ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস । আষাঢ় ১৪৩১

 

 পলাতকের খোঁজে











সৈয়দ রেজাউল করিম
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ




 

।। পর্ব : দুই ।।

পলাতককে ধরার ছক

          

গঙ্গাসাগরের বাস স্ট্যান্ডের কাছে বিরাট কয়েকটা ছাউনি পড়েছে পুলিশের। মেলার ভিতরে আছে গঙ্গাসাগর থানা। মন্দিরের সামনে গঙ্গাসাগর। পুণ্যার্থীরা সেখানে স্নান করে লাইন দিয়ে মন্দিরে যায় সেখানে তৈরি করা হয়েছে বিরাট পুলিশ কন্ট্রোলরুম। ওখান থেকে পুলিশ ডিটেল মেন্ট করা হয়, কে কোথায় ডিউটি করবে। পুলিশদের থাকার জন্য রেঙ্ক অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় আবাস্থল করে রাখা হয়েছে। বাসস্ট্যান্ডে একটা ছোট কন্ট্রোলরুম তৈরি করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে পুলিশরা এসে জড়ো হয় আলিপুর পুলিশ লাইনে। সেখান থেকে তাদের বাসে, লরিতে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গঙ্গাসাগর মেলায়। তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয় জেলা পুলিশের অর্থাৎ পুলিশের বড় সাহেবের কাছে রিপোর্ট করতে। তারা বাসস্ট্যান্ডের কন্ট্রোলরুমে এসে রিপোর্ট করে। এবছর তার চার্জে আছেন উত্তর চব্বিশ পরগনার এডিশনাল এস.পি. বিপুল নন্দ। সঙ্গে আছেন ডি.এস.পি. কপিল কর। ইন্সপেক্টর চন্দ্রনাথ মুখার্জী, সতীনাথ আচার্য, কমলেশ গোপ, পুষেন বর্মন, দিল কিশোর ছেত্রী ও আরো অনেকে। এ পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার পুলিশ ফোর্স রিপোর্ট করেছে। আরো কিছু আসার কথা আছে।

এমনিতে প্রতিবছর পাঁচ হাজারের মতো পুলিশ লাগে। সুস্থভাবে মেলাটা মেন্টেন করার জন্য। ট্রাফিক থেকে শুরু করে, পুণ্যার্থীরা যাতে সুষ্ঠুভাবে মন্দিরে পুজো দিতে পারে, চোর-ডাকাত, বাটপারেরা যাতে তাদের সহায় সম্বল চুরি করে নিয়ে যেতে না পারে, এসব কিছু দেখার জন্য। কিন্তু এ বছর ৫ হাজার থেকে দশ হাজার করা হয়েছে। তার কারণ হলো ডাকু পলাতক। সোর্স মাধ্যমে পুলিশ খবর পেয়েছে এ বছরে পুণ্যস্নান করতে আসবে ডাকু পলাতক। পুণ্যস্নান করতে আসবে, নাকি তার অভিষ্ট লক্ষ্যে আসবে, সে সম্বন্ধে প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে পুলিশ প্রশাসনের।

এই পলাতককে নিয়ে পুলিশ প্রশাসন রীতিমতো নাজেহাল। বিরোধীপক্ষরা চিৎকার চেঁচামেচি করছে বিধানসভায়। তাঁদের প্রশ্নবানে জেরবার হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারদের সাথে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। পলাতক পলাতকই থেকে গেছে প্রতিবার। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এস.পি. রাউত সাহেবকে পার্সোনালি ডেকে মুখ্যমন্ত্রী তার মনের কথা বলেছেন। এস.পি. ও তার দলবল নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন পলাতককে ধরার জন্য। তাহলে অন্তত বিরোধীদের বিষাক্ত তীরের হাত থেকে রেহাই করতে পারবেন মুখ্যমন্ত্রীকে। কিন্তু তার স্বপ্ন, তার আশা, তার ভরসা, মরীচিকায় পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার চার্জ নিয়েছেন দু'বছর। কিন্তু এখনও অধরা থেকে গেছে ডাকু পলাতক। সে সমস্যার সুরাহা হয়নি আজও। সে জন্য চিন্তিত প্রশাসন স্থরের সমস্ত লোকজন, এমনকি সাধারণ মানুষও।

বিধানসভায় বিরোধীদের হৈচৈ করার কারণ আছে। ঠিক দুবছর আগে ৩১শে পৌষ, গঙ্গাসাগরে স্নানের দিন, বেলা বারোটা নাগাদ তাদের বিধায়ক মানস আচার্জীকে খুন করেছিল পলাতক জেমস লং সরণি বাড়িতে। শুধু তাই নয়, আরো অনেক খুন-খারাপি লুট করে বেড়াচ্ছে নির্বিবাদে। তার কোনো একটার কিনারা আজও পুলিশ করতে পারেনি। বারবার অভিযোগ করার পরেও নির্বিচারে সন্ত্রাস-রাজ কায়েম করে রেখেছে। পুলিশ তার টিকি খুঁজে পাচ্ছে না কেন? এই প্রশ্ন বিরোধীরা তুলেছে বারবার। কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর অধরা থেকে গেছে তাদের কাছে।

এস.পি. এম.রাউত সাহেব তাই একটু বেপরোয়া। সামনেই তার প্রমোশন। একটা কিছু ভালো কাজ না করলে ডি.আই.জি. করে তাকে পাঠিয়ে দেবে নর্থবেঙ্গলে। তাই একটাই স্বপ্ন এখন তাঁর চোখের সামনে। কলকাতার আশেপাশে থাকতে হলে তাকে এই কাজটা করতেই হবে। তা যেকোন মূল্যেই হোক।

তিনি খবর পেয়েছেন পলাতক এখন গঙ্গাসাগরে। খবরটা নির্ভুল। যথাযথ আধুনিক টেকনোলজি সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সোর্সরাও একই কথা বলছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী ও ডিজি সাহেবকে বলে বাড়তি পাঁচ হাজার ফোর্সের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন বড়সাহেব। সাথে আধুনিক সব সাজ সরঞ্জাম। তাই তিনি গঙ্গাসাগর মেলার পুরো এলাকাটা ব্যারিকেড করে রেখেছেন। কোনরকম ফাঁকফোকর রাখেননি। সেই সাথে চলছে তল্লাশি। কোন রকম কিছু সন্দেহ হলে সাথে সাথে সেই সেক্টরে খবর পাঠানো হচ্ছে। ওয়ারলেসের মাধ্যমে। তাছাড়া মোবাইল ফোন তো আছে। খবর পেলেই সাথে সাথে ব্যারিকেড করা হচ্ছে উপদ্রুত এলাকা হিসাবে। চটজলদি পৌঁছে যাচ্ছে সুপিরিয়র অফিসাররা। তারপর বাছবিচার করে দেখা হচ্ছে। লোকটা কে? কি তার পরিচয়? কবে কোথা থেকে এসেছে? সঙ্গে কে কে এসেছে? সাথে সাথে বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশকে খবর পাঠানো হচ্ছে ভেরিফাই করার জন্য।

শুধু তাই নয়, সুপিরিয়র অফিসারদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, প্রয়োজনে গুলি করে পলাতককে আহত করার। নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে কোনো মতেই পুণ্যার্থী সেজে গঙ্গাসাগর ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে। এর জন্য দশ হাত অন্তর পুলিশ দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।সর্বত্র চেকিং চলছে। নৌকায়, গাড়িতে, কিংবা যেভাবেই যাক না কেন তাকে অন্ততঃ দশ-বারোবার পুলিশের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর জন্য লোকজন বিরক্ত বোধ করলেও কোন কিছু তোয়াক্কা করছে না পুলিশ প্রশাসন। এছাড়া স্থানে স্থানে লাগানো আছে সি.সি. ক্যামেরা। কন্ট্রোল রুমে বসে তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে অভিজ্ঞ লোকজন দিয়ে। কোন কিছু নজরে এলে সাথে সাথে খবর চলে যাচ্ছে কন্ট্রোলরুমে।

কন্ট্রোলরুমের পাশে একটা বিরাট হল ঘর বানানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় মিটিং বৈঠক করার জন্য এই ব্যবস্থা। দুপুর দুটোয় মিটিং ডেকেছেন বড়সাহেব। ল এ্যান্ড ওর্ডার সম্বন্ধে একপ্রস্থ আলোচনা সেরে নেবেন তিনি। কার কি কাজ করতে হবে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করবেন তিনি। সেই আলোচনায় সামিল হওয়ার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে ছোট-বড় সাহেবরা এসে হাজির হয়েছেন যথাসময়ে। দশজন এ্যাডিশনাল এস.পি. এসেছেন বিভিন্ন জেলা থেকে। বীরভূম থেকে এসেছেন শ্রী নারায়ন। মুর্শিদাবাদ থেকে কল্যাণ চৌধুরী। দার্জিলিং থেকে বশির আহমেদ। দিনাজপুর থেকে পরিতোষ বোস ও বর্ধমান থেকে শুভাশীষ দাশ এসেছেন। বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় পঞ্চাশ জন ডি.এস.পি এসেছেন। সি.আই.ডি-র প্রখ্যাত ডি.এস.পি অলোক মিত্রও বাদ যায়নি সেই তালিকা থেকে। বিভিন্ন থানার বড়বাবুরাও এসেছেন। সদলবলে তারা হাজির হয়েছেন। যেন একটা যজ্ঞ চলছে গঙ্গাসাগর মেলা ঘিরে। সেই যজ্ঞে যতীন দারোগাও বাদ পড়েনি।

হলঘরের চারপাশে সশস্ত্র পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। যাতে তার ধারে কাছে বা ভিতরে কোন অবাঞ্চিত ব্যক্তি প্রবেশ করতে না পারে। যাতে ভিতরের খবর বাইরে প্রকাশ না পায়। তার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রায় ২০০ জন অফিসার জমায়েত হয়েছে সেই হলঘরে। তাদের কথাবার্তায় আলাপ-আলোচনায় গমগম করছে সারা হলঘর। ঠিক দুটোর সময় বড়সাহেব এম. রাউত সাহেব ঢুকলেন সেই হলঘরে। সঙ্গে কয়েকজন এ্যাডিশনাল সাহেব। তাদের আগমনে কোলাহলপূর্ণ হল ঘর স্তব্ধ হয়ে গেল মূহূর্তে। সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জ্ঞাপন করলেন। এস.পি. সাহেব চেয়ারে বসলে সবাই যে যার সিটে বসে পড়লেন।

হলঘরে মাইকের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তার আওয়াজ দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে ভেবে বড়সাহেব সেটা ব্যবহার করতে চাইলেন না। কিন্তু ২০০ জন অফিসারের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছাবে কি করে?আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করতে গেলে সময় সাপেক্ষের ব্যাপার। এতো গুলো হেডফোন জোগাড় করা ও মুসকিল। সবাই চিন্তিত। অবশেষে এস.পি. সাহেব নিজেই পথ বার করলেন। হল ঘরের মাঝখানে বসার সিদ্ধান্ত নিলেন। সাথে সাথে ব্যবস্থা করা হলো। মাঝখানটাকে ঘিরে সব চেয়ার পাতার ব্যবস্থা হলো। এইসব কাজকারবার করতে গিয়ে আঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হল। তাতে কেউ কিছু মনে করল না। এটা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে হয়েই থাকে।

এস.পি. সাহেব মাঝখানে দাঁড়িয়ে খালি গলায় বললেন- আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

সবাই সমস্বরে বলে উঠল- হ্যাঁ স্যার!

এস.পি. সাহেব বলতে শুরু করলেন- আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি কি জন্য তা আপনারা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। তবুও ব্যাপারটা আমাকে আলোচনা করতে হচ্ছে একটি মাত্র কারণে। সে কারণটা বলার আগে দুটো কথা বলতে হয়। তা হল আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছি। আমরা সকলে ঘটনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল নই। প্রতিবছর এই মেলা পরিচালনার জন্য পাঁচ হাজারের মতো ফোর্স অফিসার ডিটেলমেন্ট করা হয়। এবছর সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দশ হাজার। এই দশ হাজার অফিসার ফোর্স গঙ্গাসাগরের তীর্থযাত্রীদের দেখভালের জন্য দেওয়া হয়নি। আমাদের আবেদন মত পাঁচহাজার অতিরিক্ত ফোর্স দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র একটি কারণে। সে কারণ শুধুমাত্র একটা লোককে ধরার জন্য। যে লোকটা আমাদের সমাজে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। নেতা খুন, ব্যবসায়ী খুন, সাকরেদ খুন, এভাবে একের পর এক খুন করে চলেছে। তার সাথে অবাধে লুটতরাজ করছে। আর আমাদেরকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে বারবার। তবে অন্যান্য অপরাধীদের মতো নিজের পরিচয় গোপন করছে না। সদম্ভে ঘোষণা করছে, এ কাজটা আমার।

- স্যার! লোকটা কি আগের জমানার মত চিঠিপত্র দিয়ে এই সব অপরাধমূলক কাজ করছে? এসব সংবাদ আমরা জানছি কি করে? ঘটনাটা সবিস্তারে জানার জন্য বীরভূম জেলার অ্যাডিশনাল এস.পি. জিজ্ঞাসা করলেন।

কথাটা শুনে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাউত সাহেব। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন অ্যাডিশনাল সাহেবের অজ্ঞতা দেখে। খবরের কাগজে বড় বড় করে হেডিং দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সেই খবর। অথচ সেই খবর সম্বন্ধে এতটা অজ্ঞতা? মনের মধ্যে রাগটা গনগন করে উঠলেও, একটুও উষ্মা প্রকাশ করলেন না বড়সাহেব। অনেকটা সহজ সরল মনে তিনি বললেন- আপনারা হয়তো অনেকেই 'রুপোর টাকা' সম্বন্ধে ইতিমধ্যে খবরের কাগজ পড়ে জেনে গেছেন। মানুষজন খুন করে, কিংবা কোনো অপরাধমূলক কাজ করে একটা লাল রুমাল রেখে যায় অপরাধী। অকুস্থলে পাওয়া সেই লাল রুমাল বাঁধা থাকে একটা রূপোর টাকা। সেই রুপোর টাকাগুলো সে লুঠ করেছিল…. বলতে বলতে হঠাৎ কি ভেবে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়ে তিনি। তারপর আবার বলতে শুরু করেন- শুধু রুপোর টাকা অকুস্থলে রেখে যাওয়া নয়, মোবাইল ফোনে মেসেজ করে জানিয়ে দেয় সেই অপরাধ করার পিছনে তার যুক্তি কি? তার লক্ষ্য কোনখানে? তবে আগে দস্যুমোহন চিঠি লিখে জানাত। নির্দিষ্ট দিনে ডাকাতি করত। এখন কিছু জানায় না। কারণ সে জানে, চিঠি হলো একটা প্রামাণ্য দলিল। ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে ওই চিঠিটা।

- কিন্তু স্যার! মোবাইল ফোনে মেসেজ দিলেও তো আমরা তার বিরুদ্ধে প্রমাণ খাড়া করতে পারি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্নটা করে বসলেন মুর্শিদাবাদের অ্যাডিশনাল এস.পি.।

জবাবে রাউত সাহেব বললেন- তা হয়তো আমরা পারি। কিন্তু পলাতকেকে অতটা বোকা মনে করবেন না আপনারা। সেও ভালো মতই জানে ব্যাপারটা। তাই কোন মেসেজ পাঠাতে সে ব্যবহার করে ছিনতাই করে নেওয়া মোবাইল থেকে। ফলে ফোনের মাধ্যমে কাস্টমার আই.ডি. জেনেও আমাদের কোন লাভ হয় না। কারণ সেই ব্যক্তির সাথে পলাতকের কোন সম্বন্ধ থাকে না। তাছাড়া পলাতক নিজেও বোধ হয় এইসব ছোট কাজে নিজেকে জড়ায় না। তার সাগরেদরা এসব কাজ করে।

একথা বলে বড় সাহেব একটু থামলেন। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন-এই গঙ্গাসাগর মেলাতে পলাতক এসে হাজির হয়েছে, একথা আমরা আমাদের বিভিন্ন সোর্স থেকে জেনেছি। আর তার একটা ছবি করে বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে রেখেছি। কিন্তু পলাতকের ওই ছবিটা এখনকার ছবি নয়। এটা তার ত্রিশ বছর আগেকার ছবি। তখন তার বয়স ছিল দশ বছর। তার কিশোর বয়সের ছবিটা যতদূর সম্ভব তোলা হয়েছিল এই গঙ্গাসাগরের কিনারে। ছবির ভিতরে অদূরে যে ছবিটা দেখা যায়, সেটা কপিল মুনির মন্দির। কিশোর বয়সের ছবিটা স্পষ্ট না হলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না ছবিটা পলাতকের। কে এই ছবিটা তুলেছিলেন তা আমাদের জানা নেই। জানা থাকলে ছবির নেগেটিভটা একবার খোঁজ করে দেখা যেত। আর পেলেও তাতে হাতি ঘোড়া কিছু পাওয়া যাবে এ ধারণা করাটা উচিত নয়। তবুও আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি ছবিটা ডেভেলপ করার। কম্পিউটারে স্কান করে বিভিন্ন বয়সে পলাতক কেমন দেখতে লাগবে, তার কয়েকটা নমুনা বার করেছি। মুখে দাড়ি গোঁফ থাকলে কেমন দেখাবে তাও বার করে নিয়েছি। এমনকি আটিস্ট দিয়ে সেই ছবির অনুকরণে একজন চল্লিশ বছর বয়স্ক লোকের ছবি আঁকিয়ে রেখেছি। সেগুলো বড় পোস্টার ছাপিয়ে স্থানে স্থানে লাগিয়ে দিয়েছি। যাতে একজন সাধারন মানুষ থেকে অতি সাধারণ মানুষ ছবিটা দেখে তাকে চিনতে পারে।

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে খোঁজখবর নিয়ে পলাতক সম্বন্ধে যেসব তথ্য আমরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি তার উল্লেখ করে দিয়েছি। পলাতককে কেউ ধরে দিতে পারলে পুরস্কার হিসেবে তাকে এক লাখ টাকা দেব বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। এতে সংবাদমাধ্যমের লোকজনেরও জড়িয়ে পড়বে। জড়িয়ে পড়বে সাধারন মানুষজনও। মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে একটা সার্বিক প্রচেষ্টা হবে পলাতককে পাকড়াও করার জন্য। পলাতকের আইডেন্টিটি সম্বন্ধে দু-চার কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি। দক্ষিণবঙ্গের গোসাবা থানা এলাকায় ওদের বাড়ি ছিল। ছেলেবেলা থেকেই নানা কুকর্মের সাথে যুক্ত ছিল। ধরাও পড়েছে বেশ কয়েকবার। তবে শিশু অপরাধী হিসাবে হোম থেকে মুক্তি পেয়েছে বারবার। আঠারো বছর বয়স থেকে তার আর ধরা সম্ভব হয়নি।

আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম সে আর দক্ষিণ ২৪ পরগনা থানা এলাকায় থাকে না। সে অধিকাংশ সময় থাকে বীরভূম জেলার সোনারগাঁতে। সোনারগাঁটি তৈরি করেছে পলাতক নিজেই। অত্যাচারিত, অবহেলিত অনেক মানুষের বসবাস সেখানে। তার মদতেই চলে গ্রামটা। সেই গাঁয়ে যদি সে একবার গা-ঢাকা দিতে পারে, তাহলে সেখান থেকে তাকে খুঁজে বার করা দুষ্কর। সেনা পুলিশ যৌথভাবে অনুসন্ধান করেও ব্যর্থ হয়েছেন বহুজেলার পুলিশ অফিসার, আধিকারিকরা। আমরা ভালো মন্দ, চোর ডাকাত খুনি প্রভৃতি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সোর্স হিসেবে কাজে লাগিয়ে রেখেছি, যাতে পলাতক গতিবিধি সম্বন্ধে আগে থেকে অবহিত হতে পারি। তাদের কাছ থেকে আমরা ফিটব্যাক পাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। আমাদের কাছে লোকবল, অর্থবল সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আমরা কৃতকার্য হতে পারিনি। বরাবরই বুদ্ধির প্যাঁচে আমাদের পরাজিত করে গা ঢাকা দিয়েছে পলাতক। আমরা আঙ্গুল-চুষে আর মাথা চাপড়ে ফিরে এসেছি। এর জন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে বা শুনতে হচ্ছে।

এতসব কথা বলে একটু থামলেন রাউত সাহেব। মুখটা তার থমথমে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা তুলে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে নিলেন। তাঁর নিস্তব্ধতার সুযোগে সামনে বসে থাকা বিভিন্ন আধিকারিকদের মধ্যে শুরু হলো গুঞ্জন। চাপা আলোচনা। কিভাবে ধরা যায় পলাতককে, তার কলাকৌশল। তাদের করণীয় কর্তব্য। সারা হলঘর গমগম করতে থাকল তাদের কথাবার্তায়।

সেই সময় আবার বলতে শুরু করলেন রাউত সাহেব! পলাতকের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব একটা বেশি নয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তো দূরের কথা, সামান্য মাধ্যমিক পাস নয়। তার বিদ্যের দৌড় সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। কিন্তু তার বুদ্ধির দৌড় অনেক অ নে ক বেশি। সেই বুদ্ধির জোরে সে আমাদের রীতিমতো ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে। এরকম একটা বুদ্ধিমান ছেলেকে যদি আমরা সমাজের কাজে লাগাতে পারতাম, তাহলে সমাজের অনেক উন্নতি হতো। কিন্তু তা বোধহয় আর হওয়া সম্ভব নয়। যেভাবে দিনের পর দিন তার অপরাধের বোঝা ভারি হচ্ছে, সেখান থেকে তার নিষ্কৃতি পাওয়া অসম্ভব।

পলাতকের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় করিয়ে দিতে দু' একটা ঘটনার কথা আপনাদের না বললেই নয়। আগে পলাতক ডাকাতি করত বলে কয়ে। বছর চারেক আগে রামপুরহাটের এক হীরে ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতি করবে বলে তাকে জানিয়ে দিল। পয়লা বৈশাখ আমি যাচ্ছি। যথারীতি ব্যবসায়ী রামপুরহাটের মহাধিকারিকে জানাল। তিনি ঘটনাটা জানালেন সিউড়ি সদরে। যথারীতি প্রটেকশনের জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা করলেন জেলার এস.পি.। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে গেল রামপুরহাট শহর। মাছি গলারও জায়গা থাকল না। পয়লা বৈশাখের সারাটা দিন নিশ্চিন্তে কাটল। সবাই ধরে নিল পলাতক ভয় পেয়ে গেছে। সে আর মুখ দেখাবে না কিন্তু ঘটনাটি ঘটে গেল উল্টো। সন্ধার সময় এক বৃদ্ধ মাস্টারমশাই গিয়ে হাজির হলেন ব্যবসায়ীর বাড়িতে। ব্যবসায়ী তাকে দেখে আইডেন্টিফাই করলেন তার মাস্টারমশাই বলে। স্বভাবতই তাকে বাড়িতে ঢোকার পারমিশন দিল পুলিশ। হাতে লাঠি, বৃদ্ধলোক দেখে কেউ আর সন্দেহ করল না। কিছুক্ষণ পরে চলে গেলেন মাস্টারমশাই। তার আধঘন্টা পরে চায়ের কথা বলতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল পুলিশের লোকজন। দেখতে পেল ব্যবসায়ী এবং তার পরিবার পরিজনদের হাত-পা বাঁধা। মুখে লিকোপ্লাসটার লাগানো। জানতে পারা গেল, ডাকাত পলাতক এসেছিল মাস্টার মশাইয়ের ছদ্মবেশ ধরে। হীরে, মনিমুক্তাগুলো তার ফাঁপা লাঠির মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে পলাতক। স্বভাবতই সার্চ করেও তার কাছ থেকে কিছু পায়নি পুলিশরা। এইভাবে পুলিশকে বোকা বানিয়ে ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে ফিরে মণিমুক্তো নিয়ে পালিয়ে ছিল পলাতক।

এরকম অনেক কাহিনী আছে। সেসব কাহিনী আপনাদেরকে পরে শোনানো যাবে। তার আগে আমাদের জানা দরকার, এই গঙ্গাসাগর মেলায় পলাতক হঠাৎ এসেছে কেন? কি তার অভিলাষ? কি তার ইচ্ছে? এই ব্যাপারে একটা কথা সারা রাজ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে যে পলাতক গঙ্গাসাগরে আসছে মন্দিরের প্রণামী লুঠ করতে। তবে আমার বিশ্বাস, পলাতক অত বোকা নয়। সে মন মন টাকা-পয়সা বয়ে নিয়ে যাবার রিস্ক নেবে। নিলে নিতে পারে প্রণামীর সোনাদানার গহনা। কিন্তু তাও পলাতক নেবার চেষ্টা করবে না। কারণ মন্দিরটা পুলিশ দিয়ে মোড়া থাকে। সাধু-সন্ন্যাসী যেই হোক, তাকে নিয়ম মেনে লাইন দিয়ে মন্দির চত্তরটা মোড়া থাকে। একটু কিছু বেনিয়ম হলে পুলিশ সেখানে দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেখানে গিয়ে বিপদে পড়তে চাইবে না পলাতক। সে ক্ষেত্রে লক্ষ্য হবে পলাতকের বিনা বাধায় কত তাড়াতাড়ি সে তার লক্ষ্য সম্পদ আহরণ করতে পারবে।এজন্য সে বেছে নিতে পারে বড় বড় ব্যবসায়ীদের দোকান। জুয়েলারি দোকান। সেটা আমরা অলরেডি সার্ভে করেছি। ডি.এস.পি, সি.আই.ডি. অলোক মিত্রকে সে ব্যাপারে আমি দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। শুধু তাই নয়, তাকে আরো একটা দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। এই গঙ্গাসাগরে যত পুণ্যার্থী, সাধু-সন্তরা আসছে তাদের ছবি দেখা। গতিবিধি লক্ষ্য করা। তাদের আইডেন্টিটি বার করা। এ ব্যাপারে যতীন দারোগা এবং অন্যান্য ফোর্স অফিসাররা তাকে সাহায্য করবে।

পলাতক এর ব্যাপারে আরো দু-চারটি ছোট ছোট কথা আপনাদের জানিয়ে রাখি। পলাতকের চেহারাটা অনেকটা নায়কদের মতো। সেও ইচ্ছেমতো নানা রূপধারণ করে। ডাকাতি করতে গিয়ে নানান সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়। কখনো সুট কোট পরা ভদ্রলোক। কখনো ধুতি পাঞ্জাবি পরা সাধারণ বাঙালি। কখনো আবার মুটে মজুর দের মত লুঙ্গি ফতুয়া ব্যবহার করে। আবার চুল দাড়ি রেখে সাধু সন্ন্যাসীও সাজে। সোজা কথায় সব সাজে সজ্জিত হতে পারে। বিভিন্ন ভাষায় কথাও বলতে পারে। অতএব চিন্তা করে নিতে হবে, আমাদের পাশের লোকটা পলাতক নয়তো? তাকে সন্দেহের মধ্যে রেখে কাজ করতে হবে।                                                                                 ( ক্রমশ)