ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

 পলাতকের খোঁজে











সৈয়দ রেজাউল করিম
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ




 

।। পর্ব : এক ।।

গঙ্গাসাগরে পলাতক

          

শীতকাল। 'দিন ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। সামনে পড়ে আছে এখনো গোটা মাঘ মাস। পৌষ মাস শেষ হতে এখনো তিন দিন বাকি। এর মধ্যে হই হই, রই রই পড়ে গেছে গঙ্গাসাগরে। নাগা সন্ন্যাসীরা চলে এসেছে দশ দিন আগে। পুণ্যার্থীরা পুণ্য অর্জনের আশায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রমাগত চলে আসছেন গঙ্গাসাগরে। থানা পুলিশ, ডাক্তার, ফায়ার বিগ্রেট ইতিমধ্যে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। দোকানিরা তাদের দোকানপাট সব সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে। এক এক করে তিলত্তমার সাজে সজ্জিত হয়ে উঠছে গঙ্গা সাগরের মেলা।

জীবনের সমস্ত কিছু পাপ ধুয়ে মুছে ফেলতে গঙ্গাসাগরের জুড়ি নেই কোথাও। তাই এত লোকের আনাগোনা। লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত। কেউ আসে বেচতে। কেউ আসে কিনতে। কেউ আসে আনন্দ উপভোগ করতে। কেউ আসে পূণ্য সঞ্চয় করতে। আবার কেউ কেউ আসে পাপের স্খলন করতে।

       এখন গঙ্গাসাগরের যাতায়াতের অনেক সুবিধে হয়েছে। পুণ্যার্থীদের জন্য শিয়ালদা থেকে ট্রেনে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এসপ্ল্যানেড ও অন্যান্য জায়গা থেকে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের লোক খুব অল্পদিনের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে গঙ্গাসাগরে। কিন্তু কয়েক দশক আগে তা হবার ছিল না। কারণ তখন না ছিল ভাল রেলপথ, না ছিল সড়কপথ, না ছিল আকাশপথ। ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে, অথবা জলযানে যেতে হতো। তাই মানুষজনের কাছে গঙ্গাসাগর ছিল অধরা। সেখানে পৌঁছতে হলে প্রস্তুতি নিতে হতো অনেকদিন আগে থেকে। পথে-ঘাটে কেউ কেউ মারা যেত, আবার কেউ কেউ গঙ্গা স্নান করে হাসিমুখে বাড়ি ফিরত। তাই শ্লোগানের মত প্রবাদ বাক্যটা ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। 'সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার'।

গঙ্গাসাগরের মন্দিরটাকে ঘিরে সাগরমেলার প্রসারতা। চারদিকে তার ব্যক্তি এক-দু' কিলোমিটার। চারদিক থেকে বড় বড় রাস্তা এসে মিলেছে মন্দিরের মাঠে। মন্দিরের বামপাশে নাগা সন্ন্যাসীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট হোগলার ঘর। সামনে দিগন্তবিস্তৃত গঙ্গা নদী। শুধু জল আর জল। ওপারের কোন কিছু নজরে আসে না। জোয়ারের ঢেউ এসে ধীরে ধীরে গ্রাস করে বিস্তীর্ণ বালুকাভূমি। পৌষ সংক্রান্তির দিন খুব ভোরে উঠে গঙ্গাস্নান করে সূর্য প্রণাম জানিয়ে মন্দিরে পূজা দেয় পুণ্যার্থীরা। মন্দিরটি কপিলমুনির মন্দির নামে খ্যাত। জায়গাটি কপিল মুনির আশ্রম হিসেবে পরিচিত। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল কে এই কপিলমুনি ?

পুরাণ মতে কপিলমুনি ছিলেন ঋষি কারদম ও দক্ষকন্যা দেবাহুতির সন্তান। ছেলে জন্মাবার পর তপস্যা করতে ঋষি কারদম চলে যান জঙ্গলে। বড় হয়ে শঙ্খযোগ শিখে ধ্যানে বসেন কপিলমুনি। এই গঙ্গাসাগরে।

প্রাচীনকালে হরিশচন্দ্র বংশের সগর নামে এক বিখ্যাত রাজা রাজত্ব করতেন অযোধ্যায়। তাঁর দুই স্ত্রী। কেশিনী আর সুমতি। পরাক্রমশালী সাগর রাজার সুশাসনে দেশের সর্বত্র সুখ-শান্তি বিরাজ করত। কিন্তু রাজার মনে ছিলনা কোন সুখ-শান্তি। কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই সন্তান লাভের আশায় একসময় রাজ্যপাট ছেড়ে দুই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে ধ্যানে বসলেন। তাঁর ধ্যানে তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে বর দিলেন। সেই বরে দুই রানী একই সময়ে সন্তানসম্ভবা হলেন । তা শুনে খুব খুশি হলেন সগর রাজা।

যথাসময়ে বড় রানী কেশিনীর এক পুত্র সন্তান হল। কিন্তু ছোটরাণী সুমতি প্রসব করল একটি লাউ। সেই লাউ দেখে সগর রাজার মাথা গেল বিগড়ে। তিনি লাউটা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতে গেলেন। ঠিক সেই সময় তিনি শুনতে পেলেন এক দৈববাণী। 'মহারাজ! ওটাকে ফেলে দিওনা। ঘিয়ের কলসির মধ্যে রেখে দাও। ওরাও হবে তোমার পুত্র সন্তান।

মহাদেবের আদেশ মত সেই লাউ ঘিয়ের কলসির মধ্যে রেখে দিলেন সগর রাজা। সত্যই সেই লাউয়ের বিচি থেকে জন্ম নিল তাঁর ষাট হাজার সন্তান। সেই সন্তানেরা যত বড় হতে থাকল, ততই অসুরের মত শক্তিধর হয়ে উঠল। আর ততই সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেল তাদের। সেই ভয়ঙ্কর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল সাধারন মানুষজন।

তারা সমবেতভাবে একদিন হাজির হল ব্রম্ভার কাছে।করজোড়ে তারা প্রার্থনা জানাল--প্রভু! আপনি আমাদের উদ্ধার করুন। বাঁচান। সগর রাজার ষাট হাজার পুত্র আমাদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার করছে। অবিচার করছে। আমাদেরকে বিনা অপরাধে নিদারুণভাবে প্রহার করছে।

ব্রম্ভা চোখ মুদে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর নয়ন মেলে আশ্বস্ত করতে তাদের বললেন-- শীঘ্রই ওরা ওদের স্বভাব দোষের সাজা পাবে।

কিন্তু সে সাজা কবে পাবে, তার কোনো ঠিক- ঠিকানা ছিল না। অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া আর অন্য গতি ছিলনা তাদের। তবে ষাট হাজার ষন্ডা-গুন্ডা পুত্র পেয়ে সগর রাজা খুব গর্বিত ছিলেন। তিনি এক সময় ভাবলেন, এটাই উপযুক্ত সময় সমস্ত রাজ্য জয় করার। কিন্তু তা তো এক-দু'দিনে সম্ভবপর নয়। তবে অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে তা সম্ভবপর হতে পারে। একথা ভেবে অচিরেই তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। ঘোড়ার কপালে জয়পতাকা লিখে ছেড়ে দিলেন। ষাট হাজার পুত্রকে নির্দেশ দিলেন, কোথাও ঘোড়া বাধাপ্রাপ্ত হলে, সেই রাজার বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করবে। তাকে পরাজিত করে বশ্যতা স্বীকার করাতে হবে।

রাজার আদেশ পেয়ে ঘোড়ার পিছনে পুত্ররা বেরিয়ে পড়লেন। সগর রাজা অপেক্ষায় থাকলেন কবে দেশ বিদেশ ঘুরে ঘোড়াটা ফিরে আসবে। ঘোড়া ফিরে এলে ঘোড়ার মাংস দিয়ে যজ্ঞ করে ইন্দ্রত্ব লাভ করবেন।

সগররাজার এই যজ্ঞের আয়োজন দেখে খুব ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন ইন্দ্র। তিনি চিন্তা করে দেখলেন। সগররাজা যদি রাজ চক্রবর্তী হয়ে পুরো স্বর্গটা চেয়ে বসেন, তাহলে তাদের গতি কি হবে? তাই তিনি ফন্দি করে যজ্ঞের ঘোড়াটি বেঁধে রেখে এলেন কপিল মুনির আশ্রমে।

হঠা চোখের সামনে থেকে যজ্ঞের ঘোড়াটা উধাও হয়ে যেতে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন সগর রাজার ষাট হাজার পুত্র। খোঁজখবর নিয়ে তাঁরা জানতে পারলেন, তাদের যজ্ঞের ঘোড়াটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাতালে। তখন তারা মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে পৌঁছে গেলেন সেই পাতালে। কপিল মুনির আশ্রমের কাছে যজ্ঞের ঘোড়াটা বাঁধা আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তাঁরা। সেইসাথে তারা চিন্তা করে নিলেন, কপিলমুনি নিশ্চয়ই তাদের যজ্ঞের ঘোড়াটা চুরি করে নিয়ে এসে বেঁধে রেখেছেন। তাই তারা খেপে গিয়ে মুনিকে গালিগালাজ দিতে শুরু করলেন। এমন কি মারধর করতেও দ্বিধা করলেন না। কপিলমুনি  বললেন- আমি ধ্যানে মগ্ন ছিলাম। আমি এর বিন্দু বিসর্গ কিছু জানিনা। এখানে কে এসে বেঁধে রেখে গেছে ঘোড়াটা!

কিন্তু তা মানতে নারাজ সগর রাজার পুত্ররা। তখন কপিলমুনি চোখ মেলে ক্রোধের সাথে তাকিয়ে দেখলেন তাঁদের দিকে। সেই ক্রোধাগ্নিতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সগর রাজার ষাট হাজার পুত্র।

পুত্রদের ভষ্ম হয়ে যাওয়ার খবর সগর রাজার কাছে পৌঁছল একটু দেরিতে। সব শুনে সগর রাজা তার পৌত্র অংশুমানকে পাঠালেন সাগরদ্বীপে। কপিল মুনির আশ্রমে গিয়ে করজোড়ে তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন অংশুমান। তাঁর করুণ প্রার্থনায় খুব সন্তুষ্ট হয়ে কপিলমুনি তাঁকে দুটো বর চেয়ে নিতে বললেন।

প্রথম বরে অংশুমান চাইলেন তাদের যজ্ঞাশ্ব ফিরে পেতে। দ্বিতীয় বরে চাইলেন সগর পুত্রদের প্রাণ ফিরে পেতে। জবাব শুনে মৃদু হাসলেন কপিলমুনি। যজ্ঞাশ্ব ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন- অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করো। কিন্তু তোমার পিতৃগণের পরিত্রাণের সময় হয়নি এখনো। তাদের উদ্ধার করবে তোমার পৌত্র। শিবকে সন্তুষ্ট করে সুরধ্বনি গঙ্গাকে সে নিয়ে আসবে স্বর্গ থেকে। তাঁর পূণ্য স্পর্শে মুক্তি পাবে তারা। গমন করবে বৈকুন্ঠে।

অগত্যা যজ্ঞাশ্ব নিয়ে রাজদরবারে ফিরলেন অংশুমান। পৌত্রের মুখে সব শুনে সগর রাজা মনে মনে কিছুটা তৃপ্ত হলেন। ধুমধাম করে অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ করলেন। তারপর পৌত্র অংশুমানের হাতে রাজ্য সমর্পন করে বনবাসী হলেন তিনি। অংশুমানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দিলীপ হলেন রাজা। তারপর তাঁর পুত্র ভগীরথ হলেন রাজা। ভগীরথ তাঁর মন্ত্রীর হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে চলে গেলেন হিমালয়ে।বসলেন তপস্যায়। দেখতে দেখতে হাজারটা বছর কেটে গেল। অবশেষে সন্তুষ্ট হলেন গঙ্গাদেবী। তপস্যার কারণ শুনে তিনি বললেন- আমি তোমার সঙ্গে মর্তে ও পাতালে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু আমাকে ধারণ করবে কে?

শিবই একমাত্র ধারণ করতে পারে, সে কথা গঙ্গাদেবীর কাছে শুনে ভগীরথ চলে গেলেন কৈলাসে। তপস্যায় তুষ্ট করলেন শিবকে। তিনি তাকে আশ্বস্ত করলেন। গঙ্গা এলো মর্তে। শিবের জটায়। গঙ্গা বললেন- তোমার জন্য মর্তে এসেছি আমি। আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো কপিল মুনির আশ্রমে।

সকল বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে ভগীরথ পতিতপাবনী গঙ্গাকে নিয়ে এলেন কপিল মুনির আশ্রমে। গঙ্গার পূণ্য স্পর্শে মুক্তি পেলেন সগররাজার সব পুত্ররা। তাই আজও ভক্ত মানুষজন বিশ্বাস করে, গঙ্গাসাগরের পূণ্যজলে নির্দিষ্ট দিনে অবগাহন করলে জীবনের সমস্ত অপরাধ, পাপ কর্ম, ধুয়ে যায়। পবিত্র হয়ে ওঠে মানুষজন। তাই মানুষ ছুটে আসে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। আর গঙ্গাসাগর ক্রমশঃ মহয়ে উঠেছে এক মহামিলনের মেলা। মহান তীর্থভূমি।

কপিল মুনির মন্দির থেকে সোজা চওড়া যে রাস্তাটা সরাসরি সাগরঘাটে মিশেছে, তার ডান পাশে বিরাট জায়গা জুড়ে যে দোকানটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, ওটি গোবিন্দ আগরওয়ালের দোকান। গোবিন্দ আগরওয়াল গড়িয়াহাটের একজন নামকরা ব্যবসায়ী। সারা রাজ্য জুড়ে তার কাপড়ের কারবার। গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, মোজা, শাড়ি ইত্যাদি তৈরি করার কয়েকটা ইন্ডাস্ট্রি আছে তার। ব্যবসা করার জন্য সাগরমেলায় তার না এলও চলে। তবুও বিগত দশ বছর ধরে মেলায় দোকান নিয়ে আসে গোবিন্দ। ধর্ম কর্ম দুটোই করে তবেই সে বাড়ি ফেরে।

প্রতিবারের মত জনা পঁচিশ লোকজন সঙ্গে নিয়ে এসেছে গোবিন্দ। থাকার জায়গা থেকে শুরু করে দোকানপাট সাজানো, রান্নাবান্না করা, এসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল সকলে। গোবিন্দ সবকিছু দেখাশোনা করছিল। এমন সময় তার কানে এলো--গঙ্গা মাঈ কি জয়।

সেই জয়ধ্বনিতে চমকে উঠল গোবিন্দ। এই পড়ন্ত বিকেলবেলায় তার দোকানে আবার কে এলো? কাজ করতে করতে আড় চোখে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক সাধু মহারাজ। মাথায় জট পাকানো বড় বড় চুল। মুখে লম্বা কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফ। পরনে গেরুয়া বসন। হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা। হাতে গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। এক হাতে ছোট্ট মাটির লোটা। কাঁধে একখানা কম্বল। পিঠে বাঁধা ছোট্ট একটা পুঁটলি।

দেবদেবী সাধুসন্তের প্রতি গোবিন্দর অগাধ বিশ্বাস। তারা ইচ্ছা করলে সবকিছু করতে পারে। বাবা যদি মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে, তাহলে এই মেলায় প্রচুর লাভ করতে পারবে। এটাই তার বিশ্বাস। গোবিন্দ তাই তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বার হয়ে সাধুবাবাজিকে প্রণাম করল। করজোড়ে বলল- ভিতরে আসুন বাবাঠাকুর! কিছু জলযোগ করে যান।

সাধুবাবাজী অতি সন্তর্পনে ঢুকলেন দোকানে। গোবিন্দ তাড়াতাড়ি একটা টুল টেনে নিজের ঘাড়ে রাখা গামছাটা দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিল। সাধুবাবাজী বসলেন তাতে। ক্যাশবাক্স থেকে টাকা বার করে কর্মচারীর হাতে দিয়ে গোবিন্দ বলল-সাধুবাবার জন্য কিছু জলখাবার নিয়ে এসো।

কর্মচারী ছুটল খাবার আনতে।

গোবিন্দ শুধালো- বাবাজী! আপনার নিবাস কোথায়?

প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলেন সাধুবাবাজী। হঠা এ প্রশ্ন কেন? তবে কি গোবিন্দ তাকে সন্দেহ করছে? তার আগমন বার্তা কি তাহলে টের পেয়ে গেছে? পথে আসার সময় সাধুবাবাজী লক্ষ্য করে দেখেছেন বিভিন্ন জায়গায় তার ছেলেবেলাকার একটা ছবি সেঁটে দিয়েছে পুলিশ। ধরে দিতে পারলে লাখ টাকার পুরস্কার দেবে বলে ঘোষণা করেছে। তবে স্বস্তির বিষয় একটাই। সেটা তার বয়স এবং আকার-আকৃতির আমূল পরিবর্তন। যার জন্য এত সহজে তাকে চিনতে পারবেনা কেউ। সঠিক ব্যাপারটা বোঝার জন্য তাই সাধুবাবাজী গোবিন্দকে শুধালেন-- কিঁউ ব্যাটা ! এ্যায়সা পুঁছ রাহি হো ?

গোবিন্দ বলল- সেরকম কিছু নয় বাবা! আমাদের রাজস্থানের লোকজন একটু বেশি সাধুসন্ন্যাসী হয়ে জীবন যাপন করে। তাই ভাবছিলাম, আপনি রাজস্থানের লোক কিনা। তবে এমনি আপনার মুখ দেখলে বাঙালি বলে মনে হয়।

সেইসময় ঠোঙাতে করে জিলিপি, সিঙাড়া নিয়ে এল গোবিন্দর কর্মচারী। গোবিন্দ তাড়াতাড়ি একটা প্লেট বার করে ধুয়ে মুছে খাবারগুলো সাজিয়ে সাধুবাবাজীকে খেতে দিল। সাধুবাবাজীর বোধহয় খুব খিদে পেয়েছিল।গোগ্রাসে তা খাওয়া শুরু করে দিলেন। অবাক নয়নে গোকুল তা পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। হঠা সাধুবাবাজীর নজর গিয়ে পড়ল সামনের দোকানের দিকে। এখানেও রাউত সাহেবের লোকেরা সেঁটে দিয়ে গেছে তার সেই পোস্টার।

রাউত সাহেবকে কোনদিন স্বচক্ষে দেখেননি সাধু বাবাজী। দেখেননি অনুজ ভার্মাকেও। কোনদিন সরাসরি সাক্ষা হয় নি সি.আই.ডি-র ডি.এস.পি. অলোক মিত্রের সঙ্গেও। তবে তাদের ছবি দেখেছে বিভিন্ন খবরের কাগজে। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তাদের কার্যকলাপ। তাদের অসামান্য ক্ষুরধার বুদ্ধি। কে জানে, এখানেও সেরকম কোন ফাঁদ পেতে রেখেছে কিনা? একবার তাকে ধরতে পারলে সারা জীবনের জন্য জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়বে। তবে যতীন দারোগা অনেক মাটির মানুষ। মাটির সাথে তার যোগাযোগ। মাটির মানুষের সাথে তার সম্বন্ধ। তিনি সেদিন না থাকলে….. কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়লেন সাধুবাবাজী। কিন্তু তখনও তার দৃষ্টি পড়েছিল সেই পোস্টারের দিকে।

-ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছেন বাবাজী? উসুক হয়ে জানতে চাইল গোবিন্দ।

তার প্রশ্নবানে ঘোর কাটল সাধুবাবাজীর। একটু অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফেরালেন তিনি।অজানার ভাব দেখিয়ে গোবিন্দকে শুধালেন-- পোস্টার মে কেয়া লিখা হে ব্যাটা?

-ওতে একটা ডাকাতের কথা লেখা আছে বাবাজী! পলাতক ডাকাতের কথা। ব্যাটাকে আজ পঁচিশ বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে সাহেবরা। এই পঁচিশ বছরে সে বহু ডাকাতি করেছে, বহু লুটপাট করেছে, অনেক খুন করেছে। এই গঙ্গাসাগর মেলাতে সে নাকি দলবল নিয়ে এসেছে ডাকাতি করতে। মন্দিরের টাকাপয়সা, সোনাদানা লুট করতে। একথা পুলিশ প্রশাসন জানতে পেরেছে। তারাও এসেছে সেজেগুজে, তাকে হাতেনাতে ধরবে বলে। শুধু তাই নয়, একটা বড় পুরস্কারের কথাও ঘোষণা করেছে। যারা পলাতক ডাকু ধরে দিতে পারবে, তাদের নগদ এক লাখ টাকা পুরস্কার দেবে সরকার। চাইলে তাদের ছবি ছাপিয়ে দেবে খবরের কাগজে। সরকারি একটা কাজের ব্যবস্থাও করে দেবে। ছবি ছাড়াও পলাতককে চেনার আর একটা উপায়ের কথা লেখা আছে। তার মাথায় নাকি একটা বড় আঘাতের চিহ্ন আছে।

গোবিন্দর কথা শুনে সাধুবাবাজীর আত্মরাম খাঁচা ছাড়ার অবস্থা। ডাকু পলাতকের ব্যাপারে অনেক কিছু জেনে বসে আছে গোবিন্দ। একটু কিছু সন্দেহ হলে আর রক্ষে নেই। ফোনে ফোনে চলে যাবে সে বার্তা। আর সাথে সাথে বুনো নেকড়ের মত তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে পুলিশের দল। কোনমতেই বার হতে পারবেনা সেই ঘেরাটপ থেকে। এখনই পালাতে হবে এখান থেকে।তাই খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সাধুবাবাজী।

তাকে উঠতে দেখে গোবিন্দ বলল- বাবাজী! উঠে পড়লেন যে? ওটুকু খেয়ে নিন।

গোবিন্দর সমস্ত রকম আবেদন নিবেদনে কান দিলেন না সাধুবাবাজী। স্মিত হেসে বললেন- না ব্যাটা উদর ভর গিয়া।

একথা বলে পা বাড়াতে যাবে এমন সময় গোবিন্দ বলল- এখন কোথায় যাবেন বাবাজী? অন্ধকার হয়ে আসছে। ঠান্ডাও পড়েছে বেশ। বরং এখানে আপনি থেকে যান। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনার কোন অসুবিধা হবে না। ( ক্রমশ)