

অবনীবাবু বললেন, ‘কেন, বিল্ব কি করেছে?’

বিলুর বন্ধুরা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘স্যার, বিল্ব বাড়িতে ময়না পুষেছে স্যার।’

অবনীবাবু বললেন, ‘তাই নাকি বিল্ব? তুমি বাড়ীতে ময়না পুষেছো?’

বিলু উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে বলল, ‘হ্যা স্যার। গত বছর চৈত্র সংক্রান্তির গাজনের মেলায় গিয়েছিলাম। ওই মেলায় দেখেছিলাম খাঁচা সমেত ময়নার বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে। তাই আমি একটা কিনে এনেছিলাম। আমি জানতাম না স্যার ময়না বাড়িতে পোষা উচিৎ নয়।’

অবনীবাবু বললেন, ‘না জেনে মানুষ অনেক ভুল করে। এখন তো জানলে বিল্ব ওই সব বনের পশু-পাখি বাড়িতে পোষা অনুচিৎ। বনের পশু-পাখি বনেতেই ভালো থাকে। স্বাধীনভাবে বিচরণ করে। কেন তাদেরকে বাড়িতে বন্দি করে রাখবে বল। তোমাকে যদি কেউ পায়ে শিকল দিয়ে ঘরে বন্দি করে রাখে আর খুব ভালো ভালো খাবার খেতে দেয়, তোমার কি ভালো লাগবে? তুমি আজ বাড়ি ফিরে তোমার পোষা ময়নাকে আকাশে উড়িয়ে দেবে। দেখবে কি সুখে সে মুক্ত আকাশে বিচরণ করছে।’   

বিলু মাথা নীচু করে বসে পড়ল। স্যারের কোনো পড়াই আর ওর মাথায় ঢুকছে না। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এত আদর –ভালোবাসা দিয়ে মনুয়াকে বড় করেছে তাকে আজ ছেড়ে দিতে হবে। মনুয়া কোথায় থাকবে, কি খাবে! ওর হাতে ছাড়া যে মনুয়া খায় না! অন্য পাখিরা মনুয়াকে মেরে ফেলবে না তো! বিলুর বুকের ভিতরটা তোলপাড় হচ্ছে। আবার বন্ধুরা ওর গায়ে অপরাধীর তকমা সেঁটে দিয়েছে, সেটাও তো দূর করতে হবে। তার উপর স্যারের নির্দেশ।

ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বিলু ঘরে ফিরল। মনুয়ার খাঁচার কাছে এসে দাঁড়াতেই মনুয়া ডেকে উঠল।  বিলুর চোখ ফেটে জল এল। রিমলিকেই বা কি বলবে! রিমলি এখন ঘুমোচ্ছে।

বিলু পিঠ থেকে স্কুল-ব্যাগটা ঘরে রেখে আবার মনুয়ার খাঁচার সামনে এল। খাঁচার দরজা খুলে হাত রাখতেই মনুয়া হাতে উঠল। বিলু মনুয়াকে বুকে চেপে আদর করতে করতে উঠোনে এসে দাঁড়াল। চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল মনুয়ার গায়ে মাথায় পড়তে লাগল। বিলু মনুয়ার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘যা মনুয়া, তোকে মুক্তি দিলাম। যেখানে থাকিস্‌ ভালো থাকিস্‌। অন্য পাখিদের সাথে ভালো থাকিস্‌। যা মনুয়া যা।’

চোখের জলে বিলু মনুয়াকে উড়িয়ে দিল। মনুয়া এর আগে ওড়ার স্বাদ পায় নি। মনুয়া বিলুর মাথার উপরে দুতিন বার পাক খেয়ে উঠোনের সামনের আম গাছে গিয়ে বসল। তারপরে আবার দুতিন বার পাক খেয়ে বিলুর হাতে এসে বসল। ভালোবাসার বন্ধন কি অত সহজে কেটে বেরোনো যায়! মনুয়াও পারল না বিলুর ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে মুক্ত আকাশে বিচরণ করতে। বিলু মনুয়াকে বুকে চেপে অনেকক্ষণ আদর করে  আবার উড়িয়ে দিল। মনুয়া আকাশে দুতিন বার পাক খেয়ে আবার বিলুর হাতে এসে বসল। বিলু বুঝতে পারল মনুয়া ওকে ছেড়ে যেতে চায় না। বিলুর দুচোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরতে লাগল।

মনুয়ার খাঁচার দরজা সেই থেকে খোলা থাকে। মনুয়া সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এ ঘর ও ঘর করে। উঠোনে ঘুরে বেড়ায়, বারান্দায় ঘুর ঘুর করে, আম গাছে গিয়ে বসে। বিলু মনুয়া বলে ডাকলে ওর হাতে চলে আসে। রিমলি ডাকলেও মনুয়া ঘরে আসে। মনুয়া খিদে পেলে খাঁচায় ঢুকে খাবার খায়, বিশ্রাম নেয়। তবে সন্ধ্যার আগেই মনুয়া খাঁচায় ঢুকে যায়। তখন বিলু খাঁচার দরজা বন্ধ করে দেয়। আবার সকাল হলেই ডাকাডাকি শুরু করে তখন খাঁচার দরজা খুলে দেয়। 

এইভাবে মনুয়া বিলুদের পরিবারের একজন হয়ে আদর-ভালোবাসায় বড় হতে থাকে।