স্বপন চক্রবর্তী

পশ্চিম মেদিনীপুর বেলদার এক অনুষ্ঠান শেষে ভবানীদার সাথে আমি ও আমার কন্যা। ২০০৮ সাল।

  ভবানীদার সংস্পর্শে

  সুখকর স্মৃতি









স্বপন চক্রবর্তী





 

ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে নিয়েকিশোর বার্তাপত্রিকার পক্ষ থেকে যে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে, প্রথমেই তাকে স্বাগত জানাই। প্রিয় ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক ভবানীপ্রসাদের সংস্পর্শে আসার সুবাদে এই উপলক্ষ্যে কিছু কথা তুলে ধরছি

প্রথমেই বলি, ভবানীদা এবং আমি প্রায় সমবয়সি। দুজনের একই সালে (১৯৫৩) জন্ম হলেও উনি আমার থেকে তিন মাসের বড়ো। ওঁর জন্ম এপ্রিল মাসে আর আমার জুলাই মাসে। আমি ওঁকে ভবানীদা বলে ডাকি আর উনি আমাকে স্বপনবাবু বা স্বপনদা বলে সম্বোধন করেন। ১৯৯২ সালে ওঁর সঙ্গে পরিচয় লেখার সূত্রে। উনি তখনওভারল্যান্ডদৈনিক পত্রিকার শিশুদের পাতাসোনার কাঠিবিভাগটি পরিচালনা করতেনসবুজবুড়োছদ্মনামে। প্রতি বুধবার প্রকাশিত হত এই পাতাটি

সেই সময় পাতাটি ছোটো থেকে বড়ো সবার কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল ভবানীদার মুন্সিয়ানায়। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম বুধবারের এই বিভাগটির জন্য। এই পাতাটিতে ভবানীদা ওরফে সবুজবুড়ো তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী নাতি-নাতনিদের চিঠির জবাব দিতেন ছন্দবদ্ধ কবিতায়, যা ছিল খুবই চিত্তাকর্ষক। এই পাতায় শিশুদের লেখা, শিশুদের উপযোগী বড়োদের লেখা, মনীষীদের জীবন কাহিনি তুলে ধরা এবং মজারছড়া-গড়াপ্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন তিনি। ছড়া-গড়ার জন্য তিনি একটি লাইন উল্লেখ করতেন, এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আরও তিনটি লাইন জুড়ে শিরোনাম সমেত একটি ছড়া লিখতে হত। এই বিভাগে সেই সময় আমার শিশুকন্যা সুস্মিতা চক্রবর্তী (চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী) যেমন লিখেছে, তেমনি আমিও লিখেছি অনেক ছড়া। একাধিকবার সেরা ছড়াকারও হয়েছিলাম। এই রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে প্রচুর ছড়াকার এই ছড়া-গড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এইভাবে নবীন প্রজন্মের ছড়াকারদের তিনি উৎসাহিত করেছেন, বর্তমানে যাঁরা অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এইভাবে ছড়া লেখা ও ছড়াকার তৈরিতে ভবানীদার অবদান অস্বীকার করা যায় না। এই পত্রিকার আর একটি মাসিক ম্যাগাজিনসোনামাণিকশিশু পত্রিকাও তিনি চালাতেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ওভারল্যান্ডেরসোনার কাঠিবিভাগটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে দেখেছিলাম ভবানীদাকে। এরপর ওভারল্যান্ড পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনিআজকের পল্লীকথানামে একটি মাসিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সেখানেও তিনিসবুজবুড়োছদ্মনামেসোনার কাঠিবিভাগ চালু করেছিলেন। ভবানীদার আহ্বানে এখানেও লিখেছি এবং পত্রিকার পক্ষে অন্যতম ছড়াকার হিসেবে ওঁর স্বাক্ষরিত শংসাপত্র পেয়েছি ওঁরই হাত দিয়ে (ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্স, ২০০২ এবং ২০০৩)। ২০০৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন এই পত্রিকায়। এরপরসুস্বাস্থ্যপত্রিকার সঙ্গেও উনি যুক্ত হয়েছেন। সেখানেও ওঁর অণুপ্রেরণায় স্বাস্থ্য বিষয়ক ছড়া লিখেছি। সেই সময় ভবানীদার অণুপ্রেরণায় একটা ঘোরের মধ্যে লিখে গেছি এইসব পত্রিকায়

ভবানীদা ২০০২ সালে আমার বেলঘরিয়ার বাড়িতে এসেছিলেন। পাশাপাশি বসে কথাবার্তা।

এরপর ভবানীদার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হল কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের ভেতরমামুদোকানে। ২০০২ সাল থেকেই ভবানীদাকে এখানে পেয়েছি। প্রতি বুধবার তিনি এখানে আসতেন, আর আমরা তার অনুগামীরা অফিস ফেরত চলে আসতাম তাঁর সাক্ষাৎ লাভ ও সাহিত্যিক আড্ডায়। এই আড্ডায় চা-মুড়ি, তেলেভাজা চলত অবিরাম। মনে পড়ছে, এখানে থাকাকালীনই ২০০২ সালে তিনি আমার প্রথম ছড়া গ্রন্থছড়ায় গড়া শিশুর পড়াবইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। এই সালেই ভবানীদা আমার বেলঘরিয়ার বাড়িতে এসেছিলেন। এই বাড়িতেই মুখোমুখি বসে আমার মেয়ে সুস্মিতা ভবানীদার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল বাংলা খবরনামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হওয়ায় খুশি হয়ে পত্রিকার অনেক কপি সংগ্রহ করেছিলেন। আমার অনুরোধে ভবানীদা একাধিকবার আমার বাসস্থান এলাকায় এসেছেন। কখনও আমার বাড়ি, কখনও আমার পত্রিকার প্রকাশ অনুষ্ঠানে, আবার কখনও আমার অনুরোধে অন্য সংস্থার অনুষ্ঠানে

এরপর কলেজ স্ট্রিট মার্কেটটি ভেঙেবর্ণ পরিচয়নামে একটি বিশাল ভবন স্থাপিত হওয়ায়মামুদোকানটি রইল না। ফলে ভবানীদার সঙ্গে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ ও আড্ডা স্থানান্তরিত হল কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় নাথ ব্রাদার্সের কমলদার ডিটিপি/কম্পিউটার রুমে। সেখানেও ভবানীদা সপ্তাহে একদিন আসতেন। তাঁর অনুরাগী হিসেবে আমরা সেখানে আড্ডা দিতাম, লেখা জমা দিতাম ভবানীদাকে। এই আড্ডায় আমাদের সঙ্গে ছিলেন কবিবন্ধু প্রদীপরঞ্জন দাস, অজয় বিশ্বাস, নির্মলেন্দু শাখারু, সঞ্জিতকুমার সাহা, অভিনন্দন রায় প্রমুখ। এখানেও বেশিদিন থাকা গেল না। এরপর আমরা স্থানান্তরিত হলাম কলেজ স্কোয়ারে কালীমন্দিরের বেদি তলে। সেখানেও যেতাম প্রতি বুধবার। আমাদের সঙ্গে প্রায়ই থাকতেন কবি প্রদীপরঞ্জন দাস এবং নারায়ণচন্দ্র দাস। ভবানীদা হাওড়ার দাশনগর থেকে আসতেন। আমাদের দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি নিয়ে আলোচনা চলত। একই সঙ্গে পত্রপত্রিকার আদান-প্রদান চলত। এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে কলেজ স্কোয়ারর বাইরেফেবারিটনামে এক রেস্তোরাঁয় বসতাম ভবানীদার প্রিয় চা-টোস্টের জন্য। সেখানেও কিছু গল্পগুজব। তারপর বেরিয়ে পড়তাম বাড়ি ফেরার রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে বেনিয়াটোলা কিংবা কখনও আমহার্স্ট স্ট্রিট মোড়ে এসে আমরা ভবানীদাকে হাওড়াগামী ৭২ নং বাসে তুলে দিতাম ওঁর বাড়ির যাত্রাপথে। এভাবে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমরা ভবানীদাকে কলেজ স্কোয়ারের সাপ্তাহিক বৈঠকে পেয়েছিলাম। এরপর করোনা চালু হওয়া, পরবর্তীকালে ভবানীদা অসুস্থ হয়ে পড়ায় উনি আর বাড়ি থেকে বেরোতেন না। বাড়িতেই একপ্রকার ঘরবন্দি। ফোন করলে বউদি ধরেন। কে ফোন করেছি জানতে চেয়ে ভবানীদাকে ফোন ধরিয়ে দেন। ভবানীদা আশাবাদী হয়ে বলতেন, অমুক সপ্তাহে কলেজ স্ট্রিট যাবেন। আমরা যেন থাকি। মনের জোরে বলতেন ঠিকই, কিন্তু আসতে পারতেন না

 

বেলদা বইমেলায় মঞ্চে মধ্যমণি ভবানীদাপোডিয়ামে আমি বক্তব্যরত।

স্মৃতিচারণ করতে বসে মনে পড়ছে অনেক পুরোনো দিনের কথা। সময়টা ছিল ২০০৮ সাল। পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদায় বইমেলা হবে। ওখান থেকে আমার কাছে অনুরোধ এল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভবানীদাকে চাই। যেহেতু ভবানীদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে, তাই আমার কাছে অনুরোধ এল। আমি ভবানীদাকে রাজি করালাম। আমারও আমন্ত্রণ ছিল ওই অনুষ্ঠানে। দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর, ভবানীদাকে নিয়ে যেতে হবে। কলকাতা থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে ভবানীদাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সকালেই। বেলদা পৌঁছে সরাসরি উঠলাম এক লজে। কলকাতা থেকে আরও দুজন যথাক্রমে প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক শৈলেন ঘোষ এবং রতনতনু ঘাটিও এসে উঠেছেন একই লজে। ভবানীদা ও আমি এক ঘরে এবং শৈলেনদা ও রতনতনু ঘাটি আর এক ঘরে। বিশ্রাম নিয়ে বিকেলেই আমরা পৌঁছে গেলাম বইমেলার উদ্বোধনী মঞ্চে। বইমেলার এই অনুষ্ঠানে ভবানীদা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলেন। বইমেলা ছাড়াও সেখানে আর একটি অনুষ্ঠানেরও উদ্বোধন করেছিলেন ভবানীদা। সঙ্গে ছিলাম আমি ও আমার মেয়ে


পত্রিকা প্রকাশের প্রাক্ মুহূর্তে ভবানীদাকে পুষ্পস্তবক দিয়ে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করছে আমার নাতনি (অনন্যা জানা)। 

ভবানীদাকে নিয়ে আর একটি কথা মনে পড়ছে। সাল-তারিখ এখন আর মনে নেই। ত্রিপুরার আগরতলা থেকে আমার পরিচিত ও আত্মীয় উত্তম চক্রবর্তী আমাকে অনুরোধ করে, ভবানীদাকে নিয়ে ওরা ত্রিপুরায় অনুষ্ঠান করতে চায়। অনুষ্ঠানটি ছিল উত্তমেরকাব্যলোকআবৃত্তি সংস্থার সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভবানীদার উপস্থিতি। এই অনুষ্ঠানেও ভবানীদার সম্মতি আদায় করলাম। উদ্যোক্তাদের খরচে ভবানীদা প্লেনে গেলেন ত্রিপুরায়। শুনেছি ত্রিপুরার নজরুল কলাক্ষেত্রে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। অনুষ্ঠান করে ওখানেও ভবানীদা প্রভূত খ্যাতিলাভ করেছিলেন

এরপর ২০১৩ সাল। বেলদার লায়ন্স স্কুল লাইফ অ্যান্ড লাইট-এর রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান। ভবানীদাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রধান অতিথি হিসেবে চাইছেন। আমার কাছে অনুরোধ এল, ভবানীদা এবং আমি দুজনকেই ওই অনুষ্ঠানে যেতে হবে। ভবানীদার সম্মতি নিলাম। ভবানীদা প্রধান অতিথি এবং আমি বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হলাম। গাড়ি ভাড়া করে ভবানীদাকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেলাম মেদিনীপুরের বেলদায় লাইফ অ্যান্ড লাইট স্কুলের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে ভবানীদা এবং আমাকে বক্তব্য-সহ কবিতা পাঠ করতে হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে ভবানীদা ও আমি বিশেষভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলাম। অনুষ্ঠান মঞ্চে ভবানীদা এবং আমি সারাক্ষণই পাশাপাশি বসে ছিলাম


বেলঘরিয়ায় তোলা এই ছবিতে ভবানীদার সাথে রয়েছে কবি মানস সরকার, লেখিকা সোনালী মুখোপাধ্যায় ও আমার কন্যা সুস্মিতা জানা চক্রবর্তী(ওর শিশু কন্যার সাথে)।

এভাবে দূরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ভবানীদার সঙ্গে ছড়া ও সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা ছিল একটা বিরাট প্রাপ্তি। কাছাকাছি থাকার সুবাদে দেখেছি, ওঁর মতো এত বিনয়ী, সদালাপী, অমায়িক, শান্ত ও নম্র স্বভাবের মানুষ খুবই বিরল। উনি সহজে রাগতেন না। কিন্তু যখন রেগে যেতেন, বোঝা যেত সঙ্গত কারণেই রেগেছেন। ভবানীদা পাশে থাকা মানে একটা বাড়তি উন্মাদনা। এক অনাবিল আনন্দে উৎসাহিত হওয়া। ওঁর সংস্পর্শে লেখার ইচ্ছে জেগে ওঠে। লেখার রসদও খুঁজে পাওয়া যায়। এমন মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে পেরে আমি নিঃসন্দেহে ধন্য হয়েছি

 

২০১৪ সালে বেলঘরিয়া আবৃত্তায়নের এক অনুষ্ঠানে ভবানীদার সাথে বাচিক শিল্পী সম্রাট দত্ত এবং আমি। এই অনুষ্ঠানে ভবানীদা অপূর্ব দত্ত স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিলেন।

ভবানীদার সঙ্গে দীর্ঘদিনের আলাপ, পরিচয় ও সান্নিধ্যের অনেক আনন্দঘন মুহূর্তের অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেলেও কিছু স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। মনে পড়ছে, চাকরি শেষে অবসর নেবার পর ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে আমার সম্পাদিত পত্রিকাসংস্কৃতি বার্তাপ্রকাশ পেল। ভবানীদা হলেন এই পত্রিকার প্রধান উপদেষ্টা। পত্রিকার প্রথম সূচনা সংখ্যার জন্য তিনি লিখে দিলেন একটি সুন্দর শুভেচ্ছা বার্তা ছন্দবদ্ধ কবিতায়। দ্বি-মাসিক থেকে পত্রিকাটি এখন ষাণ্মাসিক হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। ভবানীদা এখনও প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন। প্রতি সংখ্যায় এখনও থাকছে ভাবানীদার লেখা

একটা বিষয় খুবই লক্ষ্যণীয়, ভবানীদার কাছে যখনই লেখা চেয়েছি, তিনি নিরাশ করেননি। উদার হস্তে লেখা দিয়েছেন। বেশ মনে পড়ছে, উনি লেখা দিতেন একটি বন্ধ খামে। খামের ওপর রঙিন স্কেচ পেন দিয়ে প্রাপকের নাম ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা লিখে দিতেন। নীচে নিজের স্বাক্ষর থাকত। এভাবে লেখা দেওয়ার মাধ্যমে একটা সুন্দর মনের পরিচয় পাওয়া যেত। একটি খামে কম করে পাঁচ-ছয়টি লেখা থাকত। আমার উদ্দেশে ভবানীদার খামে করে লেখা পাঠানোর কিছু নিদর্শন 


ভবানীদার নিজের হাতের লেখায় আমার উদ্দেশে খামে করে গুচ্ছ ছড়া পাঠানোর কিছু ছবি।

আমার নিজের পত্রিকা ছাড়া অন্যান্য পত্রিকার জন্যও তিনি লেখা দিতেন। ওঁর অনেক লেখা নিজের পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশ করেছি কবি পরিচিতি সহ। লেখা প্রকাশ হবার পর পত্রিকাটি ভবানীদার হাতে তুলে দেওয়ার সময় উনি খুব খুশি হতেন। উলটেপালটে পত্রিকাটি দেখতেন। সুন্দর মন্তব্য করতেন। বিশেষ পরামর্শ দিয়ে নতুন কবি-সম্পাদকদের উৎসাহিত করতেন

কখনও আমার লেখা চেয়ে নিয়েছেন অন্য কোনও পত্রিকায় প্রকাশ করবার জন্য। প্রকাশ পাবার পর পত্রিকাটি নিজের হাতে তুলে দিয়েছেন। এমনই ছিল আমাদের ভাব-ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক

আমার সৌভাগ্য এই যে, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সহ কলেজ স্ট্রিট চত্বরের বেশ কিছু জায়গায় ভবানীদা ও আমি একসঙ্গে ছড়া পাঠ করেছি। একবার একটি আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় ভবানীদা ও আমি একসঙ্গে বিচারকের আসনে অবতীর্ণ ছিলাম

ভবানীদার একটা বড়ো গুণ ছিল, তিনি নবীন ও উঠতি লেখকদের নানাভাবে উৎসাহিত করতেন। নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের লেখা পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন, আবার পত্রিকা প্রকাশের সংবাদ পৌঁছে দেওয়া বা পত্রিকাও হাতে তুলে দিয়েছেন। ভবানীদার মতো এমন পরোপকারী, সহৃদয়, বন্ধুবৎসল মানুষ বর্তমানে বিরল। এখানেও তিনি অদ্বিতীয়

আবার অসম্ভব স্মৃতিশক্তি ছিল ভবানীদার। মনে পড়ছে, আমার এখানে দু-বার অনুষ্ঠান করতে এসে তিনি একনাগাড়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে নিজের ছড়া একের পর এক স্মৃতি থেকে বলে গেছেন। শ্রোতারাও ছিল তন্ময়।  একের পর করতালি পড়ছে। শ্রোতারা ছাড়তে চাইছে না। এক অভাবনীয় দৃশ্য। শুধু ছড়া বলেই যে দীর্ঘ সময় ধরে অনুষ্ঠান করে শ্রোতার মন জয় করা যায়, ভবানীদা তা করে দেখিয়েছেন। এই ছড়াপাঠ ও আবৃত্তিতে সত্যিই তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। এই যে ঘটনার কথা বলছি, তা একুশ-বাইশ বছর আগের কথা। তখন ভবানীদা রীতিমতো সুস্থ ও চাঙ্গা। বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান ও কবি সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন। এখন অসুস্থ হয়ে পড়ায় আগের মতো আর অনর্গল স্মৃতি থেকে বলতে পারেন না

ভবানীদার বাড়িতে ইতিপূর্বে অনেকবার গেলেও সবশেষে গিয়েছিলাম ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভবানীদাকে আমার পত্রিকা দেওয়া এবং আমার পত্রিকার শারদ সংখ্যা প্রকাশ অনুষ্ঠানে ভবানীদাকে উদ্বোধক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো। এদিন ভবানীদার বাড়ির বিভিন্ন ঘর ঘুরে দেখেছিলাম। বাড়ির ছাদেও উঠেছিলাম। একটি ঘরে ভবানীদার পাওয়া অজস্র মেমেন্টোর মাঝে ভবানীদাকে পেলাম

এছাড়াও ভবানীদাকে পেয়েছি তাঁর বাড়ির ছাদে সিঁড়ির মাথায়


ভবানীদার বাড়ির ছাদ ও তার ওপরে আরেকটি ছাদের সিঁড়ির শীর্ষে দাঁড়িয়ে ভবানীদা ও তার নীচে দাঁড়িয়ে আমি।

বেলঘরিয়ায় পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানের একটি গ্রুপ ছবিতে ভবানীদা, আমি, আমার স্ত্রী সহ উপস্হিত কবি সাহিত্যিকবৃন্দ। উক্ত ছবিতে ভবানীদার বাম পাশে ওনার স্ত্রী-ও রয়েছেন (পদ্মাবতী মজুমদার)। 

মনে পড়ছে, ২০১৭ সালের ২রা ডিসেম্বর আমার পত্রিকার শারদ সংখ্যার প্রকাশ অনুষ্ঠানে ভবানীদা এসেছিলেন বউদিকে সঙ্গে নিয়ে। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল আমার বাড়ির পাশেই বেলঘরিয়ার মিলন সংঘ ক্লাব গৃহে


পত্রিকা প্রকাশের (২০১৭ সাল) পর ভবানীদা ও আমি পাশাপাশি পত্রিকা হাতে ও একান্ত আলাপচারিতায়।

উনি পেশায় শিক্ষক থেকেও নেশায় ছিলেন সাহিত্যিক। শিশুসাহিত্যিক। নানা বিষয় ও বৈচিত্র্যে বিভিন্ন ধরনের শিশুতোষ ছড়া লিখে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। শিশুরাই তাঁর একান্ত প্রিয়। ছোটোদের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাঁর ব্রত। শিশুদের মনোরাজ্যে তাঁর অবাধ বিচরণ। শিশুদের জন্য রয়েছে তাঁর কোমল হৃদয়। তাই তো কচিকাঁচা শিশুরাও ভবানীদাকে ভীষণ ভালোবাসেন। তাঁর ছড়া কণ্ঠস্থ করে মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ায়। সুকুমার রায় ছিলেন ভবানীদার গুরু। তাঁকেই গুরু হিসেবে মানতেন ভবানীদা। সুকুমার রায়ের উত্তরসূরি হিসেবে একমাত্র ভবানীদাকেই মানায়। তাই যোগ্য কবি হিসেবে সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার তিনিই পেয়েছেন। স্বর্ণপদক মেডেল যোগ্য কবি হিসেবে তাঁর গলাতেই পরিয়ে দিয়েছেন সুকুমার-তনয় আর এক গুণী মানুষ স্বয়ং সত্যজিৎ রায় (১৯৮৮ সালের ২রা এপ্রিল)


  পত্রিকা প্রকাশের (২০১৭ সাল) পর ভবানীদা ও আমি পাশাপাশি পত্রিকা হাতে ও একান্ত আলাপচারিতায়।

     পরিশেষে বলতে হয়, শুধুমাত্র সুকুমার রায় নন, রবীন্দ্রনাথ, যোগীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুনির্মল বসু প্রমুখ বিশিষ্টদের সফল উত্তরাধিকারী হলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। সুনিপুণ শব্দচয়ন, মাত্রা-মিল-ছন্দের অভিনব দোলা ও অনায়াস উপস্হাপনায় বর্তমান বাংলা ছড়া সাহিত্যকে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ছন্দের নানাবিধ পরীক্ষায় তিনি এক অনন্য দৃষ্টান্ত। একইসাথে ছড়াগড়ার মাধ্যমে ছড়াকার তৈরি করা ও তাদের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভবানীপ্রসাদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর ছড়া আট থেকে আশি সকলের মুখে হাসি ফুটিয়েছে, সকলের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছে। এখানেই তিনি একজন সার্থক কবি ও ছড়াশিল্পী

 

  

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার

স্বপন চক্রবর্তী

 

কোন সে কবি ছন্দে গাঁথেন

খুশির ছড়া চমৎকার,

শিশুর প্রিয় প্রণাম নিও

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।

 

কোন সে কবি চিত্র আঁকেন

মজার বিষয় চমৎকার,

কিশোর প্রিয় প্রণাম নিও

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।

 

কোন সে কবি শব্দ বাঁধেন

নিত্যনতুন চমৎকার

যুবক প্রিয় আদাব নিও

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।

 

কোন সে কবি স্বপ্ন দেখেন

আলোক বিশ্ব চমৎকার,

সবার প্রিয় যুগ যুগ জিও

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।

 

 


 

<