আট থেকে আশি—সকলের প্রিয়
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। আমার সঙ্গে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুর অঞ্চলে সারাদিন-ব্যাপী একটি ছড়া উৎসবে প্রথম আলাপ। এর অনেক আগেই ওঁর
লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। পাঁচজনের মতন আমিও ওঁর লেখার ভীষণ ভক্ত। আলাপ হতেই
উনি বললেন, “আপনি তো লেখালেখি করেন। আপনার লেখা গ্ৰামে
গঞ্জের অনেক পত্রপত্রিকায় দেখেছি। পড়েছিও। ওভারল্যান্ড কাগজে পাঠান না কেন?
পাঠাবেন। আমি ছোটোদের দপ্তরটা দেখি। ছড়া, কবিতা,
গল্প পাঠান। আমি তো অনেকের লেখা ছেপে থাকি।”
জনপ্রিয় কবি ছড়াকার, যাঁর লেখা রেডিও খুললে কিংবা টিভি খুললেই ছোটোদের মুখে শোনা
যায়। টিভিতেও মাঝে-মাঝেই ওঁকে দেখা যায় লেখা পড়তে। নন্দন চত্বরে যতগুলো হল
আছে—শিশির মঞ্চ, বাংলা আকাদেমি সভাঘর, জীবনানন্দ
সভাঘর, অবনীন্দ্রনাথ সভাঘর ও মুক্তমঞ্চের সরকারি বেসরকারি
অনুষ্ঠানগুলোতে বাচিক শিল্পীদের কণ্ঠে ওঁর কবিতা আবৃত্তি শোনা যায়। শিশুশিল্পীদের
কণ্ঠে ওঁর লেখা ছড়ার গান, ছড়ার নাটিকা ছোটো-বড়োদের মুগ্ধ
করে। যিনি বড়ো বড়ো পুরস্কারে পুরস্কৃত, সেই গুণী মানুষটির
কোথাও কোনোরকম বিন্দুমাত্র অহংকার কিংবা দাম্ভিকতা দেখা তো দূরের কথা, মনে হল আমার পরিবারের অতি নিকট এক আত্নীয়। এত সহজ, সরল,
বিনয়ী, নিপাট ভদ্রলোক মানুষ ইতিপূর্বে আমার
নজরে পড়েনি।
উনি সেইদিন বললেন, “বুধবার ও শুক্রবার করে চলে আসুন কলেজ স্ট্রিটের ঘোষ কেবিনে।
ওখানে অনেক ছড়াকাররা আসে। আড্ডা বসে। অনেক কবি, ছড়াকার ও
সম্পাদকদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাবে। চলে আসুন।”
সেই থেকে শুরু হল ভবানীদার
সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। ওখানে পরিচয় হল অপূর্ব কুণ্ডু, সুখেন্দু মজুমদার, শৈলেন হালদার, দেবাশীষ বসু, তপন দাস, প্রবীর
জানা প্রমুখ একগুচ্ছ ছড়াকারদের সঙ্গে। ভবানীদা যে কত উচ্চ মনের মানুষ, তার পরিচয় পেলাম মাত্র ক’দিনে। সকল কবি-ছড়াকারদের
কাছে থেকে তিনি একরকম উপযাচক হয়ে ছড়া-কবিতা চেয়ে নেন। নিজ দায়িত্বে সেইসব
লেখাগুলো শহরের ও বিভিন্ন জেলার নামি-অনামি পত্রপত্রিকায় ছাপার অক্ষরে প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দেন। এমনকি কচিকাঁচা
দুর্বল লেখাগুলো নিজে ঠিকঠাক করে সেরে পাঠাতেন। অনেকগুলো নামি কাগজের সঙ্গে তখন
ভবানীদা যুক্ত। সেই সুবাদে অনামি কবি-ছড়াকাররা রাতারাতি পরিচিতি হয়ে
যান। এমনকি আমার কাছে থেকে দেখা, শারদীয়া সংখ্যার জন্য
বিভিন্ন কাগজে একটা বড়ো খামে নবীন-প্রবীণদের লেখা নিজ দায়িত্বে পাঠিয়ে দিতেন।
সেসব লেখা ছাপার অক্ষরে বার হত। এমন উদার মনের মানুষটি আমার জীবনে আর দুটি দেখিনি।
বলতে দ্বিধা নেই, আজকে যাঁরা ছড়া লিখে নাম করেছেন, তাঁরা সকলেই একপ্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কাছে
ঋণী। অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই।
একাধিকবার নানান কাজের জন্যে হাওড়ায় শানপুর, দাশনগর
ওঁর বাড়িতে আমায় যেতে হয়েছে। মানুষকে কীভাবে আদর-আপ্যায়ন করতে হয়, ভালোবাসতে হয়—তা খুব কাছে থেকে আমি
দেখেছি। বহু অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে গেছি। দেখেছি ওঁর জনপ্রিয়তা কতখানি।
একবার সল্টলেকের এক বড়ো
অনুষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আমি ওঁকে নিয়ে যাই। মূলত গানবাজনার অনুষ্ঠান ছিল।
এইচ.এম.ভি-খ্যাত জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীরা ছিলেন একাধিক। হল ছিল পরিপূর্ণ। ভবানীদাকে
সেই অনুষ্ঠানে আধঘণ্টা ছড়া-কবিতা বলার জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল। সেদিন হাততালি
আর শ্রোতাদের অনুরোধে হল ফেটে পড়েছিল। দর্শকদের অনুরোধে ভালোবাসার তীব্রতায় আধা
ঘণ্টার জায়গায় প্রায় দু-ঘণ্টার আগে মঞ্চ থেকে নেমে আসতে পারেননি। হাসির ছড়া, মজার ছড়া পাঠ করছেন। আর হল হাসিতে ও হাততালিতে ফেটে পড়ছে।
একইরকম ঘটনা ঘটেছিল আমার
স্কুল বহরু হাইস্কুলের ময়দানে শতবর্ষের অনুষ্ঠানে। শিক্ষকদের একান্ত অনুরোধে
ওখানেও আমি ওঁকে নিয়ে গেছিলাম। স্কুলশিক্ষকরা জানতেন লেখালেখি সূত্রে ওঁর সঙ্গে
আমার ঘনিষ্ঠতা। সেখানেও একইরকম ঘটনা ঘটেছিল। মঞ্চ থেকে ওঁকে নামতে দিচ্ছে না শ্রোতা
বন্ধুরা।
বেহালার এক সর্বজনীন
দুর্গাপুজোর মূর্তি উন্মোচনে ওঁকে একবার আমি নিয়ে গেছিলাম। মূর্তি উন্মোচনের পরে
সেখানেও একরকমই ঘটনা ঘটেছিল। সকলের প্রিয় ছড়াকারকে মঞ্চে পেয়ে কেউ ছাড়তে চায়
না। অনুষ্ঠানের শেষে ভবানীদার অটোগ্ৰাফ ও ফোন নম্বর নিতে ভিড় জমে গেছিল। অনেক
রাতে সেদিন আমরা বাড়ি ফিরেছিলাম।
এমন অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে আমার সঙ্গে ভবানীদার। বলে শেষ হবে
না।
ভবানীদার মধ্যে একটা বিশেষ
গুণ লক্ষ করেছি, ওঁর সমবয়সি কবি-ছড়াকারদের কোনোভাবেই
কাউকে কোনরকম ঈর্ষা বা হিংসা করতেন না। সবার সঙ্গে ছিল সখ্য। একটা কথা ওঁর মুখে
প্রায়ই শুনতাম, ভালো মানুষ না হলে ভালো লেখা যায় না। সবার
আগে ভালো মানুষ হতে হবে। যা আজ বিরল।
আর একটা সুন্দর অনুভূতির
কথা আমার বার বার মনে পড়ে যায়। ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারব না। কত বছর আগেকার কথা, প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর। আমার লেখা গান আকাশবাণী কলকাতা
কেন্দ্র থেকে ‘এ মাসের গান’ ও ‘পুজোর গান’ হিসাবে রেডিওতে সম্প্রচারিত হচ্ছে।
ভবানীদার শুনে সে কি আনন্দ! ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। আমার নানাভাবে তারিফ করছেন,
উৎসাহিত করছেন। এমন বড়ো মাপের মানুষ আমি আর দুটো দেখিনি।
ভবানীদা প্রসঙ্গে আর একটা
কথা না বললেই নয়। খুব মনে পড়ে। কলেজ স্ট্রিটে একটা নির্দিষ্ট তেলেভাজার দোকান
ছিল। সেই দোকানের বেগুনি খেতে ভবানীদা খুব ভালোবাসতেন। সত্যি কথা বলতে কী, রসগোল্লা-রাবড়ির চেয়ে ভবানীদার প্রিয় ছিল তেলেভাজা আর
মুড়ি। আমরা কয়েকজন মিলে প্রায় প্রতি শুক্রবার বেঞ্চির ওপর বসে মুড়ি-বেগুনি
খেতে খেতে নির্মল আড্ডা দিতাম। সেই আড্ডার মধ্যমণি থাকতেন ভবানীদা। মানে
শিশুসাহিত্যিক ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। সেসব সোনালি দিন আর কখনও ফিরে আসবে না।
ভবানীদা এখন শারীরিকভাবে
বেশ অসুস্থ। কষ্ট হয় খুব। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, ভবানীদা যেন সুস্থ থাকেন। ভালো থাকেন।