গল্প - ৫ । ফাল্গুন ১৪৩১



 মোতি ও মাতোয়ারা 

অভিষেক ঘোষ

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ



 

ছোট্ট গুমটি ঘরটাতে ঘুম আসে না মোতির। তার ঘরটা যেন চারিপাশের সবুজ গাছপালায় তৈরি একটা বিরাট ঝিলের বুকে ছোটো নুড়ির মতো ক্রমশ ডুবছে, আরো ডুবে যাচ্ছে। দেখলে মনে হবে, ঘন ঝোপঝাড়গুলো যে কোনো সময় গিলে খাবে তার মাথা গোঁজার এই যৎসামান্য ঠাঁইটুকুকে। 

অথচ বরাবর এরকমটা ছিল না। মোতির তো বয়স কম হল না! এই তো গত পূর্ণিমায় সে ন’বছরে পা দিল। তার সব মনে আছে। সেই যে... তার চোখের সামনে মা-বাবা হরিণ হয়ে গেল! তারপর তাকে বেমালুম ভুলে এক দৌড়ে উধাও হয়ে গেল দূর অরণ্যে। কত দুঃখই না সেদিন পেয়েছিল সে! কিন্তু দুঃখ পেয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকার মতো বোকা মেয়ে নয় মোতি।

তার বাবা জাদুকরী বিম্ববতীর জন্য নানা জায়গা থেকে গাছ-গাছালি জোগাড় করত। আর মা সেসব পৌঁছে দিত বিম্ববতীর প্রাসাদে। সে অনেক দূরের পথ। দু-দু’বার ছোট্ট মোতিকে পিঠে কাপড়ের সাথে বেঁধে সেই প্রাসাদে গিয়েছিল তার মা। মোতির আজও সেই দুর্গম পথের কষ্টের কথা মনে আছে। তবে দুর্গম হলেও অসাধ্য নয়, কিন্তু মুশকিল হল জাদুকরী নিজে না চাইলে তার প্রাসাদে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেতে হয় পায়ে হেঁটে অথবা ঘোড়ায় চেপে। সেই পাহাড়ে বারবার লতায় পাতায় জড়িয়ে ধরে পা, পথ হারানোর সম্ভাবনাও বড়ো কম না। অবশেষে একটা সময় গিয়ে নীল পাহাড়ের কোলে পৌঁছাতে হয়। তারপর আর পথ নেই, জাদুকরীর সাহায্য ছাড়া উপায় নেই এক-পা এগোবার! তারা গরিব, ঘোড়া কোথায় পাবে! তাই পুরো রাস্তাটাই তাদের হেঁটে আসতে হতো। জাদুকরী তখন ঠিক খবর পেয়ে যেত আর পাঠিয়ে দিত একখানা চাটাই। দেখতে অতি সাধারণ হলেও জাদুবলে সেই হলদেটে আসনখানা তাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারত গন্তব্যে। তার মা তাকে পিঠে নিয়ে নীলপাহাড়ের কোল অব্দি যেত পায়ে হেঁটে, সেখানে হাওয়ায় ভাসত চাটাইখানা, আহ্লাদে আটখানা পোষা কুকুরছানার মতো তিরতির করে কাঁপত তার চারটে লম্বাটে গিঁট্টিমারা কোণ। চেপে বসলেই নিমেষে সে উড়ে যেত বিম্ববতীর প্রাসাদে। 

আহা সে সব দিন বড়ো সুখের ছিল! কিন্তু গোলমাল বাঁধল মোতির বাবারই দোষে। মঙ্গল অর্থাৎ মোতির বাবা বেজায় বলশালী লোক আর বরাবরই খুব গোঁয়ার। একদিন সে জেদের বশে জাদুকরীর সাথে তর্ক শুরু করল। সমস্যা শুরু হলে এইভাবে... নীলপাহাড়ের পুবদিকে কোনো গোপন গুহার আশেপাশে একরকম লালচে-সাদা ফুল ফোটে তিন-চার বচ্ছর অন্তর। সেই ফুলের গর্ভকেশরে থাকে ভয়ানক বিষাক্ত কিছু, জাদুকরী সেই বিষ চেয়েছিল তার বাবার কাছে। বাবা তা এনে দিতে রাজি হয় নি। জাদুকরী তখন বলেছিল, “আমার জাদু আয়না থাকতে ভাবনা কী? চাইলে তোর মতো দশটা মঙ্গল খুঁজে নিতে পারি...” - এই বলে আয়নার দিকে তাকিয়ে সে বলেছিল, -

 

“বল দেখি মোর আয়না 

কোনখানেতে গেলে পরে

মিটবে মনের বায়না?”


ওমা! যেই না বলা, অমনি আয়না ঘোলাটে হয়ে গেল! কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আবার তাতে ছবি ফুটে উঠল। আয়নার ওই ছবিখানা দেখেই মঙ্গল বুঝেছিল, এ হল সেই গুহা যার মধ্যে আছে বিষাক্ত সেই ফুল। জাদুকরী আয়নার মধ্যে হাত গলিয়ে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সেই আশ্চর্য ফুল একগুচ্ছ মুঠো করে তুলে, আয়না থেকে হাত বের করে আনল - যেন এক গামলা জলে হাত ডুবিয়ে তোলা হল কিছু! তারপর কটমট করে তাকাল মঙ্গলের দিকে। মঙ্গল কিছুক্ষণ হাবা হয়ে ছিল বটে কিন্তু তারপর সে জাদুকরীর ফুল-সমেত হাতটা ধরে ফেলল। কিছুতেই সে হাতটা ছাড়বে না। তখন বিম্ববতী এক অদ্ভুত কাণ্ড করল। অন্য হাতে সেই ফুলের গর্ভকেশরের একফোঁটা ছিঁড়ে মঙ্গলের মুখে ঠুসে দিল, তারপর বলল, 


“যদি থাকে মোর মন্ত্রের জোর

হরিণ হয়ে থাকবি বচ্ছর-ভ’র!” 


তখনই মঙ্গল হরিণ হয়ে লাফাতে লাগল চারিদিকে। মায়ের আঁচল ধরে কাঁদছিল ছোট্ট মোতি, সে তখন মোটে সাত বচ্ছরের মেয়ে। কিন্তু জাদুকরীর প্রাণে এতটুকু মায়া নেই। মায়েরও একই পরিণতি করল সে। তাতেও জাদুকরীর রাগ কমে নি। মাটিতে জানু পেতে বসে, দু’হাত মাটিতে চেপে ধরে সে মনে মনে কী বলল... অমনি চারিপাশে যেন সাড়া পড়ে গেল। দেখতে না দেখতে চারিপাশের সব গাছপালা আশ্চর্যরকম বেড়ে উঠে চারিদিক একেবারে ঢেকে ফেলল, সূর্যের সব আলো ঢেকে যেন তৈরি হলো এক অন্ধকারের রাজত্ব। তখন জাদুকরী হেসে, মোতির করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, - 


“আজ থেকে তুই হলি জাদুর বনে কয়েদ

মুক্তি পাবি যদি আনিস পক্ষীরাজের মেদ।” 


কথাটুকু বলেই হাতে সেই বিষ-ফুল আর জাদু-আয়না নিয়ে জাদু-চাটাইতে চেপে, জাদুকরী শোঁ করে নিমেষে উড়ে চলে গেল চোখের আড়ালে। সেই দিন থেকে এই দুঃখের জঙ্গলে ডুবে বসে আছে মোতি।


(২)

মোতির ঘুম ভাঙল একটা অদ্ভুত হাসির শব্দে, যেন একটা ফাঁকা কলসির মুখে মুখ দিয়ে কেউ হাসছে। ফোকলা একটা মুখ ঝুলেছিল মোতির মুখের উপরে; ঘুম থেকে জেগেই নিজের মুখের উপর বুড়ির মুখটা দেখে আঁতকে উঠল মোতি। ক্ষয়াটে সেই মুখে সবচেয়ে বেশি করে নজরে আসে নাকখানা, সেটা বেজায় বড়ো আর টিয়াপাখির মতো ব্যাঁকা। বুড়ির মুখে কেমন এক বিচিত্র হাসি। তার পরনে চটের লম্বা নীলচে ঢিলে জোব্বা, তাতে আবার কত চকরা-বকরা কাটা!


“কী গো কন্যে,

তোমার জন্যে এলুম এত দূর

যাবে নাকি আমার সঙ্গে

নিঝুম ক্ষীরপুকুর?”


বুড়ির ঝুলন্ত হাসি-মুখে প্রশ্নটা ঝুলতে লাগল। মোতি জানে না কী বলবে! তার বিহ্বল মুখের দিকে চেয়ে বুড়ি ম্যাজিকের মতো হাত ঘুরিয়ে একখানা ইয়াব্বড় পুলিপিঠে নিয়ে এল আর সেটা এগিয়ে দিল মোতির দিকে। খাবারে মোতি কখনও ‘না’ বলে না। পিঠেটা খেতেও অপূর্ব, তার স্বাদে পুলকে মোতির চোখ বুজে আসল, পেটও ভরল। বুড়ি যেন এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল, খাওয়া শেষ হতেই বুড়ি খপ করে মোতির বাঁ হাতটা ধরল। মোতির কেমন মনে হচ্ছিল, বুড়ি তার কোনো ক্ষতি করতে চায় না। তাছাড়া তার হারানোর আছেই বা কী! এই ঘোর জঙ্গলে এতগুলো দিন সে একলাই তো কাটিয়েছে। ঘরে কোনো খাবারও নেই, বনের ফল-মূলই ভরসা। অবশ্য বনের মধ্যে ফাঁদ পেতে কীভাবে খরগোশ বা বনমোরগ ধরে আগুনে ঝলসে খেতে হয়, বাবার কাছে শিখেছিল সে; সেই বিদ্যেও এতদিন কাজে লেগেছে। কষ্ট হয়েছে ঠিকই, তবে না খেতে পেয়ে মরে যাওয়ার মতন অবস্থা মোতির কোনোদিন হয়নি।

বুড়ি যখন মোতির হাতটা ধরে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল, তখন সবে ভোর হয়েছে। বনের প্রতিটি গাছে পাখিদের কিচমিচে কান পাতা দায়। বুড়ি একটা ছোট্ট কাঠি কানে গুঁজে রেখেছিল। সেটা এবার কান থেকে খুলে হাতে নিয়ে চোখ বুজে বলল, “লম্বা হ...”! ওমা! অমনি ওই ছোট্ট কাঠি দু’হাত লম্বা পেল্লায় এক লাঠিতে বদলে গেল। এবার সেই মজবুত লাঠিটা ডান হাতে শক্ত করে ধরে বুড়ি জঙ্গলের উপর এক ঘা বসিয়ে দিয়ে বলল, “দু’ভাগ হ...”; ব্যাস, জঙ্গল দুই পাশে সরে গিয়ে ওদের যাওয়ার পথ করে দিল। তারপর গাছের পাতায় রোদের ঝিলিমিলি আর চলার পথে অজস্র গাছপালার শিকড়-বাকড়ের মধ্যে দিয়ে তারা পথ চলতে লাগল। 

এদিকে মোতির আবার খিদে পায়। ছোট্ট পা-দুটো থেকে থেকেই ক্লান্তিতে থেমে যেতে চায়। বুড়ির তখন দয়া হয়। বলে “মাছ খাবি?”

মোতি একগাল হেসে ঘাড় হেলায়। তখন বুড়ি খুঁজে পেতে একটা পুকুরপাড়ে নিয়ে যায় তাকে। তারপর বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র বলে, সেই পেল্লায় লাঠিখানা সজোরে জলের উপর মারে। তখুনি একটা আজব কাণ্ড ঘটে। জলের ভিতর থেকে অজস্র মাছ জল ছেড়ে হাত চারেক উপরে লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু জলে ফিরতে পারে না, ভাসমান অবস্থাতেই শূন্যে অসহায়ভাবে ছটফট করতে থাকে মাছগুলো। তখন ঠিক গাছ থেকে ফুল পারার মতো মোতি আর বুড়ি মুঠোমুঠো ছোটো মাছ ধরে পুকুরপাড়ে জড়ো করে। তারপর বুড়ি আবার জলে লাঠির বাড়ি মেরে বলে “ফিরৎ যা...” - বলতেই ভাসমান বাকি মাছগুলো জলে ফিরে গিয়ে শ্বাস নিয়ে বাঁচে। তখন বুড়ি এদিক ওদিক থেকে কাঠকুটো জড়ো করে, চকমকি ঠুকে, আগুন জ্বালিয়ে মাছগুলো ঝলসে নেয়। দু’জনে খুব আরাম করে তাই খায়। এদিকে ওদের দুই পাশে মাছের কাঁটা জমতে থাকে। তাই দেখে কোথা থেকে একদল বিড়াল পায়ে পায়ে জড়ো হয় সেইখানে। তারাও ভোজে লেগে যায় কাঁটাগুলো নিয়ে। কিন্তু সেই যে তারা আসে, আর যায় না, গোটা তিরিশেক বিড়াল এরপর মোতিদের সঙ্গী হয়।


(৩)

এদিকে সূর্য মাথার উপরে উঠে পড়ে। আর তারাও গভীর জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসে তেপান্তরের মাঠে। বুড়ি তখন এক আশ্চর্য কাণ্ড করে। মাটিতে আঁক কেটে বুড়ি দু’জনের বসার উপযোগী একটা রথ আঁকে। তারপর লাঠি নিয়ে কীসব বিড়বিড় করে সজোরে সেই মাটিতে আঁকা ছবির উপরে এক ঘা মেরে বলে, “বিড়ালগাড়ি”! বলতেই যেন হাওয়া থেকে সত্যিকার একটা রথ এসে হাজির হয় তাদের চোখের সামনে আর অতগুলো বিড়াল দিব্যি একে-একে জাদুবলে রথের গায়ে জুড়ে যায়। 

বুড়ির ইশারায় মোতি বুড়ির সাথে রথে চাপতেই দিব্যি গড়গড়িয়ে বিড়ালগাড়ি চলতে শুরু করে। রথের মাথার উপর গাছের পাতার ছাউনি দেওয়া, বুড়ির আঁকায় ঠিক তেমনি ছিল। ওদিকে মোতির যাতে গরম না লাগে, তাই সবচেয়ে মোটাসোটা বেড়ালটি দিব্যি টঙে উঠে, তার ঝালরের মতো মোটা সাদা ল্যাজটা নেড়ে নেড়ে মোতিকে বাতাস করতে লাগল। তাই দেখে মোতির তো ভারি মজা।


(8)

বেলা পড়ে আসে। গাছপালার ছায়াগুলো ঘন হয়ে গুটিসুটি মেরে ছিল দুপুরে, এখন তারা ক্রমে লম্বা হয়ে, বাতাসের সাথে সাথে ভূতের মতো দুলছে। এসব দেখে মোতি ভয় পায় না। সে খুব সাহসী মেয়ে। সে জানে, এতক্ষণে বিম্ববতীর বিশাল প্রাসাদের খুব কাছে এসে পড়েছে তারা। সে এটাও বুঝতে পারে বুড়ি অন্য রাস্তা নিয়েছে, এই রাস্তা দিয়ে তার মা তাকে নিয়ে আসতো না। কিন্তু সহসা বিড়ালগাড়ি বিকট ‘ম্যাঁও’ শব্দ করে থেমে যায়। বুড়ির গায়ে মোতি হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে বুড়ি শুধু বলে,

 

“ক্ষীরপুকুরে দেবো ডুব,

উধাও হয়ে ভারি সুখ!”


মোতির মাথায় অবশ্য কিছুই ঢোকে না!

অদূরেই একটা জলাশয়, আকাশে তখন গোল চাঁদ উঠেছে। বুড়ি সেই আলোয় মোতিকে নিয়ে সোজা কোমর-জলে নেমে যায়। জলটা আশ্চর্য সাদা, যেন চাঁদের দুধ ঢেলে ঢেলে পুকুরটা ভর্তি করা হয়েছে। মোতি অবাক হয়ে দেখে প্রতিটা বিড়াল নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে, পুকুরপাড় জুড়ে গোল হয়ে বসেছে। বুড়ি জলে নেমেই লাঠি দিয়ে ছপাট-ছপাট শব্দ করে, সেই দুধ-সাদা জল বিড়ালগুলোর গায়ে ছিটিয়ে দেয়। তাজ্জব কাণ্ড, অমনি বিড়ালগুলো এক-একটা এক-একজন মোতির বয়সী বালকে বদলে যায়। বুড়ি লাঠিখানা উপরে তুলে প্রথমে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করল, তারপর গলা-জলে দাঁড়িয়ে জোরে বলল, 


“আমি যদি সত্যিই হই জাদুকরী মাতোয়ারা

তবে আমার জাদুর কবল থেকে

কেউ পাবে না ছাড়া...

কী কুক্ষণে বিম্ববতীর জাদুর বলে তোরা

বিড়াল হয়ে এতক্কাল ঘুরছিলি ঘরছাড়া,

আজ থেকে তোরা, মানুষ হ’ বাছারা...!”


মোতির ঘোরলাগা চোখের সামনে তখন হৈহৈ কাণ্ড! ছেলেগুলো নিজেদের ফিরে পেয়ে, প্রথমে যেন কিছুক্ষণ কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না! তারপর তাদের ঘরের কথা মনে পড়ল, মনে পড়ল বাপ মায়ের মুখগুলো। তখন যে যার বাড়ির দিকে তারা রওনা দিল। পুকুরধারের জোনাকিরা তাদের বাড়ির পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। 

বুড়ি মোতিকে হাত ধরে জল থেকে টেনে তুলল। তখন মোতি অবাক হয়ে দেখে, তাদের দেহের ছায়া পড়ছে না মাটিতে, তারা এক্কেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে! বুড়ি ফোকলা মুখে হেসে বলল,


“এক প্রহর মাত্র,

অদৃশ্য মোদের গাত্র”।


(৫)

এদিকে বিম্ববতীর প্রাসাদের সামনে সবুজ গোলকধাঁধায় সে’সময় নানাজাতের পশু-পাখিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকলেই বিম্ববতীর শক্তিশালী জাদুর শিকার, তাদের আত্মাগুলো বিম্ববতীর জাদু-আয়নায় বন্দি। সেই বিষফুলের পরাগ দিয়ে বিম্ববতী এদের সকলকে নিজের গোলাম বানিয়ে রেখেছে। তার কাছে এটা একটা মজার খেলা। ওই গোলকধাঁধায় একবার বাইরের কেউ ঢুকে পড়লে কিন্তু আর বেরোনোর পথ খুঁজে পাবে না।

কিন্তু বিম্ববতী জানে না তার শিয়রে শমন। তার ছোটোবেলার সই মাতোয়ারা আসছে মোতিকে সঙ্গে নিয়ে। আসলে সেও এক জাদুকরী, একই গুরুমার কাছে জাদু শিখেছিল তারা। ভালো ছাত্রী হিসেবে গুরুমার চোখের মণি হয়ে উঠেছিল সে, শিক্ষা শেষে পেয়েছিল ওই জাদু-আয়না। মাতোয়ারাকে ঠকিয়ে বিম্ববতী একদিন তারই জাদু-আয়না কেড়ে নিয়ে, তাকেই বুড়ি বানিয়ে দিয়েছিল। মাতোয়ারা আসছে তারই শোধ নিতে।


(৬)

ওদিকে রাজপুত্র স্বরূপকুমার আসছেন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে বিম্ববতীকে শেষ করতে। রাজ্যের প্রজারা তাঁর পিতা মহারাজ স্বপনকুমারের কাছে বহুবার অভিযোগ করেছে, বিম্ববতীর জাদুতে গ্রাম ও নগরের বহু মানুষ জীবজন্তুতে পরিণত হচ্ছে। তাই মহারাজ নিজেই পুত্র স্বরূপকুমারকে পাঠিয়েছেন এর একটা বিহিত করতে। 

কিন্তু বিম্ববতী তখন কী করছে? পূর্ণিমার রাতে প্রিয় খেলাটিই খেলছে বিম্ববতী। তার অলৌকিক ছায়া-তরবারি দিয়ে সে মাথা কাটছে অলীক জাদু-ভ্রমরদের। চাঁদের আলোর গুঁড়ো দিয়ে বানানো সেই জাদু-ভ্রমর পলক না-ফেলতেই বাতাসে মিলিয়ে যায়, বিম্ববতী ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ছায়া-তরবারিতে কেটে ফেলছে তাদের মাথা। সে একটা তাক লাগানো দৃশ্য বটে!

(৭)

বিম্ববতী যখন ছাদে জ্যোৎস্নালোকে আনমনা, স্বরূপকুমার অতর্কিতে লাফিয়ে নামলেন ছাদে। মৃদু শব্দ হল, তাতেই বিম্ববতীর কান হল সজাগ। ছায়া-তরবারি তাঁর হাতে উদ্যত, চাঁদের আলোই তরবারির শক্তি; খালি চোখে যাকে দেখতে পাওয়াও অসম্ভব। তাই সেই তরবারির মোকাবিলা করাও যার-তার কম্ম নয়।

কিন্তু এসময় নীচে উদ্যানে এক হ্রেষাধ্বনি জাদুকরীর সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করল। এ যে পক্ষীরাজ ঘোড়ার ডাক! ওই ঘোড়ার মেদই যে চাই তার। অক্ষয় আয়ু পেতে, অমর হতে, বিম্ববতী যে যজ্ঞের পরিকল্পনা করেছে, তাতে প্রয়োজন জাত পক্ষীরাজের মেদ। কিন্তু এ-যাবৎকাল জাদুকরী তা হস্তগত করতে পারে নি। লোভে অস্থির হল বিম্ববতী সুতরাং অসতর্ক হল এবং সেই সুযোগে রাজকুমারের হাত সুকৌশলে মোচড় দিয়ে কেড়ে নিল বিম্ববতীর হাতের ছায়া-তরবারিখানি। বিম্ববতী প্রচণ্ড রাগে যেন দিশেহারা হয়ে গেল! কিন্তু ওই ঘোড়া যে তার চাইই, রাজকুমারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় কই? দ্রুত নীচে দৌড়ে গেল জাদুকরী, তার দীর্ঘ পোশাকের ধাক্কায় বাতাসে উঠল ঘূর্ণি। নীচে নেমে কিন্তু আরো আশ্চর্য হয়ে গেল সে!

বিশাল গোলকধাঁধা পেরিয়ে প্রাসাদের সামনে, এক বৃক্ষতলে সবুজ চত্বরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট মোতি। মাতোয়ারাকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এক প্রহর গত হয়েছে, ফলে অদৃশ্য শরীরে সমস্ত প্রহরীদের চোখে সহজেই ধুলো দিতে পেরেছে তারা। প্রহর গত হতেই মোতি দৃশ্যমান হয়েছে। তখন মোতির দু’চোখে জল। তাকে ঘিরে ধরেছে অসংখ্য হরিণ-হরিণী, কিন্তু এদের মধ্যে মোতির মা-বাবা কারা? সে জানে না... অসহায় মোতির চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! আর তখনই সে’খানে এসে পৌঁছায় বিম্ববতী। সেই দৃশ্য দেখে নিজের চরম বিপদ ভুলে, নিষ্ঠুর বিম্ববতী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

ওদিকে বিম্ববতীর সই মাতোয়ারা ততক্ষণে এক গোপন কক্ষ থেকে জাদু-আয়নাটি হস্তগত করেছে। আয়না হাতে পাওয়া মাত্রই সে ফিরে পেয়েছে প্রকৃত স্বরূপ। সে তখন আর মোটেই থুত্থুড়ে বুড়ি নেই, বরং স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে মায়াময় এক যুবতী। রাজকুমারের পাশে গিয়ে সে বলল, “ওই মেয়েটির বাবা-মা প্রায় দুই বচ্ছর-যাবৎ হরিণ-হরিণী হয়ে রয়েছে বিম্ববতীর জাদুবলে। কেবলমাত্র পক্ষীরাজের মেদ পেলে তবেই ওদের শাপ-মুক্তি সম্ভব। আপনি কি ওইটুকু মেয়ের মুখ চেয়ে তা দিতে পারবেন না রাজকুমার?”

রাজকুমার মন দিয়ে শুনলেন সুন্দরী মেয়েটির ব্যথিত কথাগুলো। তারপর একটিবারও না ভেবে তখুনি ছায়া-তরবারির এক কোপে পক্ষীরাজের দেহ থেকে এক খণ্ড মেদ কেটে নিলেন। রক্তাক্ত ঘোড়াটির পরিচর্যায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাতোয়ারা, তার চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে গালে নামল অশ্রুধারা। বিম্ববতী কিন্তু কোনো দিকে না তাকিয়ে পক্ষীরাজের মেদখণ্ডটুকুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু ততক্ষণে রাজকুমারের হাতের ছায়া-তরবারি স্পর্শ করেছে বিম্ববতীর গ্রীবা। এমনটা যে হতে পারে, জাদুকরী বোধহয় তা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি কোনোদিন।

রাজকুমার গম্ভীর স্বরে বললেন, “পালাবার কোনো পথ নেই। ওই মেয়ের সাথে কী কথা ছিল জাদুকরী?”

জাদুকরী ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলল, “কার জন্য এত মায়া আপনার রাজকুমার? কে হয় ওই মেয়ে আপনার?”

রাজকুমার বললেন, “ও আমার প্রজা, ও আমার বোন। ওদের মানুষ করে দে এইবেলা, আমার কথা শোন। নয়তো...”

“ঠিক আছে... ঠিক আছে, দেবো না, বলেছি কী!” - এই বলে বিড়বিড় করে কী এক মন্ত্র পড়ে, একরকম লাল গুঁড়ো রঙ সে ছুঁড়ে দিল হরিণগুলোর দিকে। কয়েক মুহূর্ত কাটল, তারপর ধীরে-ধীরে আধো আলো-ছায়ায় বৃক্ষতলে হরিণগুলো ফিরে পেল তাদের মানব-মানবীরূপ। মোতি ছলছল চোখে দেখল, তার মা আর বাবা ধীর পায়ে এগিয়ে তার দিকে... কিন্তু তাদের চোখে তখন কেমন বিহ্বল দৃষ্টি!

পলকের মধ্যে মাতোয়ারা জাদুবলে সেই মেদ পুনরায় সংযোজন করে দিল পক্ষীরাজের রক্তাক্ত ক্ষতস্থানে। জাদুবলে সুস্থ হয়ে অতিকায় ঘোড়াটি তীব্র হ্রেষায় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলল। ওদিকে মোতি ফিরে গেল বাপ-মায়ের কোলে। ছোট্ট মেয়েটির চোখে-মুখে যেন পরম নিশ্চিন্তি।


(৮)

মোতি আর তার বাবা-মা চোখের জলে ভেসে ধন্যবাদ জানাল মাতোয়ারাকে। রাজকুমারও মাতোয়ারাকে তার সুপরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভোলেন নি। তখন মাতোয়ারা জাদু-আয়নায় বন্দি করল তার ধূর্ত সই বিম্ববতীকে। বিম্ববতীর বিশাল প্রাসাদের মালকিন হল মাতোয়ারা। ছায়া-তরবারি অবশ্য থেকে গেল রাজকুমারের হাতে, মাতোয়ারাও সম্মতি জানাল।

মোতিরা বিদায় নিল। রাজকুমারও চেপে বসলেন তাঁর বলশালী পক্ষীরাজের পিঠে। চাঁদের অপূর্ব মোতি-রঙা জোৎস্নায় তখন সারা জগৎ অদ্ভুত আনন্দে মাতোয়ারা।