জ্ঞান বিজ্ঞান । শ্রাবণ ১৪৩১

 মাইক্রোবায়োলজি আর     মাইক্রোস্কোপ 












ড. সৌমিত্র চৌধুরী
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

চোখে দেখা যায় না। কিন্তু ছড়িয়ে আছে জল মাটি বাতাসে। অদৃশ্য সেই বস্তুর আক্রমণে ইনফেকশন হয়। মানে জীবাণু সংক্রমণ, রোগভোগ। কিন্তু কেমন করে হয় আর জীবাণু মাানেই বা কী?

            জানতে সময় লেগেছে কয়েক শতাব্দী। জীবাণু মানে অতি ক্ষুদ্র প্রাণী (Microorganism)খালি চোখে নয় দেখতে পাওয়া যাবে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে। যন্ত্রটির লেন্স আমাদের জানিয়েছে জীবাণুর অস্তিত্ব। ব্যাকটেরিয়া (Bacteria), প্রটোজোয়া, ফাঙ্গাস এই সব আণুবীক্ষণিক প্রাণীদের চেহারা। ভাইরাসও এর অন্তর্গত। অনেকের ভিন্ন মত কারণ ভাইরাস প্রাণহীন।

জীবাণুদের বুঝতে দরকার হয়েছে কয়েকশো বছরের গবেষণা। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে প্রথম জানলাম, দৃষ্টিশক্তির আড়ালে কাজ করে চলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী। জানালেন কোনো বিজ্ঞানী নয়, এক ব্যবসায়ী। যন্ত্র আবিষ্কার করে দেখিয়ে দিলেন, চোখে দেখা যায় না এমন প্রাণীদের অস্তিত্ব। মানুষটি অ্যানটোনিও লিয়েনহুক (Antonie Philips Van Leeuwenhoek, 1632–1723)কারবারি মানুষটি ব্যবসার প্রয়োজনে কাঁচ দিয়ে পরখ করতেন সিল্কবস্ত্রের গুণমান। ধীরে ধীরে কাঁচ ঘসে উঁচু মানের লেন্স বানালেন। সেই দিয়ে তৈরি করে ফেললেন অণুবীক্ষণ যন্ত্র। ছোট জিনিষকে বড় করে দেখবার উপায়। তারপর যন্ত্রের লেন্সে চোখ রেখে দেখতে পেলেন অদ্ভুত সব জিনিষ। জলের মধ্যে অসংখ্য পোকার মত কি সব কিলবিল করছে। কী জিনিষ? উনি নাম দিলেন আনিম্যালকুলি (Animalculi)দেখেছিলেন রক্তের মধ্যেও এরা আছে। হল্যান্ডের লিয়েনহুক কাঁচ ঘসে লেন্স বানাতেন। বিজ্ঞানী না হয়েও তৈরি করে ফেললেন সরল অণুবীক্ষণিক যন্ত্র (Simple microscope)

মাইক্রোস্কোপ তৈরি না হলে বিজ্ঞান উন্নত হত না। যন্ত্রটি আমাদের শেখাল জীবানুবিজ্ঞান। জানাল জীবানুদের আছে প্রবল জীবনীশক্তি। উষ্ণ প্রস্রবণের জলে, সাগরের সাত মাইল গভীরে, পৃথিবীতলের চল্লিশ মাইল উপরেও এরা টিকে থাকে। এমনকি বিনা অক্সিজেনেও বাঁচে অনেক জীবাণু। জীবাণুরা সুযোগ মত আক্রমণ হানে। মানে শরীরে বাসা বেঁধে দ্রুত বংশ বিস্তার করে। টাইফয়েড কলেরা ম্যালেরিয়া এমনকি সর্দির জন্য দায়ী জীবাণু। জীবজন্তুও জীবাণু আক্রমণের শিকার।   

জীবাণু রাজ্য ব্যাকটেরিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বহু রোগ সৃষ্টি করে তবে কিছু উপকারী গুন আছে। ল্যাকটোব্যাসিলাস (Lactobacillus) ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়ায় দুধ থেকে দৈ তৈরি হয়। সমুদ্রের অনেক ব্যাকটেরিয়া (Cyanobacteria) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অর্ধেক অক্সিজেন তৈরি করে। পরিবেশের আবর্জনা বা মৃতদেহ ধংস করে, মাটিকে খাদ্য যোগায় ব্যকটেরিয়া (Azotobacter,  Rhizobium)মানুষের পরিপাক ক্রিয়ায় সাহায্যকরি অনেক উপকারি ব্যাকটেরিয়াও আছে (E.Coli)ব্যাকটেরিয়া এককোষী এবং আশ্চর্যের কথা, এদের কোষে নিউক্লিউস থাকে না।     

            লিহেনহুকের পর আরও উন্নত যন্ত্র আবিষ্কার হোল। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানি রবার্ট হুক (Robert Hooke, 1635-1703) যৌগ অণুবীক্ষণিক যন্ত্র (Compound microscope) তৈরি করলেন। নিজের যন্ত্র দিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীদের পর্যবেক্ষন করতেন। আইজ্যাক নিউটনের সমসাময়িক বিজ্ঞানী হুক পদার্থ বিদ্যায় ‘হুকের নিয়ম’ (Hooke’s law) এর প্রবক্তা। রবার্ট হুক তাঁর পর্যবেক্ষণ বই আকারে (Micrographia) প্রকাশ করে (1665) জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে আলোড়ন তুললেন। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সোলা বা কর্কের গঠন বুঝতে গিয়ে দেখলেন এদের ভিতরে রয়েছে অসংখ্য ঘর (কক্ষ, কোষ বা cell) (ছবি 1)। ‘সেল’ শব্দটি তিনিই প্রথম বললেন আর জানালেন প্রাণী-শরীর তৈরি হয়েছে অসংখ্য সেল দিয়ে। হুকের ‘কোষ’ আবিস্কারের পর বিষয়টি নিয়ে জোরদার গবেষণা শুরু হয়েছিল। এখন স্কুল ছাত্রও জানে, উদ্ভিদ এবং প্রাণী দেহ অসংখ্য কোষ দিয়ে তৈরি।           

            লিহেনহুক আর হুকের আবিস্কার হাজার হাজার বছরের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল। আদ্যিকালের জিজ্ঞাসা, খাবার বা ফলে পচন ধরে কেমন করে? উত্তর, জীবাণু পচন ধরায়। পরের প্রশ্ন, জীবাণু কি এমনি এমনি জন্মায়?

            লিয়েনহুকের আবিষ্কারের আগে (1675) মানুষ আদপেই জানতো না, কী কারনে খাদ্য ফল বা মৃতদেহে পচন ধরে। এমন কি তিনিও (লিয়েনহুক) পচনক্রিয়া ও জীবাণুর যোগসূত্র বুঝতে পারেননি। শুধু প্রমাণ করেছিলেন, দৃষ্টি শক্তির আড়ালে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অসংখ্য ক্রিয়াশীল প্রাণীর অস্তিত্ব। এদের দেখা সম্ভব একমাত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে। 

            খাবার ফেলে রাখলে তার মধ্যে জীবাণু কেমন করে জন্মায়? দশ বছরের গবেষণায় প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেলেন ফরাসী বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর (Louis Pasteur, 1822–1895)পরীক্ষা করে প্রমাণ করলেন, জীবাণুরা বাইরের বাতাস বা ধূলিকণার মধ্য দিয়ে খাবারে প্রবেশ করে।

            লিয়েনহুক, রবার্ট হুক এবং লুই পাস্তুরের দুশো বছরের গবেষণায় জানা গেল, জলে বাতাসে আণুবীক্ষণিক প্রানীরা উপস্থিত। কিন্ত এরা যে রোগ ছড়ায় তার প্রমাণ পেতে দীর্ঘ কাল  অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

            জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট হেইনরিখ হেরম্যান কখ (Robert Koch 1843–1910) প্রমাণ করলেন, জীবাণু  বহু ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত গরুর রক্তে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া (ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস, Bacillus anthracis) পাওয়া যায়। আক্রান্ত গরুর রক্ত অন্য সুস্থ্য গরুর দেহে ঢুকিয়ে দিলে সেটিও রোগের কবলে পড়বে। এর পর বিজ্ঞানী কখ পেট খারাপের ভয়ংকর জীবাণু (কলেরা রোগের ব্যাকটেরিয়া, Vibrio cholera) আবিস্কার করলেন। পরবর্তী সময়ে টিউবারকিউলোসিস অর্থাৎ টিবি রোগ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। বললেন, রোগটি সৃষ্টি করে এক ধরণের  ব্যাকটেরিয়া (Mycobacterium tuberculosis)মূল্যবান এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান (১৯০৫) বিজ্ঞানী কখ।    

            জীবাণুরা অসুখ সৃষ্টি করে আবার কিছু জীবাণু উপকারি। অসুখ সৃষ্টিকারী জীবাণু-সংক্রমণ প্রতিরোধ করা উচিত। প্রাথমিক উপায়, পরিবেশ এবং জল জীবানু মুক্ত রাখা। তাই দাঁত মাজা, সাবান দিয়ে স্নান, হাত ধোয়া, পচা খাবার কিম্বা দীর্ঘক্ষন ফেলে রাখা কাটা ফল না খাওয়া--অতি সাধারন এবং অবশ্য পালনীয় স্বাস্থ্য বিধি।

            কিন্তু জীবাণুর ক্রিয়া এত জটিল যে বহু সাবধানতা সত্বেও বিভিন্ন ভাবে মানুষ এবং জীবজন্তুর শরীরে সংক্রমণ ঘটে। ফল ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী অসুখ এবং কখনও মহামারি। জীবাণু-আক্রমণ প্রতিহত করবার ওষুধও (Antibiotics) আবিস্কার হয়েছে, তবুও মারণ রোগে মৃত্যু অব্যাহত।

            সাড়ে তিনশো বছরের জীবাণু সংক্রান্ত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে অনেক নতুন আবিস্কার ঘটেছে। যেমন মানুষের ইনসুলিন তৈরির জিন ব্যাকটেরিয়ার (E. Coli) দেহে প্রবেশ করিয়ে মানুষী ইনসুলিন (Human insulin) বানিজ্যিক ভাবে তৈরি হচ্ছে। মাইক্রোবের সাহায্যে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের জীনগত চরিত্র বদলে দেওয়া যায়। জীবাণু-গবেষণার ফলে প্রয়োজনীয় বহু আবিস্কার ঘটছে। ওষুধ খাদ্যবস্তু এমন কি কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরিও ইদানীং সম্ভব।

এযুগে জীবাণুবিজ্ঞান বা মাইক্রোবায়োলজি বিজ্ঞানের অতি মূল্যবান শাখা। এর পথিকৃৎ কোনো বিজ্ঞানী নন, উন্নত মেধা আর পর্যবেক্ষণ শক্তির এক পরিশ্রমী মানুষের। তিনশ বছর আগে বয়স যখন নব্বই, মৃত্যু হয়েছে তাঁর। মাইক্রোস্কোপের জগতে একশ বছরে অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্র উদ্ভাবনের কৃতিত্ব অ্যানটোনিও লিয়েনহুক নামের এক ব্যবসায়ীর। 


অ্যানটোনিও লিয়েনহুকের তৈরি অণুবীক্ষণ যন্ত্র 

 


রবার্ট হুকের আঁকা কর্কের ছবি। ছোট ঘর গুলোই কোষ

.........

তথ্যসূত্রঃ 

1. Microbe Hunters (1954), Paul de Kruif, Harcourt Brace Jovanovich, Publishers, San Diego 

2. The Development of Microbiology (1976), P. Collard. Cambridge University Press, Cambridge.