লোককাহিনি (ত্রিপুরার) | জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

 মুরগি ও চালের পিঠে











রাজীবকুমার সাহা
উদয়পুর, ত্রিপুরা




 

ছোট্ট গাঁয়ে এক মা মুরগি থাকে তার ছানাপোনাদের নিয়ে। ছানারা একদিন বায়না ধরল তারা চালের পিঠে খাবে, অনেকদিন খায়নি। অস্থির করে তোলে মাকে। মুরগি ডানা তুলে বলে, “আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। সে হবে’খন।”

পরদিন সকালেই বাজারে গিয়ে হামানদিস্তে কিনে আনল মুরগি। তারপর উঠোনে চাল গুঁড়ো করতে বসল বিকেলে। হামানদিস্তের টুংটাং মিষ্টি শব্দের তালে তালে গান গাইছিল মুরগি।

এমনি সময় পাশের বাড়ির বেড়ালনি এসে হাজির। দুজনে আবার গঙ্গাজল পাতা সই। বেড়ালনি আশ্চর্য হয়। বলে, “কী লা সই, বেশ খুশি দেখছি আজ! করছিসটা কী? এই আয়োজন কীসের?”

মুরগি হেসে উত্তর দেয়, “আর বলিস কেন সই। ছানা ক’টা মাথা খেয়ে ফেলল চালের পিঠে খাবে বলে। তাই চাট্টি চাল ভিজিয়েছিলুম ও-বেলা।”

মুরগি পিঁড়ে এগিয়ে দেয়। আদাড়পাদাড় ঘুরে যত রাজ্যের খবর নিয়ে আসে বেড়ালনি রোজ। তারপর বিকেল পড়তে এসে বসে এই বাড়িতে। মুখে পানটি ঠুসে বানিয়ে-ছানিয়ে সব শোনাতে বসে সইকে।

মুরগির হাত কিন্তু থেমে নেই। গল্প করতে করতে সে চাল গুঁড়ো করল; তারপর তাতে ঘি আর গুড় মেখে ভাপে বসিয়ে পিঠেও নামিয়ে ফেলল। সইকে ক’টা বেড়ে দিয়ে ছানাদের খাইয়ে এল। পিঠে খেয়ে ফিরে যাবার মুখে বেড়ালনি ইতস্তত করে বলেই ফেলল, “পিঠেগুলো কিন্তু বেড়ে বানিয়েছিস সই। তা বলছিলাম কী, আমার ছানারা তো কখনও পিঠে খায়নি। আমি গিয়ে যদি এদের পাঠিয়ে দিই, দুটি করে হাতে দিবি বোন?”

মুরগি লম্বা জিভ কেটে তাড়াতাড়ি বলে, “এ কী বলছিস সই? তোর সঙ্গে বুঝি আমার এই সম্পর্ক? তোর ছানারা আমার পর? তুই পাঠিয়ে দিস, আমি খাইয়ে দেব’খন।”

বেড়ালনি ফিরে গেলে মুরগিও কী কাজে বেরিয়ে গেল অল্পক্ষণের জন্যে। ফিরে এসে দেখে সর্বনাশ করেছে! মুরগির ছানারা মিলে বাকি পিঠে ক’টাও খেয়ে ফেলেছে কখন। বেড়ালনির ছানারাও এই এল বলে। কী উপায় এখন? বড়ো মুখ করে সইকে কথা দিয়েছে যে! সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে শুয়োরের বিষ্ঠা, ছাগলের নাদি - হাতের কাছে যা পেয়েছে তুলে এনে রেখে দিল বাটি ভরতি করে। বেড়ালনির ছানারও এসে হাজির তক্ষুনি। পিঠে তারা খেল বটে, কিছু এক্কেবারেই পছন্দ হল না তাদের। বাড়ি ফিরে গেল তারা। মুরগি এগিয়ে দিল।

ছানারা বাড়ি ফিরতেই বেড়ালনি জিজ্ঞেস করল, “কী রে, পিঠে কেমন খেলি তোরা? পেট ভরে খাইয়েছে তো মুরগিমাসি?”

সবক’টা মিলে ক্যাওম্যাও করে জানাল, “ছিঃ, বিচ্ছিরি খেতে। কেমন কালো কালো দেখতে, গা গুলিয়ে ওঠা গন্ধ। আর কক্ষনো অমন পিঠে আমরা খাব না মা।”

বেড়ালনির মুখ কালো হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। ও-পিঠে তো এমন ছিল না মোটেই। এই তো খানিক আগেই খেয়ে এল সে। তবে কি সই ঠকাল তার ছানাদের? পিঠের বদলে অন্য কোনও নোংরা জিনিস খাইয়ে দিয়েছে? নিশ্চয়ই তাই। নইলে ছানারা সবাই মিলে এককথা বলবে কেন? বেড়ালনির সারা গা রি রি করতে লাগল রাগে। ফুঁসতে লাগল সে। এর প্রতিশোধ চাই।

রাত আরও খানিকটা গড়িয়ে এলে পায়ে পায়ে আবার মুরগির বাড়ি এসে হাজির হল বেড়ালনি। যেন কিচ্ছুটি হয়নি এমন মুখ করে শুধোয়, “রাতে তোরা এখন কোথায় শোস রে সই? আগে তো সেই একটা ভাঙা খাঁচায় গাদাগাদি করে শুতিস সবক’টা মিলে।”

মুরগির সন্দেহ হল। বেড়ালনি যতই ভালো মানুষ সাজুক, নিশ্চয়ই কোনও বদমতলব আছে তার। নইলে এই তো গেল সন্ধে পার করে, আবার এক্ষুনি এসে উদয় হবে কেন? ছানারা পিঠে খেতে পারেনি বলে রাগে কোনও ক্ষতি করতে আসেনি তো? সে তাড়াতাড়ি জবাব দেয়, “কী আর করি বল বোন। গরিব মানুষ, কোনোমতে রাত কাটানো দিয়ে কথা।”

বেড়ালনি মুচকি হেসে ফিরে গেল নিজের বাড়ি।

রাতে খেতে বসে মুরগি ছানাদের সাবধান করে দিল—“তোদের বেড়ালমাসির মতলবটা ভালো ঠেকল না। আজ রাতটা তোরা ওই কোণের বড়ো পিপেটার ভেতর লুকিয়ে থাক দিকিনি। কিন্তু খবরদার, একটা টুঁ শব্দও করবি না কেউ।”

এই বলে পিপের ভেতর ছানাদের লুকিয়ে রেখে মা মুরগি কীসব খুটুরখাটুর করল অনেকক্ষণ ধরে, ছানাদের তা নজরে এল না।

রাত গভীর হলে বেড়ালনি এসে হানা দিল মুরগির ঘরে। প্রথমেই দৌড়ে গেল ভাঙা খাঁচাটার দিকে। কিন্তু খাঁচা শূন্য। তারপর আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও মুরগি বা তার ছানাদের কারও সন্ধান পেল না সে। শেষে জিরোতে বসে কানে গেল, ওই দূরে বড়ো একটা পিপের ভেতর থেকে কাদের যেন ফিসফিসানির আওয়াজ আসছে। দৌড়ে গিয়ে এক লাফে তাতে উঠে বসতেই দেখে ছানাদের ডানায় পুরে মুরগি ঠকঠক করে কাঁপছে বসে। পালাবার আর কোনও পথ না পেয়ে কেঁদে ওঠে মুরগি। বলে, “জানি তোর হাতেই আমাদের সবক’টার প্রাণ দিতে হবে আজ। কিন্তু মরবার আগে একটা মিনতি রাখবি সই?”

বেড়ালনির তখন চোখ জ্বলছে। রাগে গরগর করে বলে, “কী?”

“আমাদের কাঁচা খাস না বোন। আগুনে সেঁকে খাস। শুনেছি দারুণ খেতে হয় নাকি। রাখবি বোন, এই হতভাগী সইয়ের শেষ অনুরোধটা?”

বেড়ালনি ভেবে দেখল মন্দ কী? সে পেটে এমনিও যাবে, ওমনিও যাবে। একটু রসিয়ে খেতে আপত্তি কী? বুদ্ধিটা মন্দ দেয়নি মুরগি। সে তাড়াতাড়ি উনুন জ্বালতে গেল। অমনি একগাদা ছাই উড়ে এসে ঢুকল বেড়ালনির চোখে-মুখে। অসহ্য জ্বালায় বন্ধ চোখেই হাতড়ে হাতড়ে জল খুঁজে নিয়ে মুখে ছিটোতেই কইমাছ লাফ দিয়ে উঠে কাঁটা বিঁধিয়ে দিল গালে। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পাশেই রান্নাঘরের দরমার বেড়ায় মুখ ঘষতে গেল সে। বেড়া ছিল নতুন বাঁশের, তার ধারে লেগে চোখ-মুখ, সারা শরীর কেটে ফালাফালা হল বেড়ালনির। প্রচুর রক্ত বইল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ভবলীলা সাঙ্গ হল তার।

মুরগিও তার ছানাদের নিয়ে বেরিয়ে এল পিপে থেকে। আর কোনও শত্রু রইল না তাদের।