ময়লার বালতিটা
কর্পোরেশনের গাড়িতে উপুড় করে ঢেলে আধ মিনিট দাঁড়িয়েছিল ভারতী। পাশের বাড়ির ঝিন্টিও
এসেছিল ময়লা ফেলতে। দুটো চারটে কথা বলেই ফের বাড়িতে ঢুকে দরজা আটকে দিয়েছিল ভারতী।
রুকু তখন মন দিয়ে ওর মায়ের কিনে দেওয়া জাম্বো কালারিং বুক নিয়ে রঙ করছিল।
ভারতী রুকুদের
বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টা থাকে। রুকুকে দেখাশোনা করাটাই ওর মূল কাজ। কারণ রুকুর বাবা
অরিজিৎ আর মা তমালি চাকরি করে।
রুকু নার্সারিতে
পড়ে। সকাল আটটায় স্কুলে যায় আর এগারোটার সময় চলে আসে। বাকি সারাটা দিন ও ভারতীর
কাছেই থাকে। সন্ধে হলে আগে ওর মা বাড়ি ফেরে, তার বেশ খানিক বাদে ওর বাবা ফেরে।
ভারতীর কাছে
থাকতে রুকুর কোনো অসুবিধে হয় না। রুকুর
ভালো মতনই যত্ন করে ভারতী। সাড়ে তিন বছর বয়েস তার। একটু চঞ্চল আর সেটাই তো
স্বাভাবিক। স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতেই থাকে। ছুটির দিনে মা বাবার সঙ্গে বেড়াতে যায়
রুকু।
জঞ্জাল ফেলে
বাড়িতে ঢুকে ভারতী দরজা আটকে রুকু যে ঘরে বসে ছবি রঙ করছিল, সেখানে ঢুকে দেখল রুকু নেই। বই, রঙ পেন্সিল সব ছড়িয়ে পড়ে আছে। ভারতী ডাক দিল,
'রুকু, রুকুসোনা, কোথায় তুমি?
এসো, চান করতে হবে।' ভারতী বেশ কয়েকবার ডেকেও রুকুর সাড়া পেল না। এ
ঘর, ও ঘর বারান্দা খুঁজেও
রুকুর দেখা না পেয়ে একটু ঘাবড়েই গেল ভারতী। 'রুকু,
রুকু, রুকু... বেশ জোরে জোরে ডাকতে থাকল ভারতী,
সঙ্গে চলল উঁকিঝুঁকি মেরে
খোঁজা।
একতলায় কোথাও নেই
রুকু। মহা চিন্তায় পড়ে গেল ভারতী। 'গেলো কোথায়
ছেলেটা।' নিজেই বিড়বিড়
করতে করতে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল ভারতী।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে
ডানদিকে ঠাকুর ঘর আর বাঁদিকে ছাদের দরজা। ছাদের দরজা বন্ধ। তাহলে রুকু কি... ভাবতে ভাবতেই মিহি স্বরের 'মিঁউ' ডাক কানে এলো ভারতীর। ঠাকুর ঘরের ভেজানো দরজাটা ঠেলা দিয়ে খুলতেই ভারতী দেখতে
পেল রুকুকে। ছোট্ট সাদা-খয়েরি বেড়ালছানা কোলে নিয়ে সিংহাসনের পাশে গুটিসুটি মেরে
বসে আছে।
ভারতীকে দেখেই
শুকনো মুখে বলে উঠল, 'না, আমি ওকে দেব না। ও আমার বন্ধু।'
এতক্ষণের চাপা
ভয়টা চলে যেতেই হেসে ফেলল ভারতী। 'ওকে কোথায় পেলে?'
'ওই সামনের
রাস্তায় ছিল।'
'তুমি রাস্তায়
বেরিয়েছিলে নাকি? অ্যাঁ? 'অবাক হয়ে জিগ্যেস করল ভারতী।'
না, আমি গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, গাবলুই আমার কাছে এলো।'
'গেটের কাছে
দাঁড়িয়েছিলে মানে? কখন?' গেট খোলা রাখা মানা তাই ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল
ভারতী।
'তুমি ময়লা ফেলতে
গেছিলে, তখন।' রুকুর গলার স্বর খাদে। ও জানে সামনে বিপদ অনেক।
একে তো রুকু একা গেটের কাছে গেছে, তার ওপর
বেড়ালছানা ঢুকিয়েছে বাড়িতে। ভারতীদিদি বলে দিলেই মা একেবারে তেড়ে আসবে। বাবাও
বকবে- ভেবেই মুখ ছোট হয়ে যায় রুকুর।
'তুমি মা বাবাকে বলে দেবে
না তো?' রুকু করুণ মুখে জিগ্যেস
করে। বেড়ালছানা কী বুঝল কে জানে, ডেকে উঠল মিয়াঁউ।
রুকু দুহাত দিয়ে আর একটু জাপটে ধরল ছানাটাকে, যার নাম ও দিয়েছে গাবলু।
'দেখো রুকুসোনা,
তোমার বাবা মা জানতে
পারলে তোমাকে তো বকবেই, তার থেকে বেশি
বকবে আমাকে। তুমি কি চাও আমি বকা খাই?'
দুদিকে মাথা নেড়ে
রুকু বোঝায় যে ও সেটা চায় না। তারপর যখন তাকায় ভারতীর দিকে তখন ওর চোখ ভর্তি জল।
মায়া লাগে ভারতীর। বেড়ালছানাটাও কেমন লেপ্টে আছে রুকুর গায়ে।
ভারতী বলে,
'আচ্ছা রুকু, এখন তুমি ওকে মাটিতে নামিয়ে দাও, রাস্তায় ছিল তো, ওর গায়ে অনেক ধুলো তোমার শরীর খারাপ হবে।'
'তুমি ওকে বাইরে
বের করে দেবে না তো?' কাঁদো কাঁদো হয়ে
জিগ্যেস করে রুকু।
'আমি বের করে না
দিলেও দাদা বৌদি দেখলেই ওকে বের করে দেবে। তুমি ওকে নামাও মাটিতে। চলো, তোমার হাত ধুয়ে দিই সাবান দিয়ে। জামাও ছেড়ে
ফেলো।'
ছানাটাকে মাটিতে
নামাতেই সে মিয়াঁউ মিয়াঁউ করে রুকুর পায়ের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ভারতী রুকুর হাত
ধরে টেনে নিয়ে গেল বেসিনের দিকে। রুকুর গাবলুও পেছন পেছন আসতে লাগল। রুকু পেছনে
ফিরে গাবলুকে দেখতে দেখতে সামনে হাঁটতে লাগল।
'ভারতীদিদি,
গাবলুকে কোথায় লুকিয়ে
রাখব বলো না গো। মা আসার আগেই লুকিয়ে রাখতে হবে।'
'আমি জানি না বাবা,
ওকে লুকিয়ে রাখলে কি হবে?
ও তো ডাকবে, তখনই বৌদি বুঝতে পেরে যাবে। তারপর আমি যা বকা
খাব সে আর বলার নয়।'
'তাহলে?' ছলছল চোখে জিগ্যেস করে রুকু।
'মিয়াঁউ'...
গাবলু চলে এসেছে ডাইনিং
হলে। খুশিতে ঝলমল করে ওঠে রুকুর চোখমুখ। 'দেখেছ ভারতীদিদি, গাবলু কেমন আমাকে
ভালোবেসে ফেলেছে, আমি যেখানে
যাচ্ছি, ও সেখানেই চলে আসছে।‘
'মিয়াঁউ মিয়াঁউ
মিয়াঁউ... লেজ ওপর দিকে তুলে একটানা ডেকে চলেছে গাবলু।
'ও এত ডাকছে কেন
ভারতীদিদি? ওর কি খিদে
পেয়েছে?'
'তা পেতে পারে।'
'ওকে একটু খেতে
দাও না। ও ভারতীদিদি...।'
'রুকুসোনা,
কেন শুধু শুধু মায়া
বাড়াচ্ছ। ওকে তো রাখতে পারবে না তুমি। বেশি আহ্লাদ পেলে ও আর যেতেই চাইবে না,
কিন্তু দাদা বৌদি জোর
করেই বের করে দেবে। তখন তোমাত কত মন খারাপ হবে বলো তো?'
'দাও না একটু
খেতে। ' রুকুর কথা শুনে ভারতী
বুঝল, ওর কথা গ্রাহ্যই করছে না
রুকু। যা হবে দেখা যাবে ভেবে ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে একটা বাটিতে খানিকটা ঢেলে
মাইক্রো আভেনে সামান্য গরম করে ছানার সামনে দিতেই চুকচুক করে খেতে শুরু করল সে।
হাততালি দিয়ে
রুকু বলে উঠল, 'দেখো দেখো
ভারতীদিদি, গাবলু কেমন
খাচ্ছে, ওর খুব খিদে পেয়েছিল।
সারাটা দুপুর
রুকু খেলা করল গাবলুর সঙ্গে। ভারতী নজর রাখল যাতে বেড়ালের লোম রুকুর মুখে না যায়।
বিকেল পৌনে ছটা
বাজে। রুকুর মা তমালির অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। গাবলুকে কোথায় লুকোবে সেই
চিন্তায় পড়ে গেছে রুকু। নানা জায়গায় লুকোবার কথা বলছে আর ভারতী বোঝাচ্ছে সেখানে
রাখার কী অসুবিধে।
'ও ভারতীদিদি,
বলো না গাবলুকে কোথায়
লুকোব।' রুকুর অবস্থা দেখে মায়া
লাগল ভারতীর। পুরনো একটা জুতোর বাক্স জোগাড় করে এনে, তার মধ্যে ছেঁড়া তোয়ালে ভাঁজ করে দিয়ে তার ভেতর
গাবলুকে বসিয়ে দিল ভারতী। গুটিসুটি মেরে আরাম করে বসল বেড়ালছানা।
জুতোর বাক্সটা
নিয়ে সিঁড়ির তলায় একদম ভেতর দিক করে রেখে দিয়ে বাক্সটা ঢাকা দিয়ে দিল। সামান্য
একটু ফাঁক রেখে দিল যাতে নিশ্বাস নিতে অসুবিধে না হয়।
খানিক বাদেই বেল
বাজল। অন্যদিন তমালির বেল শুনে খুশি হয় রুকু। আজ কিন্তু একটু মিইয়ে গেল। শুকনো
মুখে বলল, 'মা এসেছে।'
ভারতী গিয়ে দরজা খুলে
দিল।
ঘরে ঢুকে তমালি
দেখল রুকু পাজল গেম খেলছে। অন্যদিন যেমন 'মা' বলে আনন্দ প্রকাশ করে,
আজ তেমনটা করল না।
ভারতীর দিকে
তাকিয়ে তমালি নিচু গলায় জিগ্যেস করল, 'রুকুর শরীর ঠিক আছে তো?' ভারতী মাথা নেড়ে
বলল, 'হ্যাঁ বৌদি।' তারপর চোখের ইশারায় রান্নাঘরে যেতে বলল
তমালিকে।
রান্নাঘরে তমালি
যেতেই সকাল থেকে যা যা ঘটেছে, সব বলল ভারতী।
রুকু ভয়ে আছে যে ওর গাবলুকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, এই ভেবে। বেড়ালছানাটা কোথায় আছে তাও বলে দিল
ভারতী।
ফ্রেশ হয়ে রুকুর
কাছে গিয়ে বসল তমালি। 'কি বানালি দেখি? আরেব্বাস,
এতো তাজমহল, তাই না?' ঘাড় নেড়ে সায় দিল রুকু। তমালি দেখল রুকুর
মুখখানা শুকিয়ে ছোট হয়ে আছে।
রুকুর গাল টিপে
আদর করে তমালি জিগ্যেস করল, 'বেড়ালের বাচ্চা
এনেছিস?'
ভ্যাঁ করে কেঁদে
ফেলে রুকু বলল, 'আমি আনিনি,
গাবলু নিজে নিজে এসেছে।'
চেয়ার থেকে উঠে রুকুকে
জড়িয়ে ধরে তমালি বলল, 'কাঁদছিস কেন বোকা
ছেলে, আমি কি বকেছি তোকে?'
'তুমি ওকে তাড়িয়ে
দেবে মা?'
'রুকু, তুই বরং আজ ভারতীর সঙ্গে ওদের বাড়িতে চলে যা।
এখন থেকে ওখানেই থাকবি।'
মায়ের কথা শুনে
থতমত খেয়ে যায় রুকু। কীসব বলছে মা!
কান্না থামিয়ে বড় বড় চোখ করে তমালির দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
'কেন, পারবি না থাকতে?'
'না,' বলে আবার কাঁদতে শুরু করে রুকু। তমালি বলে,
'ভারতী, রুকু তোর কাছে থাকলে ওকে যত্ন করে রাখবি তো?'
'হ্যাঁ বৌদি।'
কিছু না বুঝেই জবাব দেয়
ভারতী।
'না, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।' মাকে জাপ্টে ধরে রুকু বলে।
'কিন্তু তুই তো
গাবলুকে ওর মায়ের থেকে আলাদা করে দিয়েছিস রুকু। ওরও তো মায়ের জন্যে কষ্ট হচ্ছে।
দেখগে যা, ওর মা-ও ওকে
খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছোট বাচ্চাকে এরকম কষ্ট দেওয়া কি ঠিক?'
ভ্যাবলার মতো
তমালির দিকে তাকিয়ে থেকে রুকু বলে, 'গাবলুকে ওর মার কাছে দিয়ে দাও মা। ও মিঁউ মিঁউ করে বলছিল, আমি বুঝতে পারিনি। আর কোনোদিন আমি এমন কাজ করব
না।'
তমালি রুকুকে আদর করে বলল, 'সোনা ছেলে, কেমন সুন্দর বুঝে গেলো! ভেরি ভেরি গুড বয়। 'এরপর ভারতীর দিকে ফিরে বলল, 'বাড়ি যাবার সময় বাচ্চাটাকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে
যাস, কেমন?'
'আচ্ছা বৌদি।'
হাসিমুখে বলল ভারতী। এত
সহজে ব্যাপারটা মিটে যাবে ভাবেনি ও। বৌদি খুব চালাক, কেমন সুন্দর করে বলল। বেচারা রুকু।
হঠাৎই রুকু
প্রশ্ন করে, ' মা, অরিত্রদের বাড়িতে যে কুকুরবাচ্চাটা আছে,
ওর মা কাঁদছে না?'
রুকুর আচমকা
প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যায় তমালি। চট করে ভেবে নিয়ে বলে, 'অরিত্ররা ওর মায়ের পারমিশন নিয়ে ওকে এনেছে। তাই
ওর মা কাঁদে না।'
কিছু সময় চুপ করে
থেকে রুকু বলে, 'আমরাও গাবলুর
মায়ের পারমিশন নিতে পারি মা?'
'হুঁ, পারি। তবে আরও ছোট অবস্থায় আনলে সেটা হতো। এখন
গাবলু একটু বড় হয়ে গেছে বলে প্রবলেম। বুঝেছিস? তুই আর একটু বড় হয়ে নে, আমরা একটা ছোট্ট কুকুরছানা আনব।'
'না, আমি গাবলুকেই চাই। ওকেই এনে দিও।'
'তুই বড় হলে
গাবলুও তো বড় হয়ে যাবে। তখন কি আর ওকে তোর ভালো লাগবে? তাছাড়া বেড়ালরা একটু দুষ্টু হয়।'
'কি দুষ্টুমি করে
মা?' তমালি বোঝে, রিকুর প্রশ্ন আজ শেষ হবে না। ওর মনটাকে ঘোরাতে
হবে অন্যদিকে।
'রুকুবাবু,
তুই কি ভুলে গেছিস কাল
খ্রিস্টমাস, যীশুর জন্মদিন!
খ্রিস্টমাস ট্রি সাজাতে হবে তো! বাবা অফিস থেকে ফেরার সময়ে কেক নিয়ে আসবে। চল,
চল, সব বের করে ফেলি।'
'ইয়ে এ এ...'
আনন্দে লাফিয়ে ওঠে রুকু।
গাবলুর জন্য ওর মনেই ছিল না যে কাল খ্রিস্টমাস!
উৎসাহের সঙ্গে
তমালি আর রুকু মিলে সাজিয়ে ফেলল খ্রিস্টমাস ট্রি। এ-র মধ্যে অরিজিতও অফিস থেকে চলে
এসেছে বেশ বড় একটা কেক নিয়ে। কাল খুব মজা হবে।
আজ রুকুকে ঘুম
থেকে ডেকে দিয়ে তমালি বলল, 'মেরি খ্রিস্টমাস!'
অন্যদিন একটু কাঁইকুঁই
করলেও, আজ তড়াক করে উঠে পড়ল
রুকু। আজ ব্রেকফাস্টে কেক! কি মজা!
দাঁত মেজে ডাইনিং
টেবিলে আসতেই রুকু দেখল বাবা বসে খবরের
কাগজ পড়ছে। আজ সবার ছুটি। ভারতীদিদিও এসে গেছে। রুকু বলে উঠল, 'মেরি খ্রিস্টমাস!' বাকিরাও বলল মেরি খ্রিস্টমাস। বাইরে থেকে আওয়াজ
এল 'মিয়াঁও!'