সে-বছর বেশ কয়েক মাস এক ফোঁটা বৃষ্টিও হল
না। পুকুর-জলা, খাল-বিল সব
শুকিয়ে খটখট করছে। পাহাড় বেয়ে
ঝমঝমিয়ে নেমে আসা ঝরনাগুলো পর্যন্ত থেমে গিয়েছে।
বনের সব পশুপাখি তৃষ্ণায় মারা পড়ে আর কি। পাগলের মতো চারদিকে
ছুটে চলেছে তারা একটু জলের খোঁজে। একমাত্র নদীতেই জল
আছে সামান্য, বেশি দূর নয়
জঙ্গল থেকে। কিন্তু সেথায় থাকে
ভয়ানক এক কুমির, জঙ্গলের
পশুরা ভুলেও নদীতে যায় না। তবে
হাতির সে ভয় নেই, পাহাড়ের মতো
দেহ তার। সামান্য এক কুমির
তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারবে কেন? হাতি চলল
নদীতে।হেলতে দুলতে
যেই না হাতি নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, অমনি কুমির
সাবধান করে দিল, “খবরদার, আমার নদীর কাছেও আসবি না। জল
এখানেও কমে গিয়েছে, তোর মতো
একটা পাহাড় সবটুকু খেয়ে নিলে
আমি খাব কী? পালা এখান
থেকে।”
উজ্জ্বল
সবুজ রঙ কুমিরের। দাঁত তো নয়, যেন করাত। হাতি প্রমাদ
গোনল। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখল, জলে নেমে কুমিরের
সঙ্গে বিবাদ করা চলে না। অথচ তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে, একটু জল না খেলেই নয়। কিন্তু কী আর করা যাবে, এই দুষ্টু
কুমির যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়ছে তার আগে নদীতে নামা যাবে না। মনে মনে
এই ফন্দি এঁটে হাতি ফিরে চলল।
এই নদীতেই
এক ব্যাঙের বাস, তারও গায়ের
রঙ উজ্জ্বল সবুজ।
কুমিরটা যখনই এ-পাড় থেকে ও-পাড়ে ভেসে বেড়ায়, তখনই টুক করে লাফ
দিয়ে সে উঠে পড়ে কুমিরের পিঠে। মজা করে ঘুরে বেড়ায় নদীর
বুকে। কুমির বিরক্ত হয়, পিঠ থেকে
ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যাঙ আঁকড়ে ধরে বসে থাকে আর হা হা করে হাসে। কুমির
রাগে গজগজ করে।
পরদিন কুমির
নদীর পাড়ে এক পাথরে গা এলিয়ে রোদ পোয়াচ্ছিল।
তন্দ্রামতো এসে গিয়ে থাকবে, চিত হয়ে চোখ
বুজে পড়ে রইল
মড়ার মতো। হাতি এই সুযোগেই ছিল, পা টিপে
টিপে নেমে পড়ল জল
খেতে। তাই না দেখে দুষ্টু ব্যাঙ করল কী, এক লাফে চড়ে বসল কুমিরের
পেটে। কুমিরের ঘুম গেল চটে। গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসল সে।
তাকিয়ে দেখে ওদিকে নদীতে নেমে জল খেয়ে চলেছে হাতি।
হুংকার দিয়ে বলে উঠল-
“এত বড়ো সাহস
তোর! বারণ করা সত্ত্বেও
আমার জল খেতে চলে এসেছিস? দাঁড়া, আজ তোর একদিন কি
আমার একদিন।”
ওদিকে সে
ব্যাঙটাকেও ঝেড়ে ফেলতে পারছে না, ব্যাঙ অনবরত লাফালাফি
করে চলেছে তার পিঠে। তাতে সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল হাতির ওপর।
দৌড়ে গিয়ে হাতির নাকটা কামড়ে ধরল কুমির। টেনে নিয়ে চলল
জলের গভীরে। ওদিকে হাতিও কম কীসে? সেও প্রবল বিক্রমে
ছাড়িয়ে নিতে চাইছে নিজের নাক, উঠে আসতে
চাইছে নদীর পাড়ে। বার
বার বলছে, “ছেড়ে দে, ছেড়ে দে
বলছি। খুব খারাপ হবে নইলে। নাকে
লাগছে আমার, ছাড়!”
কুমির
সে-কথা কানে নিলে তো। সে হাতির নাক কামড়ে ধরে টেনেই
চলেছে। একসময় জোর এক হ্যাঁচকা টানে হাতি ছাড়িয়ে নিল নিজেকে।
কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এই জোর টানাটানিতে
হাতির নাক লম্বা হয়ে গিয়ে মস্ত এক শুঁড় বেরিয়ে এসেছে। রাগে
সর্বাঙ্গ কাঁপছে তার। মুহূর্তে চোঁ চোঁ করে শুষে নিল সে নদীর
সমস্ত জল। তারপর অনেকটা কাদা টেনে নিয়ে আচ্ছা করে ছিটিয়ে
দিল কুমির আর ব্যাঙের গায়ে। সেই থেকে হাতির লম্বা শুঁড়, আর কুমির ও ব্যাঙের গায়ের রঙ কাদাটে।
( অসমের লোককাহিনি )