অভিষেক চক্রবর্তী

                                                                                                                                                                                                             ছবি - আভা সরকার মণ্ডল

  ভবানীপ্রসাদ মজুমদার: কিছু   স্মৃতি, কিছু আলোচনা









অভিষেক চক্রবর্তী





 

দিনটা ছিল ৬ বা ৭ই মে, ২০০০। সেটা অক্ষয় তৃতীয়ার দিন বা তার পরের দিন। স্থান নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের বিদ্যালয়ের অ্যাসেম্বলি হল সংলগ্ন প্রাঙ্গণ, যেখানে মাঝেমধ্যে কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হত। সেইদিন সন্ধে আন্দাজ সাতটা নাগাদ আমাদের যধ্যে এসেছিলেন কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। আমি তখন বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের আগে থেকেই জানানো হয়েছিল যে ওইদিন সন্ধ্যায় উপরোক্ত স্থানে একজন বিখ্যাত কবি আসবেন। হয়তো প্রধান শিক্ষকের কার্যালয় থেকে আসা এই বার্তায় কবির নামও ছিল, অত আমরা খেয়াল করিনি। তখন আমাদের মনের অবস্থাও সেরকম ছিল না; সন্ধেবেলায় অনুষ্ঠান জেনেই মনে আনন্দের জোয়ার উঠত সন্ধের স্টাডি হল হবে না ভেবে। সেই দিনই ভবানীপ্ৰসাদ মজুমদারকে চাক্ষুষ দর্শন করি। সেটাই প্রথম এবং শেষবার, কিন্তু এই একটি বারেই উনি আমার মনে গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন

প্রথমেই বলে রাখি যে আমি আগেও কবিতার ভক্ত ছিলাম না, এখনও নই। বিশেষ করে আজকালকার গুরুগম্ভীর ছন্দবিহীন কবিতা আমার মাথায় একেবারেই ঢোকে না। কিন্ত ভবানীবাবুর প্রথম কবিতাহাবু ও দারোগাশুনে ওঁকে অনেক কাছের মানুষ বলে মনে হতে লাগল (কবিতাটা সম্ভবত এখন বিদ্যালয়েও পড়ানো হয়)। উনি কবিতাপাঠ শুরুর আগে একজন ভদ্রলোক (সম্ভবত বিদ্যালয়ের সংস্কৃতি পরিষদের কোনও সদস্য) ওঁর সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন। আমার শুধু মনে আছে যে তখন উনি কোনও এক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং উনি প্রায় হাজার দশেক কবিতা ও ছড়া লিখেছিলেন (এখন নিশ্চয় সেই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি)। যে বিষয়টা ওই সময় আমাদের (অর্থাৎ শুধু আমার নয়, আমার সহপাঠীদেরও) আকর্ষণ করেছিল, সেটা হল ওঁর কবিতার রসবোধ। ছোটোদের জন্য লেখা এমনিতেই বিরল, তখনও পর্যন্ত সামনে থেকে কোনও সাহিত্যিককে শিশুসাহিত্য পাঠ করতে দেখিনি। ভবানীবাবুর বিভিন্ন ছড়া কবিতা যেন খোলা হাওয়ার মতোই আমাদের সজীব করে তুলেছিল (এবং এখনও কিশোর ও তরুণদের ক্ষেত্রে একই কাজ করে চলেছে)। ব্যঙ্গাত্মক (প্যারোডি) ধরনের কিছু কবিতাও উনি শুনিয়েছিলেন। ওই সময় মনে আছে, ভারতের ক্রিকেট দল শারজায় গিয়ে বাজেভাবে পরাজিত হয়েছিল। সেই সম্পর্কে উনি একটা ছড়া শুনিয়েছিলেন যার প্রথম পঙক্তি ছিল—হও ব্যাটিংয়ে তে বীর, হও বোলিংয়ে তে ধীর, হও ফিল্ডিংয়ে স্থির, নাহি ভয়!এই ছড়া কোথাও প্রকাশিত হয়েছিল কি না জানি না, কিন্ত বহু খুঁজেও ইন্টারনেটে পাইনি

আবার এই কবিতার মধ্যেও কিছু অপ্রিয় সত্যকে তুলে ধরেছেন ভবানীবাবু। যেমন ধরা যাকস্বপ্ন চুরিকবিতাটি। যেখানে উনি লিখেছেন—

কোথায় গেল লাটাই আমার, কোথায় রঙিন ঘুড়ি?’

বাবা-মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে হুড়োহুড়ি!

র‍্যাট-রেসে রোজ ছুটে-ছুটেই ক্লান্ত পুরোপুরি

স্বপ্ন গেছে চুরি আমার, স্বপ্ন গেছে চুরি!

এসব কি আমাদের বর্তমান প্রজন্মের সবথেকে বড়ো সমস্যার মধ্যে একটি নয়? পড়াশোনার চাপ, তার ওপর অন্যান্য বিষয়েও পারদর্শী হওয়ার বাড়তি চাপ, এদিকে মনোরঞ্জন এবং চাপ যুক্তির অবকাশ ক্রমশ কমে আসা—সব মিলিয়ে এক চূড়ান্ত দমবন্ধ অবস্থা কী নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর একটা বিস্ফোরক কবিতার কথা একটু বলি, যার নামস্বাধীনতার মানেএর কয়েকটা পঙক্তি তুলে ধরা আবশ্যক।—

যে ছেলেটা বস্তা কাঁধে কাগজ কুড়োয় পাড়ায় পাড়ায়

যে ছেলেটা রোজ বাজারে মুরগি কাটে, পালক ছাড়ায়

যে ছেলেটা রেস্তোরাঁতে ধুচ্ছে থালা গেলাস-বাটি

যে ছেলেরা সারাজীবন খায় লাথি-কিল চড় ও চাঁটি!

ওদের কাছে প্রশ্ন কর, ওরা কি কেউ সত্যি জানে

স্বাধীনতা কাকে বলে, স্বাধীনতার সঠিক মানে?’

কী অসাধারণ কৌশলে দারিদ্র্য পীড়িত শিশুদের প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামের মধ্যে যে স্বাধীনতা নামক শব্দটা অর্থহীন হয়ে যায় সেটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে! শিশুশ্রম বিরোধী আইন যথেষ্ট যাত্রায় থাকলেও এখনও পর্যন্ত আমরা কি এই সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পেরেছি?

কিন্তু এসব কবিতা ম্লান হয়ে যায় যে কবিতার সামনে সেটা হল সর্বজনবিদিত রচনাবাংলাটা ঠিক আসে নাকবিতাটি অনেকেরই জানা আছে, তবুও এর দ্বিতীয় স্তবকটি তুলে ধরছি।—

ইংলিশওর গুলে খাওয়া, ওটাই তো ফার্স্টল্যাঙ্গুয়েজ

হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ

কী লাভ বলুন বাংলা পড়ে?

বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে?

বেঙ্গলিথার্ড ল্যাঙ্গুয়েজতাই, তেমন ভালোবাসে না

জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না

 

এই কবিতা যখন লিখেছিলেন ভবানীবাবু, তখনই নিশ্চয় পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ ছিল। যে সময়ে, যে পরিবেশে এবং যে বয়েসে ওঁর মুখে এই কবিতা শুনেছি, তখন এটা ভালো লাগলেও এর যথার্থ মাহাত্ম্য বুঝতে পারিনি। সেটা বুঝতে আরও বছর দশেক সময় লেগেছে। যত দিন যাচ্ছে বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে-কটা সরকারি বিদ্যালয় টিকে আছে সেগুলোও মান্ধাতার আমলের পাঠক্রম অনুসরণ, সরকারের অনীহা এবং মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতির আঘাতে খুব শীঘ্রই উঠে যেতে পারে। আই.সি.এস.ই বা সি.বি.এস.ই বোর্ডে পড়া ছেলেমেয়েরা বাংলা শিখতে, পড়তে বা লিখতে একদমই আগ্রহী হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকরাই এই আচরণে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। অন্যদিকে প্রান্তিক লোকজন অশিক্ষা-কুশিক্ষায় জর্জরিত হয়ে বাংলা ভাষাটাই ঠিকমতো লিখতে ভুলে যাচ্ছে। একদিকে বাংলা অভিধানে অঢেল আরবি ফারসি শব্দের প্রবেশ, একদিকে হিন্দির আগ্রাসন, আর একদিকে ইংরেজি ও অন্য বিদেশি ভাষার প্রতি মোহ বাঙালির মাতৃভাষা চর্চাকে যে পঙ্গু করে দিয়েছে তাতে আর কোনও সন্দেহ আছে কি? এ-কারণেই ওই কবিতার তৃতীয় স্তবকে কবি লিখেছেন—

বাংলা আবার ভাষা নাকি, নেই কোনোচার্মবেঙ্গলিতে

সহজ-সরল এই কথাটা লজ্জা কীসের মেনে নিতে?

ইংলিশ ভেরি ফ্যান্টাসটিক

হিন্দি সুইট সায়েন্টিফিক

বেঙ্গলি ইজ গ্ল্যামারলেস, ওরপ্লেসএদের পাশে না

জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না

 

আগেই বলেছি, ভবানীবাবুর সঙ্গে সেই প্রথম এবং সেই শেষ দেখা। কিন্তু ওই একবারের পরিচয়ই ওঁর প্রতি আকর্ষণ তৈরি হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কর্মব্যস্ত জীবনে কবিতাপাঠ খুব একটা হয়ে ওঠে না। তাছাড়া উনি এখনও সাহিত্য রচনায় সক্রিয় আছেন কি না তাও আমার জানা নেই। উনি নিশ্চয় সেই শ্রেণির সাহিত্যিকদের মধ্যে পড়েন না যাঁরা ওপরে ওঠার জন্য সবথেকে সহজ পথটা গ্ৰহণ করে থাকেন, অর্থাৎ নির্লজ্জভাবে শাসকের স্তাবকতা করা এবং এই কারণেই হয়তো উনি প্রচারের আলোর বাইরে আছেন। ওঁর সুস্থ এবং রোগমুক্ত জীবন অবশ্যই কামনা করি (এটা শুধু একজন সাহিত্য অনুরাগী হিসেবে নয়, একজন চিকিৎসক হিসেবেও বটে) এবং এটাও কামনা করব যে উনি যখন আর আমাদের মধ্যে থাকবেন না, তখনও ওঁর ছড়া-কবিতা যেন ছোটোদের মনোরঞ্জন এবং বড়োদের অনুপ্রেরণা প্রদানের মাধ্যমে সব বয়সের বাঙালিদের মধ্যে অমর হয়ে থাকে

  

<