ত্রিপুরার নীরমহল। মাণিক্য রাজপরিবারের সামার প্যালেস বা
গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল। বিস্তীর্ণ সবুজ নিয়ে রুদ্রসাগরের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা
ছবির মতো সুন্দর এক রাজমহল। না, রুদ্রসাগর কোনও সাগরের নাম নয়। এ আসলে এপার
ওপার দেখা না-যাওয়া এক মস্ত হ্রদ। প্রাসাদটা যেন এই হ্রদের জলে একখানা শ্বেতপন্ম।
নৌকোয় চেপে নীরমহল দেখে যখন ফিরছি, পশ্চিমের আকাশ
রাঙিয়ে সূর্য ডুবে গেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার দ্রুত জাল বিছোতে শুরু করেছে।
দিনান্তের ছায়া পড়েছে হ্রদের জলে। গরমের সময় হলেও ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস বইছে।
আরামদায়ক মনোরম আবহাওয়া। নৌকোবিহার মন ভরে উপভোগ করছিলাম আমরা।
পুব আকাশে তখন একটু একটু মেঘ জমছিল। সেদিকে তাকিয়ে জিকু
বলল, 'মনে হচ্ছে বৃষ্টি
নামবে। এর আগেই পাগল বুড়ির থানটা দেখে ফেলতে হবে।'
জিকু হল গোলার মামাতো ভাই, আমাদের ত্রিপুরার বন্ধু এবং ভ্রমণ গাইডও বটে।
এবারে আমরা চার বন্ধু, অর্থাৎ আমি, গোলা, পন্টাই ও বিল্ব
এসেছি ত্রিপুরা ভ্রমণে। সেমিষ্টার শেষের দিন কয়েকের ছুটি পেয়ে যখন কী করা যায়
স্থির করতে পারছিলাম না, তখন গোলাই প্রস্তাব দিল, 'চল না এবারে সবাই
মিলে আমার মামারবাড়িতে যাই।'
আমরা জানি গোলার মামারবাড়ি আগরতলায়। অর্থাৎ ত্রিপুরা
রাজ্যে। কিন্তু সে তো অনেক দূর।
গোলা বলল, 'দুর তো কী হয়েছে, আমরা কি হেঁটে
যাব? বিমানে মাত্র চল্লিশ মিনিটের যাত্রা। ভেবে দেখ তোরা। আমারও
অনেকদিন যাওয়া হয়নি। সবাই মিলে গেলে মামারাও খুব খুশি হবে। তা ছাড়া জিকু, যে পুনা শহরে
পড়ছে, সেও এখন কলেজে ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরেছে। ওর সঙ্গেও দেখা
হয়ে যাবে।'
প্রস্তাবটা লুফে নিলাম সবাই। দেশের সীমান্ত ঘেঁসে ইতিহাস
সমৃদ্ধ রাজ্যটা দেখার ইচ্ছে আগের থেকেই
ছিল। এবারে সুযোগ পেয়ে সদ্ব্যবহার করলাম। চারমূর্তি চলে এসেছি এখানে।
আসার পর থেকে কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছি। মামাদের এস-ইউ-ভি
গাড়িটা বাহন হিসেবে পেয়ে গেছি। আর সঙ্গী তো আছেই জিকু। বন্ধু হিসেবে তো বটেই, গাইড হিসেবেও
জিকু এক কথায় অসাধারণ। রাজ্যটাকে হাতের তালুর মতো চেনে। জানে এর ইতিহাসও ৷ কোথাও
ঘুরতে গেলে অনেক কিছুই শুধুমাত্র বই বা ভ্রমণগাইড পড়ে জানা যায় না। অনেক অজানা
তথ্য উঠে আসে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে। জিকু সেই অজানা কথার খাজানা নিয়ে বসে
আছে। এইমাত্র যেমন নৌকোবিহার করতে করতে মজার একটা বিষয় জানলাম। এ কথা তো সবারই জানা যে
সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিখ্যাত শচীন দেব বর্মণ ত্রিপুরার রাজবংশের ছেলে। তিনি শচীন কর্তা নামেই বেশি পরিচিত। কিন্তু
তাকে “কর্তা” বলা হত কেন? এরও নাকি একটা নির্দিষ্ট কারণ আছে। যে সন্তান
রাজা হন, তিনি মাণিক্য উপাধিতে ভূষিত হন। অন্য যে ছেলেরা রাজা হতে
পারে না, তারা ঠাকুর উপাধি প্রাপ্ত হয়। এবং রাজার ভাইয়ের ছেলেদের কর্তা সম্বোধণ করা হয়। সেই হিসেবেই শচীন
দেববর্মন শচীনকর্তা।
কথায় কথায় যে তীরে এসে ভিড়েছি, খেয়ালই করিনি ।
নৌকো থেকে নেমে খেয়াল করলাম, মেঘে ছেয়ে গেছে চরাচর। থমথম করছে প্রকৃতি।
ঝড়ের পূর্বাভাস। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে জিকু বলল, 'পা চালা। দেরি
হলে আর পাগল বুড়িকে দেখা হবে না।'
এই পাগল বুড়ির থান সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া দরকার। এর
জন্যে আসতে হবে এই নির্দিষ্ট জায়গায়। জিকুর থেকে যা শুনেছি, সবটাই একটা আজব
কাহিনি মনে হয়েছে আমার। কোনও এক পাগল বৃদ্ধার নাকি বয়সের গাছপাথর নেই। কেউ বলে
তাঁর বয়স একশ বছর, কেউ বলে দেড়শরও বেশি, কেউ আরও বাড়িয়ে
বলে দু'শো । অদ্ভুত নাকি এই বৃদ্ধা। তাকে কেউ কখনও খেতে দেখেনি।
শ্নান-টান বা প্রাতক্রিয়াও নয়। অথচ সে বেঁচে আছে। চলে ফিরেও বেড়ায়।
আরও আশ্চর্য হল তাঁর আবির্ভাবের গল্প। হঠাৎ একদিন স্থানীয়
বাজার এলাকায় তাঁকে দেখা যায়। কোথেকে সে এল, তাঁর কী পরিচয়, কিছুই জানা নেই
কারও । সেদিন নাকি বাজারে দাঁড়িয়ে আগুন আগুন” বলে চেঁচিয়েছিল সে। আর এর ঠিক
পরদিনই, অজানা কোনও কারণে আগুন লেগে যায় বাজারে। এবং বাজারের
দোকানপাট প্রায় সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আরও একবার 'জল জল' বলে চেচিয়েছিল সে। এর পরেই বন্যায় ডুবে গিয়েছিল এলাকা।
এমনই দু'একটি ঘটনার পরে লোকে ভাবতে শুরু করে, সে সাধারণ কেউ
নয়। বৃদ্ধা এমনিতে নাকি কথাবার্তা তেমন বলে না। কিন্তু কাউকে কিছু আকস্মিক বলে
ফেললে নাকি ফলে যায়। বিশেষ করে কাউকে ধমক দিলে নাকি সে অচিরেই অসীম সৌভাগ্যের
অধিকারী হয়ে ওঠে। সব শুনে মনে হয়েছিল 'ডি-জা-ভিউ'- এর কেস। কী ঘটতে
চলেছে সেটা আগাম দেখতে পাওয়ার
অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা কারও কারও থাকে শুনেছি । সত্যি মিথ্যে জানা নেই। তবে বৃদ্ধার
গল্পগুলি শুনে তেমনই মনে হচ্ছে।
এসব কারণেই বৃদ্ধাকে প্রায় ভগবানের আসনে বসিয়ে পুজোপাঠ
করা হয় এখন।
স্থানীয় লোকেদের কাছে সে যে বিশেষ গুরুত্ব রাখে, সেটা এখানে এসেই
বুঝলাম। নৌকোর অন্যান্য যাত্রীরা, যারা সকলেই আমাদের মতোই পর্যটক, যারা আশেপাশের
শহর, গ্রামাঞ্চল, বা আরও দুর
দুরান্ত থেকে এসেছে, সবাই ছুটেছে পাগল বুড়ির থান দেখতে। কেউ
ভক্তিতে, তো কেউ নেহাতই আমাদের মতো কৌতুহলে।
লোকেরা নানারকম কথা বলছিল। বৃদ্ধার নানা রকম লীলার কথা।
পাগল বুড়ির অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে প্রায় সকলেরই গভীর বিশ্বাস ও
শ্রদ্ধা। তাঁর দর্শন পাওয়াও নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। প্রতিদিন দূর দৃরান্ত থেকে
অজস্র ভক্ত আসে তার থানে। যদিও সবাই তার দেখা পায় না। আবার অনেকেই পায়ও ।
যেতে যেতেই একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছিল। কিছু লোক আফশোস
করছিল, অন্ধকারে বৃদ্ধার দর্শন পাবে কিনা ভেবে। আবার অনেকে ভাবছিল
ভাগ্যে থাকলে অন্ধকারেই তাঁর দর্শন মিলবে, আর ভাগ্যে না
থাকলে দিনের আলোতেও তাঁর দেখা পাওয়া অসম্ভব। জিকুরও দেখলাম তেমনই অভিমত। জিকুর
মতো একজন শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান ছেলে যে গ্রাম্যদের মতো এসব আজব গল্পে বিশ্বাস করছে, সেটাই আমাকে অবাক
করছিল বেশি। যাইহোক, যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। এ নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য থাকা উচিত নয়।
জিকু জানাল, ও একাধিকবার
এখানে এলেও এক বারও পাগল বুড়ির থানে যাওয়া হয়নি। তাই এবার আমাদের নিয়েই একসঙ্গে দেখবে।
তবে আমাদের গারির চালক
ভোলাদা বলল, তাঁর বাবা নাকি পাগল বুড়িকে দেখেছে। শুনেই আমরা আগ্রহী
হয়ে উঠলাম। জানতে চাইলাম,
সে দেখতে কেমন।
দেখে কি আদৌ তাকে দেড়শ-দু'শো বছর বয়সি মনে
হয়? কিন্তু ভোলাদা
কাঁধ বাঁকাল। অর্থাৎ ওর ধারণা নেই। কারণ ওর বাবাও যে খুব ভালো করে দেখেছেন, তা নয়। তিনি
যেদিন এসেছিলেন সেদিন সেখানে অসম্ভব ভিড় ছিল। খুব অল্প সময়ই দেখার সুযোগ
হয়েছিল৷ তাতে তেমন স্পষ্ট করে কিছু দেখা যায়নি। শুধু বৃদ্ধার হাত দুটো দেখা
যাচ্ছিল। সে হাতের আঙ্গুলে ছিল বহু দিনের না-কাটা ভয়ানক বড় বড় নখ। এত বড় যে
নখগুলি পাক খেয়ে কয়েলের মতো গুটিয়ে গেছে। দেখেই নাকি গা শিরশির করে উঠেছিল
তাঁর।
জিজ্ঞাস করলাম, 'তোমার কী মনে হয় ভোলাদা, পাগল বুড়ি সত্যিই কি না-খেয়ে বেঁচে আছে?'
'তাই তো বলে লোকে। কেউ কখনও খেতে দেখেনি বুড়িকে। ভক্তরা ফলমুল-মিষ্টি-পয়সা দিয়ে যায়। কিন্তু সে
সব পড়েই থাকে। যদি কারও দেওয়া প্রসাদ সে কখনও ছুঁয়ে দেখে, তবে নাকি তার
সুদিন সমাগত ৷”
বুঝলাম শুধুমাত্র বিশ্বাস ও কল্পনায় জায়গাটা তীর্থস্থান
হয়ে উঠেছে। দিন দিন ভক্তদের জমায়েত
বেড়ে চলেছে। আমরাও রওনা হলাম তারই উদ্দেশে। কিন্তু ভাগ্য অপ্রসন্ন হলে যা হয়।
আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। প্রচণ্ড জোরে
হাওয়া বইছে। অর্থাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে আছে পুরো এলাকা।
হয়তো লোডশেডিং চলছে। কিংবা হয়তো বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থাই নেই এখানে। তারোপরি
কালো মেঘের আড়ালে আকাশের চাঁদ তারারা ঢেকে গেছে বলে নূন্যতম আলোও নেই। নিকষ কালো
অন্ধকারে একমাত্র সম্বল একমাত্র গাড়ির হেডলাইট। সরু ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে কোনওমতে চলছে আমাদের গাড়ি । দু'পাশে কখনও
মাঠ-ঘাট-জঙ্গল, কখনও দু'-চারটে বাড়িঘর নিয়ে গ্রাম। বেশিরভাগই একেবারে
ফাঁকা এলাকা।
কিন্তু নাহ, অনেক ক্ষণ অলিগলি
ঘুরেও পাগল বুড়ির থান আর পাচ্ছি না। রাস্তায় কোনও লোকও নেই যাকে জিজ্ঞেস করে জানা যায়। আবহাওয়ারও
দ্রুত অবনতি ঘটছে। এক সময় ভোলাদা হাল ছেড়ে বলল, 'আমি রাস্তা
হারিয়েছি। এই ওয়েদারে বুড়ির থান খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।”
অগত্যা কী আর করা? ফোনে জিপিএস
লাগিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়ে গেলাম। তবে পাগল বুড়ি সম্পর্কে কৌতুহলটা রয়েই গেল।
আবহাওয়ার আরও অবনতি ঘটেছে এখন। ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে শুরু
হয়েছে ঘন ঘন বিদুৎ চমকানি
ও মেঘের গর্জন। বোঝাই যাচ্ছে যেকোনও মুহূর্তে দাপিয়ে নেমে আসবে বৃষ্টি। সারাটা
দিন আকাশ পরিষ্কার ছিল। রোদঝলমলে উজ্জ্বল একটা দিনের পরে যে এমন বিপর্যয় দেখা
দেবে ভাবতেই পারিনি। ভোলাদা এ ভাঙাচোরা সরু রাস্তাতেই যতটা সম্ভব গতি উঠিয়ে গাড়ি
চালাচ্ছে।
আগরতলা এখান থেকে মোটেই কাছে নয়। কোথাও না থেমে চললেও
প্রায় দেড় ঘন্টার পথ। এই
এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে মূল সড়কে উঠে গেলে, আর সমস্যা নেই।
সেখানের রাস্তাঘাট মোটামুটি ভালো। কিন্তু খারাপ হল প্রকৃতির অবস্থা। এবং দ্রুত
প্রতিকূল হয়ে উঠছে আবহাওয়া। প্রায় আধঘন্টা চলার পরে হাইওয়ে পেলাম। এবার পূর্ণ
গতিতে বাহন ছুটিয়ে দিল ভোলাদা।
কিন্তু দেড়-দু'কিলমিটার সবে
এগিয়েছি কিনা, অমনি ঝাঁপিয়ে নামল বৃষ্টি। সেই সঙ্গে তো চলছেই তুমুল ঝড়।
আশপাশের গাছপালাগুলো উন্মত্ত দানবের মতো দুলছে। থেকে থেকেই বিদুৎ চমকে ঝলসে উঠছে
দিগ্বিদিক। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে
গর্জে উঠছে মেঘ। সে এক ভয়ানক অবস্থা। এ সবের মধ্যেই অন্ধকারের বুক চিড়ে এগিয়ে
চলেছে আমাদের গাড়ি। যদিও বৃষ্টির জন্যে বাইরের দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় গাড়ির
গতিও একদম কমে গিয়েছে। বুঝতে পারছি, পৌঁছতে সময়
লাগবে।
এভাবেই প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পরে আবার জাতীয় সড়ক ছেড়ে
এক অন্য রাস্তা নিল ভোলাদা। এ রাস্তা অপেক্ষাকৃত সরু হলেও এটাই নাকি শর্টকাট। এবার
পথের দু'পাশে কখনও ঘন জঙ্গল, উঁচু টিলা ও বড়
বড় গাছ। কোথাও দু-চারটে ছোট ছোট বাড়ি, গ্রাম, পুকুর। কোথাও
আবার শুধুই ক্ষেতজমি। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। অন্য কোনও যানবাহনের চিহ্নও নেই। এমন
আবহাওয়ায় পথচারী থাকার তো প্রশ্নই আসে না। কেবল আমরাই যেন একমাত্র পথে রয়েছি।
এমন সময় বৃষ্টি সাময়িক বিরতি
দিল। আর সুযোগ বুঝে ভোলানাথদা গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সাঁই
সাই করে এগিয়ে চললাম আমরা।
হঠাৎ, বিকট আওয়াজ করে একটা ঝাকুনি দিয়ে আচমকা থেমে
গেল গাড়ি। আমরা যারা পেছনে বসেছিলাম, সামনে ঝুঁকে
পড়লাম প্রায়। কী ব্যাপার বুঝে ওঠার আগেই শুনি ভোলানাথদা ভয়ানক রেগে বলে উঠল, 'মরার আর জায়গা
পেল না? আমার গাড়ির সামনেই আসতে হল?'
তখনই সামনের রাস্তায় চোখ গেল। দেখি, এক থুথুরে বৃদ্ধা
ঠিক রাস্তার মাঝখানে দু'হাত দু'দিকে ছড়িয়ে
দাঁড়িয়ে আছেন। যেন আমাদের যেতে বাধা দিতেই দাঁড়িয়েছেন। চারদিকে ঘুটঘুটে
অন্ধকার। প্রলয় চলছেই। রাস্তার দু'ধারের ঘন জঙ্গল
যেন ঝড়ে জেগে উঠেছে। উঁচু উচু গাছগুলো শরীর দুলিয়ে নাচছে। বাতাসের সৌঁ সৌঁ শব্দে
শিরশির করা অনুভূতি। একেবারে জনমানবহীন প্রান্তরে এই বৃদ্ধা কী করে এলেন, সেটাই বুঝতে পারছি না। গাড়ির হেড লাইটের আলো বৃদ্ধার বুক পর্যন্ত উঠে
অন্ধকারে মিশে গেছে। ফলে তার মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। বৃদ্ধা কি গাড়িতে লিফট
চাইছেন? এই নির্জন জায়গায় তিনি এলেন কোথেকে? গোলা দরজা খুলে নামতে চাইছিল, কিন্তু বাধা দিল
ভোলানাথদা। বলল, 'দরজা খুলো না। এর উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। পেছনে লোক থাকতে
পারে।'
বুঝলাম, ভোলনাথদা দুষ্কৃতি অর্থাৎ ডাকাত-টাকাতের কথা
ভাবছে। এমন ঘটনা অনেক ঘটে। শিশু, বৃদ্ধ বা দুর্বল
কাউকে টোপ রেখে ওত পেতে থাকে ডাকাতের দল। যেই আসবে চালক বা যাত্রীরা, তখনই ডাকাতদল
ঘিরে ধরবে তাদের। এটা রাস্তার ডাকতদের একটা পুরনো প্রদ্ধতি। কাজেই সতর্ক হলাম
সবাই। ভোলানাথদা শুধু জানলার কাচ খুলে মুখ বাড়িয়ে চেচিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কী চাই? রাস্তা ছেড়ে
দাঁড়াও।'
কিন্তু বৃদ্ধার প্রত্যুত্তর পাওয়ার আগেই, ঠিক সেই মুহুতেই
প্রকাণ্ড ভয়ানক এক শব্দে কেঁপে উঠলাম সবাই। ঝড়ের দাপটে চোখের সামনে পড়ল পথবাতির
স্তম্ভ। এত ভারী জিনিসটা পড়ায় রাস্তাটা পলকেই ভেঙ্গে চুর্মার। চারদিকে ছিটকে
পড়েছে ধ্বংসাবশেষের টুকরো-টাকরা। গাড়িটার হাতখানেক আগেই উড়ে এসে পড়ল কংক্রীটের
মস্ত এক চাঙড়। একটুর জন্যে গাড়িতে পড়েনি। আতঙ্কে হিম স্রোত বয়ে গেল সারা শরীর দিয়ে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেছি আমরা।
গাড়িটা না থামলে নির্ঘাত গাড়ির উপরেই পড়ত স্তম্ভটা। এমন একখানা ভারী জিনিস এটার উপরে পড়লে আর দেখতে হতো না। কাগজের ঠোঙার মতো
ফেটে ভেঙ্গে গুড়িয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত গাড়ি। যেমন হয়েছে রাস্তার অবস্থা। একজনও বাঁচতাম না। ভাগ্যিস গাড়িটা থেমেছিল।
আর অমনি সবার মনে পড়ে গেল রাস্তা আঁটকে দাঁড়ানো বৃদ্ধার কথা । আরে! তিনি কোথায় গেলেন? তাকে তো আর দেখছি
না! গাড়ির আলোতে যদ্দুর চোখ যায়, তাকিয়ে দেখলাম
সবাই। কিন্তু বৃদ্ধা যেন কর্পুরের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেছেন। আশেপাশে কোথাও নেই!
তাঁকে খুঁজতে পন্টাই ও আমি যেই গাড়ির দরজা খুলেছি, অমনি এতক্ষণ নীরব
থাকা বিন্ব হিমশীতল স্বরে বলে উঠল, 'লাভ নেই খুঁজে' ।
'লাভ নেই কেন?' স্বাভাবিক ভাবেই
প্রশ্ন করি।
''কারণ তাকে পাবি না। শুধু আমাদের বাঁচাতেই
এসেছিল সে''। একইরকম থমথমে স্বরে বলল বিল্ব।
বিল্বর এ হেন কথা শুনে বলা বাহুল্য খানিক থমকে গেলাম। অবাক
হয়ে ওর দিকে তাকালাম সবাই।
জিকো জিজ্ঞেস করল, “কেন এমন বলছিস? তুই কি তাকে চলে
যেতে দেখেছিস? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সে কোথায় যাবে?”
এরপর বিল্ব যা বলল, শুনে স্তম্ভিত
সবাই। বলল, চলে যেতে দেখিনি। কিন্তু আমি বৃদ্ধার হাত দু'টো স্পষ্ট দেখতে
পেয়েছিলাম। আঙুলে বহু দিনের না-কাটা মস্ত বড় বড় নখ কয়েলের মতো গোল পাকিয়ে
আছে।”
“পাগল বুড়ি!” প্রবল বিস্ময়ে সমস্করে বলে উঠি
সবাই। -কিন্তু এ কী করে সম্ভব? সে কী করে এতদূরে আসবে? এলেও আমাদের
গাড়ির আগে এসে পৌঁছবে কী করে? তবে কি সে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেল? অজস্র প্রশ্ন
কিলবিল করে ওঠে মনের ভেতরে। কিন্তু ততক্ষণে বুঝে গেছি, এসব প্রশ্নের
উত্তর কখনও পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য উত্তরহীন প্রশ্রেরা ঘুরে
বেড়াচ্ছে। সে জন্যেই এ জগত এত রহস্যময় ।
সামনের পথ বন্ধ দেখে ভোলানাথদা গাড়ি ইউ-টার্ণ করে ঘুরিয়ে
নিয়েছে। বিকল্প কোনও পথের সন্ধানে উল্টোমুখে রওনা হলাম আমরা। পেছনে মুখ থুবড়ে
পড়ে রইল সাক্ষাৎ মৃত্যু।