গল্প - ২ । অগ্রহায়ণ ১৪৩১



 বদনদার বদ বুদ্ধি 











পুলককুমার

বন্দ্যোপাধ্যায়

পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বঙ্গ



 

অতবড় একখানা কাঁঠাল দেখে বদনদা যেই না বলে ফেলেছে 'কী দারুণ', ব্যস্, মেসোমশাই মানে বিল্টুর বাবা লুফে নিয়েছেন কথাটা, "তাহলে এটাই নিয়ে যা, আমি ভাল করে বেঁধে-ছেঁদে দিচ্ছি। বিল্টু বাসে চাপিয়ে দিয়ে আসবে।"

অনেক দিন পরে বদনদা এ-বাড়িতে এসেছে, কম করে বছর দশ-বারো তো বটেই। বাগানের দশাসই গাছটার ডালে ডালে অজস্র কাঁঠাল ঝুলছে, মেসোমশাই না দিয়ে ছাড়বেন না, "দিন দু'য়েক বস্তা চাপা দিয়ে রাখবি, তাহলেই পুরোপুরি পেকে যাবে।"

বদনদা একটু আমতা আমতা করে, "এতখানি রাস্তা, বাস-ট্রেনের ঝক্কি...!

"থাম তো। ঠিক পারবি।" চাপা ধমক দিয়ে মেসোমশাই বললেন, "এতদিন পরে এলি, গাছের একটা কাঁঠাল নিয়ে যাবি না, তাই কি হয়?"

অগত্যা!  কিন্তু রাস্তাটা তো আর সামান্য নয়। প্রথমে বাসে চল্লিশ মিনিট, তারপরে ট্রেনে দু'ঘন্টা পার করে নিজেদের স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে মাঠের মাঝখান দিয়ে পাক্কা আধ ঘন্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের হাঁটাপথ করিমপুরে বদনদার বাড়ি। আজকাল ট্রেনে-বাসে চাপতেই কেমন অস্বস্তি লাগে, এইজন্যেই  কোথাও বেরোতে চায় না বদনদা। তার ওপরে সঙ্গে এই কাঁঠালের বোঝা থাকলে ধকল সামলাতে পারবে তো?

কিন্ত এমন অযাচিত পাওনা! ছেড়ে যেতেও কষ্ট হচ্ছে। মেসোমশাই বেশ কায়দা জানেন। কাঁঠালটাকে প্রথমে একটা বস্তায় পুরলেন, তারপরে দু'টো দিককে গামছা দিয়ে বেঁধে এমন ভাবে ঝুলিয়ে দিলেন যে কাঁধে করে দিব্যি বয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। বদনদা তো হেসে কুটোপাটি, "লোকে ভাববে খোল নিয়ে হরিনাম করতে বেরিয়েছি।"

বিল্টু চাপিয়ে দিয়ে গেল বাসে। এ দিককার বাসগুলোতে যা ভিড় হয়! কোনওরকমে ভেতরে ঢুকে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল বদনদা, দু'পায়ের ফাঁকে সেই মহার্ঘ্য বস্তু। চারপাশ থেকে গুঁতোগুঁতি ঠেলাঠেলি তো চলছেই, মাঝেমাঝে শুনতেও হচ্ছে, ''আপনার মালটাকে একটু সরান তো!''

''কোথায় সরাব? দেখছেন না আমি নিজেই কীভাবে দাঁড়িয়ে আছি!"

''তাহলে মাথায় তুলুন। এমন বোঝা নিয়ে ভিড় বাসে উঠেছেন কেন?''

রাগে সারা শরীর চিড়বিড়িয়ে উঠছে। জুৎসই একটা জবাব দিতে গিয়েও সামলে নিলো বদনদা। একে তো জষ্ঠি মাসের গরমে শরীর হাঁসফাঁস করছে, তার ওপরে খানাখন্দে ভরা এমন রাস্তায় যাকে বলে নাচতে-নাচতে যাওয়া। এক-এক সময় নিজের ওপরে রাগও হচ্ছে, দূর, এটাকে না আনলেই বরং ভাল হত! কিন্তু মেসোমশাই যে তখন বড্ড খাতির করে ধরিয়ে দিলেন। আর, কাঁঠাল তো বদনদার ভীষণ প্রিয়, সেটা কি অস্বীকার করা যায়?

ঠিক তখনই একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে হঠাৎ থেমে গেল বাসটা। তাতেই এ-ওর গায়ে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কী ব্যাপার! সকলেরই চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। হুড়োহুড়ি করে নামার জন্যে পিছন থেকে জোর ঠেলা আসছে। কাঁঠালের বস্তা নিয়ে বদনদাও কোনওরকমে একটা লাফ দিল। তারপরেই শোনা গেল, বাস আর যাবে না, ইঞ্জিন বিগড়েছে

শুনে তো বদনদা ভিরমি খায় আর কী! তার মানে এই বোঝা ঘাড়ে নিয়ে এখন হাঁটতে হবে! শাস্তি আর কাকে বলে!

''স্টেশনটা কত দূরে?'' জিজ্ঞেস করতে একজন বলল, ''কত আর! ঠিকমতো হাঁটতে পারলে বড়জোর আধ ঘন্টা।''

আ-ধ ঘন্টা!  বদনদার মাথায় হাত। যদিও এটা তার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়, কিন্তু সঙ্গে যে এরকম একটা বোঝা! এর মধ্যেই হাতের শিরাগুলো বেশ টনটন করছে। ওদিকে আবার ট্রেনটা যদি চলে যায় তাহলে তো ঝক্কির শেষ থাকবে না। দেখতে দেখতে বেলাও ফুরিয়ে আসছে

বাস বিগড়েছে দেখে সওয়ারির লোভে ততক্ষণে গোটা তিনেক রিকশা এসে হাজির। বদনদা জিজ্ঞেস করল, ''স্টেশন যেতে কত নেবে?''

''পঞ্চাশ।"

''বলো কী..!'' বদনদার চোখ ছানাবড়া, ''এইটুকু রাস্তা যেতে প-ঞ্চা-শ--! টাকা-পয়সা খুব শস্তা না কী ?"

   ''তাহলে যান না মশাই পায়ে হেঁটে, কে আর আপনাকে আরামে যাওয়ার জন্যে মাথার দিব্যি দিয়েছে? যত্ত সব!"

গজগজ করতে করতে রিকশাওলা চলে যাচ্ছে দেখে বদনদা ভেবে দেখল, গরজ বড় বালাই। হাত খালি থাকলে কি আর এত কথা ছিল? নেহাৎ ট্রেনটা ধরার তাগাদা রয়েছে, তাই। অগত্যা ওই পঞ্চাশেই রাজি হতে হল। ব্যাটা এক পয়সাও ছাড়ল না। চাপা রাগে বদনদার গা রী-রী করছে

তবে রিকশাটা না নিলে দুর্ভোগের যে শেষ থাকত না তা স্বীকার করতেই হবে। ট্রেনটা অবশ্য একটু  দেরিতেই চলছিল। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। এরপর স্টেশনে নেমে মেঠো রাস্তা ধরে এই বোঝা ঘাড়ে নিয়ে আবার হাঁটতেও হবে। উঃ, কী যে ঝকমারি হয়েছে! বদনদার মনটা একেবারে তেতো নিম। বাসটা যেন খারাপ হওয়ার আর দিন পেল না! সুযোগ বুঝে রিকশাওলাটাও কেমন কড়কড়ে পঞ্চাশটা টাকা খসিয়ে দিল! সব এই কাঁঠালটার জন্যেই। যত্ত ঝামেলা!

কিন্তু এখন আর আক্ষেপ করে লাভ কী! যত কষ্টই হোক, সামলাতে হবে তো তাকেই। স্টেশনে নেমে বদনদা কোনওরকমে কাঁধে নিলো বস্তাটাকে। উঃ, যা ভারী! খানিকটা এগিয়ে কাঁধ থেকে মাথায় তুলল। অন্ধকারে ঠিকমতো পা ফেলতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। রাগও হচ্ছে নিজের ওপরে। কী কুক্ষণে যে তখন মেসোমশাইয়ের কথায় রাজি হয়েছিল!...এত কাঁঠালের লোভ, এ্যাঁঃ !

একটু অন্যমনস্ক হতেই হোঁচট লাগল পায়ে। ব্যস্, বোঝা নিয়ে সপাটে পড়ে যাচ্ছিল আর কী! কোনওরকমে টাল সামলে মাটিতে বসে পড়েছে বদনদা

"আহা, পড়ে গেলেন বুঝি বড়ভাই! কী জ্বালা বলুন তো?" অচেনা একটা লোক মুখের সামনে ঝুঁকে পড়েছে দেখে বদনদা একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, "হ্যাঁ, পড়েছি বটে, তবে এখনও মরিনি।"

"ছিঃ, ছিঃ..., বলেন কী! মরতে যাবেন কোন্ দুঃখে? পৃথিবীতে এখনও কত কাজ বাকি।"

সেরেছে! এবার কি কোনও পাগলের খপ্পরে পড়তে হল নাকি? বদনদা মনে মনে গজরাচ্ছে, কার মুখ দেখে যে আজ দিনটা শুরু হয়েছিল! এক কাঁঠাল নিয়ে হিমসিম, তার ওপরে আবার নতুন করে কী যে উপদ্রব এসে হাজির হল কে জানে! বদনদা এখনও স্টেশন এলাকা ছেড়ে বেরোতে পারেনি। লোকটা যেন গায়ে পড়ে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এসেছে। মাঝারি গোছের চেহারা, মুখে হালকা দাড়ি, আঁটোসাটো প্যান্টের ওপরে বোতাম-খোলা পাঞ্জাবীটা ময়লা নাকি ধূসর রঙের তা এই আলো-আঁধারিতে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে লোকটা যে মোটেই পাগল-টাগল নয় সে-ব্যাপারে বদনদা একটু পরেই খানিকটা নিশ্চিত হতে পারল

"তা যাবেন কোথায়, বড়ভাই?"

"করিমপুর।"

"ও বাবা, সে তো খুব কাছে নয়!" লোকটা যেন একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলতে লাগল, "হুঁঃ! এঁদো ডোবা, বাঁশবন..., কত কী রয়েছে সেখানে। এমন রাতবিরেতে এই পাহাড় ঘাড়ে নিয়ে পৌঁছতে পারবেন তো?"

"ঠাট্টা করছ, তাই না?"

"তা কেন! চেষ্টা করে দেখুন। পারলে ভাল।"

"আমার জন্যে তুমি হঠাৎ দরদ দেখাতে এলে কেন বলো তো? কিছু উদ্দেশ্য-টুদ্দেশ্য আছে নাকি! মতলবটা শুনি একবার।"

লোকটাকে যথেষ্ট ভদ্রই বলতে হবে, বদনদার কাটখোট্টা কথা শুনে হয়তো একটু লজ্জিত হল, "ছিঃ, ছিঃ..! কী যে বলেন বড়ভাই, তামাশা করব কেন? এটা আমার স্বভাবদোষ। লোকের উপকার করার জন্যে মনটা বড় হাঁকপাক করে।"

বদনদা এবার একটু বাঁকা চোখে তাকাল, ", পরের উপকার না করতে পারলে বুঝি খুব কষ্ট হয়? তাহলে নাও না মাথায় তুলে বোঝাটা। এই তো একটুখানি পথ, দু'জনে গল্প করতে করতে চলে যাই।"

লোকটা যেন এই কথাটা শোনার জন্যেই অপেক্ষা করছিল, "এভাবে লজ্জায় ফেলবেন না বড়ভাই, মানুষের বিপদে-আপদে সাহায্য করতে হয়।শুধু হাতের মুঠোটা একটু আলগা করবেন, ব্যস্।"

"বুঝেছি, তুমি একটি পাক্কা খেলোয়াড়! বেশি ধানাই-পানাই না করে সোজাসাপ্টা বলো তো, কত নেবে?"

লোকটা এবার বস্তাটার ওপরে একেবারে ঝুঁকে পড়ল, "কী মহার্ঘ্য সম্পদ রয়েছে বস্তার ভেতরে?" তারপর একটু নাড়াচাড়া করে যেন লাফিয়ে উঠল, "ও বাবাঃ.., এ-ত্ত বড় কাঁঠাল!..  তা, এটা কোন্ কাজে লাগবে বড়ভাই? দেবসেবায়, না ভোগের জন্যে?"

"এই শোনো—", বদনদা তিরিক্ষি মেজাজে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "তুমি কী ভেবেছ বলো তো, এই রাত-বিরেতে আমি পড়েছি ঝামেলায়, আর তুমি কোত্থেকে এসে জুটলে মশকরা করতে? চিনি না, জানি না..."

"আহা, চটছেন কেন, দেবেন কিছু, আপনার কষ্ট তো লাঘব হবে।"

বদনদা গলা নামাল, "সেইজন্যেই তো জিজ্ঞেস করছি, ঠিক করে বলো কত নেবে?"

লোকটা আর কথা না বাড়িয়ে সোজাসুজি বলল, "পঞ্চাশ দিলেই হবে।"

"এ্যাঁ.., আবার প-ঞ্চা-শ...! একবার দিয়েছি, ফের তোমাকে দিতে হবে। তার মানে দু'দফায় খরচ গিয়ে দাঁড়ায় একশোতে। ...না, না, বড্ড গায়ে লাগছে।... কী যে মনে করো তোমরা!"

শুনে লোকটা আগের মতোই একই সুরে বলল, "এর কমে হয় না। আমি ছাড়া এই বোঝা বওয়ার জন্যে রাতবিরেতে এখানে কেউ আসবেও না। এবার আপনিই বুঝুন।"

বদনদার ইচ্ছে হচ্ছে নিজের গালে সজোরে একটা চড় কষায়। সুযোগ বুঝে সবাই কেমন কোপ মারার জন্যে একেবারে ওৎ পেতে রয়েছে! একশো টাকায় বাজারে কি একটা কাঁঠাল পাওয়া যেত না? কোন আহাম্মক এমন বোকামি করে !

"রাজি থাকলে বলুন, মাথায় তুলি।"

"তুমি তাহলে একটুও কমাবে না?"

লোকটা সজোরে ঘাড় নাড়ল, "এক পয়সাও না..।"

মিনমিনে গলায় বদনদা বলল, "কী আর করব, বাধ্য হয়ে এখন তোমার কথাই মেনে নিতে হবে!... আজ তো আমার গচ্চা যাওয়ারই কপাল!"

লোকটা বেশ পটু বলতে হবে। বস্তাটাকে মাথায় নিয়ে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোলে রাস্তায় আর তেমন আলো পাওয়া যায় না। বদনদা জিগ্যেস করল, "পারবে তো অন্ধকারে যেতে ?"

"বলেন কী? আকাশে অমন মস্ত চাঁদ, জোসনার ফিনিক ফুটছে। আমার সব অভ্যেস আছে, দেখবেন আপনি কেমন তফাতে পড়ে থাকবেন, আমিই বরং ছুটব।"

বদনদা কথা না বাড়িয়ে বলল, "চলো, চলো...! আগে আগে হাঁটো, আমি তোমার পেছনে যাচ্ছি।"

লোকটা তাড়াতাড়ি পা চালাতে শুরু করল। এমন আলো-আঁধারিতেও এ-গলি ও-গলি পেরিয়ে সে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। এর পরেই শুরু হবে মেঠো পথ। বদনদা ওর পিছু পিছু খানিকটা গেল বটে, কিন্তু তারপরেই করল কী, বাঁ-দিকের গলির মুখে একটা পোড়ো মন্দিরের পাশে ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে মনে বলল, আমিও কম সেয়ানা নই বাছাধন। ওই কাঁঠাল নিয়ে এখন তুমি যা খুশি তাই করো, আমি আর কিছুতেই তোমার মুখোমুখি হচ্ছি না। তবু তো পঞ্চাশটা টাকা বেঁচে যাবে

এমন বদ বুদ্ধিটা একটু আগেই ঝট করে মাথায় এসে গিয়েছিল। খানিক ক্ষণ এখানেই চুপচাপ অপেক্ষা করবে, তারপরে সুযোগ বুঝে কেটে পড়বে, ব্যস!

কিন্তু একটু পরেই "ও বড়ভাই, গেলেন কোথায়? বড়ভাই...." বলতে বলতে লোকটা ফিরে এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে। সাড়াশব্দ না দিয়ে বদনদা ঘাপটি মেরে বসেই রইল। কিছু ক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে একসময় আলো-আঁধারিতে আবার কোথায় হারিয়ে গেল সে

মশার কামড় খেতে খেতে অস্থির হয়ে উঠছিল বদনদা। অনেক ক্ষণ পরে মন্দিরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভাল করে বোঝার চেষ্টা করল লোকটা কাছেপিঠে আছে কী না! ...না, নেই। যাক বাবা, বাঁচা গেল।কাঁঠালটার জন্যে মনে মনে একটু আফশোসও হচ্ছে, কিন্তু এতগুলো টাকা তো খরচা হল না।  আর ওই লোকটা! বেচারি  ঠকবে কেন, অমন সরেস একটা মাল তো পেয়েছে....!